কে সি দাসের দোকানে নিয়ে গিয়ে রসগোল্লা খাওয়াল ‘কিং কং’

সেইসব পাড়া টারা - ৬

আগের পর্বে

স্কুলে জুনিয়র টিমের গোলকিপার ছিল সুবীর। সবার চেয়ে ডাকাবুকো ছেলে। একদিন বন্ধুদের টারজান এপম্যানের মতই একদিন ঝাঁপ দিল স্কুলবাড়ির তিনতলার ছাদ থেকে। বন্ধুরা ভয়েই চোখ বন্ধ নিমেষে। তারপর তলায় তাকাতে দেখা গেল বালির স্তুপে দাঁড়িয়ে প্যান্ট ঝাটছে সুবীর। সেই ট্রেন্ড ছড়িয়ে পড়ল স্কুলের সকলের মধ্যেই। তেতলার ছাদ থেকে ছেলেদের দল বেঁধে ঝাঁপ। মুখে ‘ইউ ও উ ও’ স্বর। একদিন বাসযাত্রীদের চোখে পড়ল সেই দৃশ্য। স্কুলের বাইরে থেকে বোধগম্য হয়নি বিষয়টা। ছাত্রদের গণহত্যার বিষয়ে নালিশ এল মাস্টারমশাইদের কাছে। অতঃপর স্যরের হারকিউলিস হওয়ার খেলা। সুবীরের দুই যমজ সাগরেদ টকাই-বকাইও ছিল একইরকম ধুরন্ধর। তবে পাড়ায় তাঁদের দৌরাত্ম্য শেষ হয়েছিল খোদ পুলিশের হাতেই।

টকাইদের ‘বিখ্যাত’ ক্লাবের অনতিদূরেই চক্কোত্তিদের বাড়ি। পাড়ায়, বিশেষ করে উত্তর কলকাতার বনেদি পাড়াগুলোয় চিরকালই এমন কিছু প্রাচীন পরিবার থাকত, যাদের প্রপিতামহের প্রপিতামহ কোন অফিসে একবার চাকরিতে জয়েন করলে নাতির নাতি, তস্য নাতি অবধি সেই ধারা অবিরত বহমান থাকত অবাধ গতিতে। এব্যাপারে সেসময় রেল কোম্পানির খ্যাতি ছিল সর্বাধিক। টকাই-বকাইদের পাড়ার চক্কোতি বাড়ি ছিল আক্ষরিক অর্থেই ওরকম একটি ‘রেলচাকুরে’ বাড়ি। যৌথ পরিবারের সমস্ত বয়স্ক সদস্যই ছিল রেলের চাকুরে। এহেন পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে ঠোঁটের ওপর ঠিকঠাক গোঁফের রেখা ধরার আগেই বাপজ্যাঠাদের তদবিরে রেলের আপিসে চাকরি পেয়ে যায় বিজন চক্কোতি ওরফে বিজেদা। খাট-আলমারি-নগদসহ টুকটুকে একটি বউও জুটে যায় অবিলম্বে। পুত্রের এহেন যৌথ সাফল্যের ফলে ধরাকে প্রায় সরা জ্ঞান করতে থাকেন বিজেদার মা। পাড়ায় বিজেদার বয়েসী প্রায় সব ছেলেপুলেই ঠা ঠা বেকার তখনও। তাদের মায়েদেরকে উদ্দেশ্য করে রাতদিন অজস্র ঠোনা দেয়া কথা শোনাতেন চক্কোত্তি বাড়ির ওই গিন্নি। কোথায় তার সোনার টুকরো বিজে আর কোথায় অন্যদের কাঠবেকার অপোগণ্ডগুলো। এজাতীয় সব জলবিছুটিমারা কথাবাত্তা আর কি।  

