সুড়ঙ্গের গোলোকধাঁধায় প্রাণসংকট, প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে প্রত্যেকটা ডাক

দুর্ধর্ষ দুশমন - ২৯
আগের পর্বে

মোহর সিং শুধু ডাকাতই ছিলেন না, ছিলেন মেহেগাঁওয়ের দু’বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। সৎ চেয়ারম্যান। আধুনিক মেহেগাঁওয়ের রূপকার তিনিই। গত মার্চে লকডাউন চলাকালীন প্রয়াত হন ৯০ বছরের মোহর সিং। মেহেগাঁওয়ের পর বিলাও-যাত্রা। ভিণ্ড বাসস্ট্যান্ড থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে ধূধূ হাইওয়ের ওপর নামিয়ে দিল বাস। আধ ঘণ্টা হাঁটার পরেও যেন শেষ হয় না পথ। তেষ্টায় শুকিয়া কাঠ গলা। স্থানীয় এক মহিলার কাছে জল চাওয়ায় তিনি ক্ষেতের মাঝে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন এক কুয়োর সামনে। জলের ওপরে শ্যাওলা পড়েছে সেখানে। থিক থিক করছে পোকা। বছরের পর বছর নিচু জাত হওয়ায় এই জলই তাঁদের পান করতে আসতে হচ্ছে। তারপর...

গ্রামের মধ্যে নামিয়ে দেয় ছেলেটি। তাকে মালখানের বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করাতে সে বলে, এখান থেকে ডানদিকে পাঁচ মিনিট হেঁটে গেলেই মালখানের বাড়ি। তার দেওয়া দিক নির্দেশেই এগিয়ে চলি। একটা বিশাল মন্দির, বেহড়ের মাথায়। সেটাকে বাঁদিকে রেখে হেঁটে চলি। আরো একটা ছোটো মন্দির সামনে পড়ে। ঠিক তার ডানদিকে লোহার গেটওয়ালা একটা বাড়ি। সম্প্রতি সংস্কার হয়েছে একদিক। দরজায় তামার প্লেটে খোদাই করা ‘বাগীসম্রাট দদ্দা মালখান সিং’। মালখানের বাড়ির সামনেই গোটা পাঁচেক সতেরো-আঠারো বছরবয়সি ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। আশেপাশে রয়েছে কয়েকজন বয়স্ক। তাদের নিজের পরিচয় দিয়ে বলি, মালখানের সঙ্গে দেখা করতে চাই। একজন বয়স্ক বলে, ‘মালখান নেহি দদ্দা বোলো, ইজ্জত সে নাম লেও উনকা’।

দুঃখপ্রকাশ করে বলি, আমি পত্রকার। এইবার কাজ হয়। ছেলের দল আমাকে বলে, এখানে থাকেন না মালখান। মাঝে মাঝে আসেন। তারা বলে, চলো তোমাকে ঘুরিয়ে দেখাব সব, কিন্তু শর্ত একটাই তাদেরও ছবি তুলে দিতে হবে। আর কোন চ্যানেলে দেখাবে সেটাও জানিয়ে দিতে হবে। এদের কাছে সাংবাদিক মানেই টিভি চ্যানেলের। একটা ছেলে আমাকে বলে মন্দির পরে দেখাব, যে মন্দিরের জমির জন্য লড়াই করে ডাকাত হয়েছিলেন মালখান। আগে চলো তোমাকে সেই রাস্তা দেখাই, যেখান থেকে পালিয়ে ছিলেন মালখান। ছেলের দল নিয়ে আসে মালখানের বাড়ির পেছনে। পেছনেও একই রকম লোহার গেট। তবে অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা থাকায়, উঁকি মেরে ভেতরে দেখি একদিকে ভাঙাচোরা একটা ঘরের আদল; অন্যদিকে রয়েছে পাকা একটা দালান। সাদা রং করা বাড়ি। বাইরে থেকে এই গ্রামের বিচারে রাজপ্রাসাদই মনে হয়।

