নিয়মিত মদ্যপান করায় জুটেছিল ‘মাতাল’ পদবি, পরোপকারে নোবেল পেতে পারতেন তাঁরাই

সেইসব পাড়া-টারা – ৪

আগের পর্বে

যে বাড়ির একতলায় জন্ম, সেই বাড়িতেই দুতলা আর তিন তলায় বসবাস ছিল হাইকোর্টের জজ সাহেব এন সি চ্যাটার্জির। তাঁর সেজো ছেলে লালা কাকু ছিলেন পরিবারের ‘ব্ল্যকশিপ’। পাড়ার ললনা-মহলের চূড়ান্ত আকর্ষন সেই মোহনবাগান-পাগল লালাকাকু ডার্বি জিতলে সারা ফেলে দিতেন গোটা পাড়ায়। চলত দেদার মিষ্টি বিতরণ। ১৯৬৬ সাল। সেবার মোহনবাগান কলকাতা লীগ জিতলেই ছুঁয়ে ফেলবে মহামেডানের রেকর্ড। কিন্তু শেষ অবধি সেবার হাসল ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরাই। দুঃখে বাড়ি ফিরলেন না লালাকাকু। রাতে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করল গঙ্গার ধারের বেঞ্চিতে শায়িত অবস্থায়। পুলিশের গাড়িতে করেই বাড়ি ফিরলেন লালাকাকু।

উত্তম ছাড়া যেমন সুচিত্রা হয় না, রোমারিও ছাড়া যেমন বেবেতোকে অসম্পূর্ণ লাগে, সচিন-সৌরভের মধ্যে কেউ একজন আগেভাগেই আউট হয়ে গেলে যেমন খেলার তালটাই যায় কেটে, ঠিক তেমনি নীলুকাকাকে ছাড়া লালাকাকুকে একটা ফ্রেমের মধ্যে আনাটা এককথায় বলতে গেলে - অসম্ভব। ফলে নীলুকাকাকে পিকচারে আনতেই হল। শ্রী নীলু মারিক। পাড়ায় বেশ গোয়ালা সম্প্রদায়ের ছেলে। সেই এতটুকু বয়েস থেকে লালাকাকুর অভিন্নহৃদয় বন্ধু। পাড়ায় সবাই ডাকতো ‘হিল অ্যান্ড হাফসোল।’ এহেন নীলুকাকার মধ্যে সেই ছেলেবেলা থেকেই জজসায়েবের ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করে নিজের শ্রেণী বলা ভালো সম্প্রদায় সম্পর্কে কীরকম একটা প্রত্যাখ্যানের ভাব এসে গেছিল। কারণ নীলুকাকার নিজস্ব বয়ানে গয়লারা কথায় কথায় মাথাগরম করে মারামারি করে, কাঁচা গালাগাল দেয়। তাদের ডিকশনারিতে ‘শ’ নামের কোনো শব্দ নেই, পুরোটাই ‘স’। অন্যদিকে ছিপছিপে চকলেট হিরো মার্কা চেহারার নীলুকাকা সবকিছুতেই যাকে বলে গিয়ে চূড়ান্ত স্টাইলিশ। নিজের খুড়ততো ভাই বিশালদেহী ব্যায়ামবীর সুধীরকাকার সঙ্গে কুস্তি লড়তে নেমেছিল পর্যন্ত টকটকে লাল রঙের সিল্কের ল্যাঙট পড়ে। 

এহেন নীলুকাকা সন্ধে হলেই চলে আসত আমাদের লাল রকে, লালাকাকুদের আড্ডায়। ঘাড়ে দু-ইঞ্চি পুরু কিউটিকুরার প্রলেপ, ফিনফিনে গিলে করা সিল্কের পাঞ্জাবী। নিম্নাঙ্গে উত্তমকুমার মার্কা ধাক্কাপাড় ধুতি অথবা আলিগড়ি চোস্ত পাজামা। কান্তা সেন্টের গন্ধে মাতমাত চারপাশ। নিজে টেনেটুনে ক্লাস টু কি থ্রি, কিন্তু বগলে সর্বদা গীতাঞ্জলী। মাঝেমাঝেই আক্ষেপ করতো আমার মায়ের কাছে - “বুঝলেন বৌদি, এই গয়লাদের না কালচার বলে কিস্যু নেই।” তবে হ্যাঁ, নীলুকাকার রবীন্দ্রসঙ্গীতের গলাটা ছিল ইংরিজিতে যাকে বলে ‘জাস্ট আনইমাজিনেবল!’ চোখ বুজে শুনলে পুরো চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। আপার সার্কুলার রোডের ওপর লাল রকের গায়ে সন্ধে গড়িয়ে যখন রাত নটায় পৌঁছত। মানিকতলার মোড় থেকে ভেসে আসা ফিনফিনে মিঠে হাওয়া। “একটা ধর নীলে।” বন্ধুর দিকে তাকিয়ে অনুরোধ লালাকাকুর। ব্যস! মুহূর্তে কোথায় উধাও লাল রক, ট্রামলাইন, শ্রীমানিবাজারের ফুটপাত, পুরো চত্বরটাই তখন জোছনায় ভেসে যাওয়া খোয়াইয়ের পাড় নয়তো ভুবনডাঙার মাঠ! চরাচর জুড়ে শুধু চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। ‘বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা / বইলো প্রাণের দখিন হাওয়া….’ মনে হত সত্যিই - বসন্ত এসে গ্যাছে!               

