দুর্ধর্ষ দুশমন – ১২
আগের পর্বে
মধ্যরাতে দরজায় ধাক্কা। ঘুম চোখে দরজা খুলতেই বেশ জোরালো শব্দ করেই ঘরে ঢুকে পড়ল জনা দশেক লোক। ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাট, টুল, টেবিলের ওপর বসল তারা। সবারই কোমরে ঝুলছে পিস্তল। সেই ফাস্টফুড সেন্টারের মালিক রবি সিং-ই আলাপ করিয়ে দিল ডাকাত গৌরী যাদব ও বাবুলি কোলের সঙ্গে। যাদের দু’জনেরই মাথার দাম কয়েক লক্ষ। কথায় কথায় জানা গেল একসময়ের চম্বলের আতঙ্ক দদুয়া, ঠকিয়া, বলখড়িয়াকে গুরু বলে মানে বাবুলি। পুলিশের এনকাউন্টারে বলখড়িয়ার মৃত্যুর পর, তার দেহ-ও পুলিশের হাতে পড়তে দেয়নি সে। সৎকার করেছিল গোপনে।
বাবুলীর সাম্প্রতিক খবর অনুযায়ী ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে চিত্রকূট জেলার মারকুন্ডি থানা এলাকার আতরসুইয়ের জঙ্গলে পুলিশের সঙ্গে তার এনকাউন্টার হয়। কিন্তু পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় সে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে এসপি মনোজ কুমার ঝাঁর নেতৃত্বে পুলিশ দল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে জঙ্গল ঘিরে ফেলে। আতরসুইয়ের পাহাড়ের কাছে তাদের সঙ্গে বাবুলীর এনকাউন্টার হয়। পুলিশ তাদের ধাওয়া করলেও বাবুলীর গ্যাং জঙ্গল থাকার ফায়দা তুলে পালিয়ে যেতে সফল হয়। পুলিশ ওই জায়গা থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী, বাসন ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করেছে। শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বাবুলী মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল এলাকায় পালিয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে গৌরী উত্তরপ্রদেশেরই মেয়ে। কলেজে পড়ার সময়ই ২০০৩ সালে তাকে অপহরণ করে নির্ভয় সিং গুর্জর। নীলম গুপ্তা সরলা জাটবের মতো তাকেও নিজের রক্ষিতা করে রেখেছিল নির্ভয়। কিন্তু বছর দেড়েক নির্ভয়ের দলে থাকার পর সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায় গৌরী। কিন্তু ততদিনে নিজের গ্রামে এবং সমাজে ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। বেহড়ে থাকাকালীনই বাবুলীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। নারীলোভী, বুড়ো নির্ভয়ের চেয়ে বাবুলীকেই তার মনে ধরে বেশি। শেষমেশ বাবুলীর দলে যোগ দেয় গৌরী। এখন সে তার দলের নাম্বার-টু।
কথা বলতে বলতেই বাবুলীকে বলি, তোমার দলের সঙ্গে তোমার আর গৌরীর একটা ছবি তুলতে দেবে? প্রথমে খানিকটা চুপ করে থেকে তারপর কোমর থেকে পিস্তলটা হাতে নিয়ে নাচাতে নাচাতে একবার সেটা আমার দিকে তাক করে আবার সেটা জানলার দিকে তাক করে। এভাবে প্রায় মিনিট পাঁচেক চলার পর খুব ঠান্ডা স্বরে বাবুলী বলে ওঠে, ‘পত্রকারসাহাব আপ রবিজীকো ডাকৈত দেখনে কি বাত কহি থি, ইতনি দূর সে আয়ে হো আপ, ইসলিয়ে মিলনেকো আয়ে। হাম কোই ফিলমস্টার নেহি হ্যায়। ডাকু হ্যায়, হামারে লেটেস্ট পিকচার পুলিশকে পাসভি নেহি হ্যায়। আপ সে ইসলিয়ে বাতিয়া রহে হ্যায় কি আপ চম্বলকো ইতনি দূর সে জাননেকে লিয়ে আয়ে হো। ফির রবিজী আপকো মেহমান বানায়া হ্যায়। রবি হামারা আচ্ছা দোস্ত হ্যায়। লেকিন হামারা বাত আপ লিখনা মত’। ততক্ষণে আমার আত্মারাম খাঁচা। একটা ছবি তুলতে চেয়ে কী ভুল করে ফেলেছি! এখন আমিই না ছবি হয়ে যাই। আমার অবস্থা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে গৌরী। তারপর বাবুলীকে বলে, ‘কাহে ডরা রাহা হ্যায় বহিনচোদ। ছোড় না ইয়ার। চল ইনে বীহড় ঘুমাইকে লে আতে হ্যায়। পত্রকারসাহাব ভি বীহড় ঘুমও লেঙ্গে থোড়া। দেখ আয়েঙ্গে বীহড়মে হাম কৌনসি গাণ্ড মারাতে হ্যায়’। ততক্ষণে আমি ঘামতে শুরু করেছি। বেহড়ে নিয়ে গিয়ে মেরে-টেরে ফেললে তো হয়ে গেল। বললাম, না না, এত রাতে আর কোথাও যাব না। তোমাদের কথা জানলাম এটাই আমার কাছে অনেক বড়ো অভিজ্ঞতা। আর কিছু দরকার নেই। এবার গৌরী খানিকটা আমার দিকে ঘেঁষে আসে। তারপর ফিসফিস করে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে ওঠে, ‘ডর মত, তুঝে মারেঙ্গে নেহি, মেহমান বোলা হ্যায়। চল থোড়া মৌজ মস্তি করেঙ্গে, দারু পিলায়েঙ্গে। তুভি কিয়া ইয়াদ রাখেগা চম্বলকি কিস রাজা আউর রানীকে পালে পড়া থা। চল।’ বলেই উঠে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন
‘কা পত্রকারবাবু, ডকৈত দেখনে কা বড়ি শক হ্যায়?’ ঘরে ঢুকে পড়ল জনা দশেক লোক
ফোন আর পার্সটা পকেটে নিতে যাব। ইশারায় নিষেধ করে গৌরী। শুধু সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে আসি। বাবুলী হোটেলের ছেলেটাকে বলে, শোন, একে আমরা নিয়ে যাচ্ছি। কেউ যেন জানতে না পারে। সকালে ছেড়ে দিয়ে যাব। নীচে নেমে দেখি হোটেলের সামনে একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে। সামনের সিটে বাবুলী আর গৌরী বসে, ড্রাইভারের সিটে রবিজী। অন্যদের সঙ্গে আমি পেছনে বসি। মধ্যরাতে ভিণ্ডের রাজপথ দিয়ে হাওয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ছুটে চলে জিপ। চারদিকে নিস্তব্ধ। সমস্ত ভিণ্ড ঘুমের অতলে তলিয়ে গিয়েছে। কেউ জানতেও পারল না, একদল ডাকাতের সঙ্গে এক বাঙালি সাংবাদিক জিপে করে ছুটে চলেছে অজানা বেহড়ের দিকে। একেই মার্চের সামান্য ঠান্ডা, তার মধ্যে অস্বীকার করব না, যতই মেরে না ফেলার কথা বলুক, তবু মনের মধ্যে ভয় তাড়া করছে। যতটা ঠান্ডা তার চেয়েও আরো বেশি শীত করছিল আমার। গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত আমার জীবনে ঘটে গিয়েছে অনেক কিছু। চম্বলের ডাকাত সম্রাটের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি, একজন প্রাক্তন ডাকাতের কাছে আরেক মৃত প্রাক্তন ডাকাতের গল্প শুনেছি, সে ছিল এক রকমের অভিজ্ঞতা। আর এখন এই মাঝরাতে আগে পিছে, ডাইনে বাঁয়ে রীতিমতো ইনামি ডাকাত পরিবেষ্টিত হয়ে অজানার উদ্দেশ্যে চলেছি। একদিকে ভয় পেলেও অন্যদিকে নিজেকে এই বলে চাঙ্গা করে চলেছি, দেখাই যাক না কী হয়। মরলে মরব। আর বেঁচে গেলে সারা জীবনের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন
মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা; অভিশপ্ত চম্বল আবার কী বিপদ নিয়ে এল?
আরও পড়ুন
‘খুনি দরওয়াজা’, ঝরতে থাকা রক্ত এবং মধ্যযুগের চম্বল
ভয়ের চোটে কতক্ষণ জিপ চলেছে খেয়াল নেই। যখন গাড়ি থামল দেখলাম আমরা এসে পৌঁছেছি সেই চম্বল নদীর ধারে, সকালে যেখান থেকে জিপে করে ভিণ্ড পৌঁছেছিলাম। আবারো সেই বালির চড়া পেরিয়ে ঘাটের কাছে পৌঁছোলাম। ডাকাতদল আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চম্বলের পাড় ধরেই হাঁটতে লাগল। প্রায় দশ মিনিট চলার পর একটা বেহড়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। নিচের চড়া থেকে লাফিয়ে মাটিতে উঠে, ছোটো ছোটো দুটো বেহড়ের মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছি। ডাকাতদলের হাতে বড়ো বড়ো চারটি টর্চ জ্বলে উঠেছে। জ্যোৎস্নার সাদা আলো আর টর্চের হলুদ আলো দুই মিলে এই মাঝ রাতে এক অদ্ভুত রহস্য তৈরি করেছে। মাঝেমাঝে ছোটো-ছোটো কাঁটাঝোপ। বেহড়ের দেওয়ালেও কাঁটার ঝাড়। ফলে অনভ্যস্ত আমার হাত পা ছড়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। ভয়ে মুখ দিয়ে টু-শব্দটি বেরচ্ছে না। দু-পাশে বেহড়ের দেওয়াল, তার মধ্যে দিয়ে এক-দেড় ফুটের পায়ে-চলা পথ। কোথাও কোথাও গর্ত। হোঁচট খাচ্ছি। জীবনে অনেকবার বাড়ি থেকে পালিয়ে অনেক বিপদের মুখে পড়েছি। কিন্তু এই নিয়ে দ্বিতীয়বার উপলব্ধি করলাম মৃত্যুভয় কাকে বলে।
আরও পড়ুন
‘বীহড়ো মে শাপ হ্যায়, পতা নেহি ফির কিসকো কব খিঁচ লে’
আরও পড়ুন
চম্বলের ডাকাতদের খপ্পরে পড়েছিলেন হিউয়েন সাং; খুন হন আকবরের জীবনীকার আবুল ফজলও
এর আগে ২০০৫-এ দার্জিলিং আর গ্যাংটকে চা-বাগানে চাকরি করতে গিয়েছিলাম। গ্যাংটকে থাকার সময় ভূমিকম্পে একটা বাড়ির নিচের তলায় থাকা চায়ের শোরুমে আমার থাকার জায়গায় আটকে পড়েছিলাম। ভূমিকম্পের ফলে দরজা জানলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কীভাবে বেরব বুঝতে পারছিলাম না। জানলা ভেঙে আমাকে উদ্ধার করেছিলেন সেই বাড়ির মালিক। এক হাত, আর এক পা ভাঙা অবস্থায়। কিন্তু তখন এমন মৃত্যুভয় ছিল না, এখন যেমন মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই একবার হোঁচট খেয়ে পড়েছি, গর্তে পা পড়ে। ‘শহরকে ছোড়ে, ইয়ে তুমহারে কলকাত্তাকে পক্কে রোড না হ্যায়’ ধরনের টিটকিরিও শুনতে হয়েছে গৌরীর মুখে। হাত-পা জ্বালা করছে। মিনিট পনেরো হয়ে গেল বেহড়ে ঢুকেছি। মনে হচ্ছে যেন পনেরো ঘণ্টা ধরে হেঁটে চলেছি। ভয়ে আর ক্লান্তিতে ছাতি পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছে। কতক্ষণ আর চলতে হবে কে জানে! এরা তো এভাবেই পায়ে হেঁটে এক বেহড় থেকে আরেক বেহড়ের মধ্যে দিয়ে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে এই উত্তরপ্রদেশ থেকে মধ্যপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ থেকে রাজস্থান করে বেড়ায়। কী করে পারে, কে জানে! আরো খানিকক্ষণ চলার পর অনেকটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। একদিকে গোটা চারেক পরপর তাবু টাঙানো রয়েছে। চারদিকে বেহড়, মাঝে তাবু, মাটিতে কয়েকটা ওলটানো কাঠের বাক্স গোল করে রাখা। মাঝখানে আগুন জ্বালানোর জন্য জড়ো করে রাখা রয়েছে কাঠকুটো। এই জায়গাটা কোথায় আমি জানি না। তবে নদী যখন পেরোইনি তখন নিশ্চিতভাবেই এটা মধ্যপ্রদেশের এলাকা। এবার বাবুলী বলে ওঠে, ‘আইয়ে হুজর, ইয়ে হ্যায় গরীবকা ডেরা। তশরিফ লাইয়ে। দেখিয়ে ক্যায়সে হ্যায় মেরা রাজমহল। নীচে বীহড়, উপর আসমাঁ, অউর চারো তরফ জংলী জানওয়ার অউর সাপ। ইসি বিচ শোতা হুঁ ম্যায়’। হিন্দি সিনেমায় এই ডায়লগে হল ফাটিয়ে হাততালি আর সিটির ধুম লেগে যেত। এর মধ্যেই ডাকাতদলের কেউ কেউ তাবুর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। রবিজী ও অন্যান্য ডাকাতরা কেউ মাটিতে, কেউবা বাক্সের উপরই বসে পড়েছে। আমিও একটা খালি বাক্সের উপর বসে পড়ি।
আরও পড়ুন
মানসিং-এর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে হাজির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাড়িয়ে দিলেন স্ত্রী রুক্মিণীদেবী
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
পুলিশের ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ গুলিবিদ্ধ রূপা সিং, আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন কুইন