নিজের স্ত্রী এবং মেয়েকেও খুন করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেন চম্বলের এই ডাকু!

দুর্ধর্ষ দুশমন - ২৭
আগের পর্বে

মোহর সিং, ডাকাত হিসাবে যতই নির্দয় হোক না কেন নিজের দলের মধ্যে চালু করেছিল কঠোর এক নিয়ম। তা হল, কোনো মহিলাদের দিকে অশালীন ব্যবহার করা হলেই তার শাস্তি হবে মৃত্যু। সেইসঙ্গে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে চম্বলের বড় বড় ডাকাত দলগুলির সঙ্গে মিলিত হয়ে অভিযান চালাত মোহর। ফলে পুলিশের পক্ষে তাকে ধরা হয়ে উঠেছিল অসম্ভব। তারই মধ্যে ১৯৬৫ সালে প্রথমবারের জন্য চম্বল সাক্ষী থাকে এক অদ্ভুত ঘটনার। খোদ দিল্লি থেকে মোহর পাকড়াও করেন এক পুরনো মূর্তির স্মাগলারকে। অনেক চেষ্টা করেও নাগাল পায়নি পুলিশ। শেষ অবধি ২৬ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দিয়েছিল তার পরিবার। যদিও ঝামেলা এড়াতে মিডিয়ার সামনে ৫ লক্ষের কথা বলেছিলেন তারা। তারপর...

শেষমেশ মোহরের গ্যাং নিয়ে ভীষণ চিন্তিত মধ্যপ্রদেশ সরকার এক সদস্যের একটা কমিশন তৈরি করে। পুলিশের উপর চাপ বাড়তে থাকে। একের পর এক এনকাউন্টার হতে থাকে। মোহর জানান চোদ্দো বছরের তার দস্যুজীবনে প্রায় সাতাশি থেকে অষ্টআশিবার পুলিশের সঙ্গে তার সামনাসামনি লড়াই হয়। প্রত্যেকবারই তিনি বেঁচে যান। কিন্তু মোহর সিংও বুঝতে পারেন যে পুলিশের ঘেরাও বাড়ছে। বেহড়ের লুকোচুরি যে কোনোদিন তার শরীর থেকে প্রাণকে আলাদা করে ফেলতে পারে। যে সময় মোহর এসব কিছু ভাবছেন, সেই সময় একদিন মাধো সিং তাকে চমকে দেন। মাধো তার কাছে এসে জানান যে জয়প্রকাশ নারায়ণ চম্বলে আত্মসমর্পণ করাচ্ছেন। মাধো, মোহরকে বোঝাতে সক্ষম হন। মোহর সিদ্ধান্ত নেন গুলি আর নৃসংশতার খেলা আর নয়।

মধ্যপ্রদেশের জৌরা শহরে বাঁধ চম্বলের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো আত্মসমর্পণের সাক্ষী। জেল খাটার পর মোহর সিং আবারো মেহেগাঁওতে ফিরে আসেন। আজো মোহরের কথা মানুষের মনে আছে, যখন শুধু চম্বলের নয়, মোহর সিং দেশের সবচেয়ে বড়ো আতঙ্ক ছিলেন, আর তার নামে দেশের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার ছিল। মোহরের কথায়, ‘ম্যায় আজ তক জিন্দা বাচা হুঁ, ইয়া মেরা গ্যাং কভি পুলিশকি গোলিয়োঁ কা ভেট চরকর নেস্তনাবুদ নেহি হো সকা, ইসকি এক প্রমুখ বজায় হ্যায় কি, ম্যায়নে অউর মেরে গ্যাং-নে কভি কিসি অউরতকে সাথ বদসলুকী নহি কি। গ্যাংকে সদস্যোকো হিদায়ত থি কি, জো ভি বাগী/ডাকু কিসি আউরতকে সম্পর্কমে আয়েগা উসে গোলি সে উড়া দিয়া জায়েগা। আজভি মেরা নাম সমাজমে লোগ ইসি বজয় সে ইজ্জত সে লেতে হ্যায়’। কতটা ক্ষমতাশালী, কতটা সাহসী হলে আকড়ু দবংগ বলা যায় মোহর সিংকে? তার কথা শুনতে শুনতে আমার গায়ে বারবার কাঁটা দিচ্ছিল। মোহরের কথায়, ‘সারেন্ডারের পর মাধো সিং, নাথু সিং আর সরু সিং-এর সঙ্গে শয়ে-শয়ে বাগীকে গোয়ালিয়রের জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলেই বসত আদালত। পনেরো মাস গোয়ালিয়র জেলে থাকি। আট মাস থাকি নরসিংহগড় জেলে, আর তারপর মুগাওয়ালি ওপেন জেলে আটক থাকি। সারেন্ডারের পর যখন আমাদের জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন পুলিশের পঞ্চাশ-ষাটটা বড়ো বড়ো গাড়ি আমাদের সামনে পেছনে যাচ্ছিল। সেই সময় ভাবছিলাম যে, চলো বেহড়ের ভেতর না হোক বাইরে অন্তত পুলিশ আমাদের জামাই আদর করছে। জেলে আমরা এতটাই দৌরাত্ম্য করতাম যে আমাদের জন্য মুরগী-মাটন আর দেশি ঘি-এর জোগান থাকত। আমার মনে পড়ছে জেলে বসা আদালতে আমাকে ফাঁসি আর সেই সঙ্গে দশ হাজার টাকার জরিমানার শাস্তি শুনিয়েছিলেন বিচারক। আদালতের সেই সিদ্ধান্ত শুনে আমার অদ্ভুত লাগে। আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারককে বলি, ‘সাহেব জব ম্যায় ফাঁসি পর লটক দিয়া জাউঙ্গা তো তুমহারা দশ হাজার কা জুর্মানা কৌন ভরেগা। মেরে ঘরওয়ালোকে পাস দশ হাজার কা ইন্তেজাম নহি হ্যায়’। আমার তর্ক শুনে পুরো আদালতে নিশ্চুপ হয়ে যায়’।

জয়প্রকাশ নারায়ণের সামনে আত্মসমর্পণ করছেন মোহর সিং

 

ঘটনার পর ঘটনা বলে যেতে থাকেন মোহর সিং। আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ফুটে উঠতে থাকে সেসব। মোহর জানান, ‘সারেন্ডারের পর একদিন মুরেনা জেলার (মধ্যপ্রদেশ) ডেপুটি এসপি বা এসপি গোয়ালিয়র জেলে পৌঁছোন। সেই ডেপিটি এসপি আমাকে জেলের দরজায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘মোহর সিং আর আট দিন হাতে পেলে তোমাকে জেলের বাইরেই হয় মেরে ফেলতাম, না হয় গ্রেপ্তার করে নিতাম।’ আমি সেই ডেপুটিকে চ্যালেঞ্জ করে বসি, এখন কী বিগড়ে গিয়েছে? চলো এখনই করে ফেলো মুঠভেড় (এনকাউন্টার)। এর আগে, জেলের বাইরে থাকার সময় তোমাদের সঙ্গে কয়েকশোবার মুঠভেড় হয়েছে, তখন তো তোমরা মোহর সিং-এর চেহেরা দেখার জন্য হাপিত্যেশ করে বসেছিলে। আর যখন আমি সারেন্ডার করে দিয়েছি, তুমি শেয়ালের মতো হুমকি দিচ্ছ?’

আরও পড়ুন
অ্যান্টিক মূর্তির টোপ দিয়ে স্মাগলারকে অপরহণ, চম্বলের ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল দিল্লিও

ভাবুন একবার সাহস। জেলের ভেতর গোপন এনকাউন্টার করে দিলেও তো কেউ জানতে পারবে না। যেখানে দাঁড়িয়ে বাঘা-বাঘা অপরাধীর প্যান্ট ভিজে যায় সেখানে মোহর সিং জেলের ভেতর সোজাসুজি পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্টকে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করছেন! পরবর্তীকালে এই ঘটনা বিখ্যাত ‘কালিয়া’ সিনেমায় ব্যবহার করা হয়। যেখানে প্রাণ আর অমিতাভ বচ্চনের মধ্যে কথার যুদ্ধ চলছে জেলে দাঁড়িয়ে। শুধু তাই নয় জেল সুপারিন্টেনডেন্টকে জেলের মধ্যেই পেটান মোহর সিং। মোহর সিং-এর জবানিতেই শুনে নেওয়া যাক তার কারণ-

