সেইসব পাড়া টারা - ১৮
আগের পর্বে
কলকাতায় ফিরেছিল রাজাদা। অ্যাকিউট লাং ক্যানসার। লাস্ট স্টেজ। যেদিন দেখা করতে যাই, একটা চিরকুটে লিখে দিয়েছিল ‘আমি ভালো নেই। তোমরা ভালো থেকো।’ পরেরদিনই চলে গিয়েছিল রাজাদা। পার্ক সার্কাস আক্ষরিক অর্থেই ‘কসমোপলিটন’। ছিল ব্যাং ব্যাং ক্লাব। সদস্যতে হিন্দু, মুসলমান, চিনা, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাদ ছিল না কেউ-ই। গান আর নেশার মধ্যে ডুবে থাকা সেই ক্লাব থেকেই দোলের দিন বেরত শোভাযাত্রা। আবার সত্যজিতের অপমান সহ্য না করতে পারা শাঁসালো মক্কেল ছেড়েছিলেন রহমান সাহাব। দুর্গাপুজোর বাঁশ পড়তে দেরি হলেও এগিয়ে আসতেন মুসলিম যুবকরা। উৎসব বন্ধ হওয়ার মুখে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন তাঁরাই। এসবই মিশে ছিল পার্ক সার্কাসের পরিবেশে। আলাদা করে ‘সম্প্রীতি’ বলে চিহ্নিত করতে হত না তাদের।
আপনারা যাঁরা চায়না টাউনে মাঝেমধ্যেই উইক এন্ড বা ছুটিছাটায় মাঞ্চুরিয়ান চিকেন বা আমেরিকান চপ স্যুই সহযোগে, ২৫/৫০ টাকা বোতলপিছু এক্সট্রা মূল্যে বিয়ার হুইস্কিসহ নানাবিধ মদিরানন্দে মাততে যান এবং পানাহার শেষ হলেই ঝাপসা চোখে উবের-ওলা অথবা স্ব-কারে এলাকাটাকে অনেক পেছনে ফেলে চলে আসেন, তাদের উদ্দেশ্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ, দিনের বেলায় সাদা চোখে একবার যান ট্যাংরার চিনেপাড়ায়। দেখে আসুন চিনা কালীমন্দিরে সেই কবে কলকাতার ঘাটে পা রাখা প্রথম চৈনিক ব্যবসায়ী টং আছুর বেঁচেকুচে থাকা কিছু উত্তরসুরির হাতে আজো কি নিষ্ঠাভরে পূজিতা হচ্ছেন শাড়ি পরিহিতা নৃমুণ্ডমালিনী। দেখুন চিনা স্কুল লিং লং। ড্রাগন ডান্স দেখতে পাড়ি দেন লাচুং-লে-লাদাখ কোথায় না কোথায়। অথচ হাতের কাছে আরশিনগরের পড়শিদের খোঁজটাই নেওয়া হয় না। তাই বলি কী, ওসব লাদাখটাদাখের দরকার নেই। চিনা নববর্ষের দিন এলাকায় গেলেই দেখতে পাবেন ড্রাম-কেটল সহযোগে মানুষের পায়ের তালে তালে মাথার ওপর নাচছে রং ঝলমলে বিশাল ড্রাগন। সাঁওতাল পরগনার হাটবাট ছাড়া মুরগীর লড়াই দেখেছেন কখনো? শীতকালে প্রতি রোববার সকালে চিনা কালীমন্দিরের পাশের গলির মাঠে চলে মুর্গির লড়াইয়ের কম্পিটিশন। এতিপেতি নয়, হায়দ্রাবাদ, লখনও, ইলাহাবাদ, জৌনপুর থেকে নিয়ে আসা দশ-বিশহাজারি আসিল (আসল) খানদানি লড়াকু মোরগা সব। তবে সাঁওতাল হাটের মত ওই নখে চাকু বেঁধে নৃশংস খুনোখুনির ব্যাপারটা নেই। নিখাদ স্পোর্টস। অনেকটা ওই জাপানের সুমো রেসলিং-এর মতো। যে তার প্রতিদ্বন্ধীকে ঠেলে রিঙের বাইরে বের করে দিতে পারবে সেই মোরগই বিজয়ী। একমাত্র চিনেপাড়া ছাড়া আর কোথাও দেখা পাবেন না এসবের। তাই আবার বলছি, সময় থাকতে থাকতে অবশ্যই একদিন যান, ট্যাংরার চিনেপাড়া ‘প্রায়’ থেকে আক্ষরিক অর্থেই বিলকুল অ-চিনা হয়ে যাবার আগেই।
