দুর্ধর্ষ দুশমন – ১১
আগের পর্বে
অকুস্থল মেহেগাঁও। আসার পথেই বাসস্ট্যান্ডের টাইমকিপার শুনিয়েছে মাধো সিং-এর রোমহর্ষক কাহিনী। মেহেগাঁওয়ে হোটেল থেকে বেরিয়েই এক ফাস্টফুডের দোকান। সেখানের মালিক রবি সিংকে দেখেই প্রথম চমক লাগে। ছ’ফুটে দশাসই চেহারার সঙ্গেই কোমরে গোঁজা রিভালবার। তাঁর সঙ্গে কথায় কথায় ডাকাতের প্রসঙ্গ উঠে আসতেই তিনি বলেন, “ডাকুওকে সাথ মিলনা হ্যায়, তো মিল যায়েঙ্গে”। তারপর রহস্যময় হাসি দিতেই মিলিয়ে যান তিনি। সেদিন হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আচমকা ধাক্কা দরজায়। ঘুমের ঘোর কাটিয়ে মোবাইল স্ক্রিন জানান দিল ঘড়িতে রাত দুটো।
বিরক্তি সহকারে বিছানা ছেড়ে উঠি দরজা খুলতে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই দুটো হাত আমাকে ধাক্কা দেয়। টাল সামলে নিয়ে দেখি আমার ঘরের ভেতর ততক্ষণে গোটা দশেক লোক। আমি কিছু বলার আগেই বেশ জোরালো একটা গলার আওয়াজ আমাকে পুরো কাঁপিয়ে দেয়। ‘কা পত্রকারবাবু, ডকৈত দেখনে কা বড়ি শক হ্যায়। লো হম আ গয়ে। ঘাবড়াইয়ে নেহি, আপসে মিলনে আয়ে, বাতিয়ানে আয়ে, আপ হামারে মেহমান হ্যায়? কোই তখলিফ তো নেই হো রাহা হ্যায় ইধার’। ততক্ষণে টাল সামলে নিয়েছি। এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখি আমার ঘরে একজন মহিলা সমতে গোটা দশজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর রয়েছেন সেই ফাস্টফুড দোকানের মালিক রবিজি। এবার আমার মনে পড়ল রবিজির আমাকে বলা শেষ কথাগুলো। বুঝলাম তখন তার সেই রহস্যময় হাসির সঙ্গে বলা কথাগুলো, ‘মিল জায়েঙ্গে’। আর রয়েছে হোটেলের সেই ছেলেটা। তাকে ঘুম থেকে তুলে আনা হয়েছে জোর করে। রবিজি এসে বসলেন আমার খাটে। বললেন, এসো বসো, ঘাবড়াবার কিছু নেই। তোমার সঙ্গে একটু মোলাকাত করতে এসেছি।
রাত দুটোর সময় আমার ঘরে প্রায় জনাদশেক ডাকাত দাঁড়িয়ে আছে, আর ইনি কিনা বলছেন আমার ঘাবড়ানোর কিছু নেই! প্রায় ফুট ছয়েক লম্বা, দাড়ি গোঁফ কামানো কোমরের দু-দিকে পিস্তল গোঁজা একজনকে দেখিয়ে রবিজি বললেন, ‘ইনসে মিলিয়ে পত্রকারসাহাব, ইয়ে হ্যায় বাবুলি কোল, আভি চম্বলকা শের। অউর উ হ্যায়, গৌরী যাদব। পেহেলে নির্ভয়কে গ্যাংকা পকড় থি, আব বাবুলীকে গ্যাংমে নাম্বার দো হ্যায়। চম্বলপে অভি ইন দোনোকা হি রাজ চলতা হ্যায়।’ ততক্ষণে আমার খাটজুড়ে ডাকাতরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। কেউ কেউ ঘরে রাখা টুলের উপর। একজন তো টেবিলের উপর উঠে বসে পড়েছে। যেন পাড়ার ক্লাবে আড্ডা হচ্ছে, আর আমি এদের অতিথি।
রবিজি হোটেলের ছেলেটাকে হুকুম দিলেন সবার জন্য ভালো করে চা বানাতে। আর বললেন আমি তাদের অতিথি, হোটেলে যেন আমার কোনো অসুবিধা না হয়। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর রবিজি আমার দিকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘মেরে দুকানকি ছোকড়ে সে গলতি হো গয়ী পত্রকারবাবু, আপ হামারে মেহমান হো। আপ সে হাম খানেকা প্যায়সা ক্যায়সে লে সকতে হ্যায়?’ আমি বললাম, না না, আমি খেয়েছি তার দাম তো দিতেই হবে। জোর করে আমার হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে রবিজি বললেন, ‘পুরি দুনিয়ামে চম্বল বদনাম জরুর হ্যায় সাহাব, পর চম্বল মেহমানোকি খাতিরদারি জানতে হ্যায়, দুনিয়ামে চাহে হাম কিতনে বদনাম হো পর মেহমানো কো হম সিরপে বিঠাকে রাখতে হ্যায়’।
আরও পড়ুন
মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা; অভিশপ্ত চম্বল আবার কী বিপদ নিয়ে এল?
