দুর্ধর্ষ দুশমন - ১৯
আগের পর্বে
শশীগরন গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সন্ধান মিলল না নিলমের। অতঃপর ফিরে আসা আউরিয়ায়। সেখানে এক চায়ের দোকানে দুই পুলিশের থেকেই সন্ধান মিলল নিলমের। তবে বিস্ময় লাগল নিলমের ব্যাপারে তাঁদের কথার ভঙ্গি শুনে। মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। মিনিট তিরিশেক অপেক্ষার পর হাজির হল নিলম। নির্ভয়ের কাছে বারবার ধর্ষিত হয়ে, পালাবার রাস্তা খুঁজেছিল সে। কাজে লাগিয়েছিল নিজের শরীরকে। নির্ভয়ের পালিত পুত্র শ্যামকে সঙ্গী করে সরলার গয়না, অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই পালিয়েছিল নিলম। বুঝতে পারেনি ধূর্ত সরলাও। জেল মুক্তির পরে একাধিক মিডিয়ার কাছে নিলম জানিয়েছিল সে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। কিন্তু বন্দুক চালানোর ভিডিও প্রমাণ মেলে সহজেই। কিন্তু কিশোরী অবস্থায় তার অপহরণ না হলে হয়তো আর পাঁচটা মেয়ের মতোই হত তাঁর জীবন। পা রাখতে হত না দস্যুবৃত্তিতে।
চম্বলের নারীদের নিয়ে অনেক কথাই বলা গেল, সবটা কিন্তু নয়। সেই ১৯৫২ থেকে ২০১৫ চম্বলে নারী বাগীদের সংখ্যা পুরুষ বাগীদের তুলনায় কম হলেও নেহাত সেই সংখ্যাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এমন এমন সব নারী চরিত্র চম্বলের সাম্রাজ্য শাসন করেছে যে তাদের নিয়ে লিখতে বসলে গোটা একটা মহাভারত হয়ে যেতে পারে। কারও কারও কথা মনে রেখেছে চম্বল, কাউকে একেবারে উপেক্ষার গভীরে তলিয়ে দিয়েছে। তাদের কথা একমাত্র পুলিশ রেকর্ড ছাড়া আর কোথাও নেই। এমনকি পুলিশ রেকর্ডেও অনেকের কথা নেই। ফলে চম্বলের নারীদের কথা এটুকুই থাক। বরং এবার চম্বলের এমন এক ডাকাতের গল্প বলা যাক, যে চম্বল ছাড়িয়ে তার জনপ্রিয়তা বিস্তার করেছে বলিউডেও। তার জীবন নির্ভর একটি বলিউডি ফিল্ম হিন্দি সিনেমার জগতকেই পালটে দিয়েছিল পুরো। তিনি আর কেউ নন গব্বর সিং। হ্যাঁ হিন্দি সিনেমার সেই ভয়ঙ্কর ডাকাত গব্বর সিং। একটু ফিরে যাওয়া যাক অতীতের দিকে।
‘পঁচাশ পঁচাশ কোশ তক জব কোই বাচ্চা রোতা হ্যায়... তো মা কেয়া কহতি হ্যায়? বেটা শো যা... নহি তো গব্বর আ জায়েগা...’। শোলে সিনেমার এই জনপ্রিয় সংলাপ সকলেরই প্রায় মুখস্থ। সিনেমার পর্দায় গব্বরের হাসি আজো যে কোনো মানুষের হৃদয় আতঙ্কের ঝড় তোলে। শোলের গব্বর হিন্দি ফিল্মে ভয় আর আতঙ্কের নতুন অধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আপনার কখনো কি মনে হয়েছে যে ফিল্মের গব্বর নকল? হ্যাঁ, শোলের গব্বর সত্যিই নকল। কারণ সিনেমার পর্দায় দেখা আমজাদ খান ওরফে গব্বর, চম্বলের আসল গব্বর সিং-এর কপি ছিল। গব্বরের গল্প এমন এক ডাকাতের গল্প যা হিন্দি সিনেমা জগতে আতঙ্কের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সিনেমা শেষ হতেই ভয়ের চিহ্নও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আসল গব্বরের আতঙ্কের চিহ্ন আজো চম্বলের বেহড়ের গ্রামগুলিতে দেখতে পাওয়া যাবে।
ছিনসরেঠা গ্রাম। চম্বলের বেহড়ে আরো কয়েকশো গ্রামের মতোই একটা গ্রাম। গব্বরের গল্প আজ থেকে প্রায় ছ-দশক আগেই শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সেই গল্পের ভয় আজ পর্যন্ত এই গ্রাম তার কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছে। ফিরেলাল... নব্বই বছরের এই বৃদ্ধ নিজের জীবন শেষের দিন গুনছেন। কিন্তু একষট্টি বছর আগের সেই দিন আজো তার মনে এমনভাবে জাঁকিয়ে বসেছে, মনে হয় যেন কালকের কথা। একষট্টি বছর এমন এক জীবন অতিবাহিত করা, তা খালি তিনিই জানেন যিনি সেই জীবন কাটিয়েছেন। শুধু ফিরেলাল নন, চম্বলের কয়েক ডজন গ্রাম গব্বরের আতঙ্কের কাহিনি নিজের হৃদয়ে লুকিয়ে রেখেছে। আজো কোনো অপরিচিত যদি সেখানে গিয়ে গব্বরের নাম উচ্চারণ করে, তাহলে তার পুরোনো ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
আরও পড়ুন
অপহরণই বদলে দিয়েছিল নীলমের জীবন, চম্বলের ধূর্ত ডাকাতের নেপথ্য কাহিনি
গব্বরের কাহিনি আপনাদের সম্ভবত কাল্পনিক মনে হতে পারে। ভাবতে পারেন শোলের গব্বর তো সিনেমার ভিলেন ছিল। তাহলে আপনার জেনে নেওয়া দরকার ভারতের সবচেয়ে সফলতম পুলিশ আধিকারিক, যার অর্ধেক জীবন কেটে গিয়েছিল বাগীদের শেষ করতে, সেই বিখ্যাত পুলিশ আধিকারিক যার নাম ‘অভিশপ্ত চম্বল’, ‘বেহড় বাগী বন্দুক’-এর মতো বইতেও উল্লেখ করেছিলেন তরুণ কুমার ভাদুড়ী, সেই আইপিএস অফিসার কেএফ রুস্তমজি গব্বরের মৃত্যুর খবর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুকে তাঁর সত্তরতম জন্মদিনে মধ্যপ্রদেশের পুলিশের তরফে সবচেয়ে বড়ো উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। গব্বরের শখ ছিল মৃত্যু উপহার দেওয়া, আর নির্দোষ লোকেদের নাক কাটা। গব্বর এমনই এক নাম, যে সিনেমার পর্দাতেও তার নাম শুনলে মেরুদণ্ড বেয়ে চোরা স্রোত বয়ে যায়। চম্বলে যখন গব্বরের জীবনের কাহিনি শেষ হয়, ততদিনে গব্বর রক্ত আর লাশের এমন ইমারত দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, যে তার মৃত্যুর কয়েক দশক পরেও আজো লোকের মনে তার আতঙ্ক থেকে গিয়েছে। আমি এই ধুলো আর মাকড়সার জালের মধ্যে বসে সফর করছি সেই আসল গব্বর সিং-এর জীবনের।
আরও পড়ুন
বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই সৎ ছেলের সঙ্গে পালাল নীলম, অগ্নিগর্ভ চম্বল
চম্বল। দূর পর্যন্ত বিস্তৃত বেহড়ের মাঝখানে ভিণ্ড শহর। চম্বলের ডাকাতদের বেশিরভাগ গল্পেই ভিণ্ডের নাম বারবার ঘুরে ফিরে আসে। এই ভিণ্ড এলাকার গোহদ থানা থেকে কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পরই একটা রাস্তা ডাঙের (জঙ্গল) দিকে যায়। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা যেন গ্রামের চরিত্র জানান দেয়। এই গ্রামেরই একটি বাড়ি চম্বলের সবচেয়ে বড়ো আতঙ্কের সাক্ষী বহন করে চলেছে। বাড়ি নয় আসলে খণ্ডহর, দু-একটা ইঁটের স্তুপ আর জঙ্গল। এটাই গব্বর সিং-এর বাড়ি। গুর্জরদের এই গ্রামে গব্বরের জন্ম হয় ১৯২৬ সালে। গব্বরের বাবার কাছে ছিল নামমাত্র জমি। আর চম্বলে কম জমি থাকা মানেই মানসম্মানও অনেক কমে যাওয়া। পেট চালানোর জন্য গব্বরের পরিবার মজদুরি করত। এই এলাকায় আজো পাহাড় কেটে পাথর বার করা হয় বৈধ এবং অবৈধ, দু-রকমভাবেই। গব্বরের বাবা-মাও গ্রামে এই পাথর বহন করার কাজ করতেন। গব্বরকেও সেই একই কাজ করতে হত। তাই ছোটো থেকেই গব্বরের শরীর ছিল যথেষ্ট শক্তপোক্ত। তাছাড়া মজদুরি করার পাশাপাশি বিকেলে গ্রামের আখড়াতে গিয়েও গব্বর নিজের শক্তি প্রয়োগ করত। সে নিজের শারীরিক শক্তির অহংকারে গ্রামবাসীদের একের পর এক চ্যালেঞ্জ জানাত। ছেলেবেলা থেকেই গব্বর ছিল বাউন্ডুলে। গ্রামে চাষাবাদ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। গব্বরের বাবা একটা অপরাধ করায় গ্রামের পঞ্চায়েতের রায়ে তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়। এরপরই বাউন্ডুলে গব্বরের সামনে রুজি-রুটির সংকট দেখা দেয়। আর এমন মানুষের জন্য চম্বল দু-হাত খুলে স্বাগত জানাতে সবসময়ই প্রস্তুত। ব্যস এখান থেকেই শুরু গব্বরের চম্বল সফর।
আরও পড়ুন
দস্যুসুন্দরীকে পাওয়ার জন্য খুনোখুনি, লাল হয়ে উঠেছিল চম্বলের মাটি
গ্রামের রখীশ্বর নামে এক ব্যক্তিকে শত্রুতার কারণে খুন করে গব্বর। কিন্তু তার ডাকাত হয়ে ওঠার কাহিনি এর আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। আসলে, চম্বলে চল্লিশ পঞ্চাশের দশকে বাগী আতঙ্কের রমরমা ছিল। এলাকার মানুষ ভয় থেকেই তাদের সম্মান করত। সেই সময়ই একবার পাশের গ্রামে গব্বর নিজের এক ডাকাত আত্মীয়র সঙ্গে দেখা করে। তার রোয়াব এবং প্রভাব দেখে গব্বরের মধ্যে ডাকাত হওয়ার পাগলামি দেখা যায়। সেই আত্মীয়ের বাড়ি থেকে যখন সে গ্রামে ফেরে, তখন সে বদলে যাওয়া গব্বর। যে প্রত্যেক কথায় গ্রামের লোককে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। ইতমধ্যেই গব্বরের বাবা রঘুবীর সিংহ গ্রামের মধ্যে একটা ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়লে তার শাস্তি হয় এবং পঞ্চায়েতের নির্দেশে গ্রামে তাদের দানাপানি বন্ধ হয়ে যায়। তারা একঘরে হয়ে যান। শেষপর্যন্ত গব্বর সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই এলাকায় নিজের সম্মান হাসিল করবে। সম্মান হাসিল করার জন্য যে রাস্তা সে বেছে নেয়, তা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনই সেই রাস্তা সোজা গিয়ে শেষ হয় বেহড়ে। একদিন গব্বর গ্রামের রখিশ্বরের পরিবারকে একটা সামান্য ঘটনায় গুলি করে মেরেই ফেলে চম্বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমবারেই দু-দুজনকে খুন করার খবর চম্বলে পৌঁছে গিয়েছিল আগেই। ফলে গব্বর সেই সময়ের বিখ্যাত ডাকাত কল্যাণ সিং গুজ্জরের দলে এন্ট্রি পেয়ে যায়।
আরও পড়ুন
‘আজ তুমনে হামার ইজ্জত বাড়া দি’, বলে উঠলেন চম্বলের দলিত গৃহবধূ
চম্বলের প্রবাদ, খুন করার পর কেউ আর পুলিশের চর হতে পারে না। অর্থাৎ পুলিশের লোক হওয়ার ভয় কমে যায়। এই কারণে কোনো দলে শামিল হওয়ার জন্য, অথবা দলে শামিল হওয়ার পর খুন আর লুঠের অংশীদার হওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। গব্বর সিং তার প্রথম বাধা সহজেই পার করে নেয়। এলাকায় নিজের আতঙ্ক তৈরি করার জন্য ডাকাতি, অপহরণ আর খুনের ঝড় বইয়ে দেয় নতুন ডাকাত গব্বর সিং। চম্বলে আশ্রয় নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই গব্বরের আতঙ্কের ছায়া সারা চম্বলে তার জাল বিস্তার করতে শুরু করে। মধ্যপ্রদেশের প্রত্যেক পুলিশ থানার রেকর্ডে প্রায় প্রত্যেকদিনই গব্বরের নাম নথিভুক্ত হতে শুরু করে। একের পর এক হাড় হিম করে দেওয়া ঘটনা চম্বলের এক থানা থেকে আরেক থানায় শোনা যেতে লাগল। গব্বর চম্বলের সেই গুটিকয় ডাকাতদের মধ্যে একজন, যে পরিস্থিতির শিকার হয়ে ডাকাত হয়নি, হয়েছিল স্বেচ্ছায়। গ্রামের নামমাত্র শত্রুতা থেকে খুনের করার পর, প্রথমে বেঁচে থাকা শত্রুদের সঙ্গে মরণ-খেলা শুরু করে গব্বর। তারপর গ্রামের অন্যান্য লোকেদের উপরও তার বন্দুক গর্জে ওঠে। নির্দোষ গ্রামবাসীদের নিয়ে মৃত্যুর খেলা গব্বরের এক নতুন শখ হয়ে ওঠে। চম্বলে যেন মৃত্যুর এক বান ডেকে আনল গব্বর সিং গুর্জ্জর। কারণে অকারণে খুন করার অভ্যেসের ফলে দলের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল শত্রু। কয়েক মাস পরে গব্বর নিজের পছন্দের কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে দল ছেড়ে নতুন দলের সূচনা করল। লুঠের টাকায় তার দল হাতিয়ার হাসিল করে ফেলেছিল। এখন গব্বর নিজেই নিজেকে চম্বলে মহারাজ বলতে শুরু করে। প্রত্যেকটা ডাকাতির ঘটনার পর তার দলের লোকরা অত্যাচারিতদের জোর করে বলতে বাধ্য করত, ‘চম্বলের মহারাজা গব্বর সিং-এর জয়’। ভিণ্ড, মুরেনা, গোয়ালিয়ার, ধৌলপুর, ইটাওয়া আর আশেপাশের এলাকায় একের পর এক লুঠতরাজ ঘটাতে শুরু করে গব্বরের দল। ধীরে ধীরে তার গ্যাং বড়ো হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে তার আতঙ্ক।
Powered by Froala Editor