চক্কোতি গিন্নির এহেন আচরণে যারপরনাই ক্ষুব্ধ ছিল গোটা পাড়া বিশেষ করে ক্লাবের ছেলেরা। অনেকদিন ধরেই এর একটা বিহিত করার সুযোগ খুঁজছিল তারা, বিশেষত টকাই-বকাই। পাড়া তথা ক্লাবের দাদাদের এহেন হেনস্থা অপমান আর সহ্য হচ্ছিল না দুভাইয়ের। সেই বহুকাঙ্ক্ষিত বিহিত করার সুযোগটা শেষমেশ এসেই গেল একদিন। টকাইদের বন্ধু দর্জিপাড়ার অতনু ওরফে অত হঠাতই একদিন এসে হাজির পাড়ায়। ক্লাবের সামনে রোয়াকে জোর আড্ডা চলছে, ঠিক সেই সময় সামনে রাস্তা ধরে অফিস থেকে ফিরছিল বিজে। দেখামাত্র ভুরুজোড়া ধনুকের মত বেঁকে গেল অতর। “এ মালটা তোদের পাড়ার?” - বেজায় সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করলো টকাই-বকাইকে। জবাব ইতিবাচক হবার পর অতর কাছে জানা গেল খবরটা। মাসকয়েক আগেই পুজো গেছে। অতদের পাড়ার উল্টোফুটেই ওয়ার্ল্ড ফেমাস সোনাগাছি। দর্জিপাড়ার ছেলেরা মোটামুটিভাবে মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই জেনে ফেলে ওফুটে কি হয়। নবমীর দিন সন্ধেবেলা অত নিজের চোখে দেখেছে বিজেকে জটাধারী পেট্রল পাম্পের পাশের গলিটায় ঢুকতে। এরকম একটা কয়েক মেগাটনের ন্যাপাম বোমা টকাই-বকাই এবং তাদের বন্ধুবান্ধবদের হাতে তুলে দিয়ে রাত নটা নাগাদ পাড়া থেকে বিদায় নিল অত। 

পরদিন ভোরবেলা। আধো অন্ধকারমাখা শীতভোরের কুয়াশা ভেদ করে পল্লীর একাধিক দেয়ালে বেশকিছু ছোট ছোট লিফলেট আকারের পোস্টার চোখে পড়লো পল্লীবাসীর। প্রতিটি পোস্টারের বিষয়বস্তু যুক্তাক্ষরবিহীন একটি অতি সরল কবিতা। তার প্রথম চারটি লাইন এইপ্রকার -
নবমীর দিনে
পথ চিনে চিনে
সোনাগাছি গিয়ে
দশটাকা দিয়ে...  

পরবর্তী দুটি লাইন যেহেতু পৃথিবীর সমস্তরকম শালীনতা বা অশ্লীলতার সীমা অতিক্রম করে যাবে ফলে কিছুতেই আর সেটি ছাপার অক্ষরে দিতে পারলাম না এই প্রতিবেদনে। দুঃখিত তার জন্য।
এখানেই শেষ হতে পারত ঘটনাট। কিন্তু উপায় নেই। ফের একবার ঢুকতেই হবে পোস্টার-উত্তর পর্বে। সেদিন একটু বেলা বাড়তেই চক্কোত্তি বাড়ির অন্দরমহল থেকে একটানা ভেসে আসতে থাকে বিজেদার মায়ের প্রবল মড়াকান্না - “ওরে আমার বিজে রে! ঘরে অ্যামনধারা লক্ষীপিতিমের মত বউ থাকতে কেন তুই ওই রাঁড়পাড়ায় গেলিরেএ এ এ!” জবাবে বিজেদার হাহাকার - “ওদের ও লেকা বিস্বাস কোর না মা। ওরা সব মিত্যে কতা বোলচে!”
এসবের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে হাওড়ায় বাপের বাড়িতে রওয়ানা দিয়েছিল বিজেদার বউ। অনেক সাধ্যসাধনা করে, হাতেপায়ে ধরে ফিরিয়ে আনতে আনতে ঝাড়া তিনমাস। এতে আর কি উপকার হয়েছিল জানা নেই তবে পাড়ার মা-মাসীমাদের উদ্দেশ্য করে চক্কোত্তি গিন্নির ঠোনামারা ওইসব জলবিছুটিসম বাক্যবাণ বন্ধ হয়ে গেছিল বরাবরের জন্য। 

আরও পড়ুন
তিনতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ সুবীরের, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল সবাই

শ্যামবাজার, হেদো, গোয়াবাগান, অনেকক্ষণ তো হল। এবার ফের একবার গড়পারে ফেরা দরকার। তবে তার আগে চিরবন্ধু সুবীরের সঙ্গে সেই কবে অনন্য একটি অভিজ্ঞতার কথা সেরে নিই। অতঃপর ফিরবই গড়পারে, কথা দিচ্ছি। কারণ ‘সেইসব পাড়াটারা’ উপখ্যানের উত্তর-পর্বটার সমাপ্তি তো ঘটবে ওখানেই।
খাস উত্তর কলকাত্তাইয়া সুবীর যেমন জন্মেই মোহনবাগান, তেমনি আমি গড়পারে জন্মেও চিরকেলে লাল-হলুদ। তবু ময়দানে সবুজ-মেরুনের খেলা থাকলে আমাকে সঙ্গে নেবেই ও। এদিকে আমি যেতে রাজি নই কিছুতেই। ফলে অনুরোধ উপরোধ, টোস্ট-ঘুগনির প্রলোভন, তাতেও কাজ না হলে টুকটাক চাঁটা, বলপ্রয়োগ ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে যেতেই হত প্রায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই। আজো মনে আছে সেদিন লিগের খেলায় ছোট টিম, উয়াড়ি না হাওড়া ইউনিয়ন কার সঙ্গে যেন একটা ড্র করেছে মোহনবাগান। খুব স্বাভাবিকভাবেই চূড়ান্ত মুড ব্যাজার সুবীরের। সেই ঝাড়টা পুরোটাই এসে পড়ছে আমার ওপর। এইভাবে চলতে চলতে গভর্নর হাউস পেরিয়ে কার্জন পার্ক চত্বরে এসে পড়লাম দুজন। ঘড়িওয়ালা ট্রামগুমটির কাছে একটা লোক, ডালাগাড়িতে কাঁচের জারে মুসম্বির রস, খুব জোর চ্যাঁচাচ্ছে - “ইয়েচ্চারানা! ইয়েচ্চারানা!” বোঝাই যাচ্ছে একেক গ্লাস চার আনা। “চ, মেজাজটা একটু ঠান্ডা করা দরকার।” বলে ডালাগাড়ির দিকে এগিয়ে গেল সুবীর। অতঃপর দুই বন্ধু একেকজন দুগ্লাস করে মোউসম্বি সুধা পান করার পর লোকটার দিকে এক টাকার একটা নোট বাড়িয়ে ধরলো সুবীর। তা দেখে তৎকালীন হিন্দি সিনেমার ভয়ঙ্করতম ভিলেন কে এন সিংয়ের মতো ক্রূর চোখে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল লোকটা। “চুতিয়া পায়া হ্যায় ক্যা?” “কেন বাঁড়া? তুমি তো চার আনা করেই বললে।” পাল্টা ঝাঁঝিয়ে উঠল সুবীর। “কভি নহি, হাম বোলা এক চারানা, মতলব এক রুপিয়া চার আনা। আব ফটাফট পয়সা নিকাল।” হুমকে উঠল লোকটা। ইতিমধ্যেই আশপাশের সব ফেরিওয়ালারাও জড়ো হয়ে গেছে লোকটার সমর্থনে। দুজনেই বুঝতে পারলাম বেজায় ফেঁসে গেছি। ওই অদ্ভুত উচ্চারণটাই মুসম্বিওয়ালার লোক ফাঁসানোর কায়দা। কিন্তু কিছু করার নেই। দুজনের কাছে মিলিয়েমিশিয়ে টাকাচারেক উপরহস্ত করে ট্যাঁকখালির জমিদার হয়ে বেরিয়ে এলাম ভিড়ের মধ্যে থেকে। 

আরও পড়ুন
নিয়মিত মদ্যপান করায় জুটেছিল ‘মাতাল’ পদবি, পরোপকারে নোবেল পেতে পারতেন তাঁরাই

“শালা আমি শ্যামবাজারের মাল, সেই আমাকেই কিনা বেমালুম হাঁস বানিয়ে দিল শুওরের বাচ্চা!” কার্জন পার্কের ঘাসে বসে ব্যর্থ রাগে গজগজ করছিল সুবীর। কিই বা উত্তর হয় এ প্রশ্নের। চুপ করে রইলাম আমি। “ইউরেকা!” হঠাতই চেঁচিয়ে উঠলো সুবীর। “মনে পড়েছে, আমার ফুলুমামা এখানে লোকাল থানার এস আই। মায়ের খুড়তুতো ভাই। চ এক্ষুনি!”
থানায় গিয়ে দেখা গেল বেজায় নিরীহ চেহারার এক ভদ্রলোক। নাকের ওপর চশমা। মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন পায়ের ওপর পা তুলে। সামনে টেবিলে রাখা ফাইলপত্তরের পাশে ফিলটার উইলসের প্যাকেট, খালি চায়ের গেলাস। ভদ্রলোককে দেখামাত্র “ম্যাম্যাআ আ আ” বলে তীরবেগে ছুটে গিয়ে টেবিলের ওপর বিকট হাঁউমাউ কান্নায় ভেঙে পড়ল সুবীর। “আরে সুবু, ওঠ ওঠ! কী হয়েছে?” সুবীরকে কাঁধ ধরে তুললেন দৃশ্যতই উদ্বিগ্ন ভদ্রলোক। অতঃপর সমগ্র ঘটনাক্রমের বিস্তৃত বিবরণ। শোনার পর “রামপ্রবেশ” বলে একটা হাঁক পাড়লেন সুবীরের ফুলুমামা। পরমুহূর্তেই পর্দা সরিয়ে পাশের ঘর থেকে এ ঘরে প্রবেশ ঘটল রামপ্রবেশের। দেখামাত্র একটা উপমাই মনে এসছিল - জীবন্ত কিং কং!’ এহেন কিং কংয়ের গায়ে সিল্কের হাফহাতা শার্ট, খাটো করে পড়া ধুতি। মোজাসহ সাদা কেডস। “জী স্যর!” বলে সেলাম ঠুকে সংক্ষেপে পুরো বৃত্তান্তটা শুনে নিলো কিং কং। তারপর পিছন ঘুরে আমাদের দুজনের উদ্দেশ্যে একটা সংক্ষিপ্ততর ব্রিফিং। যার মানে - আমরা দুজন ঘটনাস্থলে পৌঁছে মুসম্বি রসওয়ালার সঙ্গে ঝামেলা শুরু করব। কিং কং থাকবে একটু পেছনে। লোকটা পাল্টা কিছু করার আগেই তুরন্ত পৌঁছে যাবে স্পটে। 

আরও পড়ুন
ইস্টবেঙ্গল লিগ জেতায়, দুঃখে ‘দেশান্তরী’ হয়ে গিয়েছিলেন মোহনবাগানী লালাকাকু

সেই অনুযায়ী ফের কার্জন পার্কের দিকে রওয়ানা দিলাম দুজন। পিছনে মিটার বিশেকের দুরত্ব রেখে কিং কং। ট্রাম গুমটির কাছে পৌঁছেই জুসওয়ালার দিকে তেড়ে গেল সুবীর - “শালা চোট্টা কাঁহিকা, আভভি মেরা পয়সা ওয়াপস করো।” প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত জুসওয়ালা “আবে শালা, তেরা ইতনা বড়া হিম্মত!” বলে চড় তোলার আগেই এসে গরিলার মত হাতের পাঞ্জায় ওর কলার চেপে ধরল কিং কং। পরমুহূর্তেই শূন্যে তুলে প্রবল ঝাঁকুনি কয়েকটা। কাটা ঘুড়ির মত লটপট করে মাটিতে পড়ে গেল লোকটা। তুলে খুব মোলায়েম একটা চড় গালে। তারপর ডালার গায়ে ক্যাশবাক্স খুলে পুরো নগদটাই খামচে পকেটস্থ করে জুসওয়ালার দিকে রক্তচোখে তাকালো কিং কং। “গোড় পাকড়কে মাফি মাঙ্গ বাবুলোগসে।” মাফিটাফির পর্ব চুকলে আমাদের দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে কে সি দাসের দোকানে নিয়ে এল কিং কং। খুব মিঠে গলায় জিগ্যেস করল “রসগুল্লা খাইবি কা?” এরকম প্রস্তাবে কখনো না করতে আছে। বিদ্যুতগতিকে লজ্জা দিয়ে ঘাড় হেলালাম দুজনে। দুপিস করে কে সি দাসের দুরন্ত রসগোল্লা আস্বাদনের পর পকেটে হাত ঢোকাল কিং কং। লুন্ঠনকৃত অর্থের মধ্যে দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে এল আমাদের দুজনের দিকে। “ইয়ে লে বাবুয়া, যাইকে পিকচার দেখ লেইবি।” যথারীতি এ-প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছিল জেটগতিতে। টাকা পকেটে পুরেই দে ছুট অপেরা (সম্ভবত) সিনেমাহল। ইভনিং শো। এক টাকা পঁয়ত্রিশের মিডল স্টলের টিকিট ব্ল্যাকে আড়াই টাকায়। জীতেন্দ্র-ববিতার সুপারহিট ফর্জ। ইশ্বরকণ্ঠী রফিসাহেবের গান - ‘সারা জাঁহা হ্যায় মেরে লিয়ে...।’ এরপরে আর স্বর্গ বলতে কী বোঝায়?

আরও পড়ুন
‘ম্যাস্টর’রা ইচ্ছে করেই ফেল করাচ্ছে নোদোকে, অভিমান বিধবা পিসির

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

আরও পড়ুন
গ্রামার বইয়ের আড়ালে বাজপাখির রক্তচক্ষু, ধরা পড়লেই পিঠে ভাঙত স্কেল

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More