সেইসব পাড়া-টারা – ১৫
আগের পর্বে
পার্ক সার্কাসে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির পিছনেই থাকতেন খাঁদা মিয়াঁ। সিনেমা হলের প্রজেকশন মেশি অপারেটর। এ কাজে তাঁর রীতিমতো নামডাক। নিখাদ কলকাত্তাইয়া মুসলমান তিনি। এই সম্প্রদায়ের কথ্য হিন্দি, উর্দু এবং বাংলার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। যা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। পার্ক সার্কাসে প্রথমদিককার বন্ধু শঙ্কর গাঙ্গুলী ওরফে বাপ্পা ছিল দারুণ মেধাবী। তবে সুপুরি অবধি না ছোঁয়া সেই ছেলেই জড়িয়ে পড়েছিল নেশার চক্রে। শেষে আকণ্ঠ মদ খেয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল সিগারেট নিয়ে। অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে ফেরা হয়নি তার আর। আরেক বন্ধু বেবু ছিল বর্ন স্পোর্টসম্যান। সবার আগে চাকরিও জুটিয়েছিল সে। কোনোদিন সিগারেটও ছুঁয়ে দেখেনি বেবু। বেবুই চিনিয়েছিল লিভারপুল, হটস্পার, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। শুনিয়েছিল ইয়োরোপিয়ান কাপ জয়ের রূপকথার গল্প।
শুধু কি আন্তর্জাতিক ফুটবল? ইস্টবেঙ্গলের ডাই হার্ড ফ্যান(এই অধমও) আমার এই বন্ধুটি গড়গড় করে বলে যেতে পারে ক্লাবের একশো বছরের উল্লেখযোগ্য সব কীর্তিকলাপের ইতিহাস, পাশাপাশি অপর দুই প্রধান মোহনবাগান এবং মহামেডানেরও। ষাট পয়সার গ্যালারিতে পাশাপাশি বসে লেবু লজেন্স আর চিনেবাদাম সহযোগে বহু খেলা দেখেছি দুজনে। এছাড়াও ইংরিজি, বাংলা দুই ধরনের সাহিত্যের আঙিনাতেই অবাধ বিচরণ ওর। ইংরিজিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস এবং খেলাধুলোর ওপর যে কোন ভালো বই, অন্যদিকে বাংলায় বিশেষভাবে সুকুমার ও শরদিন্দু, আরাধ্য দেবতা ওর কাছে। বলে বলে যে-কোনো লাইন কোট করতে পারে যখনতখন, সজারুর কাঁটা, তুঙ্গভদ্রার তীরে, ঝিন্দের বন্দী, আবোল তাবোল, খাই খাই, ঝালাপালা, লক্ষণের শক্তিশেল থেকে। ইংরিজি, বিশেষ করে ৬০/৭০ দশকের হলিউডি সিনেমার এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়ার নাম শ্রীমান শুভব্রত দাশগুপ্ত। কোন সালে রিলিজ করেছিল গুড ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি? গডফাদারের চিত্রনাট্যকার কে? কোনো গুগুল সার্চের দরকার নেই। সব উত্তর ঠোঁটের ডগায়। একটি বহুজাতিক কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অবসর নিয়েছে বছরতিনেক হল। চূড়ান্ত ফিট এখনো, কমপক্ষে কিলোমিটারদুয়েক জগিং করার ক্ষমতা রাখে অনায়াসে। পার্ক সার্কাস ছেড়ে অনেককাল হল টালিগঞ্জে নিজের ফ্ল্যাটে। সেখান থেকে সন্ধের পর মাঝে মাঝেই আড্ডা মারতে চলে আসে লেকের মাঠে, সুনীল ভট্টাচার্য, কানাই সরকার, কার্ত্তিক শেঠ, অমিত বাগচী, সুমিত বাগচী, বিশ্বজিত ভট্টাচার্যদের সঙ্গে। এই অধমও সে আড্ডায় গিয়েছে বারদুয়েক। সমৃদ্ধ হয়েছে দেশের জার্সি গায়ে চড়ানো এইসব অসামান্য ফুটবলারদের নিজের মুখে তাদের জীবনের নানা ওঠাপড়া আর লড়াইয়ের কাহিনি শুনে।
