দুর্ধর্ষ দুশমন - ১৩
আগের পর্বে
২০০৩ সালে অপহৃত হয়েছিল গৌরী নিজেই। তারপর নির্ভয় তাকে রক্ষিতা করে রেখেছিল তার। সুযোগ বুঝে পরে পালিয়ে গেলেও তাকে গ্রহণ করেনি তার গ্রাম। বাবুলীর সঙ্গেই বেহড়ের পথ বেছে নিয়েছিল গৌরী। সে রাতে বাবুলী এবং গৌরীর ছবি তুলতে চাওয়াই যেন অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অজান্তেই। পুলিশের কাছেও যে তাঁর কোনো ছবি নেই, সে কথা পিস্তল বার করে গম্ভীর কণ্ঠে জানিয়েছিল বাবুলী। তারপর বাঙালি মেহমানকে জিপে করে নিয়ে গিয়েছিল বেহড়। এক আতঙ্কই যেন তাড়া করছিল সেই নিশকালো রাতের অন্ধকারে। শেষ অবধি বেহড় আর জঙ্গলের মাঝে এক তাঁবুতে এসে থেমেছিল সেই অভিযান। গৌরী, বাবুলী, রবিজি ছাড়াও সেখানে আরও বেশ কিছু ডাকাত।
আগুন জ্বালা হয়। ডায়নামো জ্বালিয়ে তাবুর এক কোণে বালবও জ্বলছে। তার উপর জ্যোৎস্না রাত হওয়ায় আলোর কমতি নেই। হাওয়া বইছে শনশন করে। নদী কাছে হওয়াতে হাওয়ায় একটা ভেজা ভাব। শীত করছে। ভালো করে দেখলাম, এই অংশে ডাকাতদের পুরো সংসার সাজানো। এদিক ওদিক বাসন ছড়িয়ে, জলের ড্রামও আছে। ইঁটের উপর ইঁট সাজিয়ে উনুনও আছে একটা। বাবুলী হাঁক দেয় গৌরীকে, ‘আরে এ মোরি, মেহমান আয়া হ্যায়, কুছ খাতিরদারি তো করো, চায় উয় পিলাই দো সাহাবকো। আউর খানা হ্যায় দেও উনকো’। তাবুর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে গৌরী। জবাব দেয়, ‘ইতনি রাতকো অউর চায় না পিলা, কুছ অউর দেতি হুঁ, পেহেলিবার পত্রকারবাবু আয়ে হ্যায় গরিব কি দুয়ার, কুছ অ্যায়সা মেহমান নওয়াজি করে কি তবিয়ৎ খুশ হো জায়ি, নাম করেঙ্গে কলকাত্তা যা কে’। ফের তাবুর ভেতর ঢুকে যায় গৌরী। ফিরে আসে খানিক বাদেই। সকলেই আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসেছি।
গৌরী একটা রামের বোতল নিয়ে আসে। সঙ্গে গোটা কয়েক ফয়েল প্যাকেট। তারপর আরেকজনকে হুকুম দেয় গেলাস আনতে। এতক্ষণ খেয়াল করিনি, এবার নজরে আসতে আমার চোখ ছানাবড়া। একটা তাঁবুর ভেতর দেখতে পাচ্ছি সারি সারি লাইন দিয়ে রাখা বন্দুক। এবং সমস্তটাই আধুনিক। কোনোটা একে-৪৭, কোনোটা ডবল-ব্যারেল রাইফেল, কোনোটায় টেলিস্কোপ লাগানো। যত দেখছি ভেতর ভেতর শুকিয়ে যাচ্ছি। গৌরী এসে আমার একদম গাঁ ঘেষে একটা কাঠের বাক্স নিয়ে বসে পড়ে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে ও আমাকে ভয় পেতে দেখে আমাকে নিয়ে আরো মজা করতে চাইছে। ও জানে যে ও আমার ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে আমি সিঁটিয়ে যাব ভয়ে, আর ও আরো উত্যক্ত করবে। আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছে। আমি আরো কাঁটা হয়ে যাচ্ছি। বুঝতে পারছি না বাবুলী ওর এই আচরণ কীভাবে নিচ্ছে। আমি যত সরে যাই গৌরী তত সরে আসে। শেষে বিরক্ত হয়ে বলেই বসে, ‘কাহে ইতনা ডরে রহে বেহেনচোদ, ম্যায় কোই জঙ্গল কা ভুতনী না হুঁ, কি তোরে খায়ে যাই’। তারপর আমাকে বলে, আমাকে নিয়ে যাবে কলকাতা? শহর ঘোরাতে? আমি হ্যাঁ-না-এর মাঝামাঝি হাসি।
মদ ঢালা হয়ে গিয়েছে। আমি ওকে এন্টারটেন করব না বুঝতে পেরেই বোধহয় এবার ঠিক হয় গৌরী। বাবুলী বলে, ‘কমফোর্টেবল হো যাও বাঙ্গালিবাবু, গৌরী কি আদত হ্যায় খিচাই করনে কি, পর দিলকি বুরি না হ্যায়’। ততক্ষণে এক ডাকাত টেপরেকর্ডারে গান চালিয়েছে। সকলের হাতেই মদের গ্লাস। গতকাল রাতেও আমি মহাবীরের বাড়িতে বেহড়ের মায়ায় আকৃষ্ট হয়ে মদ নিয়ে বেহড়ের মাথায় চড়তে চেয়েছিলাম। জ্যোৎস্না রাতে বেহড়ে বসে মদ খেতে চেয়েছিলাম। আর ঠিক তার একদিন পরেই আজ আমি বসে আছি একটা আস্ত বেহড়ের মধ্যে। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। একদিকে হালকা ঠান্ডা, অন্যদিকে আগুন ও রামের গরম। চুমুক দিতে থাকি। সকলেই ফয়েল প্যাক থেকে মাংস তুলে খেতে থাকে। আমি শুধু খাচ্ছি দেখে ফয়েলপ্যাক থেকে এক টুকরো মাংস আমার হাতে তুলে দেয় গৌরী। দিয়ে নিজের গ্লাস নিয়ে গুনগুন করতে থাকে গানের সঙ্গে। কেন জানি না এই জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাওয়া চরাচর, এই বেহড় আমি ঠিক সেভাবে উপভোগ করতে পারছি না, যেভাবে গতকাল করতে চেয়েছিলাম। ওদিকে রবিজি আর বাবুলী নিজেদের মধ্যে কোনও একটা বিষয়ে আলোচনা করতে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন
চম্বলের ডাকাতের সঙ্গী বাঙালি সাংবাদিক, জিপ ছুটে চলেছে বেহড়ের দিকে
সেদিক মন না দিয়ে আমি গৌরীকে প্রশ্ন করি, এই যে তোমরা বেহড়ে থাকো এখন তো বেহড়ে অজগরের খুব উৎপাত, ভয় লাগে না? অদ্ভুত উত্তর দেয় গৌরী, বলে, ‘সাহাব জঙ্গলী আদমখোর উতনী জালিম নেহি হোতি হ্যায় জিতনী জঙ্গলকে বাহার লোগ হতে হ্যায়’। আমি প্রশ্ন করি, কেন এমন বলছ? গৌরী উত্তর দেয়, ছাড়ো, কী লাভ। গল্পের গন্ধ পাই। জিজ্ঞাসা করি, কেন এলে বেহড়ে? খানিকটা চুপ করে থেকে গৌরী জানায় সে নিজের ইচ্ছেয় আসেনি বেহড়ে। গৌরী চিত্রকূটের গোস্বামী তুলসীদাস গর্ভনমেন্ট কলেজে বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিল। নিচু জাতের কৃষকের মেয়ে সে। বললাম, তুমি তো যাদব, নিচু জাত কী করে? এবার হাসে। ‘যাদব নেহি বাবু, জাটভ, শুনমে লাগতা হ্যায় যাদব হ্যায়। হাম নিচু জাতকে কিষান হ্যায়’। বলি, তুমি যদি গরীবই হবে, তাহলে নির্ভয় তোমাকে অপহরণ করল কেন, পয়সা তো পাবে না বেশি। গৌরী জানায়, এখানে শুধু অপহরণ পয়সার জন্য হয় না। শত্রুতা থাকলেও কোনো ডাকাতকে দিয়ে যে কেউ অপহরণ করাতে পারে। গ্রামের পঞ্চায়েত-প্রধানের ছেলে তাকে উত্যক্ত করত, শুতে চাইত, কিন্তু দিনের পর দিন সে মানা করে এসেছে। একদিন কলেজে অসভ্যতা করায় চড় মেরেছিল তাকে গৌরী। সেই সময় গ্রামে সালিশিসভা বসে। কিন্তু যেহেতু দোষ পঞ্চায়েত-প্রধানের ছেলের, আর তার দোষ প্রমাণিত হয়েছিল ফলে সেদিন রায় গিয়েছেল প্রধানের ছেলের বিরুদ্ধেই।
