গ্রেনেডের আঘাতে উড়ে গেল গব্বর সিং-এর চোয়াল

দুর্ধর্ষ দুশমন – ২২

আগের পর্বে

চম্বলে এক চেটিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল গব্বর। চাল, দুধ, ঘি আর আটা— এসব না পেয়ে গ্রামবাসীদের ওপর চরম অত্যাচার চালায় গব্বর। দু’জনের নাক কেটে নেওয়া হয় গ্রামেই। বাকিদের শাস্তি দেওয়া হয় বন্দুকে বাট আর লাঠি পেটা করে। তার ওপর এক তান্ত্রিকের কথায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে গব্বর। ১১৬ জনের নাক কাটলে পুলিশের গুলি ছুঁতে পারবে না তাকে, এমন কথা গেঁথে গিয়েছিল গব্বরের চিন্তায়। অন্যদিকে ঘুম ছুটে যায় পুলিশের। এর মধ্যে ডিএসপি আরপি মোদি অগ্নিকাণ্ড থেকে এক শিশুর প্রাণরক্ষা করে। প্রতিদান হিসাবে তার বাবা গব্বরের ডেরার সন্ধান দেয় ডিএসপিকে। সেই মতো তৈরিও হয়ে যায় গব্বর-হত্যার সমস্ত নকসা।


১৯৫৯ সালের ১৩ নভেম্বর। তখনো সূর্য পুরোপুরি উদয় হয়নি। সেই সময়ই মোদিকে এক অতিথি এসে চমকে দেয়। রামচরণ থানায় আসে। পুলিশ কর্মচারীদের মাঝেই মোদিকে ইশারায় জানিয়ে দেয় পুরো গ্যাং ঠিকানায় পৌঁছে গিয়েছে। মোদি তাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে পুরো ডিটেলস জেনে নেন। রামচরণ তাকে জানায় যে গব্বরের পুরো গ্যাং সেই জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। শেষ করে দিন পুরো দলকে। কারণ চম্বলে যদি দলের একজনও বেঁচে যায়, তাহলে সে মুখবীরের পুরো পরিবারকে শেষ করে দেবে। 

সকাল দশটার মধ্যে গোহদ থানায় তিনশো সশস্ত্র পুলিশ মজুত হয়ে যায়। প্ল্যান হয়, তিনদিক ঘেরাবন্দি করে চতুর্থ দিক থেকে সার্চ পার্টি আগে পাঠানো হবে। মোদি কোনো পুলিশ কর্মচারীকেই এটা বুঝতে দেননি যে শেষপর্যন্ত কোথায় যেতে হবে। নিশানাই বা কে! মোদি আর তিরিশজন লোক হাইওয়ের দিক থেকে সার্চপার্টি হিসেবে শিকারের দিকে এগোন। দ্বিতীয় দিক থেকে ডেপুটি এসপি মাধো সিং নিজের পার্টি মোতায়েন করেন। সেই পার্টি আগে এগোতেই দেখতে পায়, গব্বরের লোকেরা মাটিতে ঘষটে ঘষটে অন্যদিক থেকে বেরনোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সেখানেও পুলিশ ছিল। শেষপর্যন্ত গব্বরের দল ফায়ারিং শুরু করে। দলের এগারোজন লোক সমস্ত শক্তি দিয়ে ফায়ারিং করছিল। মুঠভেড় সকাল দশটা থেকে শুরু হয়েছিল। গব্বরের দলের সঙ্গে কিছু অপহৃত লোকও ছিল। ডাকাত দল ফায়ারিং করতে করতে যেদিক থেকেই পালানোর চেষ্টা করে, সেদিক থেকেই পুলিশের হেভি ফায়ারিং শুরু হয়ে যায়। সকাল থেকে শুরু হওয়া এনকাউন্টার বিকেল পর্যন্ত চলে। 

গব্বর সিংকে ধরার জন্য আরপি মোদির নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল বিশেষ পুলিশ বাহিনী

 

ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে। ডাকাতরা সেই অন্ধকারের ফায়দা নিতে পারে। কিন্তু মোদি গব্বরকে শেষ করার এই শেষ সুযোগ হাত থেকে যেতে দিতে চাননি। ফলে তিনি একটা বড়ো সিদ্ধান্ত তৎক্ষণাৎ নেন। তিনি নিজের সঙ্গীদের জানান যে, তিনি সোজাসুজি হামলা করতে যাচ্ছেন। যদি কেউ তার সঙ্গে স্বেচ্ছায় যেতে চায়, তাহলে যেতে পারে। এই কথায় এগারোজন গোর্খা সেপাই, যারা পুতলীবাঈয়ের এনকাউন্টারের সময়ও তাঁর সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা এগিয়ে আসেন। মোদি গর্তের দিকে এগোন, কিন্তু ডাকাতদের তরফে আবারো হেভি ফায়ারিং শুরু হয়। মোদি হ্যান্ডগ্রেনেডের সাহায্যে গর্তে হামলা করেন। কিছু ডাকাতের মৃত্যু হওয়ায় ফায়ারিং কম হয়ে আসে ডাকাতদের তরফ থেকে। তা সত্ত্বেও যখনই পুলিশ এগোতে শুরু করে ফের এক ডাকাতের মার্ক থ্রি রাইফেল গর্জে ওঠে। দ্রুত মোদি আবারো দুটি হ্যান্ডগ্রেনেড গর্তে ছুড়ে দেন, আর আহত ডাকাতদের উপর লাইট মেশিনগান দিয়ে হামলা করেন। কিছুক্ষণ পর, যখন পুলিশপার্টি সেই গর্তের ভেতর পৌঁছোয়, দেখা যায় গ্রেনেডে মারা যাওয়া ডাকাতদের মধ্যে গব্বর সিং নিজের শেষ নিশ্বাস ফেলছে। তার নিচের দিকের চোয়াল গ্রেনেডের আঘাতে উড়ে গিয়েছে। যখন তল্লাশি শেষ হয় দেখা যায় ডাকাতের পুরো গ্যাং শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই অপারেশনে ডাকাতদলের হাতে বন্দি চারজন অপহৃতের মধ্যে দুজন এই ফায়ারিং-এ মারা যান। এদিকে গব্বরের মৃত্যুর খবর পাকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাইওয়ের উপর দাঁড়ানো হাজার হাজার গ্রামবাসীর ভিড় গব্বরের মৃত্যুর উৎসব শুরু করে। এই ঘটনা ছিল একশো-ষাটজন লোকের নাক কেটে নেওয়া, চম্বলের সবচেয়ে নৃশংস আর ঘৃণ্য ডাকাতের জীবনের পরিসমাপ্তি, কিন্তু চম্বলের শেষতম ডাকাতের নয়।

গব্বরের জনপ্রিয়তা চম্বল ছাড়িয়ে সারা দেশের পাশাপাশি পৌঁছেছিল বলিউডেও

 

আরও পড়ুন
১১৬ জনের নাক কাটলে ছুঁতে পারবে না পুলিশ, গব্বর সিং-কে ‘উপদেশ’ তান্ত্রিকের

এই বেহড়ই ছিল গব্বরের আসল সহায়

 

স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। গব্বরের আতঙ্কের শিকার কয়েকজনের নাম ঠিকানা লিখে নিয়েছি ইতিমধ্যেই। এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়, মাত্র মিনিট পনেরোর রাস্তা ছিনসরেঠা। এখনই গেলে বেলাবেলি ফিরে আসা যাবে ভিণ্ডে। জানি না যাদের ঠিকানা লিখেছি তারা জীবত আছে কিনা। কিন্তু চম্বলে ভাগ্য আমার যখন এতটা সহায় হয়েছে, তখন দেখাই যাক না। ফের রণবীর সিং-এর কাছে যাই। ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে বলি, আমি ছিনসরেঠায় যেতে চাই, কীভাবে যাব বলে দিন। রণবীরজী আমাকে বলেন, ‘কা বাঙ্গালিবাবু, কাহে ইতিনি সাল পুরানি গড়ে মুর্দে উখার রহে হো। কা মিলেগা একষট সাল বাদ?’ রণবীরজীকে বুঝিয়ে বলি, কিছু পাওয়ার জন্য সেখানে যাচ্ছি না। যাচ্ছি সেই এলাকা ঘুরে দেখতে। সেখানকার পরিবেশ কেমন, যদি বয়স্ক কেউ বেঁচে থাকে, যারা চাক্ষুষ দেখেছিল গব্বরকে, তাদের অভিজ্ঞতা শুনতে চাই। কিছু না পাওয়া যাক, একটা নতুন জায়গা তো দেখা হয়ে যাবে। তাই বা কম কী! আর আমার কাজের কিছু পেলে তা তো বাড়তি পাওনা। আপনি শুধু বলে দিন কীভাবে যাব। রণবীর সিং-ই একটা জিপের বন্দোবস্ত করে দেন। আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়ে আবার হোটেলে পৌঁছে দেবে। সব মিলিয়ে তিনশো টাকা দিতে হবে। রাজি হই। জিপে করে হাইওয়ে ধরে আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলে জিপ। নাহ্‌, চম্বল আমাকে নিরাশ করেনি। ছিনসরেঠায় গ্রামের চৌহদ্দিতেই আমি দেখা পেয়ে যাই নব্বই-উত্তীর্ণ ফিরেলালের। আমার পনেরো দিনের চম্বল সফরে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ যেখানেই গিয়েছি, চম্বল আমাকে দু-হাত ভরে দিয়েছে। অসংখ্য গল্প, শয়ে-শয়ে মানুষের জীবন-কাহিনি যেমন দিয়েছে, তেমনই দিয়েছে অগাধ বন্ধুত্ব। তা সে মহাবীর সিং হোক, জগরূপজী হোক, বাবুলী-গৌরি হোক, বা এই ফিরেলাল। হয়তো এদের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। অনেকেরই ফোন নাম্বার আছে। কিন্তু যোগাযোগ করা হয়নি। তবু এদের কাছ থেকে যা পেয়েছি, যে ভালোবাসা, আতিথেয়তা পেয়েছি, নিজেদের জীবনকে এরা যতটা উজাড় করে দিয়েছে আমার কাছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে যাবে আমৃত্যু। ছিনসরেঠা গ্রামের ফিরেলাল, রতনপাল এদের কাছ থেকেও শুনেছি, গব্বরের একের অপর এক নারকীয় অত্যাচারের ঘটনা। এদের সকলেরই বয়েস আশি-নব্বই-এর কোঠায়। কিন্তু প্রত্যেকেই গব্বরের অত্যাচারের এক একজন জ্বলন্ত নিদর্শন।  ফিরেলালের কথায়, ‘মেরি ইয়ে দর্দ কভি কম নেহি হুয়া, পর জিস দিন পুলিশ গব্বর কো মার গিরায়া থা, উস দিন দিলকো ঠন্ডক পহুচিথি, সাহাব। দুখ তো কম নহি হুয়া, পর জখম পর মরহম জরুর লগা থা’।