যাকগে, আবার মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এ শহর ছেড়ে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর নিষ্ক্রমণ পরবাসে। তবে প্রতিবেদকের মতে একে নিষ্ক্রমণ না বলে মহা গণনিষ্ক্রমণই বলা ভালো বোধহয়। আ ম্যাসিভ মাস এক্সোডাস! আর এই এক্সোডাসের পালে শেষ হাওয়াটা এসে লাগল ’৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর। পার্ক সার্কাসে এর দ্বিমুখী ফল দেখা গেল। প্রথমত ভিনরাজ্যের বিশেষত গুজরাত এবং উঃ প্রদেশের অনেক সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীরাই ভাবতে শুরু করলেন তাদের নিজেদের রাজ্য আর তাদের জন্য নিরাপদ নয়। অন্যদিকে স্থানীয় বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মনেও এই পাড়া সম্পর্কে একই ধারণা বলা ভালো ত্রাস বদ্ধমূল হয়ে গেড়ে বসলো। ভবিষ্যতে ফের যদি কিছু ঘটে যায়! নিজে চার যুগের ওপর বাস করছি এই এলাকায়, দ্বায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, গোটা দাঙ্গার সময়টায় এলাকার একটিও হিন্দু বাড়িতে একটিও ঢিল ছুঁড়ে মারতে আসেনি কেউ, অথচ সেই বাঙালি হিন্দুরাই এপাড়ার পাট ওঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রাতারাতি। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে সচেষ্ট হলেন অবাঙালি ধনী সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীরা। এই অঞ্চলে ফ্ল্যাট, বাড়ি অথবা স্থাবর সম্পত্তির দাম সাধারণত যা হতে পারে তার তুলনায় সেই সম্পত্তির দাম দ্বিগুণ এমনকি তিনগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিলেন তারা। কম দামে কিনে নেওয়া নয়, ভীতিপ্রদর্শন তো নয়ই, স্রেফ হঠাৎ পেয়ে যাওয়া অকল্পনীয় বর্ধিত দাম আর অহেতুক একটা ত্রাস, এই দুয়ের কাছে হেরে গেলেন তারা। সেটা যদি না হত তাহলে এই অধম প্রতিবেদকের পক্ষে বাবরি কাণ্ডের প্রায় তিরিশ বছর পরেও এতটা সসম্মানে পার্ক সার্কাসের এই সংখ্যালঘু পাড়ায় আজো থেকে যাওয়া সম্ভব হত না। এ মহল্লায় যেখানে আমার বাস, সেই সামশুল হুদা রোডে, হিন্দু জনসংখ্যা যেখানে কমতে কমতে মাত্র গোটা ছয়েক পরিবারে এসে ঠেকেছে, সেখানে আজও মহাসমারোহে দুটি দুর্গা পূজা এবং দুটি কালী পুজো সংগঠিত করাও সম্ভব হত না কিছুতেই। যারা এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছিলেন বহুকাল আগে, তারা আজো এসে এইসব পুজোয় উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করেন। পুজোর সময় এপাড়ায় এলেই তার প্রমাণ মিলবে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি সামশুল হুদা রোড ছাড়াও পার্ক সার্কাস এলাকার গোটা বিশেক পুজোর মধ্যে একটিও বন্ধ হয়নি এই এতগুলো বছরে, বরং বেড়েছে দুয়েকটা। জৌলুশ যেটুকু কমেছে সেটা অর্থবল এবং জনবলের অভাবে। আর অন্য কোনো কারণ খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন এর মধ্যে। দীর্ঘকাল এই এলাকার বাসিন্দা হিসাবে ফের একবার অত্যন্ত দায়িত্ব নিয়েই বলছি কথাটা।
