দুর্ধর্ষ দুশমন – ১৪
আগের পর্বে
ডায়নামোর সাহায্যে জ্বলছে একটা বাল্ব। তাঁবুর বাইরেই সবাই গোল হবে বসে। ছড়িয়ে রয়েছে জলের ড্রাম, উনুন, আগ্নেয়াস্ত্র— ডাকতদের পুরো সংসার। ‘মেহেমান’-এর জন্য গৌরী নিয়ে আসে মাংসের টুকরো আর রাম। কথায় কথায় জানা যায় গৌরী ইচ্ছে করে বেছে নেয়নি বেহড়ের পথ। বাধ্য হয়েছিল। অপহরণ করে ধর্ষণ করা হয় তাঁকে। ভাড়া করা ডাকাত নির্ভয়কে দিয়েই গ্রামের প্রধান করিয়েছিল সেই কাজ। নির্ভয় মারা গিয়েছিল পুলিশের এনকাইউন্টারে। তার আগেই গৌরী পালিয়ে গিয়েছিল তার ডেরা থেকে। তবে গ্রামে তার টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। কথায় কথায় অপমান অপদস্থ করা হয় তাকে। আবার এক পালিয়ে যাওয়া তার। এবার বেহড়ে বাবুলীর দলে যোগ দেয় গৌরী।
এই বেহড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে হাতে মদের গ্লাস নিয়ে দেখতে পাচ্ছি দূরে আবছা তিরতির করে বইছে চম্বল নদী। কোনো হেলদোল নেই। কোনো উথাল পাথাল নেই। যেন কোনো প্রভাবই পড়ে না তার এই মানুষগুলোর জীবনকাহিনি নিয়ে। তার কাজ যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা আর এই সমস্ত করুণ কাহিনির নীরব সাক্ষী থাকা। এক সময়ের সালোয়ার কামিজ পরা, দু-চোখে স্বপ্ন দেখা লজ্জাবতী অষ্টাদশী গৌরীর কাহিনিরও নীরব সাক্ষী সে। যে গৌরী তার বাবা-মায়ের দুলারী ছিল, আজ তার হাতে বন্দুক, মুখে খিস্তির ফোয়ারা। এক সময় রক্ত দেখলে যে কিশোরীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেত, আজ সে দু-হাত ভরে রক্ত নিয়ে হোলি খেলে। এটাই বোধহয় চম্বল আর চম্বলের মানুষের ভবিতব্য। কাকে কখন বেহড় টেনে নেবে কেউ জানে না। মহাভারতের এক নারীর অভিশাপ তাই আজো বুকে করে বয়ে নিয়ে চলেছে চম্বল। আরো কত পুতলী, ফুলন, সীমা, কুসুমা হয়ে গৌরী তার বলি হবে কে জানে! অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম।
হঠাৎ গৌরী আমার পিঠে চাপড় মেরে বলে, “ছোড়ো ইয়ার, খুদকে কিস্মত পর ক্যা রোনা, যাহা লে জায়েঙ্গী জায়েঙ্গে, ফির একদিন সব খতম। পর আজ তো মজা মত খারাপ করো ইয়ার। তুম মুঝে পসন্দ আগয়ে, বাবুলী বিজি হ্যায়, তো তুমহারে সাথ হি মৌজ করতে হ্যায়।” রক্ষে করো মা, প্রেমে পড়তে কে না চায়, কিন্তু তা বলে এমন আগুনের প্রেমে। বেঁচে থাক আমার বাঙালি বউ। মাঝেমাঝে বউয়ের মেজাজের জন্য তাকে ফুলন দেবী বললেও এই দস্যুরানীর চেয়ে ঢের ভালো সে। ঝগড়া হলে বন্দুক তো চালাবে না। দুজনে মিলে আবার ফিরে আসি আগুনের কাছে। টেপরেকর্ডারে বাজছে বেবি ডল, ম্যায় সোনে দি। বাবুলী উঠে এসে গৌরীকে নিয়ে নাচতে শুরু করে। সকলেই মাতাল। অন্যদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এদিকে আমার ফেরার চিন্তা। সবাই মদের নেশায় মাতাল হয়ে গেলে হোটেলে ফিরব কী করে? রবিজি চিন্তা করতে বারণ করেন।
নাচ থামলে বাবুলী বলে, “পত্রকারভাই আপকো রবি হোটেল ছোড়কে আয়েঙ্গে, উনকে সাথ চলা যাও, আজ ম্যায় থোড়া আপনি জান সে মোহব্বত করলুঁ, ক্যা পাতা কব পুলিশ কি গোলি ছলনি কর দে। পর এক বাত, যো দেখা যো শুনা, কভি লিখনা নেহি আগর লিখে তো...” বলেই গৌরীকে জড়িয়ে তাবুর ভেতর চলে যায়। পাগল নাকি! সিংহের গুহা থেকে বেঁচে ফিরছি এই অনেক। কে আর নিজের বিপদ ডেকে আনে? অন্যান্য ডাকাতরা তাঁবুর বাইরে খোলা আকাশের নিচে মদের নেশায় বেহুঁশ, মাটিতেই শুয়ে আছে। রবিজীর সঙ্গে আবারো সেই আগের পথ ধরে ফিরি। আবারো নদীর ধার ধরে এগিয়ে, জিপে গিয়ে উঠি। জিপ ছুটে চলে চম্বল নদী, বাবুলীর ডেরা, বেহড় সমস্ত পেছনে ফেলে। রবিজি যখন আমাকে হোটেলের সামনে নামালেন তখন পৌনে ছ-টা বাজে। আমাকে নামিয়ে দিয়ে জিপ নিয়ে চলে গেলেন রবিজি। যাওয়ার আগে আরো একবার মনে করিয়ে দিলেন, আমি যেন বাবুলী আর গৌরীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা পেপারে না লিখি। ওরা ভীষণ খতরনাক।