সিনেমাতেও করেছিলেন অভিনয়

‘এক সুপারিন্টেনডেন্ট জেলের ভেতরে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছিল, আমরা (ডাকাতরা) জেলের ভেতরই তাকে ধরে পেটাই। আর এই ঘটনা এমন শিরোনামে চলে আসে যে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। শেষে মুখ্যমন্ত্রী জেলের স্টাফদের বোঝান এরা সব ভয়ঙ্কর বাগী। অনেক মুশকিলের পর এদের এখন জঙ্গল থেকে বাইরে আনা হয়েছে। তোমরা একটু ধৈর্য্য ধরো। ধীরে ধীরে এই বাগীরা নিজে নিজেই শুধরে যাবে’। মোহর সিং বলেন, ‘আমার এটা নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই যে, আমি বেহড়ে বন্দুক চালিয়েছি, শয়ে শয়ে হত্যা করেছি, বহু মামলাই পুলিশ অপরাধের হার কম দেখানোর জন্য নথিভুক্ত করেনি। আমি প্রায় চারশো হত্যা করেছি। আমার নামে পাঁচশো-পঞ্চাশটা মামলা ছিল। এখন আমি গ্রামে চাষাবাদ করি, আর বাকি সময় মন্দিরে ভজন গাই। ভজন গায়ক হিসেবে আমার যথেষ্ট নামও রয়েছে। গ্রামের যেখানেই ভজন পূজন হয় সেখানেই আমাকে দেখতে পাওয়া যায়’।

ডাকাতি ছেড়েছিলেন ১৯৭২-এ। কিন্তু তারপরেও খুন করা থামেনি। ২০১২-তে নিজের স্ত্রী এবং পনেরো বছরের মেয়েকে খুন করে মোহর সিং সিন্ধ নদীতে তাদের লাশ ভাসিয়ে দেন। কারণ তিনি তার স্ত্রী এবং মেয়ের চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করতেন। ২০০৬-এ পাঁচ বছরের জন্য তাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল, মধ্যপ্রদেশের দাতিয়া জেলার একটা অপহরণের ঘটনায়। ২০১২-তে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মোহর সিং সোজা নিজের শ্বশুরবাড়ি পৌঁছোন। সেখানে মেয়ের বিয়ের কথা বলে তিনি স্ত্রী রামবতী দেবী আর দুই মেয়ে আরতি আর পুনমকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তারপর থেকেই স্ত্রী আর বড়ো মেয়ে আরতি নিখোঁজ।

আরও পড়ুন
চম্বলের ‘রাজা’ ডাকু মোহর সিং, তিন রাজ্যের এক-নম্বর শত্রু

লম্বা গোঁফের জন্য চিরকাল ছিল গর্ব

জুন ২০১২-এর এই ডবল মার্ডার কেস নিয়ে পুলিশ যখন মোহর সিং-কে জিজ্ঞসাবাদ করে তখন মোহর সোজাসুজি পুলিশকে খুনের কথা স্বীকার করেন। সিন্ধ নদীতে মৃতদেহের অবশেষ অনেক খুঁজলেও তা পাওয়া যায়নি, ফলে মোহরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই পুলিশ প্রমান করতে পারেনি। চিরকালই স্পষ্ট-বক্তা মোহর সিং ফুলন দেবীকেও বাগী বলতে নারাজ। তথাকথিত নারীবাদীরা হয়তো মোহর সিং-এর কথায় প্রতিবাদ করতে পারেন, কিন্তু মোহর সিং স্পষ্টই বলেন ফুলন দেবী ডাকাত ছিলেন না। মিডিয়া তাকে ডাকাত বানিয়েছে। মোহরের কথায় একে ফুলন মেয়ে, তায় নিচু জাতের, আর একজন মেয়ে কীভাবে ডাকাত হবে! তাকে বলেছিলাম, তাহলে বেহেমাই কাণ্ড? সেটা তো মিথ্যে নয়। প্রায় একুশজন ঠাকুর জাতের পুরুষদের এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা! মোহর সিং গুজ্জর বলে ওঠেন, ‘লিখনেওয়ালে লিখতে হ্যায়, পর ফুলন কোই বাগী নেহি থি। মাল্লাহ জাতকি মোড়ি থি ওহ। পেহেলে পেহেলে মেরে পাস আয়া থা, গ্যাংমে সামিল হোনেকে লিয়ে। ম্যায়নে ভাগা দিয়া। বাদমে শুনা কি মালখানকে পাস গয়া থা, উসনে ভি ভাগা দিয়া। আরে ফুলন বাগী ক্যায়সে হোগী, শালিকো বন্দুক পকড়নাই নেহি আতি থি, ওহ কিয়া মারেগি ঠাকুরো কো। ঠাকুরো কো মারা থা উসকে গ্যাংকে সাথিও নে। নাম হুয়া ফুলন কা’। এরপর আর কোনো কথা চলে না।


Powered by Froala Editor

More From Author See More