আরও পড়ুন
‘কা পত্রকারবাবু, ডকৈত দেখনে কা বড়ি শক হ্যায়?’ ঘরে ঢুকে পড়ল জনা দশেক লোক
কিন্তু সে অপমান ভুলতে পারেনি প্রধান। নির্ভয়কে পয়সা দিয়ে অপহরণ করায় তাকে। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে তাকে তুলে নিয়ে যায় নির্ভয়। দিনের পর দিন জোর করে ধর্ষণ করে তাকে। সেই সময় নির্ভয়ের দলে আরো দুজন মেয়ে ছিল। একজন নীলম গুপ্তা, আরেকজন সরলা জাটভ। নির্ভয় একটা বাচ্চা ছেলেকে অপহরণ করেছিল। তার নাম শ্যাম জাটভ। শ্যামকে নির্ভয় পরিচয় দিত নিজের ছেলে বলে। নির্ভয় বিখ্যাত দস্যু-সুন্দরী কুসুমা নাইনকে বিয়ে করেছিল। তারপর আরেক বিখ্যাত দস্যুরানী সীমা পরিহারকেও বিয়ে করে। এরপর ১৯৯৪ সালে বাসন্তী নামের একজনকে বিয়ে করে নির্ভয়। কিন্তু সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায় বাসন্তী। নির্ভয় তাকে খুঁজতে শুরু করে, অবশেষে ১৯৯৯ সালে বাসন্তীকে খুঁজে তাকে আর তার ভাইকে খুন করে সে। তারপরই বাসন্তীর ভাইয়ের এগারো বছরের মেয়ে সরলাকে তুলে নিয়ে যায় নির্ভয়। দু-বছর পর শ্যামের সঙ্গে সরলার বিয়ে দেয় নির্ভয়। কিন্তু তাকে ভোগ করত সে নিজে। এরপর থেকেই সরলা চম্বলে দস্যু-সুন্দরী হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা; অভিশপ্ত চম্বল আবার কী বিপদ নিয়ে এল?
আরও পড়ুন
‘খুনি দরওয়াজা’, ঝরতে থাকা রক্ত এবং মধ্যযুগের চম্বল
আরো একটা মেয়েকে উত্তরপ্রদেশের ইটাবা জেলার আউরিয়া থেকে অপহরণ করে নির্ভয়। তার নাম নীলম গুপ্তা। তাকে নিজেই বিয়ে করেছিল সে। এরপর ২০০৩-এ গৌরীকে অপহরণ করে নির্ভয়। নির্ভয় নারীলোভী। নিজের পাতানো ছেলের বউকেও ছাড়েনি। এর মধ্যেই নীলম এবং শ্যাম নির্ভয়ের বিরুদ্ধে গোপনে ষড়যন্ত্র শুরু করে। শ্যাম আর নীলমের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। নীলম আর সরলা তখন চম্বলের হটকেক। ফর্সা টকটকে রঙে সরলা যেমন সুন্দরী তেমনি বুদ্ধিমতী, অন্যদিকে নীলম শ্যামলা হলেও সরলার চেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিল না। কিন্তু সরলা হয়ে উঠেছিল দলের নাম্বার দুই। নির্ভয় তার উপরেই বেশি ভরসা করত। ফলে যখন নির্ভয় থাকত না তখন গ্যাং চালাত সরলা। যা শ্যাম বা নীলম কেউই মেনে নিতে পারেনি। গোপনে নীলম নিজের সৎ ছেলের সঙ্গে প্রেমের খেলা চালাতে থাকে, তাকে উসকাতে শুরু করে। নির্ভয়ের বিয়ে করা বউদের মধ্যে যেমন সীমা পরিহার, কুসুমা নাইন, বাসন্তী ছিল, তেমনি ছিল মুন্নি পাণ্ডে, পার্বতী ওরফে চমকোও। নির্ভয়ের যে কত বউ তার কোনো হিসেব নেই।
আরও পড়ুন
‘বীহড়ো মে শাপ হ্যায়, পতা নেহি ফির কিসকো কব খিঁচ লে’
