সেইসব পাড়া-টারা – ৩
আগের পর্বে
গলি গড়পারের নোদোদা। আধ ডজন গৃহশিক্ষক, দিনের ১২ ঘণ্টা বাগদেবীর আরাধনা, পরীক্ষার আগে চন্দনের ফোঁটা— ম্যাট্রিকে কোনোকিছুই রক্ষা করতে পারত না নোদোদাকে। কারণ? ‘ম্যাস্টর’ প্রজাতির শ্রেণীশত্রুরা, এমনটাই সুর করে গলা চড়াতেন বিধবা পিসি। পাড়ায় নামও হয়েছিল ‘মাথামোটা নোদো’। কিন্তু বিনা মেঘে বাজ পড়ার মতই এসেছিল খবরটা। ষষ্ঠ প্রচেষ্টায় ‘ম্যাট্রিক’-চ্যানেল পার হয়েছিল নোদোদা। সেই উপলক্ষেই বিরাট ‘বিজয়’-মিছিল ঘুরেছিল উত্তর কলকাতার গলিতে গলিতে...
নোদোদার গল্প হল আর লালাকাকুর গল্প হবে না? সারকুলার অধুনা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে শ্রীমাণি বাজারের ঠিক উল্টোদিকে যে বাড়িটার একতলায় আমার জন্ম, তার দোতলা আর তিনতলা জুড়ে থাকতেন হাইকোর্টের জজসাহেব এন সি চ্যাটার্জি(স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পিতৃদেব নন)। বেজায় রাশভারী ধরনের মানুষ। ওঁর স্ত্রীকে রাঙাঠাম্মা বলে ডাকতাম আমি। ভারি শান্ত আর কোমল স্বভাবের মানুষটি। মিঠে একটা হাসি সর্বদা ঠোঁটের কোণে। জ্ঞান হয়ে ইস্তক দেখা ওঁর চার ছেলে। তারমধ্যে বড় রামকাকু, উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা। মেজ কানাইকাকু, মেদিনীপুর না কোথাকার একটা জেলাশাসক যেন সেসময়। ছোটছেলে হরলালকাকু খড়গপুর আই আই টি-তে পাঠরত। বোর্ডিং-এ থাকে। ছুটিছাটায় বাড়ি আসে মাঝেসাঝে। এহেন যে পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড অথবা ক্রেডেন্সিয়াল, সেই পরিবারে তুলনামূলকভাবে বলতে গেলে খানিকটা ‘ব্ল্যকশিপ’ ছিল লালাকাকু। পরিবারের সেজোছেলে। পঃ বঙ্গ সরকারের নিম্নবিভাগীয় করণিক। অসম্ভব রূপবান। একইসঙ্গে চূড়ান্ত রসিক এবং সপ্রতিভ। পাড়ায় অসম্ভব জনপ্রিয়। বাড়িতেও তাই। রাঙাঠাম্মার আদরে বেশ খানিকটা প্যামপারড-ও। এসব কারণেই পাড়ার ললনামহলেও জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। কিন্তু লালাকাকুর জীবনে প্রেম মাত্র একটিই - মোহনবাগান। দল জিতলে বন্ধুবান্ধব সহযোগে প্রবল উল্লাসে পাড়ায় ফেরা। আর লিগ বা শিল্ড চ্যাম্পিয়ন হলে তো কথাই নেই। ঘোড়ার গাড়ির মাথায় সবুজ-মেরুন পতাকা আর গ্যাস বেলুন বেঁধে, ইন্দ্রর রসগোল্লা নিয়ে সবান্ধবে এলাকায় প্রবেশ। উল্লাসের পরিমাণ দ্বিগুণ স্বাভাবিকভাবেই, সন্দেহ নেই। পাড়ায় ঢুকে প্রথমেই আমাদের ঘরের পর্দা তুলেই এই অধমের দিকে তাকিয়ে বিটকেল একটা খ্যা খ্যা হাসি - “কিরে বাঙাল? কিরম দিলুম? নে নে, রসগোল্লা খা!” পরমুহূর্তেই জানলা দিয়ে বাড়িয়ে ধরা দুটো গরম রসগোল্লা।
সেটা ১৯৬৬ সাল। গত চার বছর কলকাতা ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মোহনবাগান। আর একবার মানে এইবছরটা চ্যম্পিয়ন হতে পারলেই মহামেডান স্পোর্টিং-এর পাঁচবার লিগ জেতার রেকর্ডটাকে ছুঁয়ে ফেলবে। কিন্তু বাংলার আপামর মোহনবাগান সমর্থকদের দুঃখ ও হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করে সেবার লিগ জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। পুরো পাড়া জুড়ে সেদিন শ্মশানের নিস্তব্ধতা (একমাত্র আমাদের মত হাতেগোনা দুয়েকটা বাড়ি ছাড়া)! ওয়াটারলুর যুদ্ধে বিদ্ধস্ত নেপোলিয়ানের মত মুখ করে পাড়ায় ফিরেছিল লালাকাকু আর বন্ধুরা। পর্দা তুলে বাড়িয়ে ধরা হয়নি ইন্দ্রর রসগোল্লা!