দুর্ধর্ষ দুশমন – ২১
আগের পর্বে
একের পর এক মুঠভেড়েও গব্বরের গায়ে আঁচড় কাটতে পারেনি পুলিশ। অন্যদিকে ঝড়ের গতিতে বাড়তে থাকে গব্বরের নামে পুলিশি রেকর্ডের সংখ্যা। গব্বরের মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছিল, গ্রামের লোকেরাই মুখবিরী করছে তার সঙ্গে। মুখবীরদের জন্য চরমতম শাস্তি ঠিক করে গব্বর। এক চৌকিদার-সহ গ্রামের ৩ গ্রামবাসীকে পিটিয়ে আধমরা করে দেয় গব্বর। তারপর কেটে নেওয়া হয় তাদের নাক। এই ঘটনার পর থেকে চম্বলে কাটা পড়তে থাকে একের পর এক গ্রামবাসীদের নাক-কান। গব্বরের সেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল চম্বলের বাইরেও। যা অন্য ডাকাতদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল গব্বরকে।
গ্রামের চৌরাস্তায় বসে যখন আপনি এই যন্ত্রণার কাহিনি শুনবেন নিশ্চিতভাবে আপনার মনে পড়ে যাবে শোলের সেই বিখ্যাত দৃশ্য, যখন গব্বরের সঙ্গী কালিয়া রামগড়ের লোকেদের বলে যে, ‘গব্বর আপ সে কেয়া চাহতা হ্যায় সির্ফ থোড়া সা আনাজ অউর ক্যায়া?’ কিন্তু এই গ্রামের লোকেরা সেই দৃশ্যের চেয়েও বেশি আতঙ্কের আর ভয়ের কাহিনি আপনার কাছে তুলে ধরতে পারে। কারণ বাস্তবে এরা সেই সমস্ত লোক, যারা ফিল্মি পর্দার ওই দৃশ্য বাস্তব জীবনে ঘটতে দেখেছেন। যারা আজ কোনো মতে নিজেদের সেই কাহিনি শুনিয়ে চলে। এই গ্রামের বেঁচে থাকা লোকের কথা শোনা যাক, যাঁরা আসল গব্বর সিং-এর অত্যাচার বছরে পর বছর ধরে ভোগ করেছেন।
গ্রামের চৌরাস্তায় আড্ডা মারতে বসা ফিরেলালের সঙ্গে একদল বৃদ্ধও ছিল। যাদের কথায়, ‘গল্লা না দেনে পর নাক কাট লিয়ে। অউর পুরে গাঁও পর জুর্মানা কিয়া। দেশি ঘি, দুধ, চাওল অউর আটা। গাঁওমে উস ওয়াক্ত কিসি কিসিকে ঘর মে ইতনা সামান হোতা থা, কি ও তিস আদমিকে গিরোহ কো ইস তরহ খানা খিলা দে। অউর এক-দোবার দেনে কে বাদ যব গাঁওয়ালোনে একবার কহা কি উনকে পাস কুছ নেই হ্যায় তো গব্বরনে আপনা খৌফ দিখা দিয়া। পহেলে দো লোগোকো গাঁওকে বিচো-বিচ নাক কাটলি, অউর উসকে বাদ বাকি গাঁওকো লাঠিয়ো আউর বন্দুক কী বটো সে বেহঁশ হোনে তক পিটা। গাঁও ওয়ালোকো মাফি মিলি তব জব উনহোনে সজা কে বদলে জুর্মানা দেনে কি হামি ভরী’। ফিরেলালের কথায়, সেই সময় যখন একজন মানুষের একদিনের কাজের মজুরি মাত্র একআনা বা দু-আনা ছিল, তখন এই গ্রামের লোকেরা গব্বরের এগারোশো টাকা মেটানোর জন্য এক বছর গ্রাম ছেড়ে শহরে মজদুরি করে পয়সা জমিয়ে শূন্য গ্রাম ফিরে আসে।
গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এইসময় চম্বলে এক তান্ত্রিকের সঙ্গে পরিচয় হয় গব্বরের। সেই তান্ত্রিক তাকে বলে, যদি সে একশো ষোলোজনের নাক কেটে দুর্গামাকে উপহার দেয়, তাহলে পুলিশের গুলি তাকে ছুঁতে পারবে না। ব্যস আর কী! এক সময় যা ছিল গব্বরের শখ, শেষে তা পরিণত হল পাগলামিতে। গ্রামে গ্রামে লোকের নাক কাটার জন্য উঠে পড়ে লাগল সে। তার পাগলামির এমন মাত্রা ছাড়াল, যে গব্বর কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবলেরও নাক কেটে নেয়। একদিন এক সেপাই গ্রামে ওয়ারেন্ট তামিল করতে গিয়ে গব্বরের খপ্পরে পড়ে গেলে গব্বর তার নাক কেটে নেয়। এর পরপরই গব্বর একই গ্রামে একসঙ্গে এগারো জনের নাক কেটে নেয় নিজের পুজো সম্পূর্ণ করতে। মুখবীরদের প্রতি বিশেষ ক্ষোভ ছিল গব্বরের। পুলিশের সঙ্গে একটা এনকাউন্টারের পর তার সন্দেহ হয় চম্বলের একটি গ্রামের লোকেদের উপর, যে তারা তার দলের মুভমেন্টের খবর পুলিশকে দিয়েছ। এটুকুই যথেষ্ট ছিল গব্বরের জন্য।
আরও পড়ুন
নাক কেটে ‘শাস্তি’ দিল গব্বর সিং, সেদিনের ঘটনায় আজও শিউরে ওঠেন ফিরেলাল
একদিন সেই গ্রামে উপস্থিত হয়ে একের পর এক একুশজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করে সে। গব্বরের আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। মধ্যপ্রদেশের রাজনীতিও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ১৯৫৮ সালে বিপক্ষ দল গব্বরের শিকার এক ডজন লোককে নিয়ে ভোপাল বিধানসভার বাইরে বিক্ষোভ দেখায়। গ্রামের নির্দোষ লোকেদের নাক বাঁচাতে প্রশ্নের মুখে পড়ে সরকারের নাক। মধ্যপ্রদেশ সরকার, পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেলকে ভিণ্ডে ক্যাম্প করার আদেশ দেয়, যাতে গব্বরের গ্যাং-কে শেষ করা যেতে পারে। পুলিশের বড়ো আধিকারিকেরা জেলার সমস্ত পুলিশ আধিকারিকদের মিটিংয়ে ডেকে এই কাজের জন্য কোনো অফিসারকে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসার জন্য বলেন। আর তারপর দায়িত্ব দেওয়া হয় তরুণ ডেপুটি এসপি রাজেন্দ্রপ্রসাদ মোদিকে। আরপি মোদি কিছুদিন আগেই চম্বলের দস্যুসুন্দরী পুতলীবাঈয়ের এনকাউন্টার করে শিরোনামে উঠে এসেছিলেন। মোদিসাহেবের জন্য গব্বর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ গব্বরের আতঙ্কে কোনো মানুষই তার ব্যাপারে খবর দেওয়া তো দূরের কথা, তার নামও মুখে আনতে সাহস করেনি। পুলিশের সমস্ত প্রয়াসই লাগাতার জলে যাচ্ছিল।
আরও পড়ুন
চম্বলের কুখ্যাত গব্বর সিং-কে দেখেই তৈরি হয়েছিল ‘শোলে’র গব্বর চরিত্রটি
দু-বছর কেটে গেলেও পুলিশ গব্বর তো দূর অস্ত, তার ব্যাপারে কোনো খবর হাসিল করতে পারছিল না। গব্বরের উপর সেইসময় তিন রাজ্যই পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। কিন্তু চম্বলে ঘাঁটির কারো কাছে ইনামের লোভ নয়, বরং নিজের প্রাণের মায়া বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক সেই সময় গোহাদ থানায় বসে মোদি এমন এক কাজ করলেন যে তার জন্য গব্বরের কাছে পৌঁছোনোর রাস্তা খুলে গেল। গোহদ সড়কের কাছে ঘুমকাপুরা গ্রামে এক ঝুপড়িতে আগুন লেগে যায়। মোদি ঘটনাস্থলে পৌঁছোন। পুলিশ আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার সময়ে জানা যায় যে, একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত সে ঝুপড়িতেই আটকে রয়েছে। কেউ কিছু ভাবার আগে মোদিজি স্বয়ং জ্বলন্ত ঝুপড়িতে ঢুকে পড়েন আর সেই পাঁচ বছরের বাচ্চাটিকে উদ্ধার করে। বাচ্চাটা আগুনে ঝলসে গিয়েছিল। ডিএসপি মোদিজী নিজের জিপ আর কিছু টাকা সেই বাচ্চার বাবাকে দিয়ে তাকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠান। সেই বাচ্চাটার বাবার নাম ছিল রামচরণ। গোহদ থানা আর ডাঙ (জঙ্গল) গ্রামের মধ্যে থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু ডাঙের গব্বর আর গোহদ থানার মধ্যপ্রদেশ পুলিশ, দুজনের মধ্যে এত দূরত্ব যে গব্বর পর্যন্ত পুলিশের গুলি পৌঁছোচ্ছিল না। এই অবস্থায় ঝুপড়িতে আগুন লাগার পঁচিশদিন পর, রামচরণ গোহদ থানায় এসে মোদিকে বলে যে সে মোদির উর্দিতে মেডেল পরিয়ে নিজের ঋণ শোধ করতে চায়। মোদি অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করেন যে রামচরণ ঠিক কী করতে চাইছে। আচমকাই রামচরণ বলে ওঠে যে সে গব্বরের ঠিকানা দিতে চায় তাকে।
আরও পড়ুন
অপহরণই বদলে দিয়েছিল নীলমের জীবন, চম্বলের ধূর্ত ডাকাতের নেপথ্য কাহিনি
রামচরণ মোদিকে বলেন রাতে তাঁর সঙ্গে ডাঙ-এ যেতে। রাতে মোদি আর রামচরণ ডাঙ-এ পৌঁছোন। তারপর রামচরণ মোদিকে নিয়ে হাইওয়ে আর সেখান থেকে ঘুমকাপুরা পৌঁছোন। রামচরণ ভিণ্ড হাইওয়ের একদিকে ডাঙ, আর অন্যদিকে ঘুমকাপুরার মধ্যেকার সেই জায়গা দেখিয়ে দেয়, যেখানে গব্বর হামেশাই থাকত। মোদি নিজের নকশা তৈরি করে ফেলেন, আর জালও তৈরি হয়ে যায়। এখন খালি শিকারের অপেক্ষা।
আরও পড়ুন
বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই সৎ ছেলের সঙ্গে পালাল নীলম, অগ্নিগর্ভ চম্বল
Powered by Froala Editor