সেইসব পাড়া-টারা – ১২
আগের পর্বে
গাছ বেয়েই জন সাহেবের পাত্তি ফাঁসার কথাটা জানাতে গিয়েছিল গোরা। আর আলো-আঁধারে ছায়ামূর্তি দেখে ‘ঘোস্ট’ ভেবেই মূর্ছা গিয়েছিলেন জনগিন্নি। তবে এই খবরে সোৎসাহে বাড়তি পঞ্চাশ টাকা বকশিস দিয়েছিলেন তিনি গোরাকে। সঙ্গে নিউইউয়ারের পার্টি। জন সাহেব কলকাতা ছেড়েছেন বহুদিন। উঠেছে সেই ট্রামকোম্পানির সাবসিডি ক্যান্টিনও। এই মহল্লায় সঙ্গত কারণেই বিখ্যাত ছিলেন আরেকজন— মুমতাজ ভাই। তাঁর পান-সিগারেটের দোকান ভোর ছটা থেকে রাত দুটো অবধি খোলা থাকত। ৯৪-৯৫ সাল নাগাদ আমার অফিসের দুই ঊর্ধ্বতন কর্তার মধ্যরাতের ধুম্রপানের তেষ্টা মিটিয়েছিলেন তিনি। আজও রয়েছে সেই দোকান। তবে পার্ক সার্কাসের অধিকাংশ দোকানেরই ব্যবসা বদল হয়েছে দু’দিন অন্তর অন্তর।
সংখ্যালঘু মহল্লায় গোমাংসের দোকানের প্রাচুর্যের কথা তো আগেই লিখেছি একদম প্রাথমিক পর্বে। এর পাশাপাশি খাসির মাংসের, বিশেষভাবে পার্ক সার্কাসের খাসির মাংসের দোকানগুলোর ব্যাপারেও কিঞ্চিৎ বিশদে আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে বোধ করছি। এইসব দোকানের বিশেষত্ব বা অভিনবত্ব যাই বলুন না কেন, বাঙালি হিন্দুপাড়ার মতো আপাদমস্তক কষে নাইয়ে দোকানের সামনে টাঙানো হয় না। টাঙানোর পর হাল্কাভাবে পরিষ্কার ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে আলতো করে একবার পুঁছে দেওয়া হয় মাত্র। ফলে মাংসের শুকনো অথচ তাজা ঝরঝরে চর্বিদার, ঈষৎ সোনালি হলদেটে ভাবটা বজায় থাকে বহুক্ষণ। বাঙালি হিন্দু পাড়ার দোকানগুলোর মত ভ্যাটভ্যাটে সাদা কখনো নয়। দেখেশুনে বারবার প্রশ্ন জেগেছে মনে - আচ্ছা, বাঙালি হিন্দু পাড়াতেও তো এ-ধরনের দোকানগুলো চালান মুসলমান কসাইরা। তাহলে এক যাত্রায় এরকম পৃথক ফল কেন? জানতে চাওয়ায় অদ্ভুত এক তত্ত্ব শুনিয়েছিলেন বৃদ্ধ আসফাক চাচা। এলাকার এক বিখ্যাত খাসির মাংসের দোকানে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কর্মরত অভিজ্ঞ কসাই। থিওরিটা এইরকম।
হিন্দু বাঙালি বাবুরা মাছের বাজারে গিয়ে সবসময় জল ছেটানো টরটরে টাটকা তাজা ভাবটা দেখতে চান। সেই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে মাংসের ক্ষেত্রেও। অন্যদিকে সংখ্যালঘু মহল্লায় মাংসের গায়ে জলের আধিক্যকে বিষনজরে দেখা হয় কারণ ওতে পাতলা চর্বির পরতটা ক্ষয়ে গিয়ে মাংস বা গোস্তের মধুর সুগন্ধটা চলে যায়। তত্ত্বটা কদ্দূর সঠিক, যাচিয়ে দেখা হয়নি কোনোদিন। তবে সংখ্যালঘু মহল্লায় যে কোনো খাসির মাংসের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তাজা মাংস-চর্বির যে মিশ্র সুগন্ধটা নাকে এসে ধাক্কা মারে, বাঙালি হিন্দু পাড়ার দোকানগুলোয় সেটা অনুপস্থিত থাকতে দেখেছি প্রতিবার।