বেহড়ের এই অঞ্চলে ছিল গব্বরের ডেরা, ঠিক এই ... ের রামগড়ে খুঁজে বের করেন শোলের পরিচালক

 

আরও পড়ুন
নাক কেটে ‘শাস্তি’ দিল গব্বর সিং, সেদিনের ঘটনায় আজও শিউরে ওঠেন ফিরেলাল

এখনও এভাবেই পায়ে হেঁটে চম্বলের বেহড়ে অ্যাম্বুশ করে পুলিশ বাহিনী, গাড়ি মেইন রোড অব্ধিই চলে

 

শোলে আমার খুব প্রিয় সিনেমার একটা, কিন্তু আজকের পর আমি যতবার শোলে দেখব, ততবার আমজাদ খান নন, আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে মেহেগাঁও থানার পুলিশ ফাইলে থাকা মৃত গব্বরের ছবি। তবে শোলের গব্বর খানিকটা আলাদা হলেও, তা ছিনসরেঠার গব্বরের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। সত্যিকারের গব্বরের সিনেমা হয়ে ওঠার পেছনেও ছিল এক মজাদার কাহিনি। মুম্বাইয়ের ফিল্ম-রাইটার জুটি সেলিম-জাভেদের সেলিম খান, অভিনেতা সালমন খানের বাবা। সেই সেলিম খানের বাবা আবদুল রশিদ খান ছিলেন মধ্যপ্রদেশের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল। সেইসময় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে গব্বরকে ধরার জন্য চম্বলে পুলিশক্যাম্প করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল মধ্যপ্রদেশের ইনস্পেক্টর জেনারেলকে। তৎকালীন ইনস্পেক্টর জেনারেল যে মিটিং ডেকেছিলেন, সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলে ডেপুটি জেনারেল আব্দুল রশিদ খানও। এমনকি তিনিও উপস্থিত ছিলেন গব্বরকে নিকেশ করার অভিযানে। ফলে সেলিম খান সমস্ত কিছুই জানতেন গব্বরের বিষয়ে। পরবর্তীকালে শোলে ফিল্ম লেখার সময় তিনি গব্বরের নৃসংশতাকে অনেকটাই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আরো একজন গব্বর সিং ছিল চম্বলে। তার আসল নাম, প্রীতম সিং। উত্তরপ্রদেশের ললিতপুরা জেলায় সক্রিয় ছিল তার দল। শোলে সিনেমার পরপরই তিনি নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন গব্বর সিং। সমস্ত ছিনসরেঠা ঘুরে, গ্রামের গাছবুড়োদের কথা শুনে, ফের জিপে করে ফিরে আসি আমার চেনা ভিণ্ডে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা করি জগরূপজীর সঙ্গে। আড্ডা দিই খানিক। মোহর সিং, গব্বরের গল্প করি। তারপর চা-টা খেয়ে ফিরে আসি হোটেলে। এবার সম্পূর্ণ বিশ্রাম। আজ আর কোথাও যাওয়ার নেই।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
চম্বলের কুখ্যাত গব্বর সিং-কে দেখেই তৈরি হয়েছিল ‘শোলে’র গব্বর চরিত্রটি

More From Author See More