দুর্ধর্ষ দুশমন – ১৫
আগের পর্বে
বেহড় যে কখন কাকে টেনে নেয় কেউ জানে না। তিরতির বয়ে চলা চম্বল নদী শুধু দেখতে থাকে বদলে যাওয়া। রাতের জলসা শেষ হল বাবুলী গৌরীকে নিয়ে ঢুকে যায় তাঁবুতে। মনে করিয়ে দিয়ে যায় সেই রাতের কথা কোথাও যেন না লিখি। রবিজির সঙ্গে তারপর সেই একই পথে জিপে করে ফিরে আসা। ভোর পৌনে ছ’টায় হোটেলে ফিরতে দেখে ছুটে আসে হোটেলের সেই ছেলেটা। রাম সিং। ডাকাতরা তুলে নিয়ে গিয়ে আবার ছেড়ে দিয়ে গেছে এমন ঘটনা সে দেখেনি। তার চোখে মুখে অন্য এক সম্ভ্রম। গতরাতে ছড়ে যাওয়া জায়গায় ডেটল লাগিয়ে, মচকে যাওয়া পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে এরপর বেরিয়ে পড়া। গন্তব্য মোহর সিং-এর গ্রাম মেহেগাঁও।
যুগ যুগ ধরে নারীকে তার শিকড়চ্যুত হতে দেখা যায় নানা সময়ে নানান দেশে। ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে সেই শিকড়চ্যুত হওয়ার সংখ্যাটা আরো বেশি। জীবনের বিভিন্ন সময়ে কখনো বা কাজের তাগিদে কখনো আবার নিছক বাউন্ডুলে জীবনের টানে আমার বেশ কিছু সময় কেটেছে বিভিন্ন প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই বাংলার বাইরেও আমার সেই কাটানো জীবনে বারবার আমি নারীকে শিকড়চ্যুত হতে দেখেছি। নারীদের প্রতি অত্যাচারের সবচেয়ে করুণ চিত্রটি আমি দেখেছি চম্বলে। যে চম্বল আতঙ্কের পর্যায়, যে চম্বল মানেই আমরা ডাকাত বা বাগী বুঝি সেই অভিশপ্ত চম্বলে।
পৌরাণিক এক নারীর অভিশাপেই এই চম্বল অভিশপ্ত। সেখানেও নারীকে শিকড়চ্যুত করার গল্প। মহাভারতের সেই বিখ্যাত পাশাখেলা যেখানে এক নারীকেই পাশা খেলার বাজি হিসেবে তুলে দেওয়া হয়। বাজি ধরা হয় নারীর সম্ভ্রমকেই। আর সেই লাঞ্ছিত, অপমানিত নারী দ্রৌপদীর অভিশাপেই চম্বল হয়ে ওঠে অভিশপ্ত। বারবার চম্বলে দেখা গিয়েছে নারীর সম্মান ভুলুণ্ঠিত হতে। তবে বাগীদের হাতে তা হাতে গোনা। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে আশির দশক পর্যন্ত বাগীরা ছিলেন সকলেই নারী বর্জিত। বাগীদের দলে ছিল না নারীদের স্থান। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া।
মধ্য আশির দশক থেকে ছবিটা বদলাতে শুরু করে। চম্বলে নারীদের এমন এক অবস্থান যা যে কোনো সভ্য সমাজকেই লজ্জায় নত করে ফেলবে। আর এই অপমান থেকেই জন্ম হয় পুতলীবাঈ, ফুলনদেবী, নীলম গুপ্তা, রেনু যাদব, সরলা জাটভ প্রমুখদের। শৈশবেই বিয়ে হয়ে যাওয়া ফুলনকে বাপের বাড়ি ফিরে আসতে হয় স্বামীর অত্যাচারে। সেখান থেকে গ্রামের মোড়লের ছেলের হাতে তাকে হতে হয় লাঞ্ছিত। এমনকি আইনের কাছে ন্যায় চাইতে গেলে আইনের রক্ষকদের হাতেই তাকে ধর্ষিত হতে হয়। হতে হয় শিকড়চ্যুত। গ্রামের বাড়ির শিকড় ছিঁড়ে ফুলনকে আশ্রয় নিতে হয় বেহড়ের ভয়ঙ্কর এবং অনিশ্চিত জীবনে। এটা তো গেল একটা দিক। কয়েনের উল্টো পিঠও আছে। রেনু যাদব, নীলম গুপ্তা সরলা জাটবদের স্কুল যাওয়ার পথে হতে হয় অপহরণ। কারণ? কারণ গ্রামের শত্রুতা। রেনু যাদবের প্রতিবেশীর সঙ্গে তার বাবার বনিবনা না হওয়ায় সেই প্রতিবেশী ডাকাত দলের মাধ্যমে তাকে অপহরণ করায়। ক্লাস ফাইভে পড়া কিশোরী রেনুর জায়গা