এর পাশাপাশি কচি পাঁঠা নয়, সংখ্যালঘু মহল্লার অল টাইম ফার্স্ট চয়েস চর্বিদার রেয়াজি খাসি। দোকানের সামনে বিশাল অ্যালুমুনিয়ামের গামলায় রাখা একনম্বর পাঞ্জাবী চানা বা রেলিঙে বাঁধা তাজা কাঁঠালপাতা চিবোচ্ছে নধর জায়ান্ট সাইজ রেয়াজি খাসি, এ অতি পরিচিত দৃশ্য যে কোনো সংখ্যালঘু মহল্লায়, বিশেষত পার্ক সার্কাসে। ইদানীং হেলথ কনশাস কিছু শাঁসালো বং বাবু টাইপ কাস্টমারদের তাগিদে মহল্লার কিছু দোকান ছোটো সাইজের কম চর্বিদার খাসি রাখতে শুরু করেছে বটে তবে সেটা ব্যতিক্রম, নিয়ম কখনোই নয়।
পার্ক সার্কাসে আসা ইস্তক দীর্ঘ এতগুলো বছরে গরু, খাসি, শুয়োর, ভেড়া ছাড়া আরো দুধরণের মাংস চেখে দেখার সুযোগ হয়েছে যা কোনো মাংসের দোকানেই পাওয়া যায় না। মুসলমান মহল্লাতেও পাওয়া যায় বছরে মাত্র একবার। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশেষ পরব, বকর ঈদ বা কুরবানির উৎসবের দিনে। এর মধ্যে উট, কিঞ্চিৎ ছিবড়ে, একটু বেশি পরিমাণে শক্ত এবং নোনতা হবার কারণে প্রাণীটির মাংস কোনোদিনই বিশেষ পছন্দের নয় আমার।
আরও পড়ুন
মাঝরাত্তিরেও গিজগিজে ভিড়, মুমতাজ ভাইয়ের পান-সিগারেটের দোকানের রহস্য কী?
দ্বিতীয়টি দুম্বা। ঠাকুর বংশের উত্তরসূরী শুভো ঠাকুর লিখেছিলেন কোবে বিফের কথা। জাপানের একটি প্রদেশ কোবে, তার নামেই নামকরণ এই মহার্ঘ মাংসের। সেখানে বাছাই করা গরুদের বিশেষ ধরণের প্রোটিন ফুড খাইয়ে ছোটো থেকে বড়ো করা হয়। শরীরে জমা হওয়া বিপুল পরিমাণ চর্বিকে যন্ত্রের সাহায্যে মাসাজ করে মিশিয়ে দেওয়া হয় মাংসের সঙ্গে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘মার্বেলিং’। সেই ৮০-র দশকে শ্রী ঠাকুর এর দাম লিখেছিলেন ১২০০ ডলার প্রতি কেজি। দুনিয়ার সবচেয়ে দামি মাংস নাকি। নাঃ! কখনো চেখে দেখা হয়নি সেই বহুমূল্য বেহেস্তের পদ। তবে দুম্বার স্বাদ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে দুয়েকবার। আদতে আফগানিস্তান নিবাসী এই মেষ বা ভেড়া গোত্রের প্রাণীটির মাংস ধনী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ডেলিকেসি। কিলোপ্রতি দাম পড়ে কমপক্ষে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এক ধনী পরিবারের তরফ থেকে কয়েকবার পাঠানো হয়েছিল বাড়িতে, কুরবানির দিনে। স্বাদ কীরকম? সেটা বর্ণনা করার সাধ্য এ-জিভের নেই। কারণ জিভেই লেগে রয়েছে স্বাদটা। তবে পটলডাঙ্গার প্যালারামের মতো পটল দিয়ে শিঙ্গিমাছের ঝোল খাওয়া পেটে লাঞ্চে এ-পদ খাওয়ার পর রাতের ডিনারটা স্কিপ করতে হয়েছে প্রত্যেকবার, এটুকু বলতে পারি নির্দ্বিধায়।
আরও পড়ুন
ক্রিকেট, হকি, ফুটবল – কলকাতার খেপ খেলার দুনিয়ায় একমেবাদ্বিতীয়ম রিচার্ড হুপার
আজ থেকে বহুবছর আগে কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে প্রথম যখন পার্ক সার্কাসে আসি, সেসময় এই বিস্তীর্ণ মহল্লায় উমদা রেয়াজি খাসির গোস্তের দোকান বলতে মাত্র দুটি। প্রথমটি স্ট্যান্ডার্ড মিট শপ। কংগ্রেস এগজিবিশন রোডে, পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপোর গেটের উল্টোদিকে। তবে ‘দ্য বেস্ট’ পার্ক স্ট্রিটে পার্ক শো হাউস সিনেমা হলের গায়ে হাজি সাহেবের দোকান। দোকানের সামনেই একপাশে গদিতে বসা বৃদ্ধ হাজীসাহেব। পালিশ করা চন্দন কাঠের মত গায়ের রঙ। চোখের পাতায় গাঢ় আফগানি সুর্মার টান। একমুখ বেনারসি জর্দাপান আর সারা গায়ে ভুরভুরে আতরের খোশবাই। গিলে করা চুনোট সফেদ পাঞ্জাবি আর ৮০-৮০ জড়িপাড় লুঙ্গি পরনে। রুপোর গড়গড়ায় অম্বুরি তাম্রকূট। থেকে থেকে অর্ধনিমীলিত চোখে টান মারছেন ভুড়ুক ভুড়ুক। দশ-বারোজন কর্মচারী মাংস কাটতে কাটতে হাঁপিয়ে হালেকান হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে প্রায় বোজা চোখটা আরেকটু খুলে টুকটাক নির্দেশ দিচ্ছেন নিচু গলায়, চোস্ত উর্দুতে। হুবহু সেই আলি শাহের আমলের লখনও থেকে এনে বসিয়ে দেয়া একটি চরিত্র যেন, এই পার্ক সার্কাসের বুকে। এদিকে দোকানের সামনে খদ্দেরের লম্বা লাইন। মাংস ঘাঁটাঘাঁটি করার নিয়ম নেই। আগলা রান, পিছে কা রান না শিনা কা গোস্ত, সেটুকু শুধু বলা যেতে পারে বড়োজোর। এটুকু বলাতেই যে শহরের সেরা জিনিসটা পাওয়া যাবে, সে ব্যাপারে ক্রেতারা নিশ্চিত সবাই।
আরও পড়ুন
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েদের দেখে দমবন্ধ ভাব; সুন্দরী দেখার অভিজ্ঞতা পার্ক সার্কাসে এসেই
পরবর্তীতে আরো দুটি নামি রেয়াজি খাসির মাংসের দোকানের পত্তনি হয় এলাকায়। প্রথমটি পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপোর ঊল্টোফুটে বাহালভাইয়ের (পরবর্তীতে জিশান হোটেলের মালিক) বেঙ্গল মিট শপ। অন্যটি পার্ক সার্কাস থুড়ি ধাঙড় বাজারের উল্টোদিকে কোহিনূর মিট শপ। তবে ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ যে হাজিসাহেব তা নিয়ে সেসময় কলকাতার খাদ্যরসিক মহলে সন্দেহ ছিল না এতটুকুও।
আরও পড়ুন
বিপ্লব অসমাপ্ত রেখে, রেসের মাঠেই ঘুমিয়ে পড়েছে বুনো ঘোড়া