বেশি তর্কে গেলাম না, কে জানে সকলেরই কোমর থেকে পিস্তল ঝুলছে, বেশি কথা বললে যদি চালিয়ে দেয়। অগত্যা নিয়েই নিই টাকা। এবার বাবুলির দিকে তাকাই। কোনো অ্যাঙ্গেল থেকেই এই লোকটাকে ডাকাত বলে মনে হচ্ছে না। কৈশোরে দেখা হিন্দি সিনেমার নায়ক বিবেক মুসরানের মতো দেখতে অনেকটা। ব্যাকব্রাশ করা চুল। দোহরা শরীর। আমারই বয়সি একটা ছেলে। একমাত্র তার চোখ দুটো ছাড়া আর কোনোভাবেই তাকে ডাকাত বলে মনে হয় না। তার মতো এত ঠান্ডা চোখের দৃষ্টি আমি খুব কমই দেখেছি।
আরও পড়ুন
‘খুনি দরওয়াজা’, ঝরতে থাকা রক্ত এবং মধ্যযুগের চম্বল
আরও পড়ুন
‘বীহড়ো মে শাপ হ্যায়, পতা নেহি ফির কিসকো কব খিঁচ লে’
আমাকে তার দিকে তাকাতে দেখে হাত বাড়িয়ে দেয় বাবুলি। তার সঙ্গে হাত মেলাই। আমার হাতটা ধরে খানিকটা ঝাঁকুনি দেয়। এত শক্ত হাত যে আমার হাতটাই টনটন করে উঠল। কোথায় আমি পেটরোগা, প্যাংলা পাঁচ-ফুট-পাঁচ-ইঞ্চি’র বাঙালি সাংবাদিক, আর কোথায় এই ছ-ফুট লম্বা হাতে সবসময় বন্দুক পিস্তল নিয়ে ঘোরা চম্বলের ডাকাত। হাতের আর দোষ কী! আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাবুলি হেসে ওঠে, ‘আরে আপকি হাত তো মৌরিয়ান জ্যায়সি হ্যায় বাবু (আরে তোমার হাত তো মেয়েদের মতো নরম)’। বাবুলির কথায় ঘরের সকলেই হেসে ওঠে।
আরও পড়ুন
চম্বলের ডাকাতদের খপ্পরে পড়েছিলেন হিউয়েন সাং; খুন হন আকবরের জীবনীকার আবুল ফজলও
চা এসে গিয়েছিল। একটা গেলাস তুলে নিয়ে বাবুলি বলে ওঠে, ‘বোলিয়ে সাহাব কাহে মিলনা চা রহে থে হম সবন সে?’ আমার উদ্দেশ্যের কথা বলি। এবার গৌরী আমার দিকে খানিকটা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, ‘আপ মিডিয়াওয়ালেকো ক্যা লাগতা হ্যায়, কোই শখ সে বীহড় পকড়তা হ্যায় ক্যা?’ এ প্রশ্নের কোনো জবাব হয় না। এবার খানিকটা বুঝিয়ে বলি গৌরী আর বাবুলিকে। তাদের জানাই আমি এসেছি, চম্বলের মানুষের জীবন, কেন তারা ডাকাত হয়ে উঠেছে, তাদের বেহড়ের জীবনযাত্রাই বা কেমন সেটা জানতে। মানুষকে জানাতেও। বলতে বলতেই দেখি গৌরী আমার সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে নিয়েছে। আমাকে বলে ওঠে, ‘আগার আপ কি এক সিগরেট লু তো বুরা তো নেহি মানোগে সাহাব?’ বলেই জবাবের অপেক্ষা না করে পাশে পড়ে থাকা লাইটারটা নিয়ে ফস করে সিগারেট ধরিয়ে ফেলে। আমার অবস্থা তথৈবচ। মনে মনে বলছি, আমি মানা করলেই যেন শুনবে! পারলে তো এখনই ধাঁই করে গুলি চালিয়ে আমার জীবনটাই নিয়ে নিতে পারো।
আরও পড়ুন
মানসিং-এর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে হাজির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাড়িয়ে দিলেন স্ত্রী রুক্মিণীদেবী
আরও পড়ুন
পুলিশের ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ গুলিবিদ্ধ রূপা সিং, আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন কুইন
আমাকে নিরুত্তর দেখে গৌরী বলে ওঠে, ‘আপকি শহরকি লড়কিয়া তো পিতি হোগি সিগরেট। হামনে শুনা হ্যায় বহত সারে পত্রকার লড়কিয়াভি সিগরেট পিতি হ্যায়, দারুভি পিতি হ্যায়’। আমি কাষ্ঠ হাসি দিয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করি। লম্বায় প্রায় পাঁচ-ফুট-আট-ইঞ্চি, শ্যামলা গায়ের রঙ। কপালে একটা লাল তিলক। সারাক্ষণ পান চিবিয়ে ঠোঁট দুটো লাল। টাইটফিট জিন্স আর গেঞ্জির উপর দিয়ে বোতাম খোলা শার্ট, পেটের কাছে গিঁট মারা। গৌরীকে দেখে সত্যিই দস্যুসুন্দরীই লাগছে। বছর সাতাশের গৌরী দারুণ কিছু সুন্দরী না হলেও তার শরীরের একটা আলগা চটক আছে, যা চোখ টেনে নেয়। তার হাঁটা-চলার, কথা বলার ধরন অনেক শহুরে মেয়েকেও ঘোল খাইয়ে দেবে। কথা ঘোরাবার জন্য প্রশ্ন করি, তোমরা কোন এলাকার লোক? রবিজি এবার উত্তর দেন, বলেন তুমি কি জানো এরা কত বড়ো ডাকাত। বাবুলীর মাথার দাম সরকার পাঁচ লাখ টাকা ধার্য করেছে। আর গৌরীর মাথার দাম দু-লাখ টাকা। এর দুজনেই চিত্রকূট এলাকার লোক। এরপর রবিজির মুখেই শুনি এদের কিছুটা বর্ণনা।
আরও পড়ুন
চম্বলের দুর্ধর্ষ লাখন সিং-এর চরিত্রে সুশান্ত, মনোজ বাজপেয়ী ছিলেন মানসিং-এর ভূমিকায়
উত্তরপ্রদেশের চিত্রকূট এলাকার বাদশাহ হল বাবুলি। সে এই এলাকার পঞ্চম ডাকাত, যার মাথার দাম পাঁচ লাখ টাকা। এর আগে দদুয়া, ঠোকিয়া, রাগিয়া আর বলখড়িয়ার মাথার দাম ছিল পাঁচ লাখ টাকা, যারা আগেই পুলিশের গুলির শিকার হয়েছে। এখন বাবুলি এদের থেকেও বড়ো ডাকাত হতে চায়। নিজের আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য যে-কাউকে গুলি করা বাবুলি কৌলের জন্য ছেলেখেলার ব্যাপার। আর এখন তার মাথার দাম পাঁচ লাখ টাকা হয়ে যাওয়ায় চিত্রকূট, পাঠা এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে বাবুলীর আতঙ্ক ছড়িয়ে গিয়েছে। একসময় চম্বলের আতঙ্ক, ডাকাত দদুয়া, ঠোকিয়া, রাগিয়া এবং বলখড়িয়াকে গুরু বলে মানে বাবুলি। খুন, খুনের চেষ্টা, অপহরণ মিলিয়ে এই মুহূর্তে বাবুলির নামে সাতচল্লিশটা মোকদ্দমা নথিভুক্ত রয়েছে।
আরও পড়ুন
কলকাতায় হাজির চম্বলের মাধো সিং, আত্মসমর্পণে সাহায্য চাইলেন জ্যোতি বসুর কাছে
আরও পড়ুন
‘নয়া পঞ্ছি মালুম হোতা হ্যায়’ - শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে রূপা ডাকাতের নাতি
বাবুলি সেই সময় শিরোনামে আসে যখন ২০১২ সালে চিত্রকূট জেলার মারকুন্ডি থানা এলাকার ডোডামাফি গ্রামে তাণ্ডব চালিয়ে একই পরিবারের পাঁচজনকে গুলি করে খুন করে সে। এই ঘটনার পর চম্বল এলাকায় আতঙ্কের আরেক নাম হয়ে ওঠে বাবুলি কৌল। আগে সে ছিল বলখড়িয়ার দলে। চম্বলের আতঙ্ক বলখড়িয়ার নামে পঁচাশিটার বেশি খুন, অপহরণ এবং লুঠের মামলা নথিভুক্ত ছিল। উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের পুলিশ তাকে খোঁজার জন্য দিন রাত এক করে দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে তার মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন
‘খুন কা বদলা স্রেফ খুন’; মানসিং-হত্যার পর, শপথ নিলেন চম্বলের নয়া ডাকাত সর্দার
পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টার চলাকালীনই বলখড়িয়া নিজের সঙ্গীদের বলেছিল, ‘মর জাউঁ তো মোর লাশ পুলিশকা না মিলে কা চাই’। অর্থাৎ যদি মরে যাই তো আমার লাশ পুলিশের হাতে যেন না পড়ে। সেই সঙ্গে মৃত্যুর আগে বলখড়িয়া আরো বলেছিল যে তার মৃত্যুর পর দলের সর্দার হবে বাবুলি কৌল। বলখড়িয়ার মৃত্যুর পরপরই বাবুলি ঘোষণা করেছিল যে প্রথমে তারা তাদের সর্দারের মৃত্যুর বদলা নেবে। বলখড়িয়ার মৃত্যুর পর তার দেহ বয়ে নিয়ে গিয়ে বাবুলি কোনো এক গোপন জায়গায় সৎকারও করে। সর্দারের মৃতদেহ সে পুলিশের হাতে পড়তে দেয়নি।
Powered by Froala Editor