সেইসব পাড়া-টারা : ২
আগের পর্বে
আজকের কলকাতা নয়, সাদাকালো রূপকথার একটা নস্টালজিয়ামাখা সময়। তাও উত্তর কলকাতা। আর উত্তর মানেই সরু গলি, তস্য-গলি সম্বলিত এক মায়ানগরী। সেসব গলি যেন সারাক্ষণই কান পেতে থাকত সাবেকি মধ্যবিত্ত বাড়ির জানলায়। এপাড়-ওপাড়ের মাঝে শুধু একটা ঝুলের আস্তরণ। সে সুযোগ করে দিত পাড়ায় আসা নতুন বৌদির সঙ্গে সুবোধ ফাজলামি করার। তবে অ্যাথেনিয়াম ইশকুলে পড়া দক্ষ পচু-ও একদিন ধরা পড়ল। অদৃশ্য ব্যারিটোন ভয়েসের পিছন থেকেই বেরিয়ে এল নিমডাল চেহারা। অতঃপর ‘ফুট’ কাটার জন্য ফুটবল হয়েই পদাঘাত সহন। সেই আর্তনাদ শোনা গিয়েছিল মানিকতলার মোড় অবধি...
পরের ঘটনাটা বাবার কাছে শোনা। গলি গড়পারের নোদোদা। বারপাঁচেক চেষ্টা করেও ম্যাট্রিক পরীক্ষা নামক ভয়ঙ্কর দুর্গম ও উত্তাল সমুদ্র পার হতে পারছিল না কিছুতেই। পিতৃদেব পুলিশ কোর্টের পেশকার, তাই অর্থের অভাব নেই স্বাভাবিকভাবেই। ফলে বিভিন্ন সাবজেক্টের জন্য সব মিলিয়ে প্রায় আধডজন গৃহশিক্ষক। এই শিক্ষককূলের কড়া তত্ত্বাবধানে দিনে গড়পড়তা বারো ঘণ্টা বাগদেবীর আরাধনা চালাত নোদোদা। পরীক্ষা সামনে এগিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা নিয়ে সেই সময়টাও বাড়ত, বলাই বাহুল্য। অতঃপর একদিন পরীক্ষা জাগ্রত দ্বারে। মা-পিসির দেওয়া গোবদা সাইজের একটা দই-চন্দনের টিপ কপালে দেগে পিছন থেকে সমবেত ‘দুগগা দুগগা’ মঙ্গলধ্বনি শুনতে শুনতে পরীক্ষা হলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিত নোদোদা। পরীক্ষা শেষে মাস দেড়-দুইয়ের অবসর। রেজাল্ট বেরোলে দেখা যেত কমপক্ষে গোটা তিনেক সাবজেক্টে তাপমাত্রা হিমাঙ্কেরও নিচে। অতঃপর প্রায় গোটা একটা দিন জাঁদরেল পেশকার পিতৃদেবের হাড় হিম করে দেওয়া ভয়ঙ্কর সব গর্জন আর বিধবা পিসি সুরবালা ঠাকুরানীর দুনিয়ার যত ‘ম্যাস্টর’ প্রজাতির শ্রেণীশত্রুদের প্রতি অকুণ্ঠ অভিসম্পাত বর্ষণ! সুরোঠাকরুনের ধারণায়, ওইসব ড্যাকরা মাস্টার আর এগজামিনাররাই নাকি ইচ্ছে করেই তার হিরের টুকরো নোদোটাকে ফেল করিয়ে দিচ্ছে বারবার। পরদিন থেকেই গৃহের পটচিত্রে আমূল পরিবর্তন। গৃহশিক্ষকদের আগমন এবং নোদোদার পুনঃপ্রবেশ প্রত্যহ বারো ঘণ্টার সেই পরীক্ষা প্রস্তুতি নামক রণাঙ্গনে!
পরদিন সন্ধের মুখে মুখে গলি গড়পার থেকে বেরোল মিছিলটা। মিছিলের প্রথমেই রাজাবাজারের সেই দুনিয়াসেরা আলেকজান্ডার তাসাপার্টি (দলের সদস্যদের মাথার টুপিটি গ্রিক সম্রাটের শিরস্ত্রাণের অনুকরণে হওয়ার কারণেই দলের এহেন নাম)। তাঁসা আর ব্যাঞ্জোর তালে তালে সামনে নৃত্যরত পাড়ার দুশো শাম্মীকাপুর। ঠিক তার পিছনেই যুগিপাড়া থেকে নিয়ে আসা শতদল ব্যান্ডের পাশে-পাশে গম্ভীরমুখে পথ হাঁটছেন পাড়ার বয়স্করা আর এই গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখেই বাঁশিতে সুর তুলেছে ব্যান্ডবালিকারা - ‘উঠো গো ভারতলক্ষী..।’ মিছিলের একদম শেষে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি। গ্লোবলাইটের আলোয় আলোকময়। গাড়ির ওপরে নবনির্বাচিত সাংসদ বা বিধায়কের মতো নমস্কারের ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো নোদোদা। পরনে দুধশুভ্র পাটভাঙ্গা ধুতি পাঞ্জাবি। মুখে ভুবনভোলানো এক স্বর্গীয় হাসি। পাউডারচর্চিত গলায় মণখানেক রজনীগন্ধা আর গোলাপের মালা। গাড়ির সামনে ঝোলানো সিল্কের শালুতে লেখা - ‘পাড়ার নোদোর মাট্রিক চ্যানেল অতিক্রমের সম্মানে পল্লীবাসীর সশ্রদ্ধ নিবেদন।’ নোদোদার দুইপাশে দাঁড়ানো দুই পল্লীবালিকা, মাঝেমাঝেই ফোয়ারাদানি থেকে গোলাপজল ছিটিয়ে দিচ্ছে জনতার মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে হররা উঠছে ভিড়ের মধ্যে থেকে। “ম্যাট্টিক চ্যানেল পেরোল কে? নোদো নোদো আবার কে!” “পাড়ার মান রাখল কে? নোদো নোদো আবার কে!” “ও নিতাই, ও বকু, কি হোয়েচে? বলি ব্যাপারটা কী?” - জাফরিকাটা ঝুলবারান্দার রেলিং থেকে ঝুঁকে প্রশ্ন করছেন মাসীমা-কাকিমা-বৌদিরা। “নোদো ম্যাট্টিক পাস করে গ্যাচে মাসীমা!” চেঁচিয়ে জবাব দিচ্ছে রক কমিটি। পরমুহূর্তেই ঘুরে কড়া ধমক। “অ্যাই নোদো! ওরকম ভ্যাবলা মেরে দাঁড়িয়ে রয়েচিস ক্যানো? বৌদিদের নোমস্কার কর!” সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে সে আদেশ পালন করছে নোদোদা।