এক সময় চম্বল এলাকার দুশোটি গ্রাম নির্ভয়ের নামে কাঁপত। দুশো-র বেশি খুন অপহরণ করেছিল সে। তার মাথার দাম সেই সময় ছিল আড়াই লক্ষ টাকা। এরপরই ২০০৫-এ একদিন শ্যামের সাহায্যে নিয়ে নীলম বেহড় থেকে বেরিয়ে পুলিশকে নির্ভয়ের খবর দিয়ে দেয়। আর পুলিশ এনকাউন্টারে মারা যায় নির্ভয়। শ্যাম আর নীলম পুলিশের সামনে সারেন্ডার করে। বারো বছরের জেল হয় নীলমের। সরলাও পুলিশের সামনে সারেন্ডার করে। তার আগে ২০০৫-এ নির্ভয়ের মৃত্যুর আগেই গৌরী পালিয়ে যায়। কিন্তু বাড়ি ফেরার রাস্তা তার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বেহড় থেকে গ্রামে ফিরে, দিনের পর দিন তাকে থানায় অত্যাচারিত হতে হয়েছে। বন্দুক চালাতে শিখলেও সে কখনোই কোনো ডাকাতি বা খুন করেনি ততদিন। তার কাজ ছিল রান্না করা, অন্যান্য ডাকাতদের খেয়াল রাখা। তা সত্ত্বেও বেহড়ে থাকার কারণে তাকে বদনাম হতে হয়। প্রশ্ন করি, কেন পুলিশ তোমার কথা বিশ্বাস করল না? গৌরী জবাব দেয়, ‘কিঁউ করেগী মেরে বাত পর ভরোসা? চম্বলকে সারে ডাকু পুরা গ্যাংকো লপেটেমে লে লেতি হ্যায়। যাহা ভি ডাকা ডালনে যাতে থে, ওহাঁ ডাকা ডালনে কে বাদ এক পর্চিমে, গ্যাঙকে সবই কা নাম উস পর দর্জ করকে ওহাঁ ছোড় আতে হ্যায়’।
আরও পড়ুন
চম্বলের ডাকাতদের খপ্পরে পড়েছিলেন হিউয়েন সাং; খুন হন আকবরের জীবনীকার আবুল ফজলও
কিছু না করলেও জড়িয়ে গিয়েছিল গৌরী। গ্রামে ফেরার পর পুলিশের অত্যাচার তো ছিলই, সেই সঙ্গে ছিল পঞ্চায়েত প্রধানের ঝামেলা। কথায় কথায় তাকে অপমান করা হয়েছে, বেশ্যা বলে, নির্ভয়ের রক্ষিতা বলে। বারবার বসেছে সালিশিসভা। অপদস্থ করা হয়েছে তাকে। শেষে একদিন না সইতে পেরে বাবুলীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সে। তারপর পালিয়ে আসে বেহড়ে। তখন থেকেই সে বেহড়ে রয়েছে। এবার সে সক্রিয়ভাবে বাবুলীর সঙ্গে কাজ করতে শুরু করে। আরো ভালো করে বন্দুক চালানো শেখে। খুন করে, ডাকাতিও করে। প্রশ্ন করি, প্রথমবার খুন করতে হাঁত কাপেনি? হাসে গৌরী, তারপর জবাব দেয়, ‘নেহি, থোড়া হিচকিচাহত জরুর থা, পর দুনিয়ানে মেরে আন্দর ইতনি নফরত প্যায়দা কর দিথি, কি বহিনচোদ উস সময় হর কিসি কো গোলিও সে ছলনি করনে কা মন কারতা থা। কা কসুর থা হামারা? ম্যায় পড়না চাহতিথি, আচ্ছি রেজাল্ট করতিথি। চাহতিথি পড় লিখকর নৌকরি লেকে মেরে মা বাপকা তকলিফ দূর করনা। পর শালি তকদীর মুঝে হিয়া খিঁচ লাই’। এটাই চম্বলের স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ ভাবে এক, ভাগ্য তাকে নিয়ে যায় আরেক দিকে।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মানসিং-এর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে হাজির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাড়িয়ে দিলেন স্ত্রী রুক্মিণীদেবী