সেইসব পাড়া-টারা – ৫
আগের পর্বে
লালাকাকুর ব্যাপারে বললে প্রসঙ্গেসূত্রেই নীলুকাকুর কথা উঠতে বাধ্য। গোয়ালা সম্প্রদায়ের ছেলে। বড়জোর ক্লাস টু কি থ্রি অবধি পড়াশোনা। লালুকাকুর সঙ্গে আমাদের রকে আড্ডা মারতে আসত বগলে গীতাঞ্জলি চেপে। গলা একেবারে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের মতো। তবে সে সময়ে যারা মদ্যপান করতেন তাঁদের মাতাল পদবি দেওয়া হত আবশ্যিকভাবে। গড়পাড়ের এমনই দুটি নাম হল দুলালজ্যাঠা আর বিলেকাকা। তবে এই মাতাল তকমার পিছনে লুকিয়ে ছিল এক আদ্য-প্রান্ত সুপার-হিউম্যান। পাড়ার সকলের যে কোনো বিপদেই রক্ষাকর্তা এই দু’জন। তবে এতটাই প্রচারবিমুখ যে তার সাড়া ফেলতেন না বিন্দুমাত্রও। কিন্তু তাঁদের সেই পরিচয় পাড়ার ক’জনই আর মনে রেখেছে?
বলি, অনেকক্ষণ তো ঘোরাঘুরি হল গড়পারে। এবার ওই গানের ভাষায় যাকে বলে - আরো গভীরে যাও। গভীরে বলতে শ্যামবাজার। দীনেন্দ্র স্ট্রিটের ওপর পার্কের গায়ে তিনতলা ইশকুলবাড়ি। স্মৃতিতে স্মৃতিতে মাখামাখি। সেই কবে, ৭০-এর দশকের প্রথম কয়েকটা বছর দুহাতে অনেক আগুন মেখেছিল আমাদের এই ইশকুল। তবে আগুন মাখার সাহস যে এই ইশকুল একদিন দেখাবেই তার প্রমাণ মিলতে শুরু করেছিল কিন্তু অনেক আগে থেকেই। সেটা কীরকম? একটা নমুনা ছাড়লেই ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আজো স্পষ্ট মনে আছে ঘটনাটা। সিক্স টপকে সেভেনে উঠেছি সেবার। সবে ক্লাস শুরু হয়েছে। পড়াশুনো তেমনভাবে চালু হয়নি। শীত যাই যাই করেও যাচ্ছে না। টিফিন টাইমে পিঠে রোদ সেঁকতে সেঁকতে আড্ডা মারছি ছাদের পাঁচিলে পা ঝুলিয়ে। নিচে পার্কের ছড়ানো ঘাসজমি, গাছগাছালি। স্কুলের গা ঘেঁষে একজায়গায় ডাঁই করে রাখা দেড়মানুষ সমান উঁচু বালির স্তুপ। পার্কের কোনো নির্মাণকাজের জন্যই সম্ভবত সেদিকে তাকিয়ে দলের মধ্যে সবচাইতে ডাকাবুকো, স্কুল জুনিয়ার টিমের গোলকিপার সুবীরের(আসল নাম নয়, ওকে দেখেই আমার ‘দ্রোহজ’ উপন্যাসে পুনে চরিত্রটা এঁকেছিলাম) চোখজোড়া হঠাৎই চকচক করে উঠল! “টারজান দ্য এপম্যান দেখবি?” ব্যাপারটা কি ঘটতে যাচ্ছে ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই “ইও ও উ ও” - বিখ্যাত সেই টারজানি হাঁক ছেড়ে সুবীরের ঝাঁপ তিনতলার ছাদ থেকে। তীব্র ত্রাস-আতঙ্কে মুহূর্তে চোখ বন্ধ সবার! চ্যাঁচানোর ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত হারিয়ে গেছে। ঠিক তখনি নীচ থেকে সুবীরের হো হো হাসি - “আবে ধসুর(ভীতুর) বাচ্চারা! এই দ্যাখ আমি!” ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখা গেল ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে প্যান্টের বালি ঝাড়ছে সুবীর। সেকেন্ড পাঁচেক বাদেই ফের চিৎকার - “ক্যালানের মত হাঁ করে দেকচিস কী? মার ডাইভ সব্বাই মিলে! এক্টুও লাগবে না। হেব্বি মজা মাইরি!”
অতঃপর আর কী? গুরু টারজানের অনুসারি হয়ে শিষ্য শাখামৃগবাহিনীর একের পর এক উল্লম্ফন পার্কে রাখা সেই বালির স্তুপে। সবার মুখে সেই টারজানসুলভ হুঙ্কার - ‘ইও ও উ ও!’