যাই হোক, বাঙালি হিন্দুদের ছেড়ে যাওয়া ফ্ল্যাট আর বাড়িগুলোয় এসে ঢুকলেন অবাঙালি সংখ্যালঘু শ্রেষ্ঠীরা। দুগ্যি ময়দানের ওপরে আমাদের বারো ঘরের ফ্ল্যাটবাড়ির মধ্যে শুধু আমাদের পরিবারকে বাদ দিয়ে বাকি এগারোখানাই খালি হয়ে গেল দেখতে দেখতে। চলে গেল গুজরাতি মুসলিম ব্যবসায়ী পরিবারগুলোর দখলে। এই একই ঘটনা ঘটল অন্যান্য বাঙালি হিন্দু বাড়িগুলিতেও। যারা এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলেন না সেইসব শ্রেষ্ঠীরা হাত বাড়ালেন অন্যদিকে। এলাকায় বিপুলসংখ্যক বস্তি, এপাড়ার ভাষায় ‘খোলাবাড়ি’, তাদের মালিকদের টোপ দিতে শুরু করলেন তারা। মালিকরা সেই কোন আদ্যিকেলে জমিদারি ঠিকা টেনেন্সি অ্যাক্টের প্রজা। পাকা বাড়ি তোলা অত্যন্ত জটিল পদ্ধতি। হাজারটা আইনী ঝুটঝামেলা। আর সেই রন্ধ্রপথেই ঢুকল ইললিগাল অর্থাৎ বেআইনি নির্মাণের কালসাপ। এপাড়ার লব্জে ‘আনলিগাল’ বিল্ডিং’। খোলাবাড়ি ভেঙ্গে মাথা তোলা সার সার সব বেআইনি বহুতল। সস্তা নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে তোলা রাতারাতি। প্রোমোটার নামক বাহুবলী, পুলিশ, প্রশাসন আর পার্টির ঝুলি উপচে পড়তে শুরু করল ‘আনলিগাল’ লক্ষীর কৃপায়। এতে খোলাবাড়ির আদি বাসিন্দা ‘সন অফ দ্য সয়েল’ সাধারণ সব দরিদ্র মুসলমান ভাড়াটিয়াদের আদৌ কোন উন্নতি তো হলই না, উলটে অবনতিই হল বলা চলে। একতলায় বাহুবলী প্রোমটারের ভীষণ অযত্নে বানিয়ে দেওয়া কবীর সুমনের গানের সেই ‘দশফুট বাই দশফুট’ জানালাহীন অন্ধকার খুপড়ি ঘর। বসবাসের অযোগ্য নারকীয় পরিবেশ। যাদের কপালে তাও জুটল না তাদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে ভাগিয়ে দেয়া হল আক্রা-সন্তোষপুর, বাখড়াহাট, খাল গড়িয়া, মল্লিকপুর। এদিকে দোতলায় উঠলেই আমূল পাল্টে যাওয়া দৃশ্যপট। সামনেই রাতারাতি আমীর বনে যাওয়া বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাট। জানলা বা বারান্দায় স্প্লিট এসি-র পাখাওয়ালা বাক্স। পাকা বন্দোবস্ত। লাভের গুড়ের ভাগে প্রোমটার ৬০ আর বাড়িওয়ালা ৪০। সঙ্গে বরাদ্দ একটা বা দুটো সাতশো / সাড়ে সাতশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। এরপর দোতলা, তিনতলা, চারতলা, পাঁচতলা। হিন্দি-উর্দুভাষী মুসলমান শ্রেষ্ঠীদের ঝাঁ চকচকে সব এক দেড় হাজার স্কোয়ার ফিটের হর্ম্য প্রাসাদ। ইন্টেরিয়ার ডেকরেশনে আচ্ছা আচ্ছা ফিল্মস্টারের ঘরকেও বেবাক লজ্জায় ফেলে দেবে। পঁচিশ তিরিশ চল্লিশ লাখ টাকা কবুল করে ফ্ল্যাট কিনেছেন কিন্তু হঠাতই পাল্টে যেতে চাওয়া এই বেজায় গরিবগুর্বো