যে সময়ের কথা লিখছি, সমাজের নিয়মকানুন তখন বেশ খানিকটা রক্ষণশীলই ছিল বলতে গেলে, বিশেষত উত্তর কোলকাতার পুরনো পাড়াগুলোয়। যারা নিয়মিত মদ্যপান করতেন তাদের খানিকটা ছোটো নজরেই দেখা হত। নামের পিছনে আবশ্যিকভাবে পদবি যোগ হত মাতাল। গড়পাড়ে এরকমই পদবি-সম্পন্ন তিনজন ছিলেন সুধীরজ্যাঠা, দুলালজ্যাঠা আর বিলেকাকা। এরমধ্যে প্রথমজনের সম্পর্কে যেহেতু অন্য একটি পর্বে লিখেছি ফলে ওদিকে আর গেলাম না। তারচে বরং বাকি দুজনের কথাই বলি। প্রথমজন দুলালজ্যাঠা। অকৃতদার এই মানুষটি ছিলেন পাড়ার যত কুচোকাঁচাদের নিত্যরোজের সান্তাক্লজ। নিজে পেশাসূত্রে ছিলেন স্যাক্সবি ফার্মার না রেমিংটন র্যা ন্ড কোন যেন একটা নামী কোম্পানির ডিপার্টমেন্টাল হেড মেকানিক। রোজ সন্ধেবেলায় একটু রসস্থ অবস্থায় পাড়ায় ঢুকতেন হাতে বড় বড় কয়েকটা ঠোঙা নিয়ে। জ্যাঠাকে দেখলেই ঘিরে ধরত পাড়ার কুচোকাঁচাগুলো। ঠোঙা থেকে সেই ‘ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া’-র ম্যাজিকের মতো বেরিয়েই আসতে থাকত দাদুর হোটেলের ডিমের ডেভিল, প্রতিভার ঢাকাই পরোটা, মর্টনের লেবু লজেন্স, সাউজীর কুচো নিমকি... এরকম আরো কতকিছু। উত্তরপাড়ায় মেজভাইয়ের বানানো নতুন বাড়িতে পাকাপাকিভাবে চলে না যাওয়া পর্যন্ত এ নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটেনি একদিনের জন্যও। 

এবার বিলেকাকার গল্প। দুলালজ্যাঠার মতই কনফার্মড ব্যাচেলার বিলেকাকার আয়ের রাস্তা বলতে ছিল নিজস্ব একটি ট্যাক্সি। টাকা দিয়ে ভাইদের সংসারে খেতেন। লালাকাকুর মতোই উন্মত্ত মোহনবাগানি। ক্লাবে অসম্ভব জনপ্রিয়। জহর গাঙ্গুলী, বলাইদাস চাটুজ্জে, মান্না দে, চুনী গোস্বামীদের মত সেলিব্রেটি সব মোহনবাগানিরা অসম্ভব স্নেহ করতেন বিলেকাকাকে। ফলে মোহনবাগানের খেলা থাকলে ওসব ট্যাক্সিফ্যাক্সি মাথায় উঠত। সেদিন শয়নে স্বপনে শুধুই সবুজ মেরুন। সেই ছেলেবেলায় আমাদের কাছে মূল আকর্ষণ ছিল প্রতি শনিবার বিলেকাকার ট্যাক্সিতে আধঘণ্টাটাক এলাকায় চক্কর বা জয়রাইড। রাত আটটা-নটা নাগাদ পাড়ায় ঢুকেই জড়ানো গলায় হাঁক ছাড়তেন বামুনজী-রতনজী অথবা পেয়ারাবাগানের বাংলা-দোকানফেরত বিলেকাকা - “কোথায় গেলি রে সব ট্যাবলেট ক্যাপসুলের দল।” শোনামাত্র হুড়মুড়িয়ে এসে গাড়িতে সেঁধিয়ে যেত পাড়ার যত বাচ্চারা। ডবল মজার টানে। ডবল মজা বলতে জয় রাইডের শেষে মাস্ট মোহন সাউয়ের ডালমুট!

আরও পড়ুন
ইস্টবেঙ্গল লিগ জেতায়, দুঃখে ‘দেশান্তরী’ হয়ে গিয়েছিলেন মোহনবাগানী লালাকাকু

দুলালজ্যাঠা অথবা বিলেকাকা, দুজনেরই একটা কমন ফ্যাক্টর ছিল। সহজাত গুণ। সেটা হল নিঃস্বার্থ পরোপকার। কন্যাদায় থেকে শ্মশানযাত্রার খরচ, হাসপাতালে রাত জাগা থেকে রক্তদান, পাড়ায় সব ব্যাপারে আগে দুজন। এলাকার কত দুঃস্থ পরিবারকে যে সেসময় সাহায্য করেছেন এঁরা, তার লেখাজোখা নেই। আর সেটা করতেনও এমন গোপনে যাতে ডানহাতে দিলে বাঁহাত টের না পায়। এতটাই প্রচারবিমুখ ছিলেন দুজন।

আজ এই এতদিন বাদে অবাক হয়ে ভাবি এরকম দুজন সুপার হিউম্যান স্পিসিস অন্তর্ভুক্ত মানুষের পিঠে সমাজ কীভাবে স্রেফ মাতালের তকমা সেঁটে দিয়েই নিজের দায় সেরেছিল! তবে মন খারাপ করবেন না দুলালজ্যাঠা, বিলেকাকা। এই অধম প্রতিবেদকের বিচারে ইতিমধ্যেই নোবেল প্রাইজ থেকে ভারতরত্ন, দুনিয়ার তাবৎ পুরস্কার পেয়ে গেছেন আপনারা। শুধু নিজে চোখে দেখে যেতে পারলেন না, এই যা।

আরও পড়ুন
‘ম্যাস্টর’রা ইচ্ছে করেই ফেল করাচ্ছে নোদোকে, অভিমান বিধবা পিসির

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
গ্রামার বইয়ের আড়ালে বাজপাখির রক্তচক্ষু, ধরা পড়লেই পিঠে ভাঙত স্কেল

More From Author See More