সেইসব পাড়া টারা – ১৩
আগের পর্বে
পার্ক সার্কাসের গোমাংসের দোকানের পাশাপাশিই খাসির দোকানও সমান উল্লেখযোগ্য। তবে হিন্দু জল ছেটানো তরতাজা মাংসই পছন্দ করতেন। উল্টোদিকে এই রেওয়াজ একেবারেই বরদাস্ত নয় সংখ্যালঘু মহল্লায়। সেখানে গরু, খাসি, শুয়োর, ভেড়া ছাড়াও চেখে দেখার সুযোগ হয়েছিল উট এবং দুম্বার মাংস। দুম্বার দাম আকাশছোঁয়া বললেও কম হবে। সে সময় রেওয়াজি খাসির বাজারে একাধিপত্য ছিল হাজি সাহেবের। লখনও থেকে কেটে আনা এক চরিত্র যেন। তাঁর মৃত্যুর পরেই সেই ব্যবসার আলো কমেছিল খানিক। সেই দোকানের পাশেই নাসির মিঁয়ার তাড়িখানা এবং পার্ক শো হাউস। ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলেই পড়ে আরও এক ভগ্নস্তূপ পোড়ো বাড়ি। ৭০ নং পার্ক স্ট্রিট। সেখান থেকেই দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়েছিলেন দীনেশ গুপ্ত, বাদল গুপ্ত।
চলুন, হাজিসাহেব, ৭০ নং পার্ক স্ট্রিট, এসব প্রসঙ্গ ছেড়ে এবার একটু বাজার মানে পার্ক সার্কাস বাজার চত্বরে পা রাখা যাক। এলাকার মানুষের মুখে পরিচিত ধাঙ্গড় বাজার। হরিজন সাফাইকর্মীদের নিয়ে এখানেই অনশনে বসেছিলেন স্বয়ং গান্ধীজি। সেই সূত্রেই লোকমুখে এহেন নাম প্রাপ্ত হয়েছে বাজারটি। কলকাতা শহরে এটাই একমাত্র বাজার যেখানে গরু আর শুয়োরের মাংস পাশাপাশি দোকানে বিক্রি হয়। মাঝখানে শুধুমাত্র একটা সরু গলির ব্যাবধান। আজ চারপাশে যখন হাজার হাজার ধম্মো শেয়ালের হুক্কাহুয়া, সেই জটিলকুটিল সময়ে সম্প্রীতি, সহিষ্ণুতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই পার্ক সার্কাস মার্কেট।
সাতের দশকে যখন আমি এই অঞ্চলে আসি তখন এই বাজারে মাছের চত্বরটা শাসন করত মূলত তিনজন - ধীরেন, মনি আর খালেক। এরমধ্যে ধীরেন, বিশালকায় চেহারা। নিজের আকারের মতই বিরাটাকার একটা আঁশবঁটি নিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর এবং ব্যক্তিত্বপূর্ণ মুখে বসে থাকত চাতালে। মুখগহ্বর সদাসর্বদা তাম্বুলরসে রঞ্জিত। দুপাশে দুজন সহকারী। ছুটছাট খদ্দেরপাতি তারাই সামলাত। সেরকম ওজনদার কেউ না হলে বিশেষ মুখ খুলত না ধীরেন। দেড়মণি রুইকাতলা থেকে শুরু করে দু-কেজি ছুঁই ছুঁই কোলাঘাটের ইলিশ হয়ে জায়ান্ট পাবদা, দুধসাদা পমফ্রেট (একেকটা কমপক্ষে ৭৫০ থেকে ৮০০ গ্রাম), প্ল্যাটিনাম কালার আধহাত সাইজ টরটরে পার্শে, ডোরাকাটা বাঘাটে বাগদা, রাক্ষুসে চিতল, কি না থাকতো ধীরেন নামক অলীক সেই মৎস্য বিপণীতে। আমার চোখে দেখা ধীরেনই একমাত্র মাছ ব্যবসায়ী, যার নিজস্ব একটা ল্যান্ডমাস্টার গাড়ি ছিল। মনে রাখতে হবে সেটা ৭০ দশক। ই এম আই স্কিমের দৌলতে আম মধ্যবিত্ত তো দুরস্থান, অনেক সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবারেও চারচক্রযান ঢোকেনি তখনো। এহেন অবস্থায় ওই গাড়িতে চেপে রোজ বাজারে আসত ধীরেন। স্বচক্ষে দেখা এসব। বাড়িয়ে বলছি না এতটুকু।
দ্বিতীয়জন মণি। মণির হাতযশ ছিল খলবলে লাফানো জ্যান্ত চারাপোনা, বাটা, ফলুই আর মৃগেলে। মণি। ক্লিন শেভড মুখে লেগে থাকা সদাসৌম্য একটা হাসি। একনজরে দেখলে কোনো কলেজের বাংলার অধ্যাপক বলে ভ্রম হওয়া সম্ভব। অন্যান্য মাছওয়ালাদের মত অত হাঁকডাক ছিল না মণির। শুধু মাঝে মাঝে সুললিত মিহি গলায় “লড়চে(নড়ছে), লাপাচ্চে!” বলে চেঁচিয়ে উঠত একাধবার। ব্যস, ওতেই কেল্লাফতে। কাস্টমারের ভিড় জমতে শুরু করত ড্রামের সামনে। বাজারের মাছ চত্বরে মণির মাছ শেষ হত সবার আগে। কারণ দেঢ়মণি রুইকাতলার পাশাপাশি জ্যান্ত চারাপোনাপ্রেমীর সংখ্যাও নেহাত কম নয় এ-শহরে।
“আরে কোন বাগানে ছিল রে! কোন বাগানে ছিল…” বাজখাঁই হাঁক পাড়তে পাড়তে বাজারে ঢুকত খালেক। রাজদূত বাইকের পেছনে একটা গাম্বাট সাইজের ড্রামে কানকো নাড়ছে তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি ওজনের কাতলার দল। বাইকের সাইডে পেল্লায় থলেতে ঝোলানো ভেড়ির জাম্বো ভেটকি। মৎস্যপ্রেমী বহু খলিফার কাছে শুনেছি, খেতে সেরা সেই কাতলা যার ওজন কখনোই তিন কিলোর কম হবে না আবার সাড়ে তিনের বেশি কদাপি নয়। পার্ক সার্কাস মার্কেটে ঠিক এই ওজনের কাতলাই নিয়ে আসত খালেক। তাও আবার জ্যান্ত। এর বাইরে মানিকতলা বাজার ছাড়া আর কোথাও চোখে পড়েনি এই বিরল দৃশ্য। অন্তত আমার তো নয়ই। কদ্দূর থেকে কীভাবে বাজার অবধি জীবন্ত নিয়ে আসা সম্ভব হত এই মৎস্যকূলকে সেটা আজো এক অপরিসীম রহস্য এই অধম প্রতিবেদকের কাছে।
খালেক। পুরো নাম মহঃ খালেক। গায়ের রং আবলুষ কালো। ভারিসারি চেহারা। তেল চুপচুপে কানঢাকা হেয়ার স্টাইল। এহেন খালেকের মাছের ভক্ত ছিলেন অনেক সেলিব্রেটিই। সেসময় এ-বাজারে প্রায়ই বাজার করতে দেখেছি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, গায়ক সুবীর সেন, সাহিত্যিক সমরেশ বসু, গায়িকা ঊষা আয়ার (সম্ভবত উত্থুপ হননি তখনো), অভিনেত্রী সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, লিয়েন্ডার পেজের বাবা বিখ্যাত হকি খেলোয়াড় ডঃ ভেস পেজ, ক্রীড়া সাংবাদিক অরিজিত সেনকে। এদের মধ্যে সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, একদম ডাই হার্ড ফ্যান ছিলেন খালেকের মাছের। থাকতেন থিয়েটার রোড অঞ্চলে। বলতে গেলে প্রায় নিয়মিতই আসতেন নিজে হাতে বাজার করতে। বাজারের ঠিক উল্টোফুটেই অধুনা বিখ্যাত কোহিনুর মিট শপের দোতলায় থাকতেন সুপ্রিয়াদেবীর দিদি। স্থূলকায়া এবং অসম্ভব সুদর্শনা। ওপাড়ার দুয়েকজনের কাছে শুনেছিলাম, রান্নার হাতখানা ছিল নাকি কনিষ্ঠা ভগ্নীর চাইতেও এককাঠি সরেস। মাঝেমাঝেই এসে হাজির হতেন খালেকের কাছে - “অই খালেক, আইজ সন্ধায় তগো গুরু খাইতে আইবো আমার বাসায়। তরা তো হক্কলে জানসই, হে(সে) আবার আমার রান্না খুব পছন্দ করে। গাদাপেটি মিলাইয়া স্যারা(সেরা) মাছখান দিবি এক কেজি। খাইয়া ভাল লাগলে তর কথা কমুখনে তগো গুরুর কাছে, বুঝছস।” জবাবে খালেকও সমান রসিক - “ও নিয়ে আপনি একদম চিন্তা করবেন না দিদি। একশ বছরের মধ্যে সেরা হিরো গুরু আর ইউসুফ সাহাব (দিলীপ কুমার)। গুরুর জন্য একশ বছরের সেরা মাছটাই যাবে।” এই ‘গুরু’-টি কে, সেটা আশা করি পাঠকদের আর বলে দিতে হবে না।
মাছ বিক্রির পেশার পাশাপাশি আর একটা পেশা কাম প্যাশন বা নেশা ছিল খালেকের। পিয়ানো অ্যাকরডিয়ান। বাজাত ধর্মতলা অঞ্চলের বেজায় ক্যাওড়া টাইপের একটা বারে। ফলে ডে টাইম ড্রেস কোড জালি স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি হলেও সন্ধে নামলেই রাস্তাঝাড়ু বেলবটম, ডগকলার চকরাবকরা শার্ট আর ইয়া উঁচু হিলওয়ালা বুট পায়ে গলিয়েই রাজদূত চেপে সোজা ধর্মতলা। এহেন খালেকের দুই বিবি। প্রথমজন বাপমায়ের দেখেশুনে নিকে দেয়া, দ্বিতীয়টি ওই বারেরই এক গায়িকা। সিংগিং পার্টনার থেকে লাইফ পার্টনার বনে গেছিল কবে যেন।
আরও পড়ুন
সিনেমা দেখতে এসে প্রণয়; দম্মকের জন্য টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে হাজির ‘সেকেন্ড ওয়াইফ’
পার্ক সার্কাস মার্কেট অর্থাৎ কড়েয়া অঞ্চলে পুজো, ঈদ, যে-কোনো জলসায় ডাক পড়ত খালেকের। মনে আছে কর্নেল বিশ্বাস রোডে অষ্টমীর দিন স্থানীয় একটি ক্লাবের দুর্গাপুজোর বিচিত্রানুষ্ঠানে ডাক পড়েছিল খালেকের। রফি, কিশোর, মান্না, মুকেশ, লতা, আশা, এরকম ডজনখানেক গান বাজানোর পর সামনের সিট থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন পুজো কমিটির এক বর্ষীয়ান দাপুটে কর্মকর্তা - “ওইসব হিন্দি গান অনেক হইসে খালেক, হেইবার তুই ভাল দেইখ্যা একখান রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজা তো।” ওনার অনুরোধে খালেক ধরল, ‘খর বায়ু বয় বেগে…’। গান শেষ হতেই প্রবল করতালি সহযোগে সোল্লাসে ফের চেঁচিয়ে উঠলেন সেই কর্তাটি - “দুর্দান্ত হইসে খালেক! জবাব নাই তর, আর অ্যাকখান ধর তাড়াতাড়ি!” এইবার খালেক পড়লো মহা ফাঁপরে। সর্বসাকুল্যে ওই একটিমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতই যে জানা আছে ওর। ঢোঁকটোক গিলে মিনমিন করে জানালোও সে কথা। তাতেও দমবার পাত্র নন সেই কর্তা। “ঠিক আছে। হেইডাই বাজা আরেকবার!”
অতঃপর দুবার নয়, বারচারেক ওই একই গান বাজিয়ে প্রায় ভোররাতে সমাপ্ত হয়েছিল অষ্টমী পুজোর জলসা। পরের বছর পুজো আসার আগেই আর যাতে বিড়ম্বনায় পড়তে না হয় ভেবেই নাকি ‘আলো আমার আলো’-টাও তুলে নিয়েছিল খালেক। যদিও সে অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য এ অধমের হয়নি।
কলকাত্তাইয়া বা ক্যালকেশিয়ান মুসলিম। এদের দেখা মিলবে খিদিরপুর, রাজাবাজার, বিশেষত পার্ক সার্কাস অঞ্চলে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে একাধিক লেখা বা প্রতিবেদন পড়ার সুযোগ হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বই অথবা পত্রপত্রিকায়। কলকাত্তাইয়া মুসলমানদের নিয়ে সম্পূর্ণ রচনা তো দূরের কথা, দুয়েকটি লাইনও চোখে পড়েনি কোথাও। হতে পারে নিজের বিপুল পাঠের অভাব। তবু মনে হল এই বিশেষ গোষ্ঠীটিকে নিয়ে সামান্য কয়েক কথা লেখা দরকার।
আরও পড়ুন
মাঝরাত্তিরেও গিজগিজে ভিড়, মুমতাজ ভাইয়ের পান-সিগারেটের দোকানের রহস্য কী?
কলকাত্তাইয়া মুসলিম। পুরুষের পর পর পুরুষ ধরে এই গোষ্ঠীর মানুষরা বাস করে আসছেন কলকাতায়। আদিতে কোত্থেকে এসছিলেন প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে বরাবরই ওদের আবাসস্থল তিনশ বছরের গণ্ডি টপকানো এই শহর। ঠিক একইভাবে যেমন উত্তরে শ্যামবাজার, বাগবাজার, শোভাজার, অন্যদিকে দক্ষিণে কালীঘাট-ভবানীপুর ইত্যাদি অঞ্চলে পিওর কলকাত্তাইয়াদের দেখা মেলে। বাংলা সাহিত্যে, সিনেমায়, বিভিন্ন প্রতিবেদনে এদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে বারবার। অথচ সেখানে কলকাত্তাইয়া মুসলমানরা ব্রাত্য সম্পূর্ণভাবে। সংখ্যাগুরু ক্ষেত্রের যে কোন উপরোক্ত মূলধারায় কোট আনকোট চূড়ান্ত অবহেলিত থাকা অথবা অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণেই কি? সেসবের উত্তর খোঁজা যাবে অন্য পরিসরে। আপাতত ফের কলকাত্তাইয়া মুসলমান প্রসঙ্গে ফিরি। যুগ যুগ ধরে এই গোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা। তারও নিজস্ব এক ধারা, অ্যাকসেন্ট এবং ভোকাবুলারি আছে। যেখানে ভাঙ্গাচোরা উর্দু, সাধু এবং পুরোন কলকাতার কথ্যভাষা মিলেমিশে একাকার। একটা উদহারণ দিলে আশাকরি ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে পাঠকদের কাছে।
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ক্রিকেট, হকি, ফুটবল – কলকাতার খেপ খেলার দুনিয়ায় একমেবাদ্বিতীয়ম রিচার্ড হুপার