ইদানীং দূরত্ব এবং বয়স দুটোই বেড়ে যাওয়ায় দেখাসাক্ষাৎ কমে গেলেও যোগাযোগ নিয়মিত রয়েছে চলমান দূরভাষ এবং অন্তর্জালে। খেলাধুলো নিয়ে ই-মেইলে অসামান্য সব লেখা পাঠায় আমার বন্ধুটি। হালফিল এই লকডাউনের বাজারে সেটা আরও বেড়েছে। এই তো কদিন আগে পাঠাল স্যর আলেক্স ফারগুসন আর আহমেদ খানকে নিয়ে অসাধারণ দুটি লেখা! যতবার ওর লেখা পড়ি ততবারই একটা প্রশ্ন জাগে মনে। কবে শ্রী শুভব্রত দাশগুপ্তকে লিখতে ডাকবেন নামী ইংরিজি দৈনিকগুলোর ক্রীড়া সম্পাদকরা? ফি বছরে আই পি এল আর চার বছর বাদে বাদে বিশ্ব ফুটবলের মহাযজ্ঞ এলে রাতারাতি টিভির পর্দায় বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা বিনোদন জগতের কোট-আনকোট কিছু সেলেবের বদলে কবে দেখতে পাব চার যুগের বেশি সময় ধরে অকৃত্রিম সুহৃদ, আক্ষরিক অর্থেই ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ, আমার এই বন্ধুকে? প্রশ্নটা কিন্তু রয়েই গেল।
আমার জীবনে দেখা দশজন সেরা আশ্চর্য মানুষের মধ্যে অন্যতম নামটা অবশ্যই রাজেন্দ্র কুমার সরকার ওরফে রাজাদা। ব্রাইট স্ট্রিটে প্রায় সত্তর ভাগ সংখ্যালঘু অঞ্চলের দাপুটে বাঙালি হিন্দু নেতা। অনুগামীরা শতকরা প্রায় একশ ভাগই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের। পার্ক সার্কাস ময়দান দুর্গা পুজো কমিটির প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা এবং ধুরন্ধর কংগ্রেসি নেতার বিশ্বস্ত অনুচর ছিল রাজাদা। গোটা পার্ক সার্কাস-বেনিয়াপুকুর এলাকায় ‘চাণক্য’ নামে পরিচিত ছিলেন ওই নেতা, মূলত তার অসম্ভব কূটবুদ্ধির জন্য। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সারা কলকাতার তাবড় তাবড় বাহুবলীরা পোষা বেড়ালের মত লেজ নাড়তো ওই নেতার সামনে, সেসময়। এহেন গুরুর শিষ্য রাজাদা যে বুদ্ধিতে - বাপ কা বেটা সিপাহি কা ঘোড়া’ হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
রাজাদার সঙ্গে যখন এই অধমের আলাপ হয় তখন ব্রাইট স্ট্রিট আর নিউ পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে বিখ্যাত নরেনদার মিষ্টি কাম চায়ের দোকানে(উঠে গেছে বর্তমানে) রাজাদার ঠেক বা দরবার। আক্ষরিক অর্থেই যাকে রাজার দরবার বলা চলে। পাঁচবছরের কংগ্রেসি আমল সদ্য বিগত হলেও এলাকায় দাপট অক্ষুণ্ণ তখনো। দোকানের একপাশে পাতা গোটাতিনেক বেঞ্চে চারপাশ ঘিরে বসে থাকা পারিষদবর্গের মাঝখানে দরবার আলো করে বসে থাকা মধ্যমণি শ্রী রাজেন্দ্র কুমার সরকার। সকাল থেকে সন্ধে অবধি লোকজনের আসাযাওয়ার বিরাম নেই। বিভিন্নজনের বিভিন্নরকম সমস্যা। সমাধান একমাত্র রাজাদা। বয়স বছর চল্লিশ। দেখলে ত্রিশ বত্রিশের বেশি মনে হবে না। বিদ্যে ক্লাস এইট পাশ ওনলি। নিজেই বারবার গর্বভরে বলত সে কথা। কিন্তু একইসঙ্গে ইংরিজি, হিন্দি, উর্দু, তিনটে ভাষাতেই অনর্গল কথা বলে যেতে পারত ঝরঝর করে। সংস্কৃতের প্রায় সবকটি শব্দরূপ আর ধাতুরূপ ছিল ঠোঁটের ডগায়। এর পাশাপাশি যাকে বলে বইপোকা একেবারে। এলাকায় দুটি লাইব্রেরির(উঠে গেছে সেদুটিও) লাইফ মেম্বার। সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’ পড়ে শেষ করতে দেখেছিলাম মাত্র তিনদিনে। পুজোর সময় তৎকালীন প্রায় সবকটি শারদীয় সংখ্যার অগ্রিম অর্ডার দেওয়া থাকত কাগজওয়ালাকে, মোটামুটি মাসখানেক আগে থাকতে। একইসঙ্গে চেহারা আর মেজাজটাও ছিল রাজার মতো। পালিশ করা হাতির দাঁতের মত গায়ের রং। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত কি আট। কন্দর্পকান্তি অভিজাত চেহারা। পরনে সর্বদা দুধসাদা কাঁচিপাড় ধুতি আর গিলেকরা পাঞ্জাবি। শুনেছিলাম উত্তমকুমারের আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁর অসমাপ্ত একটি ছবির নির্মাতারা নায়কের ডামি খুঁজে না পেয়ে একজনকে পিছন ঘুরে বসিয়ে ছবির শ্যুটিং শেষ করেছিলেন। তাদের দুর্ভাগ্য, তাঁরা রাজাদাকে দেখেননি।