ভিণ্ডের রাজপথ তখন জাগতে শুরু করেছে। দোকানে দোকানে আগুন জ্বলেছে। কোথাও চা, পকোড়া, ভাজা হচ্ছে। কোথাও ভাজা হচ্ছে জিলিপি। আমাদের হোটেলের নীচের দোকানেও জিলিপি ভাজা হচ্ছে। চা ফুটছে। আমাকে ঢুকতে দেখে দৌড়ে এল হোটেলের ছেলেটা। অবাক চোখে আমাকে প্রশ্ন, “সাহাব, সব ঠিক হ্যায় না?” সব ঠিক বলে তার পিঠ চাপড়ে দিই। তাকে বলি আমাকে আর সাতটায় নয় এবার যেন ন-টায় ডেকে দেয়। জানি ঘুম আসবে না তবুও। ক্লান্তি রয়েছে। বাথরুমে ঢুকে সোজা শাওয়ার চালিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। জায়গায় জায়গা কেটে-ছড়ে গেছে। রক্ত জমাট বেঁধেছে। হোঁচট খেয়ে গোড়ালিতেও ব্যথা। গিজারের জলে আমার শরীরের ক্লান্তি, ক্লেদ সব ধুয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে কাহিনি, যে যন্ত্রণার ক্লেদ এতক্ষণ আমি শুনে এলাম ওই বেহড়ের ভেতর, তা কি কখনো ধুয়ে যাবে? স্নান সেরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে, ঘুম আসছে, তবু মনের ভেতর চলছে এতক্ষণ বেহড়ের সমস্ত দৃশ্য। মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে থাকি সেসব। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।
আরও পড়ুন
‘নিচু জাতের’ হওয়ায় হেনস্থা, অপহরণ, ধর্ষণ; ক্রমশ ডাকাতদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে গৌরী
সাড়ে ন-টা নাগাদ ঘুম ভাঙল দরজা ধাক্কানোর শব্দে। এর আগেও কয়েকবার দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনেছি। কিন্তু খুলিনি। মনে হয়েছে স্বপ্ন দেখছি কাল রাতের। এবার একটু জোরে হওয়াতে ঘুমটা ভাঙল। দরজা খুলে দেখি হোটেলের ছেলেটা। ডাকতে বলেছিলাম বলে ডাকতে এসেছে। দরজা খুলতে সে জানাল আগেও দুবার ডেকে গেছে, সাড়া পায়নি। তার প্রশ্ন, “আপ ঠিক হ্যায় না, স্যার?” তাকে হাসি মুখে আশ্বস্ত করি। আজ ছেলেটার রকম সকম বদলে গেছে, কাল আমার প্রতি হোটেলের অন্যান্য গেস্টদের মতো কমন সম্ভ্রম ছিল, আজ চোখে মুখে অন্যরকম সম্ভ্রম দেখতে পাচ্ছি। ভাবছে আমি বোধহয় কেউকাটা গোছের কেউ। যাকে ডাকাত তুলে নিয়ে যায়, আবার যত্ন করে হোটেলে ছেড়েও দিয়ে যায়। ছেলেটাকে চা আনতে বলে বাথরুমে ঢুকি। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ভাবছি একরামদাকে কি একবার জানাব কালকের ঘটনা? আবার ভয়ও হচ্ছে। রবিজি, বাবুলী সকলেই তো মানা করেছে এসব কথা না লিখতে। ফোনটা হাতে নিয়ে দ্বিধায় বসে আছি। চা আসে, সঙ্গে দুটো শিঙাড়া। হোটেলের ছেলেটার নাম, রাম সিং। রাম চা শিঙারা খাটের উপর নামিয়ে বলে, “সাহাব কাল রাত সে আপ খায়া নেহি কুছ, ইসলিয়ে সামোসা লে আয়া”।
হাত-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, কাটা-ছড়া জায়গায় কিছু লাগাতে হবে নইলে ভোগাবে। রামের হাতে টাকা দিয়ে বলি একটা ডেটল আর ক্যালপল কিনে আনতে। চা খেয়ে আজকের রুটিন ঠিক করে নিই। এখান থেকে বেরিয়ে প্রথমে বাসস্ট্যান্ড, জগরূপজীর সঙ্গে দেখা করে মেহেগাঁওয়ের বাসে চাপতে হবে। সেখানে গিয়ে খোঁজ করতে হবে মোহর সিং-এর। তারপর সময় থাকলে যাব বিলাও। মালখান সিং-এর গ্রাম। রেডি হয়ে নিই। সঙ্গে থাকা একটা ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে নিয়েছি ডান পায়ের গোড়ালিতে। কাল গর্তে পড়ে মচকেছে পা। খুব বেশি না ফুললেও টনটন করছে। আজো কতটা হাঁটতে হবে জানি না। এর মধ্যেই রাম ডেটল নিয়ে আসে। বাকি পয়সা ফেরত দিতে গেলে সেটা ওকেই রেখে দিতে বলি। খুশি হয়ে চলে যায়। এবার কেটে যাওয়া জায়গাগুলোয় ডেটল লাগিয়ে, ক্যালপল খেয়ে তৈরি হয়ে নিই। রিসেপশনে চাবি দেওয়ার পর কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে না। হয়তো রাম ছাড়া আর কেউ জানেও না কাল রাতে এই হোটেলে কী ঘটে গেছে।
আরও পড়ুন
চম্বলের ডাকাতের সঙ্গী বাঙালি সাংবাদিক, জিপ ছুটে চলেছে বেহড়ের দিকে
Powered by Froala Editor