হয় ভয়ঙ্কর বেহড়ে। দিনের পর দিন অত্যাচারিত হতে হতে হাতে তুলে নিতে হয় বন্দুক নেহাতই অনিচ্ছায়। চম্বলের প্রতিটি ঘরের ঘরেই গল্পটা এক। যারা প্রতিবাদ না করে মুখ বুজে থেকেছে তাদের গল্পটা এক। আর যারা মুখ খুলেছে প্রতিবাদে তাদেরই হতে হয়েছে শিকড়চ্যুত। বেছে নিতে হয়েছে অনিশ্চিত জীবন। তারপর সমাজের চোখে, আইনের চোখে তাদের হতে হয়েছে অপরাধী। অথচ তারা অত্যাচারিত হয়েছিল। না সমাজ, না আইন কেউই তাদের ন্যায় দেয়নি, আর যখন তারা নিজেরাই নিজেদের ন্যায় ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয়েছে, তারা হয়েছে সমাজচ্যুত, শিকড় চ্যুত। তাদের গায়ে লেগেছে বাগী, ডকৈত শব্দের লেভেল।
বেহড় বা স্থানীয় ভাষায় যার নাম বীহড়, আর এই বিহড়ের নাম শুনেই আতঙ্কে মাথার চুল খাড়া হয়ে যায় তামাম ভারতবাসীর। আর এই বেহড় অবস্থিত এক অভিশপ্ত নদী চম্বলের অববাহিকায়। এই নদীর বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে আছে অবিচার, অন্যায় আর অত্যাচারের করুণ কাহিনি, আর সেখান থেকেই এই চম্বল নদী সাক্ষী হয়ে গিয়েছে প্রতিবাদেরও, যে করুণ কাহিনি শেষপর্যন্ত জন্ম দিয়েছে এক ভয়ঙ্করের যাদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় বাগী, আমরা চিনি ডাকাত। আর তারা নিজেরা নিজেদের বলে প্রতিবাদী যার ইংরেজি নাম রেবেল। চম্বল এমন এক অঞ্চল যার নিজস্ব কোনো অর্থনীতি নেই। এমন একটা জায়গা যেখানে প্রতি মুহূর্তে নদীর ভাঙনে হয় ভূমিক্ষয়। আর এই ভূমিক্ষয়ের হলেই ছোটো ছোটো মালভূমি অঞ্চলের মত তৈরি হয়ে যায় মাটির ঢিপি, যাকেই স্থানীয় ভাষায় বেহড় নামে ডাকা হয়ে থাকে। প্রতি মুহূর্তে যেখানে মাটি পরিবর্তিত হয়ে চলে। বেহড়, জল, জাতপাত, আর অনুন্নয়ন চম্বলকে আঁকড়ে রয়েছে। ২০১৭ সালে আমি যখন চম্বলে যাই সেই সময় বাইরে থেকে চম্বলকে বেশ সুন্দর এবং উন্নত এলাকা মনে হলেও যত এর ভেতরে ঢুকেছি, দেখতে পেয়েছি সামাজিক বিভেদ ও অর্থনৈতিক দুর্দশা।
উত্তরপ্রদেশের বেশ কিছু জায়গায় গ্রামগুলিতে প্রধানমন্ত্রী গৃহযোজনার অন্তর্গত কিছু পাকা-বাড়ি এবং সিমেন্টের রাস্তাঘাট হলেও মধ্যপ্রদেশের অবস্থা তথৈবচ। শহরাঞ্চলে রাস্তাঘাট থাকলেও গ্রামাঞ্চলে সে অর্থে নেই রাস্তাঘাট। ভিন্ড শহর থেকে মালখান সিংয়ের খোঁজে আমি যখন উমরি থানার বিলাও গ্রামের দিকে চলেছি, বাস থেকে নামতে হয়েছিল বিলাও গ্রামের হাইওয়ের ধারে। যেখান থেকে কাঁচা-মাটি আর কাঁটাঝোপে ভর্তি ২০ কিমি রাস্তা আমাকে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে। হাইওয়ে থেকে গ্রামের ভেতর ঢুকতে যানবাহন বলতে হয় সাইকেল, নয়তো মোটরবাইক, আর না হলে ট্র্যাক্টর। মনে পড়ছে মার্চের দুপুরে রোদে ঘামতে ঘামতে যখন আমি রাস্তা হাঁটছি, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, মাথায় জঙ্গলের কাঠকুটো জড়ো করে নিয়ে যাওয়া এক মহিলার কাছে আমি যখন জল চাই তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন খেতের পাম্প হাউসের পেছন দিকে। সেখানে একটা চৌবাচ্চা দেখিয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন, এখান থেকে জল খেয়ে নাও। সেই চৌবাচ্চার কালো হয়ে যাওয়া জলে কিলবিল করছে পোকা, পাঁকের মতো পচা গন্ধ বেরোচ্ছে। প্রশ্ন করেছিলাম, এটা খাওয়ার জল? দেহাতি সেই মহিলা আমাকে জবাব দিয়েছিলেন, ‘হাম তো এ হি পিতে হ্যায়, গাঁওকে নলকে মে জানা হামারে লিয়ে মানা হ্যায়, হাম নীচ জাতকে হ্যায় না!’ সেই জল না খেয়ে রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে সেই মহিলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, খাবার জল, রান্নার জল কোথা থেকে পান আপনারা? আমার এই প্রশ্নে প্রথমে খানিকটা অবাক হলেও ওই মহিলা বলেছিলেন ভোর থাকতে উঠে প্রায় ৩০-৪০ কিমি হেঁটে কারো বাড়ির কুয়োর সামনে গিয়ে দাঁড়ান তাঁরা। তাদের যদি দয়া হয় তাহলে তাদের কপালে জোটে জল। তাও নিজের হাতে কুয়ো থেকে জল তোলা যাবে না। কেউ দয়া করে জল তুলে কলসী ভরে দিলে তবেই মেলে জল, নইলে কোনো নালা থেকে জল তুলেই কাজ সারেন তারা। অথবা যেদিন সময় পান দূরের নদী থেকে জল আনতে যান। যে জল দেখে, যার গন্ধে আমার গা গুলিয়ে উঠেছিল সেই জল এখানকার মানুষ দিনের পর দিন খান। সবাই অবশ্য নয়, নীচু জাতের লোকেরা। এমনই সামাজিক বিভেদ।
আমি যখন মালখানের বাড়ি পৌঁছেছিলাম, ততক্ষণে আমার সারা হাত-পা রক্তাক্ত, তৃষ্ণায় প্রাণ ফেটে গিয়েছিল। ধুলোয়-কাদায় আমার শহুরে সভ্যতা গিয়েছিল ঢেকে। আরো মজার ঘটনা হল, যখন আমি মালখানের পৈতৃক ভিটেতে পৌঁছোই, মালখানের বাড়ি ছিল তালাবন্ধ। সেখানে খুব কম সময়ের জন্যই আসেন মালখান। সেই গ্রামের অন্যান্য বাড়ির তুলনায় রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ির পেছনেই রয়েছে একটা ঝুপড়ি। উঠোনে বসে থাকা এক মহিলার কাছে আমি জল চেয়েছিলাম, তার অবাক হওয়া মুখ আমি কোনোদিনই ভুলতে পারব না। যেন আমি কত অন্যায় কথা বলে ফেলেছি। দু-বার জল চাওয়ার পর বিস্মিত সেই মহিলা আমাকে বলেছিলেন, ‘হামারা পানি পিয়োগে তুম?’ প্রশ্ন করেছিলাম, কেন খাব না? সেই মহিলা করুণ মুখে জবাব দিয়েছিলেন, আমরা নীচ জাত। তাকে বলেছিলাম, আপনি নিয়ে আসুন, আমি খাব। নালার জল আমি খেতে পারিনি গন্ধের কারণে। সেই মহিলা তখন তার ছেলের বউকে চিৎকার করে বলেছিলেন জল নিয়ে আসতে। বলেছিলেন নতুন পেতলের ঘটি বের করতে। আমাকে দুটো বাতাসা দিয়ে বলেছিলেন, ‘গরীবনকা পানি পি লৌ বাবুয়া, আজ তুমনে হামার ইজ্জত বাড়া দি। আজ খানা খাকে যাও, বাজরে কি রোটি অউর, শুখি সাগ’। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে নীচু জতের মহিলাদের উপর অত্যাচার হবে স্বাবাভিক। যে কোনো ছোটো খাটো ঝামেলা হলেই শত্রু বাড়িতে চড়াও হয়ে মহিলাদের ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। যার কোনো নিষ্পত্তি হয় না। এমনকী আইনও হয় না সহায়। ফলে বারবার নারী সেখানে অত্যাচারিত হয়, তাদের মূল উপরে ফেলা হয়, শিকড় হারিয়ে যায় তারা, হয় মৃত্যু নয় বাগী হয়ে যাওয়া তাদের একমাত্র ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এখন ছবিটা কিছুটা হলেও বদলেছে।
আরও পড়ুন
‘খুদকে কিস্মত পর ক্যা রোনা, যাহা লে যায়েঙ্গী জায়েঙ্গে’, পিঠে চাপড় মেরে বলল গৌরী
Powered by Froala Editor