আরও পড়ুন
নিয়মিত মদ্যপান করায় জুটেছিল ‘মাতাল’ পদবি, পরোপকারে নোবেল পেতে পারতেন তাঁরাই
ব্যাস! সুবীরের ওই ঝাঁপ স্কুলে মহামারির চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ল ক্লাসে ক্লাসে। টিফিনের আধঘন্টা তখন যাকে বলে ‘ডাইভিং সেশন।’ রোজ রোজ ঝাঁপ খেয়ে পড়া নিচে। তারপর উঠে আসা স্কুলের পায়খানার পাঁচিল বেয়ে। ভালোমানুষের মত মুখ করে ঢুকে পড়া ক্লাসে। কিন্তু এরপরেও শেষরক্ষা হল না। কারণ দিনেন্দ্র স্ট্রিটের ওপর দিয়ে চলাচল করা ৩৬বি (সম্ভবত) বাসের যাত্রীরা।
সেদিন টিফিন টাইমে ডাইভিং সেশন চালাচ্ছিল ক্লাস টেনের দাদারা। চলন্ত বাস থেকে সহসা দৃশ্যটি চোখে পড়ে যায় যাত্রীদের মধ্যে কারো। পার্কের রেলিঙের সামনে বড় বড় দেবদারু গাছের ঢাল থাকার কারণে তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি পতনস্থলটা কোথায়? এরপরের পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়। গণ আত্মহত্যার আশঙ্কায় বাস থামিয়ে তীব্র চিৎকারসহ শ’খানেক যাত্রীর তীরবেগে স্কুলের মধ্যে ঢুকে পড়া। মুহূর্তের মধ্যে খবরটা পৌঁছে যাওয়া মাস্টারমশাইদের কানে। ফলে তখনো স্কুলে ঢুকতে না পারা হতভাগ্য ছাত্রদের বমাল গ্রেফতারি অবিলম্বে। ড্রিল টিচার ছবিদা। গোবরবাবুর আখড়ায় মুগুর ভেঁজেছেন এককালে। ইহুদি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প পরিদর্শনকারী গেস্টাপো চিফ হিমলারের মত হেসেছিলেন দুর্ভাগা ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে, “সবাই টারজান হয়েছ বাবা। কিন্তু আমি যে টারজানের ঠাকুর্দা হারকিউলিস।” এরপরের কাহিনি চরম মর্মান্তিক! সেসব আর না শোনাই ভাল।
আরও পড়ুন
ইস্টবেঙ্গল লিগ জেতায়, দুঃখে ‘দেশান্তরী’ হয়ে গিয়েছিলেন মোহনবাগানী লালাকাকু
ইশকুলে সুবীরের মোস্ট ট্রাস্টেড লেফটেন্যান্ট ছিল অপূর্ব আর অচিন্ত্য। দুই যমজ ভাই। নিবাস হেদো ঘেঁষা গোয়াবাগান অঞ্চলে। পাড়ার নাম টকাই ও বকাই। দুনিয়ার যত দুর্বৃত্তদের নিয়ে যদি একটা অলিম্পিক বা বিশ্বকাপ জাতীয় প্রতিযোগিতা হয়, টকাই-বকাইয়ের সেখানে যুগ্ম গোল্ডমেডেল একেবারে বাঁধা - দুভাইয়ের সম্পর্কে ইশকুলে এরকমটাই ধারণা ছিল প্রত্যেক শিক্ষকের। এহেন চূড়ান্ত বিরূপ ধারণার কারণ কী? বেশি না, মাত্র গোটাতিনেক স্যাম্পল দিলেই পাঠকরা উপরোক্ত ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হবেন বলেই এই প্রতিবেদকের স্থির বিশ্বাস।
এলাকায় যে গলিটায় টকাই বকাইদের বাড়ি সেই গলিটার একদম শেষপ্রান্তে পাড়ার ক্লাব। ক্লাবের গায়েই একটা বেজায় পুরনো বাড়ির ভাঙ্গাচোরা দেয়াল। এলাকার অন্যান্য অংশের তুলনায় জায়গাটা ছিল অপেক্ষাকৃত নির্জন। এরকম দেয়াল দেখলেই পাক বা না পাক, আম বাঙালির দাঁড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। ওই দেয়ালের পাশ দিয়ে শর্টকাট মেরে মানিকতলায় পড়া যেত। ফলে এলাকার নয় এরকম অনেকের যাতায়াত ছিল ওখানটা দিয়ে। এবার পথচলতি ওরকম একটা দেয়াল দেখলে কারো না কারো দাঁড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করবেই। প্রথমে কিচ্ছুটি বলা হত না। জলবিয়োগ সেরে গন্তব্যে পা বাড়ানোর মুখেই “ও দাদা, একবার আসবেন এদিকে” - হাঁক পড়ত ক্লাবের ভেতর থেকে। খানিকটা হতচকিত, অপ্রস্তুত অবস্থায় পথচারী ক্লাবের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে একটিও কথা না বলে আঙুল তুলে উল্টো ফুটপাতে দিকনির্দেশ করা হত। সেখানে একটা মান্ধাতা আমলের টিউবওয়েল, যার হ্যান্ডেল পাম্প করে একবালতি জল তুললে হাতের গুলি বিশ্বশ্রী মনোহর আইচের মট হয়ে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। পাশে গাম্বাট সাইজের একটা লোহার বালতি। কল ঘেঁষা দেয়ালে পেরেক মেরে টাঙানো ঢাকনা চেরা একটা টিনের কৌটো। কৌটোর গায়ে আলকাতরা দিয়ে ধ্যাবড়া অক্ষরে লেখা - ‘প্রস্রাবের পর পাঁচ বালতি জল দেয়ালে ঢালুন এবং কৌটায় জরিমানা হিসাবে আটআনা ফেলুন।’ ণীচে লেখা - ‘ক্লাবের সদস্যবৃন্দ।’ এরকম একটি ক্লাবের সদস্য হিসেবে টকাই বকাইদের ক্রেডেনশিয়াল যে শিক্ষকদের মতামতের সঙ্গে একশো শতাংশ মিলে যাবেই তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে?
আরও পড়ুন
‘ম্যাস্টর’রা ইচ্ছে করেই ফেল করাচ্ছে নোদোকে, অভিমান বিধবা পিসির
ওপাড়ার ছেলেপুলেদের আরেকটি রোমহর্ষক কার্যকলাপের কথা শোনাই এবার। ঘটনাটা ঘটত মূলত শীতকালে। অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হবার পর দীর্ঘ ছুটির সময়। তখনো হেদো ঘেঁষা ওইসব অঞ্চলে প্রচুর গাছপালা ছিল। সন্ধে নামলেই গলির মোড়ে ওইরকম একটা ঝাঁকড়া কদম গাছে চড়ে বসে থাকত ওপাড়ার ছেলেরা, গাছতলায় রাখা পালিশ করা ঝকঝকে একপাটি জুতো অথবা চপ্পল। কোনো বেচারা নিরীহ পথচারী লোভে পড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে জুতোয় পা গলানো মাত্র “তবে রে শুওরের বাচ্চা জুতোচোর!”- বলে সগর্জনে গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ত সবাই। অতঃপর চড়চাপড়, কান ধরে ওঠবোস করানো ইত্যাদি নানাবিধ শাস্তিপ্রদান। নাকের জলে চোখের জলে হেনস্থার একশেষ হয়ে পালানোর পথ পেত না বেচারি নিরীহ পথচারী।
বাংলায় বহু পুরনো একটা গান আছে না। ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।’ টকাই-বকাইদের ক্লাবের কপালেও ঠিক তাই ঘটল। বেশ কিছুকাল এরকমটা চলতে চলতে সম্ভবত কোন ভুক্তভোগী পথচারী সাহসে ভর করে স্থানীয় থানায় গিয়ে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানান। পরদিন সন্ধের মুখে মুখে থানার তরফ থেকে অতীব তাগড়া চেহারার কয়েকজন সাদা পোশাকের কনস্টেবলকে ব্যাপারটা সরজমিনে তদন্ত করে দেখতে এলাকায় পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে গিয়ে জুতোয় পা গলাতেই যথারীতি রণহুঙ্কারে গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে সবাই। বাকিটুকু বোধহয় আর না বললেও চলবে। পাড়ার বয়স্করা গিয়ে দারোগাবাবুর প্রায় হাতেপায়ে ধরে গভীর রাতে থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন সবাইকে। পুলিশি হেফাজতে অশেষ দুর্গতিটাও ফিকে হয়ে গেছিল পাড়ায় ফিরে। ফলে জুতোচোর খেলাটা বন্ধ হয়ে গেলেও টিউবওয়েল পাম্প গেমটা কিন্তু স্বমহিমায় চালু ছিল এরপরও বহুকাল।
আরও পড়ুন
গ্রামার বইয়ের আড়ালে বাজপাখির রক্তচক্ষু, ধরা পড়লেই পিঠে ভাঙত স্কেল
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor