দুর্ধর্ষ দুশমন - ২৫
আগের পর্বে
মেহেগাঁও যাওয়ার পথে বাসে কন্ডাক্টর জানালেন তাঁর বাড়ি বিলাও গ্রামে। যে গ্রামে মালখানের জন্ম। তিনিই জানালেন মালখানকে ধরার জন্য আলাদা করে তৈরি হয়েছিল একটি থানা। এখন যা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মেহেগাঁও নেমে একটা দোকানদারের কাছ থেকেই ঠিকানা পাওয়া গেল মোহর সিংয়ের। কিন্তু তাঁর বাড়ি গিয়ে খানিকটা হতাশ হতে হল। দুই ভদ্রমহিলা বেরিয়ে জানালেন, তিনি বাড়িতে নেই। শুনশান রোয়াকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর আবার কড়া নাড়লে বেরিয়ে আসে একটি বাচ্চা। পিছনে পিছনে এসে হাজির হয় এক বছর আশির বৃদ্ধ। লাঠি হাতে সোজা হয়ে হাঁটছেন তিনি। জলদগম্ভীর গলায় নিজেই পরিচয় দিলেন তিনি। মোহর সিং। বাজার থেকে যে কখন ফিরেছেন তিনি, তার টেরই পাওয়া যায়নি। তারপর...
পঞ্চাশের দশকে বাগীদের বান ডেকেছিল চম্বলজুড়ে। মানসিং, রূপা, লক্ষ্মণ সিং, গব্বর সিং, সুলতানার মতো ডাকাতদের পদধ্বনিতে চম্বল সেইসময় থরথর করে কাঁপত। ষাটের দশকের শুরুর দিকে এর মধ্যে বেশিরভাগ ডাকাতই পুলিশের গুলির শিকার হয়েছিলেন বা তাদের গ্যাং ছোটো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই ষাটের দশকেই এমন একটা নাম উঠে এসেছিল চম্বলে যা বাকি সমস্ত নামকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল। সেই নাম, মোহর সিং। ডাকু মোহর সিং ছিলেন ষাটের দশকে চম্বলের রাজা। চম্বলের বেহড় হাজারে হাজারে ডাকাতদের আশ্রয় দিয়েছে, শয়ে শয়ে গ্রামের শত্রুতা চম্বলে গড়ে উঠেছে, আর সেই শত্রুতায় জন্ম নিয়েছে হাজার ডাকাত। কিন্তু শত্রুতার এমন এক কাহিনিও সেখানে জন্ম নেয়, যে শত্রু শেষ হয়ে যায়, অথচ সেই শত্রুতা থেকে জন্ম নেওয়া বাগী চম্বলের বাদশাহ হয়ে বসেন। বাদশাহ, যার কাছে চম্বলের ইতিহাসের এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড়ো ডাকাত-সেনা ছিল। মানসিং-এর পর চম্বল ঘাঁটির সবচেয়ে বড়ো নাম মোহর সিং, যার দলে দেড়শোর বেশির ডাকাত ছিল। মোহর সিং চম্বল ঘাঁটির উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ আর রাজস্থানের পুলিশের ফাইলে ই-ওয়ান অর্থাৎ এক নম্বর শত্রু হিসেবে নথিভুক্ত ছিলেন। ষাটের দশকে মোহর সিং-এর বন্দুকই ছিল চম্বলের রায়, আর তার কথাই ছিল চম্বলের আইন।
মধ্যপ্রদেশ আর উত্তরপ্রদেশের পুলিশের রেকর্ড দেখেছি। তা থেকেই জেনেছি ১৯৬০-এ অপরাধের শুরুয়াত করা মোহর সিং এতটাই আতঙ্ক তৈরি করেছিলেন যে পুলিশ চম্বলে ঢুকতেই ভয় পেত। এনকাউন্টারে মোহর সিং-এর দলের ডাকাতরা সহজেই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যেত। ওর নেটওয়ার্ক এত বড়ো ছিল যে পুলিশ চম্বলে পা রাখলেই মুহুর্তে তার কাছে খবর পৌঁছে যেত। সঙ্গে সঙ্গে মোহরও বদলে ফেলত তার রণনীতি। ১৯৫৮ সালে প্রথম অপরাধ করে পুলিশের খাতায় নাম তোলা মোহর সিং যখন বন্দুক নামিয়ে রাখলেন ততক্ষণে তিনি অফিসিয়ালি দু-লাখ টাকার ইনামি ডাকাত, আর তার গ্যাং হয়ে দাঁড়িয়েছিল বারো লাখ টাকার ইনামি গ্যাং। ১৯৭০ সালের এই পরিমাণ টাকাকে আজকের বিচারে মাপলে কোটি টাকাকেও ছাড়িয়ে যাবে। পুলিশ ফাইলে ৩১৫টি মামলা মোহর সিং-এর নামে ছিল, এছাড়াও পঁচাশিটা খুনের মামলা ছিল মোহর সিং-এর মাথায়। ওর অপরাধের সফর চম্বলের ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা সফর। কিন্তু হঠাৎ করেই মোহর সিং একদিন বন্দুক নামিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। মোহর সিং, চম্বলের ডাংয়ে (বেহড়ের জঙ্গল) থাকা এক ছোট্ট গ্রামের এক অনামি যুবক। গ্রামে ছিল কিছু জমি আর চাষাবাদ। চম্বলে অন্যায়ের বদলা নেওয়ার অসংখ্য কাহিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক কাহিনির সম্পর্ক গিয়ে জুড়ে যায় সেই একটাই কাহিনির সঙ্গে। অর্থাৎ জমি নিয়ে লড়াই। মোহরের জীবনেও নিজের ছোট্ট জমিকে বাঁচানোর লড়াই ছিল। আর অসফল মোহরের জীবনের রাস্তা হারিয়ে গিয়েছিল বেহড়ের অন্ধগলিতে।
ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়ের জঙ্গল, আর তার মাঝে সাদা রঙের এক মন্দির। এই ছিল সত্তর বছর আগের এক ছোট্ট হাসিখুশি গ্রাম। কিন্তু এখন সেখানে বেহড়ই বেহড়ে ভরা। এখন এই গ্রামটা প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সরে গিয়েছে। আর পুরোনো গ্রামের সলিল সমাধি হয়েছে বিসুলীনদীর গর্ভে। এই গ্রাম থেকেই শুরু হয়েছিল মোহর সিং-এর বাগী জীবনের কাহিনি। মোহর সিং এই গ্রামের এক ছোটো চাষী। গ্রামে ছিল তার সামান্য কিছু জমি। সুখে দুঃখেই কেটে যাচ্ছিল জীবন। কিন্তু চম্বলের ইতিহাস বলে কৃষকের জমিতে ফসলের পাশপাশি শত্রুতাও ফলে। মোহর সিং-এর জমির দখল নিয়ে গ্রামে ঝগড়া শুরু হয়। আর এই ঝগড়ায় ওর জমির কিছু অংশ গ্রামেরই অন্য একটি পরিবার দখল করে নেয়। যা নিয়ে ঝামেলা তুঙ্গে ওঠে। মামলা যায় পুলিশের কাছে। আর পুলিশ সেই সময় চম্বলের স্বভাব অনুযায়ী পয়সাওয়ালাদের পক্ষে থাকে। কেস চলতে থাকে। আর মোহর সিং হন এই কেসের প্রধান সাক্ষী। চম্বলের গ্রামে মোকদ্দমার সাক্ষী দেওয়ার অর্থ শত্রুতা বাড়ানো। জটপুরা গ্রামে একদিন মোহর সিংকে পাকড়াও করে তার শত্রুরা সাক্ষী না দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু নিয়মিত ব্যায়াম আর পালোয়ানি করা মোহর সিং তাদের কথা উড়িয়ে দেয়। তাদের কথা না মানায় শত্রুরা মোহর সিংকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে মেরে আধমরা করে দেয়।
আরও পড়ুন
‘এক ঘন্টে সে দেখ রাহা হুঁ, মতলব ক্যা তুমহারা?’ গর্জে উঠলেন চম্বল-কাঁপানো ডাকাত মোহর সিং
আহত মোহর সিং পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু থানায় তার কথা শোনার বদলে পুলিশ তার নামেই কেস করে দেয়। অপমানিত মোহর আর কোনো রাস্তা খুঁজে না পেয়ে বেহড়ের রাস্তায় নেমে পড়েন। ১৯৫৮ সালে গ্রামের সেই মন্দিরে মোহর সিং নিজের শত্রুদের ধুলোয় মিলিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে ঝাঁপিয়ে পড়েন বেহড়ে। মোহরের প্রথম শিকার তার শত্রু। তারপরই বন্দুক নিয়ে মোহর জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। শুরুর দিকে তিনি বাগীদের দলে শামিল হওয়ার চেষ্টা করলেও দু-বছর পর্যন্ত জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো মোহর সিং কোনো দলেই শামিল হতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজের গ্যাং বানাবেন আর তা এমন একটা গ্যাং হবে যে তার নাম শুনলেই কেঁপে উঠবে গোটা চম্বল। গ্রামের শক্তিশালী শত্রুর সঙ্গে বদলা নিতে না তো আইন পাশে দাঁড়ায়, না ভগবান, আর না আদালতের চৌকাঠ। চম্বলে যে কোনো দুর্বল লোকের জন্য শক্তি হাসিল করার একটাই শর্টকাট। তা হল চম্বলের ডাংগে বসে রাইফেলের সাহায্যে নিজের শত্রুর উপর নিশানা সাধা। মোহরের বন্দুক গর্জে উঠছিল, আর তার নিশানা হচ্ছিল একের পর এক শত্রুরা। মোহর সিং নিজের সঙ্গীদের সঙ্গে প্রথমে ছোটো ছোটো ডাকাতি করতে শুরু করেন। আর পুলিশের রেকর্ডে তার নাম নথিভুক্ত হওয়া শুরু হল।
আরও পড়ুন
‘চম্বলের থেকেও অনেক বড়ো বড়ো ডাকাত আছে রাজনীতিতেই’ : বাগী মোহর সিং
আমি যখন মোহর সিং-এর সঙ্গে দেখা করে মেহগাঁও থানায় যাই, সেখানকার রেকর্ডে দেখেছিলাম মোহরের দলের বিরুদ্ধে যে রেকর্ড প্রথমে নথিভুক্ত হয়েছিল তার নাম্বার ছিল ১৪০/৬০। ১৯৬০-এ গৌহদ থানায় তার দলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছিল হত্যার প্রচেষ্টার। ১৯৬১তে গৌহাদ থানাতেই তার বিরুদ্ধে প্রথম হত্যার মামলা নথিভুক্ত হয়। এরপরে একের পর এক হত্যাধারা শুরু হয়ে যায়। মোহর প্রথমে মধ্যপ্রদেশের ভিণ্ড আর আশেপাশের এলাকায় অপরাধ করা শুরু করেন। কিন্তু যেমন যেমন তার দল বড়ো হতে শুরু করে তেমন তেমন নিজের এলাকা বাড়াতে থাকেন মোহর। নিজের দলের নীতি এবং অনুশাসন নিয়ে ভীষণই সতর্ক ছিলেন এই বাগী সম্রাট। দিনকে দিন মোহরের দল বেড়ে চলেছিল আর অন্যদিকে পুলিশ এক এক করে চম্বলের অন্যান্য গ্যাং শেষ করছিল। মোহর পুলিশের হাত থেকে বাঁচার উপায় খুঁজে বার করেন।
আরও পড়ুন
গ্রেনেডের আঘাতে উড়ে গেল গব্বর সিং-এর চোয়াল
মোহর সিং একদিন ঘোষণা করে দিলেন যে কেউ তার দলের মুখবীরি (গুপ্তচরবৃত্তি) করবে তার সম্পূর্ণ পরিবারকে শেষ করে দেওয়া হবে। শুধু ঘোষণা করাই নয় মোহর সিং এই ঘোষণা অনুযায়ী কাজ করাও শুরু করে দিলেন। কোনো মুখবীরকে শেষ করার ক্ষেত্রে মোহর সিং ভীষণই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতেন। মুখবীর আর তার পরিবারের উপর মোহর পাকা শিকারির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে শেষ করে দিতেন। মোহরের দলের উপর বেশিরভাগই এই মুখবীরদের হত্যা করার মামলা নথিভুক্ত হতে থাকে সেইসময়। যাকেই মুখবীর বলে সন্দেহ করতেন মোহর তার সম্পূর্ণ বংশকেই শেষ করে দিতেন। ফলস্বরূপ চম্বলে মোহর সিং-এর আতঙ্ক পুলিশ এবং তার মুখবীরদের কাছে বেড়েই চলেছিল। যার ফায়দা তুলছিলেন মোহর। এই দুর্ধর্ষ ডাকাতের নাম ছড়িয়ে পড়েছিলে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানে। যেখানে অন্যান্য দলের কোনো গ্রামে আশ্রয় নেওয়ার সময় মুখবীরের ভয় থাকত সেখানে মোহরের দলের নিজের জাতের গ্রামে নির্ভয়ে আশ্রয় নিত আর পুলিশের খবর পাওয়ার আগেই সেখান থেকে চলে যেত।