এলাকায় সেই পরিমাণে গ্যারেজ নেই। ফলে ‘আনলিগাল’ ফ্ল্যাটবাড়ির সামনের মাঠ অথবা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্করপিও, ফরচুনার এমনকি মার্সিডিজ বেঞ্জ বা বি এম ডব্লু - ইদানীং এ অতি পরিচিত দৃশ্য এ মহল্লায়। সেই সত্তরের শেষভাগে আমার পরিবার যখন এপাড়ায় আসে তখন সন্ধেবেলা আমাদের ব্যারাকমার্কা বেজায় পুরনো ফ্ল্যাটবাড়িটার ছাদে দাঁড়ালে সার সার টালির চালের ফাঁক দিয়ে উনুনের ধোঁয়া বেরনো খোলাবাড়িগুলোর ওপারে দূরে টাটা সেন্টারের মাথায় লাল লাইটদুটো দেখা যেত। আজ মনে হয় ওগুলো কি সত্যিই ছিল? নাকি হ্যালুসিনেশন? কারণ এখন আমার দোতলার জানলা দিয়ে ফুটদশেক দূরেই দৃষ্টি আটকে যায়। সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানো একটা বেঢপ ‘আনলিগাল’ ফ্ল্যাট। জানলায় জাললায় দেড় টনের এসি। সন্ধের পর মাঝে মাঝেই গাঁক গাঁক গর্জনে বন্ধ জানলার ওপার থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে ‘কাঁটা লাগা আ আ আ, হায় লাগা’। আসে প্রস্তাব - “দাদা, আচ্ছা ভাও দেঙ্গে, কভি ইয়ে ফ্ল্যাট ছোড়নেকা শোচিয়েগা তো ইস বান্দা কো ইয়াদ কিজিয়েগা জরুর।” নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি মন তো। টাল খেয়ে যায় মাঝেমধ্যে। ফের ভাবনাটা ঘুরে দাঁড়ায় যখন মসজিদ কমিটির মেম্বার বৃদ্ধ হাফিজ সাহেব রাস্তায় দেখা হলেই সালাম জানিয়ে বলেন - “সব কোই চলা গিয়া ইয়ে ফেলাটবাড়ি ছোড়কে, হামলোগোঁকো বহোত দুখ পঁহুছা। সির্ফ এক আপ হি রহে গয়ে আলাদিন কা চিরাগ বনকে। আপ মৎ যাইয়েগা।” ভাবনাটা আরো জোর পায়, মাঠে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের বাঁশ পড়তে একটু দেরি হলে পাশের বাড়ির দুই ভাই সাজেদ আর সায়েদ যখন একবুক উদ্বেগ নিয়ে তাদের অননুকরণীয় কোলকাত্তাইয়া অ্যাকসেন্টে প্রশ্ন তোলে - “কী হল বাপ্পিদা (বাপিদা)? এবার মোদের দুগ্যি আসবে না?” মনে পড়ে যায় অসমসাহসিনী সেই রমণী, আমার মা অঞ্জলি চৌধুরানীর সেই কথাগুলো - “সবাই গ্যাসে, যাউক গা! আমরা যামু কিহের (কীসের) লেইগ্যা?” এইসব অমোঘ উপরোধ, প্রশ্ন আর বাক্যবন্ধের মুখে দাঁড়িয়ে এই মহল্লা ছেড়ে আর যাওয়া হয় না এই অধম প্রতিবেদকের। তবে ওই যে একটু আগে বললাম, দুর্বল মধ্যবিত্ত বাঙালি চিত্ত। কোনোদিন যদি টাল খেয়ে যায় ভাবনাটায়? ভাবতে ভাবতে মাঝেমাঝেই ধড়ফড় করে মাঝরাতে উঠে বসি বিছানায়। পাশের ফ্ল্যাটের জানলাটাই ছিল বাপ্পার ঘর। জানলায় এসে দাঁড়ায় বাপ্পা! সেই ফিসফিসে গলা - “আজ ম্যাটিনি শো ম্যাজেস্টিকে দিওয়ার। জলদি তৈরি হয়ে নে। পাক্কা দুটোয় বেরোব। মনে থাকে যেন।” ওকে একা ফেলে রেখে একে একে এ ফ্ল্যাটবাড়ি ছেড়ে চলে গেল সবাই। আমি যাই কীভাবে!
অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor