দুর্ধর্ষ দুশমন - ২০
আগের পর্বে
হিন্দি সিনেমার জগতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল ‘শোলে’। সিনেমার পর্দায় আতঙ্কের ছাপ এঁকে দিয়েছিলেন আমজাদ খান ওরফে গব্বর। আসলে এই চরিত্রটি বানানো হয়েছিল চম্বলের কুখ্যাত দস্যু গব্বর সিংয়ের অনুকরণে। যাঁর আতঙ্কের চিহ্ন এখনও লেগে রয়েছে বেহড়ে। গব্বরের শখ ছিল মৃত্যু উপহার দেওয়া, নাক কেটে নেওয়া নিরপরাধ মানুষের। প্রায় ছ’ দশক আগে মৃতদেহের ইমারত গড়ে তুলেছিল গব্বর। ভিন্ড শহরের গোহদ থানার কাছেই ১৯২৬ সালে জন্ম গব্বর সিংয়ের। বাবার সামান্য অপরাধের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত কেড়ে নেয় তাদের জমি। সেখান থেকেই শুরু গব্বরের চম্বল সফর। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর ৭০তম জন্মদিনের দিনই শেষ হয়েছিল সেই অধ্যায়। ভারতের সফলতম পুলিশ আধিকারিক কেএফ রুস্তমজি গব্বরের মৃত্যুর খবর সেদিন উপহার দিয়েছিলেন নেহরুকে।
পঞ্চাশের দশকে চম্বলে ছিল বড়ো বড়ো গ্যাং-এর ধারা। এই অবস্থায় গোবরা ওরফে গব্বর এক নতুন সমস্যা হয়ে দেখা দিল পুলিশের সামনে। গব্বর নিজের দলকে যেন এক মেশিনে পরিণত করে তুলল। মৃত্যু আর লুঠের মেশিন। শুধুমাত্র মেহগাঁওয়ের পুলিশ রেকর্ড মোতাবেক অক্টোবর ১৯৫৬ থেকে ডিসেম্বর ১৯৫৬ এই তিন মাসে মেহেগাঁও থানাতেই গব্বরের নামে কয়েক ডজন ডাকাতি, আর একই সংখ্যক খুনের মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। অন্যান্য থানাতেও সংখ্যাটা বেশি বই কম নয়। তিন রাজ্যের পুলিশ পাগলা কুকুরের মতো গব্বরের খোঁজে বেহড় থেকে বেহড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। পুলিশের উপর চাপ বাড়ছিল এই নতুন কিন্তু ভয়ঙ্কর দলকে শেষ করার জন্য। কিন্তু গব্বরের মনে পুলিশেরই কোনো ভয় ছিল না। পুলিশ রেকর্ড মোতাবেক এই তিনমাসে পুলিশের সঙ্গে তার বেশ কয়েকটা মুঠভেড় হয়। কিন্তু প্রত্যেক মুঠভেড়েই হয় পুলিশের জওয়ান আহত হয়, না-হলে তাদের প্রাণ দিতে হয়। গব্বরের দলের গায়ে একটা আঁচড়ও কাটতে পারেনি পুলিশ। একের পর এক এনকাউন্টার থেকে বেঁচে যাওয়ায় চম্বলে গব্বরের সম্মান আর প্রতিপত্তি আরো বেড়ে যায়। বাড়িয়ে দেয় গব্বরের আত্মবিশ্বাসও। চম্বলের অন্যান্য ডাকাতদের মতো গব্বরও দেবীর পুজো করত, এই ব্যাপারে বেশ খানিকটা অন্ধবিশ্বাসীই সে ছিল। চম্বলের ঘন জঙ্গলে থাকা রতনগড় দেবীমন্দিরে সে এক সপ্তাহ পর্যন্ত থেকে পুজো করত। জঙ্গলের মধ্যে অনেক উঁচুতে তৈরি এই মন্দির পর্যন্ত পৌঁছোতে পুলিশকেও অনেক মেহনত করতে হত। যতক্ষণে তারা সেখানে পৌঁছোতেন, গব্বর ফেরার হয়ে যেত। চম্বলে গব্বরের রাজত্ব চলতে শুরু করে। গ্রামের পর গ্রাম তার নাম শুনলেই কাঁপতে থাকে।
ডাকাতদের পরম্পরা অনুযায়ী গব্বর একদিন ঘোষণা করে সে মা শীতলাদেবীর মন্দিরে নাগাড়া চড়াতে যাবে। সেই সময় চম্বলে শীতলাদেবীর এই মন্দির যথেষ্ট শ্রদ্ধার কেন্দ্র ছিল। গব্বর যখন এই মন্দিরে ঘণ্টা আর নাগাড়া চড়ানোর কথা ঘোষণা করল, সেইসময় পুরো এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। কারণ প্রত্যেকবারই এই ধরণের ঘোষণার পর নতুন ঘটনা ঘটাত সে। একদিন পুরো দলের সঙ্গে দিনে-দুপুরে গব্বর শীতলামায়ের মন্দিরে উপস্থিত হয়। মন্দিরে পুজো দেওয়ার ঘোষণা পুলিশের কানেও পৌঁছেছিল। কিন্তু যতক্ষণ পুলিশ এসে গব্বরকে ঘিরে ধরার উপক্রম করে, তার অনেক আগেই সেখান থেকে ফেরার হয়ে গিয়েছিল। গব্বরের আত্মবিশ্বাস আর আতঙ্ক যে কতটা উচ্চতায় পৌঁছেছিল সেইসময়, আজো তার সাক্ষী বহন করে চলেছে গব্বরের দেওয়া শীতলাদেবীর মন্দিরে রাখা নাগাড়া। শীতলাদেবীর এই মন্দির স্বয়ং যেন ডাকাতদের মিউজিয়াম। কারণ আজো বহু ডাকাতদের চড়ানো ভেট এই মন্দিরে সযত্নে রক্ষিত আছে। এই মন্দিরে আজো রোজ সন্ধ্যারতির সময় জ্বলে ওঠে যে পেতলের প্রদীপের ঝালর, তা চম্বলের প্রথম মহিলা-ডাকাত পুতলীবাঈয়ের দেওয়া।
পুলিশের খাতায় এখন আর গব্বর সিং কোনো ছোটোখাটো ছিঁচকে ডাকাত নয়, বরং সে চম্বলের এক নামী ডাকাত হয়ে উঠেছিল। গব্বরের বিখ্যাত হওয়ার লোভ শুধু বিখ্যাত হয়েই শেষ হয়নি, বরং সে চাইত সমস্ত ডাকাতদের চেয়ে আলাদা করে যেন তার নাম মনে রাখে লোকে। তার নাম শুনলেই যেকোনো গ্রামে যেন আতঙ্কের বান ডেকে যায়। আর এই কাজের জন্য সে আচমকাই এক নতুন সিদ্ধান্ত নেয়। যা তার নাম চম্বল ঘাঁটির বাইরেও ছড়িয়ে দিয়েছিল। সে সিদ্ধান্ত নিল যে মুখবীরদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে তাদের শাস্তি দেবে। চম্বলে গব্বরের নাম প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করে, কিন্তু গব্বরের মনে অন্য সুর বাজছিল। পুলিশের সঙ্গে একের পর এক এনকাউন্টার থেকে গব্বর যতই নিজের দলকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলুক, তার সন্দেহ ছিল, যে তার গ্রামের লোকেরাই তার মুখবিরী করছে। এই সন্দেহ গব্বরের মনে এমনভাবে দানা বাঁধে যে সে শাস্তির বিধানও তৈরি করে ফেলল।
আরও পড়ুন
চম্বলের কুখ্যাত গব্বর সিং-কে দেখেই তৈরি হয়েছিল ‘শোলে’র গব্বর চরিত্রটি
হঠাৎই একদিন সে নিজের গ্রাম ছিনসরেঠায় দিনেদুপুরে উপস্থিত হয়। গ্রামের এক চৌকিদারের উপর তার সন্দেহ ছিল যে, সে-ই পুলিশের চর। গ্রামে ঢুকেই সে প্রথমে চৌকিদারকে পাকড়াও করে, তার সঙ্গে আরো একটা গ্রামবাসীকে ধরে সে। যখন সেই দুজনকে টেনে হিঁচড়ে গ্রামের কুয়োর কাছে আনা হয়, সেইসময় রাস্তায় বসে থাকা আরো দুই দলিতকেও তার দল বন্দি করে নেয়। আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা ঘরের দরজা বন্ধ করে থরথর করে কাঁপতে থাকে। পুরো গ্রাম যেন শ্মশানের মতো নিস্তব্ধ। প্রথমে গব্বর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে সেই চারজনকে প্রায় আধমরা করে ফেলে। তারপর জলদ গম্ভীর স্বরে সে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘লা তেরি নাক, দেখতা হুঁ কিতনী বড়ি হ্যায়,’ বলেই সে সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে ছুরি বের করে ওই চারজনের নাক কেটে দেয়। এরপরই যন্ত্রণায় অজ্ঞান সেই বন্দিদের মধ্যে চৌকিদারকে এলোপাথারড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করে সে। তারপর রাজার মতো ধীর পদক্ষেপে সেখান থেকে সিটি বাজাতে বাজাতে চলে যায় গব্বর।
আরও পড়ুন
অপহরণই বদলে দিয়েছিল নীলমের জীবন, চম্বলের ধূর্ত ডাকাতের নেপথ্য কাহিনি
গ্রামের বাড়ির দরজা তো খুলে গিয়েছিল, কিন্তু কারোরই সাহসে কুলোয়নি যে, সেই চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। কেউই চাইছিল না গব্বরের রাগ তাদের উপর এসে পড়ুক। কোনোমতে সকালবেলায় পুলিশের কাছে খবর পৌঁছোয়। পুলিশ সেখানে পৌঁছে যন্ত্রণায় নির্জীব আহতদের কোনোমতে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেই চারজনের একজন ফিরেলাল আজও জীবিত।
আরও পড়ুন
বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই সৎ ছেলের সঙ্গে পালাল নীলম, অগ্নিগর্ভ চম্বল
নব্বই-উত্তীর্ণ সেই বৃদ্ধের নতুন নকল নাক সরকারি খরচায় লাগানো হয়েছিল। কিন্তু একবার দেখলে যে কেউ সহজেই বলে দেবে, যে সেই নাক কী নিষ্ঠুরভাবে কাটা হয়েছিল। একই গ্রামের চারজন লোকের নাক কাটার ঘটনা পুরো এলাকাকে স্তব্ধ করে দেয়। আগে এই ধরনের ঘটনা চম্বলের বেহড়ে খুব কমই শোনা গেলেও একসঙ্গে চারজনের নাক কাটা এই প্রথমবার। এই ঘটনা পুলিশের সামনে নতুন সমস্যা ডেকে আনল। তবে গব্বরের আতঙ্ক এতে আরো বেড়ে গেল। উচ্ছ্বসিত গব্বর ছোটোছোটো যে-কোনো ঘটনাতেই গ্রামবাসীদের শিক্ষা দেওয়ার দারুণ উপায় হিসেবে গ্রহণ করল এই নাক কাটার শাস্তি। যে-কোনো ব্যাপারেই যদি সে ক্ষুব্ধ হত কারোর প্রতি, তাহলে গ্রামে ঢুকে সোজা এভাবেই গ্রামবাসীদের নাক-কান কেটে তাদের শিক্ষা দিতে থাকে। সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে আজো আতঙ্কে কেঁপে ওঠেন এই বৃদ্ধ।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দস্যুসুন্দরীকে পাওয়ার জন্য খুনোখুনি, লাল হয়ে উঠেছিল চম্বলের মাটি