হিন্দিতে একটা কাহাওয়াত আছে - ‘সময় সবসে বলওয়ান হ্যায়।’ সেই সময় নামক অপার্থিব অস্তিত্ব সত্যিই বড় নির্দয়ভাবে বলবান হয়ে উঠল হাজিসাহেবের মৃত্যুর পর। সম্পত্তি আর দোকানের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ছেলেদের মধ্যে বেধে গেল দায়ে-কুড়ুলে কাজিয়া। দোকানের অবস্থা পড়তে লাগল দিন কে দিন। অতঃপর একদিন ধুঁকতে ধুঁকতে বন্ধই হয়ে গেল হাজিসাহেবের দোকান। ছেলেরা তো বটেই, ভাইভাতিজারাও সব ‘হাজিসাহেব’, ‘রিয়াল হাজিসাহেব’, ‘অরিজিনাল হাজিসাহেব’ নামে দোকান লাগাল এলাকায়, এলাকার বাইরেও। অনেকটা ‘লক্ষীবাবুর আসলি সোনা চান্দিকা দুকান’ বা শিবপুর বটানিকাল গার্ডেনের ওই প্রাচীন বটগাছটার মতো। অজস্র শাখাপ্রশাখার ভিড়ে মূল কাণ্ডটাই গেল হারিয়ে! সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক যেটা - হাজিসাহেবের দোকানের সাইনবোর্ডে হাজিসাহেব’ কথাটা লেখাই ছিল না কোথাও। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও অনেককাল অবধি ভাঙা, জংখাওয়া কোলাপসিবল গেটের মাথায় একটেরে হয়ে হেলে ছিল দোকানের নাম লেখা রং চটে যাওয়া সাইনবোর্ডটা। ওপরে লেখা দোকানের নাম - ক্যালকাটা মিট সাপ্লায়ার্স’। তার নিচে - ‘দ্য বেস্ট গোট মিট শপ ইন টাউন’। আক্ষরিক অর্থেই শহরের সেরা খাসির মাংসের দোকান!
আরও পড়ুন
খাওয়ার মাঝখানে বরের মামাকে কান ধরে টেনে তুললেন সাধনকাকা, তেড়ে এল বরযাত্রীরা
হাজিসাহেবের দোকানের কথা হল আর পাশেই পার্ক শো হাউস আর নাসিম মিয়াঁর তাড়িখানার কথা একাধটু হবেটবে না? সেটা কেমন করে সম্ভব? ফলে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও ঢুঁ মারতে হচ্ছে বিশ্বখ্যাত ওই দুই প্রতিষ্ঠানে। এদের মধ্যে পার্ক শো হাউস। দিলীপ কুমার, দেবানন্দ, রাজ কাপুর থেকে শুরু করে ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন। সিঙ্গল স্ক্রিন আর হিন্দি সিনেমার সেই দুরন্ত রমরমার যুগে টিকিট ব্ল্যাকারদের স্বর্গরাজ্য এই প্রেক্ষাগৃহ। টিকিট কাউন্টারের বুকিং ক্লার্ক ফেকু মিয়াঁ। মাঝবয়েসি, ছোটোখাটো চেহারা। বাংলা শার্ট আর ঢোলা পাজামা। চোখে ডাঁটি ক্ষয়ে যাওয়া পুরনো ফ্রেমের চশমা। সন্ধের মুখে কাউন্টার খুলে গোটাদশেক টিকিট দিয়েই মাইলখানেক লম্বা লাইনের মুখের ওপর খটাস করে কাঠের ছোটো জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে হাঁক পাড়তেন হেঁড়ে গলায় - “বেচু, ছে বাজে কা বোর্ড লাগা দে!” হলের গেটকিপার বেচু। হাঁক শোনামাত্র নির্লিপ্তমুখে উঠে গিয়ে কাঠের বোর্ডটা টাঙিয়ে দিত হলের সামনে। যেখানে সাদা বোল্ড লেটারে লেখা, ‘সিক্স পি এম - হাউস ফুল’। পরমুহূর্তেই বাকি সব টিকিট চলে যেত হলের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান ব্ল্যাকারদের হাতে। “দো কা পাঁচ!”, “পাঁচ কা দশ!” শুরু হয়ে যেত প্রবল হাঁকডাক। খুল্লামখুল্লা টিকিট কালোবাজারি। প্রেক্ষাগৃহের সমস্ত কর্মচারীর কমিশন - ফ্ল্যাট টেন পারসেন্ট! হলের চিফ ব্ল্যাকার দম্মক। এলাকার মশহুর বাহুবলী। সেরকম কোনো সুপারহিট সিনেমার ওপেনিং শো-টো না হলে নিজে আসরে নামত না বড়ো একটা। একটু দূরে বান্দরপট্টির মোড়ে দাতাবাবার মাঝারের গায়ে ঝাঁকড়া গাছটার নিচে বসে তীক্ষ্ণ নজর রাখত চারপাশে। প্লেনড্রেসরা এলে ডিলফিল যা কিছু হত সব দম্মকের সঙ্গেই। শাকরেদরা অবধি মামলা পৌঁছত না কিছুতেই। ইভনিং শো চালু হবার পর কিছুটা নিশ্চিন্ত দম্মক। এই সময় পার্মানেন্ট রিকশা চেপে এসে পড়ত দম্মকের সেকেন্ড ওয়াইফ। রিপন স্ট্রিটের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ললনা। সিনেমা দেখতে এসেই প্রণয়। প্রণয় থেকে পরিণয়। বিবির হাতে ইয়া গোবদা সাইজের একটা পাঁচ বাটির টিফিন ক্যারিয়ার। ভেতরে ঠাসা খাস্তা পরোটা আর কাবাব। সঙ্গে শশা-পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কাকুচির সালাদ। ধান্দাপানি সেরে শাকরেদরাও উপস্থিত ততক্ষণে। খেয়েদেয়ে উল্টোফুটে সিরাজ হোটেলের পোয়াপাত্তি এককাপ চা। অতঃপর একটা ফিল্টার উইলস ধরাত দম্মক। ধূমপানের ফাঁকে ফাঁকে একটা স্টেটসম্যান থেকে আঙ্গুঠা ছাপ দম্মককে এই দুনিয়ার হালহকিকত সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিবহাল করার চেষ্টাচরিত্র চালাত ওর ফিরিঙ্গি বিবি।
আরও পড়ুন
কে সি দাসের দোকানে নিয়ে গিয়ে রসগোল্লা খাওয়াল ‘কিং কং’
নাসির মিয়াঁর তাড়িখানা। পার্ক শো হাউস আর হাজিসাহেবের দোকানের ঠিক মাঝখানে। সামনে বিশাল বিশাল দুটো র্যা কে সাজানো কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল। ঠান্ডা বাক্স। র্যা কদুটোর মাঝখানের চেপা গলতাটা দিয়ে সুট করে গলে গেলেই ভেতরে মধুশালার এলাহি আয়োজন। এ-মধুশালার ওয়ান অ্যান্ড ওনলি অ্যাট্রাকশন ইজ দুধসাদা সফেন তাড়ি। সঙ্গে চাট, পাশে চুলিয়া হোটেলের কাবাব আর ফুটপাতের ভুজাওয়ালার চানা-বাদাম মিক্সচার। বন্ধুত্রয়ী দেবু, উৎপল আর বাপ্পার সঙ্গে বেশ কয়েকবার গিয়েছি ওখানে। এক সে এক খলিফার আনাগোনা সে আড্ডায়। আসত বক্সু, জানি, হায়দার, বিষনি(বিষাক্ত) শওকত, সেসময় এলাকার বেতাজ বাদশা পাগলা জান ওরফে দাদাভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহচর সব। দেবু আর উৎপলের জিগরি দোস্ত। আসত সিতারা, চাঁদতারা, সালমা, লক্ষী। বামুনপাড়া লেন, চেতলা, দারাপাড়া, মেটেবুরুজের বৃহন্নলারা। বাচ্চা নাচিয়ে ‘খোলে’ (আস্তানায়) ফেরার পথে ওদের সব্বার ফেভারিট জয়েন্ট ছিল নাসির মিয়াঁর ঠেক। মুড ভালো থাকলে মানে ভাল কামাইধামাই হলে ঢোল বাজিয়ে নেচেগেয়ে শুনিয়েও দিত দুচার কলি। আসত পেন্টার সেলিম কারণ সে মল্লিকবাজারে গাড়ি রং করে, আসত বোর্ড সেলিম কারণ সে ফুটপাতে জুয়ার বোর্ড চালায়, আসত ‘সেয়ানা’ বা ‘পাকিটমার’ সেলিম কারণ সে থার্টি নাইন বাসরুটে পকেট মারে, আসত ‘কাট্টা’ সেলিম কারণ সে পকেটে ওয়ান শটার নিয়ে ঘোরে, আসত আইসকিরিম(আইসক্রিম) সেলিম, স্বাভাবিকভাবেই সে ডালাগাড়িতে আইসক্রিম বেচে। একই নামের বহু মানুষ এক পাড়ায় থাকলে অথবা কোনো জায়গায় নিয়মিত জমায়েত হলে শারীরিক বা স্বভাবগত কোনো দোষগুণের উপমা বা বৈশিষ্ট্যকে নামের আগে জুড়ে দিয়ে ডাকার রেওয়াজ আছে সর্বত্র। মুসলমান পাড়ায় এর সঙ্গে যুক্ত হয় পেশাগত পরিচয়ের দিকটা। অন্যান্য সংখ্যাগুরু এলাকায় তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম পরিলক্ষিত হয় এই ব্যাপারটা। সে যাকগে, বিশেষণের প্রসঙ্গ আপাতত সরিয়ে ফের ফিরে যাই নাসির মিয়াঁর ঠেকে। দোকান বন্ধ হওয়ার মুখে মুখে আসত নূরজাহান, পুতুল, কমলি, আসিয়া, শেফালিরা। মিন্টো পার্ক, অকল্যান্ড স্কোয়ার, রডন স্কোয়ারের পাঁচ দশ টাকার বেজায় সস্তা যৌনকর্মী সবাই। আসত উল্টোফুটে দ্বিশতাব্দী প্রাচীন কবরখানার ভাঙ্গা পাঁচিলের ফোকরে রাতের অন্ধকারে শরীর বেচে বেঁচে থাকা মূক ও বধির সেই যমজ দুই বোন। একজনের গালে একবিঘত লম্বা একটা ক্ষুরের দাগ। খদ্দেররূপী কোনো বীরপুরুষের কাজ নিশ্চয়। এদের কাউকে দোকানে ঢুকতে দেখিনি কোনোদিন। নাসির মিয়াঁর বাড়িয়ে দেওয়া বোতলটা নিয়ে টাকা মিটিয়েই নীরবে মিলিয়ে যেত ফুটপাতে। আরব্য উপন্যাসের সেই সিন্দাবাদ নাবিকের মত সমাজের সব লজ্জা যেন ওদের কাঁধে!
নাসির মিয়ার ঠেক বন্ধ হতে হতে রাত নটা, সাড়ে নটা। পয়সা মিটিয়ে পথে নামতে নামতে প্রায় পৌনে দশ। সেদিন একাই গেছিলাম। বন্ধুবান্ধবরা কেউ ছিল না সঙ্গে। শীতের রাতে ফুটপাত ধরে ফিরতে ফিরতে চোখ আর পা দুটোই জমে গেছিল রাস্তার ওপরে প্রায় ভগ্নস্তুপ পোড়োবাড়িটার দিকে তাকিয়ে। ৭০ নং পার্ক স্ট্রিট। মুহূর্তে বিদ্যুৎচমকের মত একটা ফ্ল্যাশব্যাক! ৭-ই ডিসেম্বর। এরকমই এক শীতকালের সকালে এই বাড়িটা থেকেই বেরিয়ে রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানে গেছিলেন দেশমাতৃকার দুই অগ্নিপুত্র দীনেশ গুপ্ত আর বাদল গুপ্ত। বাকিটা ইতিহাস! হাজীসাহেবের দোকান। এ শহরের অন্যতম এক ল্যান্ডমার্ক। কালগ্রাসে বিলুপ্ত বহুকাল। ৭০ নম্বর পার্ক স্ট্রিটকে কি হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষণা করা যায় না? না কোনো আবেদন নয়, উচ্চতম কর্ত্রীপক্ষের কাছে রইল প্রশ্নটা।
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
Powered by Froala Editor