দুর্ধর্ষ দুশমন - ১৬
আগের পর্বে
অভিশপ্ত চম্বলে বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে নারীদের সম্মান। পুতলীবাঈ, রেণু যাদব, সরলা জাটভ, ফুলনদেবী, নীলম গুপ্তারা অপমানিত, লাঞ্চিত হয়েছে। তারপর বেছে নিয়েছে বেহড়ের পথ। সেই চম্বলের বাঁকে বাঁকে যে বৈষম্য লুকিয়ে থাকবে, তা আর নতুন কী? মালখানের বাড়ি যাওয়ার পথে গলা শুকিয়ে কাঠ। এক মহিলাকে জলের জন্য জিজ্ঞেস করায় দেখালেন একটি কুয়ো। কালো হয়ে গেছে জল। দুর্গন্ধ, পোকায় ভরে আছে। তিনি জানালেন দিনের পর দিন এই জলই পান করেন। কারণ নিচু জাত। মালখানের বাড়ি পৌঁছেও যখন তাঁকে পাওয়া গেল না। শেষ অবধি সে মহলের পিছনে এক ঝুপড়িতে সামান্য জলপ্রার্থনা। নিচু জাতের থেকে জল খেতে চাওয়ায় অবাক হলেন ভদ্রমহিলা। জানালেন, সম্মান বাড়িয়ে দিলাম তাঁর। তারপর...
চম্বলের নারীর সমাজচ্যুত হওয়ার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলেন দুজন। নীলম গুপ্তা আর রেণু যাদব। ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসের ২৯ তারিখ। অন্যান্য দিনের মতোই রেণু যাদব উত্তরপ্রদেশের আউরিয়া জেলার জমালীপুর গ্রামের বাড়ি থেকে স্কুল যাওয়ার জন্য বেরোয়। সবেমাত্র সে গ্রামের বাইরে পৌঁছেছে কী পৌঁছয়নি, ঠিক সেইসময় চম্বলের আতঙ্কের পর্যায় হয়ে ওঠা ডাকাত চন্দন যাদব রেণুকে অপহরণ করে। রেণুর মুক্তির বদলে চন্দন তার বাবা-মার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা দাবি করে। রেণুর বাবা গরিব চাষী বিদ্যারাম যাদব মেয়েকে এত টাকা দিয়ে ডাকাতের হাত থেকে মুক্ত করতে পারেননি। ফলে চন্দন রেণুকে নিজের বউয়ের তকমা দিয়ে দলে রেখে দেয়। রেণুর জীবন স্কুলের রাস্তার বদলে চলতে শুরু করে চম্বলের জঙ্গলের কাঁটা বেছানো এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায়। তার হাতে খাতা-কলমের জায়গায় পুলিশের কাছ থেকে লুঠ করা মারাত্মক হাতিয়ার তুলে দেওয়া হয়। দলের বেশিরভাগ ডাকাতের লোলুপ দৃষ্টি রেণুর সুন্দর সুঠাম শরীরের উপর প্রথম থেকেই পড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু সর্দার চন্দনের ভয়ে কেউই কিছু করতে পারছিল না। চম্বলে দীর্ঘদিন থাকা অনেক মহিলা ডাকাতই বেহড়ে মা হয়েছেন। কিন্তু এই তালিকার মধ্যে যতটা আলোচনা চম্বলে রেণু যাদবের মাতৃত্ব নিয়ে হয়েছিল, ততটা আর কোনো মহিলা ডাকাতের মা হওয়া নিয়ে হয়নি। সূত্রদের মোতাবেক সুরক্ষার কারণে, শিক্ষা এবং ভালোভাবে লালন-পালনের জন্যই রেণু নিজের মেয়েকে বাপের বাড়ি রেখে আসে। যাতে রেণুর চম্বলের ভয়ঙ্কর অতীতের ছায়া তার মেয়ের উজ্বল ভবিষ্যতের উপর না পড়ে। ২০০০ সাল নাগাদ চম্বলের জঙ্গলে আশ্রিত সমস্ত ডাকাত সর্দাররা রেণুকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কে ছিল না সেই দলে! নির্ভয় সিং গুজ্জর, চন্দন গরোদিয়া, গাট্টা নাম গুনে শেষ করা যাবে না। কিন্তু সেইসময় তারা রেণুর তথাকথিত স্বামী চন্দন যাদবের ভয়ঙ্কর স্বভাবের কথা ভেবে, চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা চলতে থাকে ভেতরে ভেতরে।
চন্দনের ভয়ে বাকি দলের সর্দাররা যতই রেণুর থেকে দূরে থাকুক, নিজের দলেরই অন্য এক ডাকাত রামবীর গুর্জর হঠাৎ একদিন গভীর রাতে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় চন্দনকে। আশা ছিল, এবার রেণুকে পাওয়ার রাস্তায় আর কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। রেণুকে পাওয়ার জন্য দুই ডাকাতের খুনখারাপির এই ঘটনা ঘটেছিল ২০০৫-এর ৫ জানুয়ারি। ঠিক এর দশ-বারো দিনের মাথায় ঘটে আরেকটা ভয়ঙ্কর ঘটনা। ২০০৫-এর ১৫ জানুয়ারি গভীর রাতে রামবীর যখন রেণুকে প্রেম নিবেদন করে, তাকে জোর করে বিছানায় নিয়ে যেতে চায়, ঠিক সেইসময় ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো নিজের পাশে থাকা সেলফ লোডেড রাইফেল (এসএলআর) তুলে নিয়ে সমস্ত গুলি রামবীরের বুকে খালি করে দেয় রেণু। শত্রু মারা গেছে ভেবে চম্বল ছেড়ে পালায় সে। কিন্তু মারা যায়নি রামবীর, তবে ভয়ঙ্করভাবে আহত হয়েছিল। রেণুর হামলায় গুরুতর জখম রামবীর যখন জানতে পারে যে, রেণুর পালিয়ে যাওয়ার পেছনে দলেরই কিছু ডাকাতের বিশ্বাসঘাতকতা রয়েছে, সেই রাতেই শুধুমাত্র সন্দেহের বশে দলের তিন ডাকাতকে পরপর লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় সে। অর্থাৎ আবার এক দস্যুসুন্দরীকে পাওয়ার জন্য শুরু হয় খুনোখুনি। চম্বল ঘাটির সবচেয়ে সুন্দরী আর ভয়ঙ্কর ডাকাত হিসেবে পরিচিত রেণু নিজের জীবন নিয়ে ভীত হয়ে পড়ে। পুলিশ বা অন্য কারো নয় বরং সেই ভয়ঙ্কর ডাকাত রামবীর গুর্জরের ভয়ে। সেই রামবীর, যে কখনো সর্দার চন্দন যাদবের এক গেলাসের বন্ধু ছিল।
আরও পড়ুন
‘আজ তুমনে হামার ইজ্জত বাড়া দি’, বলে উঠলেন চম্বলের দলিত গৃহবধূ
রেণুর ভাগ্য খারাপ যে রামবীর বেঁচে যায়। এই মুহূর্তে রামবীর জেলে যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছে। যবে থেকে রেণু জেল থেকে ফিরে এসেছে, তবে থেকেই রামবীর আর তার দলের কাছ থেকে নিয়মিত হুমকি পাচ্ছে সে। জানা গিয়েছে রামবীর আর তার গুন্ডারা আবারো রেণুকে চম্বলে ফিরে যাওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। চম্বলে আবার না ফিরে গেলে তাকে মেরে ফেলা হবে, এই মর্মে দেওয়া হয়েছে হুমকি। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ রেণুকে সুরক্ষা দিয়েছে। রামবীরকে গুলি করার পর ছয়-সাত দিন বেহড়ে পাগলের মতো ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ এটাওয়ায় পৌঁছয় সে। রেণু বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে যে, সে নিজেই সারেন্ডার করেছিল। কিন্তু সেই সময়কার এটাওয়া পুলিশ এসএসপি দলজীত সিং চৌধুরি দাবি করেছিলেন, রেণু যাদবকে সেলফ লোডেড রাইফেলের সঙ্গে সিভিল লাইন্স থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। পুলিশের বক্তব্য রেণু যাদব দেখতে যতটা সুন্দরী, ঠিক ততটাই মন আর মগজে ভয়ঙ্কর সে। যতদিন চম্বলে এই দস্যুসুন্দরী ছিল, ততদিন ডাকাতরা তাকে পাওয়ার জন্য এতটা লালায়িত হয়ে উঠেছিল যে, নিজেদের মধ্যেও খুনোখুনি করতে পেছপা হয়নি। চম্বলে থাকাকালীন না পুলিশ না মিডিয়া, কেউই রেণুকে চোখের দেখাও দেখতে পায়নি। ফলে কোর্টে তোলার সময় তাকে দেখার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন
‘খুদকে কিস্মত পর ক্যা রোনা, যাহা লে যায়েঙ্গী জায়েঙ্গে’, পিঠে চাপড় মেরে বলল গৌরী
আরও পড়ুন
‘নিচু জাতের’ হওয়ায় হেনস্থা, অপহরণ, ধর্ষণ; ক্রমশ ডাকাতদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে গৌরী
প্রায় পাঁচ-ফুট-এগারো-ইঞ্চি লম্বা, ছিপছিপে চেহারা, কমনীয় মুখ। সবসময় সাদা শার্ট বা টি-শার্ট, নীল জিন্স আর স্পোর্টস্-সু পরে থাকা রেণুর আরো একটা বিশেষত্ব ছিল। আর তা হল তার কথাবলার ধরন। পুলিশের মতে, রেণুর মুখে সবসময়ই গালাগালির ফোয়ারা ছুটছে। যা শুনে কোনো মহিলা বা মেয়েরাই শুধু নয়, যে কোনো পুরুষরাও অবাক হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, হাত-পা আর বন্দুক চালাতেও রেণুর জুড়ি মেলা ভার। রেণুর শরীরের আকর্ষণ এতটাই যে, প্রথমবার দেখলে যে কোনো পুরুষই তার দিকে আকর্ষিত হয়ে পড়বে। তাকে ২০০৫-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি জেলে পাঠানো হয়। আর্মস অ্যাক্ট, লুঠপাট, অপহরণ, খুনের মতো বহু মামলা রেণুর নামে নথিভুক্ত হয়। সাত বছর জেলে থাকার পর আদালত তাকে সসম্মানে মুক্তি দেয়। ২০১২ সালের ২৯ মে রেণু লখনউ নারী নিকেতন ওপেন জেল থেকে মুক্তি পায়। মুক্তি পেয়ে রেণু খুশি হলেও, চম্বলের বাইরের জীবন তাকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। যে পুলিশরা রাতের পর রাত ফোন করে তাকে পুলিশ সুরক্ষা, বন্দুকের লাইসেন্স, সরকারের তরফে পুনর্বাসনের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তাকে ভোগ করেছিল বা করার চেষ্টা করেছিল সেই নেতা, পুলিশ, সরকারি কর্মচারী সকলেই আসল সময় মুখ ফিরিয়ে নেয়। জেল থেকে বাইরে আসার পর রেণু বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের হাত ধরে বাকি জীবন সসম্মানে কাটানোর কথা ভাবে। কিন্তু সব জায়গায় থেকেই আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পায়নি সে। বেশ কয়েকজন ফিল্ম প্রোডিউসারও রেণুর জীবন নিয়ে সিনেমা বানানোর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সেখানেও রেণুকে জীবন থেকে ছিটকে দেয়। বেশ কিছুদিন রেণু গো-রক্ষা কমিটির একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করে। সেখানেও নেতাদের তার শরীরের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি, তাকে সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য করে। লোকসভায় নির্বাচন লড়ার চেষ্টাও করে রেণু, কিন্তু সেখানেও কাগজপত্র পুরো হতে হতে সময় পেরিয়ে যায়। রে-ব্যান সানগ্লাস আর দামি লিপস্টিকের প্রতি রেণুর আকর্ষণ ভয়ঙ্কর। প্রায় ত্রিশ-চল্লিশটি ডাকাতি, অপহরণ আর পনেরোটির বেশি খুন করা রেণুকে ভাগ্যের পরিহাসে, নেতা থেকে মন্ত্রী হয়ে বহু পুলিশ আধিকারিকের শয্যাসঙ্গিনী হতে হয়েছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টায়। কিন্তু হাতে আসেনি কিছুই। আজ ফের চম্বলের বেহড়ে ফেরার কথা ভাবছে রেণু। আর যদি সেটা কোনোদিন সত্যি হয়ে যায়, তাহলে তার দায় কে নেবে? রেণু যদি আবার ফিরেও যায়, তাকে অন্তত দোষ দেওয়া যাবে না।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
চম্বলের ডাকাতের সঙ্গী বাঙালি সাংবাদিক, জিপ ছুটে চলেছে বেহড়ের দিকে