বাড়ির পেছনে মাটি আর পাতায় ছায়া একটা ঝুপড়ি। উঠোনে বসে এক মহিলা কাজ করছেন। তাকে বলি একটু জল খাওয়াবে? ছেলের দল আমাকে বলে, ‘ইহা মত পিও পানি, ছোটে জাতকা হ্যায়। বাদমে পি লেনা কিসি অউর ঘর সে’। তাদের থামিয়ে বলি, নাহ্‌, আমি এখান থেকেই খাব। আমি জাতপাত মানি না। আমাকে অবাক হয়ে দেখতে থাকে ছেলেগুলো। সেই মহিলা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তাকে বলি, ‘মা-জী পিয়াস লগা হ্যায়, থোড়া পানি পিলাও না’। তাও আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন মহিলা। অনেকক্ষণ পরে জবাব দেন, আমার বাড়ির জল খেও না বাবা, আমরা ছোটো জাতের লোক। তাকে অশ্বস্ত করি। আমাকে জল দাও। মহিলার চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। চিৎকার করে কাকে যেন ডাকেন, ‘এ মোরি, নয়িওয়ালি লোটেমে পানি লাও মটকে সে, আর বাতাসা। মেহেমান আয়া হ্যায়। জলদি লাও’।

এই মন্দিরের জমির জন্যই বাগী হয়েছিলেন মালখান

 

আরও পড়ুন
থিকথিক করছে পোকা, দূষিত জলেই তেষ্টা মেটান চম্বলের ‘নিচু জাতে’র মানুষরা!

অন্য একটা ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। একবার আমাকে দেখে, তারপর ছুটে যায় ঘরে। খানিক পরেই চকচকে পেতলের ঘটিতে জল আসে, একটা থালায় গোটা কয়েক বাতাসা। দুটো বাতাসা মুখে দিয়ে আলগোছে জল খেয়ে ঘটিটা ফেরত দিই মেয়েটাকে। মহিলা আমাকে বলে, ‘মেরা বহু হ্যায়। বেটা আজ তুম মেরা ইজ্জত বাড়া দিয়ে। ঘরমে সাগ বানি হ্যায় আজ, খানা খাকে যাও। মেরা ইজ্জত অউর বাড় জায়েগা’। তাকে বলি, খিদে নেই, কাজ আছে। শেষ করেই আমাকে চলে যেতে হবে। আবার কখনো এলে খাব নিশ্চই। ঝুঁকে পড়ে একটা প্রণাম করি ওকে। দু-পা পেছিয়ে যান তিনি। ‘আরে ক্যা কর রহে হো বেটা, পাপ লাগে গা। ভগবান তুমহে লম্বি উমর দে’। মহিলাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাই ছেলেগুলোর সঙ্গে। ‘ইয়ে আপনে ঠিক নেহি কিয়া ভাই, আপকো দিক্কত হো জায়েগি কাম করনেমে, সবকো পতা লাগ জায়েগা নিচলে জাত সে পানি পিয়া আপনে’। বলে ওঠে একটা ছেলে। এক ধমকে থামিয়ে দিই তাকে। ‘আপনে কাম সে মতলব রাখো, মুঝে আপনা কাম করনে দো’। ছেলেটা বলে, আমাকে পরে বলো না অসুবিধা হলে।

প্রধান দরজায় বাগী হওয়ার স্বাক্ষর এখনও গর্বের সঙ্গে ধরে রেখেছেন মালখান

 

আরও পড়ুন
নিজের স্ত্রী এবং মেয়েকেও খুন করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেন চম্বলের এই ডাকু!

দু-পা এগিয়ে যেতেই ছেলেগুলো একটা বেহড়ের মাথায় চড়িয়ে দেয় আমাকে। মালখানের বাড়ির পেছনের দরজা থেকে তার দূরত্ব বড়োজোর কুড়ি ফুট। তারপর বেহড়ের ভেতর দিয়ে এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বলে, এই সেই রাস্তা যেখান দিয়ে পালিয়েছিলেন দদ্দা মালখানজী। বললাম, রাস্তাটা পুরো দেখা যায়? একটা ছেলে উত্তর দিল, ‘আরে ভাই, বহোত রাস্তা হ্যায়, ইয়ে রাস্তা তো ভিণ্ড তক যাতে হ্যায়’। বললাম, যতটা সম্ভব দেখি না। নেমে পড়ি বেহড় থেকে। কোনোমতে একজনের হেঁটে যাওয়ার মতো রাস্তা। কাঁটাঝোপে ভর্তি। রাস্তা সে অর্থে কিছুই নেই। মাঝে মাঝে গর্ত, ডাইনে-বাঁয়ে করতে করতে এগোচ্ছি। গলির পর গলি, কানাগলি, শেষে এক জায়গায় দেখি সুড়ঙ্গ। গোটা একটা বেহড় দাঁড়িয়ে রয়েছে, অথচ তার নিচে সুড়ঙ্গ। বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। ঢুকব কি ঢুকব না করছি। একজন বলল, ঢুকেই দেখো না। ঢুকলাম। এই সুড়ঙ্গটা পেরিয়ে একটা হল ঘরের মতো জায়গায় ঢুকলাম। বিশাল হল ঘর। প্রায় পাঁচশো জনের মতো থাকতে পারে। একটা ছেলে বলল, এরকম সুড়ঙ্গে বেহড়ে প্রচুর আছে। ডাকাতরা এরকম সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে লুকোনোর জন্য, রোদ-জল থেকে বাঁচতে। এরকম কত সুড়ঙ্গ যে তাদের অস্ত্রভাণ্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হত কে জানে! পুলিশ কেন, মিলিটারি-প্যারামিলিটারি কারো পক্ষেই এই সুড়ঙ্গ খুঁজে বের করা মুশকিল।

মালখানের পৈত্রিক বাড়ি, এই বাড়ির পেছনের দরজা দিয়েই বেহড়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন মালখান

 

আরও পড়ুন
অ্যান্টিক মূর্তির টোপ দিয়ে স্মাগলারকে অপরহণ, চম্বলের ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল দিল্লিও

সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আবার এসে দাঁড়াই সরু রাস্তায়। আরো খানিকটা এগিয়ে যাই। পেছন ফিরে দেখি ছেলেরা নেই। গেল কোথায়? পিছিয়ে গিয়ে খুঁজতে শুরু করি। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। জোরে জোরে, চিৎকার করতে থাকি। কিন্তু এই বেহড়ের মধ্যে আমার কথা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, কিন্তু সাড়া আসে না। পাগলের মতো সেই সুড়ঙ্গে গিয়ে ঢুকি। সেখানেও কেউ নেই। আমার তখন পাগল পাগল অবস্থা। যে রাস্তা ধরে এসেছিলাম সেই রাস্তায় ছুটে যাই। ডাইনে-বাঁয়ে করতে করতে দেখি আবার সেই সুড়ঙ্গের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আবারো দৌড়ে যাই পেছনের দিকে। যতবার যেদিক দিয়েই যাই না কেন, এসে দাঁড়াই সেই সুড়ঙ্গের সামনেই। ভয়ে, আতঙ্কে, ক্লান্তিতে আবারো জল তেষ্টা পেয়ে যায়। দৌড়তে গিয়ে দু-বার পড়ে গিয়েছি। সারা গায়ে ধুলো ভর্তি হয়ে গেছে। চোখে জল এসে যাওয়ার মতো অবস্থা। বসে পড়ি সেই সুড়ঙ্গের সামনেই। ফোন বার করি, কাউকে যদি ফোন করা যায়। কিন্তু এখানে নেটওয়ার্কও নেই। মাথায় হাত দিয়ে বসি পড়ি।

এই বেহড়েই পথভ্রষ্ট হয়েছিলাম আমি

 

আরও পড়ুন
চম্বলের ‘রাজা’ ডাকু মোহর সিং, তিন রাজ্যের এক-নম্বর শত্রু

এভাবে কত সময় কেটে গিয়েছে জানি না। কিছুক্ষণ পর মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে উঠে দাঁড়াই। পাগলের মতো ছুটে যাই, যেদিক দিয়ে আওয়াজ আসছে। দেখি সেই ছেলেগুলো। সঙ্গে আরো কয়েকজন যোগ হয়েছে। আমাকে দেখেই ছুটে এল তারা। প্রশ্নের পর প্রশ্নবাণ ধেয়ে এলো আমার দিকে। বারণ করা সত্ত্বেও তুমি কোথায় চলে গেলে? কতক্ষণ ধরে খুঁজছি তোমাকে! আমার তখন হালত খারাপ। কোনোমতে বলি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। অনেক কষ্টে তাদের সঙ্গে বেরিয়ে আসি সেই বেহড়ের গোলকধাধাঁ থেকে।

সেই নীচু জাতের মহিলার বাড়ি, যিনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন

 

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More