এহেন রাজেন সরকারের দরবারে যে-কোনো মত ও পথের পথিকদেরই ছিল সাদর আমন্ত্রণ। বিশেষ করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারা মানুষজনের সবিশেষ কদর ছিল রাজেন্দ্র কুমার সরকার নামক রাজার দরবারে। দুই বন্ধুবর বাপ্পা ও বেবুর হাত ধরেই নরেনদার দোকানের ওই রাজদরবারে প্রবেশ ঘটে আমার। রাজনীতির সঙ্গে সাতজম্মেও কোনো সম্পক্কো ছিল না ওদের দুজনের। তবু বিরুদ্ধ মতের তুফান উঠত চায়ের পেয়ালায় গোদার, ঋত্বিক থেকে জরুরি অবস্থার বাড়াবাড়ি নিয়ে। কিন্তু কখনো কোনোরকম অসূয়া বা অসহিষ্ণুতার লেশমাত্র চোখে পড়েনি রাজাদার মধ্যে। অন্যদিকে আমি, আমার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয়টা কীভাবে যেন জেনে ফেলেছিল মানুষটা। এ নিয়ে খুব সংক্ষেপে একবার দুয়েকটা কথা জিগ্যেস করেছিল মাত্র। তবে ওই একবারই। দ্বিতীয়বারের জন্য আর কোনদিন উত্থাপিত হয়নি ওই প্রসঙ্গ। এর বাইরে সবসময় নিঃশর্ত ভালোবাসা আর প্রশ্রয়ই পেয়ে এসছি মানুষটার কাছে।
এজাতীয় নানাবিধ গুণাগুণের পাশাপাশি নানাধরনের ফিচেল বুদ্ধিও অনায়াসে খেলত রাজাদার উর্বর মস্তিস্কে। আগেই বলেছি পার্ক সার্কাসে আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সচ্ছলতম দুটি নাম বেবু আর বাপ্পা। এদের মধ্যে বাপ্পা, বেজায় অর্থকষ্টে পড়ে গেল একদিন। কারণটা আর কিছুই নয়, রোজ রাতে মালঝাল খেয়ে বাড়িতে ফিরে ব্যাপক কিচাইন করা। রেগেমগে মাসিক মোটা মাসোহারাটা বন্ধই করে দিলে জাঁদরেল উকিল বাবা। বাপ্পা পড়লো মহা ফাঁপরে। রোজ সকালে নরেনদার দোকানে এসে বসে থাকত পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাওয়া মুখ করে। “কী হয়েছে তোমার?” অবস্থা দেখেশুনে জিগ্যেস করলো রাজাদা। বাপ্পার মুখে সমস্তটা শোনার পর খুব মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করল - “বাড়িতে সেই ক্যামেরাটা আছে।”
এক্ষেত্রে মনে হয় ক্যামেরার ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলা দরকার। ৮০-র দশকের গোড়ায় একধরনের ক্যামেরা এসছিল কলকাতার বাজারে। মেড ইন চায়না না থাইল্যান্ড, কোথাকার যেন একটা হবে। দাম অবিশ্বাস্য রকম সস্তা, মাত্র আঠারো টাকা! তবে সস্তা হলে কী হবে, দেখতে কিন্ত প্রচণ্ড আকর্ষণীয়, যে-কোনো দামি বিদেশি ক্যামেরার মত হুবহু। ছবিও উঠতো নেহাত মন্দ না, অন্তত এখানকার একশো-দেড়শো টাকাওয়ালা বেজায় অনাকর্ষণীয় চেহারার ক্লিক থ্রি বা আগফা গেভার্টগুলোর তুলনায় তো বটেই। নাম ছিল ডায়না বা ডেবনিয়ার - এজাতীয় একটা কিছু। পাওয়া যেত মেট্রো গলিতে। কিনে এনেছিল বাবা। দেখাদেখি পরদিন বাপ্পাও। এবং সেই ক্যামেরা দিয়ে চুটিয়ে ছবি তোলা হয়েছিল কয়েকদিন যার মধ্যে নরেনদার দোকানের আড্ডার ছবিও ছিল। ফলে ক্যামেরার ব্যাপারটা মনে ছিল রাজাদার। বাপ্পার কাছে অর্থকষ্টের কারণটা জেনে একচিলতে মুচকি হেসে মাখনমাখানো গলায় বলল - “ক্যামেরাটা নিয়ে এসো।”
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor