সেইসব পাড়া-টারা – ১১
আগের পর্বে
বর্ন স্পোর্টসম্যান কথাটা যেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে মিশে যায় অচিরেই। পার্ক সার্কাসে চলে আসার পর আলাপ হয়েছিল এমনই একঝাঁক দক্ষ খেলোয়াড়ের সঙ্গে। রবার্ট রোজারিও, রিচার্ড হুপার, পিটার আগা ছিলেন অন্যতম। ক্রিকেট থেকে শুরু করে ফুটবল, হকি, বক্সিং সব ক্ষেত্রেই তাঁদের জুড়ি মেলা ভার। রিচার্ড ফুটবলের পাশাপাশিই হকিতেও সমানভাবেই ফুল ফোটাতেন। খেপ খেলার জন্য ফিরিয়ে দেন ময়দানের অফার। পরবর্তীকালে ড্রাগ আর মদের নেশা, জুয়ায় খেলার ইতিহাস থেকেই মুছে যায় তাঁর নাম।
সময়টা ছিল শীতকাল। রাত সোয়া বারোটা নাগাদ এসেছিল ক্লোজের খবরটা। জনসায়েবের পাত্তি ফেঁসেছে! শোনামাত্র তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছিল গোরা। এক্ষুনি খবরটা দেওয়া দরকার আঙ্কেলকে! ঠেকের গায়েই একটা কাঁঠালগাছ। উঠে গেছে সোজা জনসায়েবের শোবার ঘরের গা ঘেঁষে। আলোয়ানটা গায়েমাথায় ভালো করে মুড়িয়ে নিয়ে তরতরিয়ে গাছ বেয়ে উঠে গেছিল গোরা। জানলার দিকে মুখ করে শোয়া জনগিন্নি। পাশে প্রবল নাসিকাগর্জনে নিদ্রিত জনসাহেব। কাঁঠালগাছে আলোয়ানে মোড়া গোরাকে প্রথম চোখে পড়েছিল মেমসায়েবের। পরমুহূর্তেই “ঘো ও ও ও স্ট!” তীব্র চিৎকারে দাঁতকপাটি লেগে ভির্মি খাওয়া। জিমির তীব্র খেউ খেউয়ের মধ্যেই সগর্জনে “হোয়াটস দ্য ব্লাডি হেল!” বলে বিছানায় উঠে বসেছিলেন জনসায়েব। সায়েবের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসি গোরার - “আঙ্কেল, আপকা পাত্তি ফাঁস গিয়া!” অতঃপর বাকি সবকিছু চুলোর দোরে, বেহুঁশ গিন্নিকে মেয়ের জিম্মায় রেখে ওই শীতের রাতে নাচতে নাচতে রাস্তায় বেরিয়ে এসছিলেন জনসায়েব। একশ টাকার ওপর আরো পঞ্চাশ টাকা টিপস পেয়েছিল গোরা। কদিন বাদেই বড়দিনে আলম-আমিন-গোরাসহ সাট্টার ঠেকের সমস্ত এমপ্লয়িদের উদ্দেশ্যে একটা গালা পার্টি দিয়েছিলেন জন আঙ্কেল। সব মিলিয়ে মেরি ক্রিসমাস অ্যান্ড নিউ ইয়ার্স ইভটা রসেবসেই কেটেছিল সায়েবের, বলা চলে।
সেই কবেকার কথা! ঝাঁ চকচকে বাড়ি আর জিশানের আড়ালে কবেই কাটা পড়েছে কোয়ার্টার ঘেঁষা সেই কাঁঠালগাছ। রশিদ খান বোমাকান্ডের পর শহরের বুক থেকে প্রায় অবলুপ্তই হয়ে গেছে সাট্টাসাম্রাজ্য, সঙ্গে আলম-আমিন অ্যান্ড কোং সাট্টার ঠেকও। রিটায়ারের পর এ শহরকে বরাবরের জন্য গুডবাই জানিয়ে বউ, মেয়ে, জিমিসহ জনসায়েবও অস্ট্রেলিয়া বহুকাল হল। ট্রামকোম্পানির শেষ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ডিপো ম্যানেজার! কবেই উঠে গেছে ডিপোর সেই সাবসিডি ক্যান্টিন। ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে শব্দ তুলে ডিপোর গেট থেকে আর বেরোয় না কুড়ি, একুশ, বাইশ নম্বর ট্রামগুলো। তার বদলে লাইনের ওপর আর সেই বিশাল ট্রাম ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা বাস। ডানকুনি না কোথায় একটা যায় যেন। প্রায় দুশো বছর ছুঁতে চলা ট্রাম কোম্পানি এখন বাস চালিয়ে টিকে রয়েছে কোনোমতে। টিমটিম করে। ছাউনির একদম পেছনদিকটায় এখনো দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা কয়েকটা ট্রামের কঙ্কাল! অতীত গৌরবের ভগ্নস্তুপ যেন! দেখলেই কীরকম হু হু করে ওঠে ভেতরটা। এই বেমক্কা দমচাপা মনখারাপের পর্দাটা সরিয়ে চলুন, ফের একবার হাঁটা লাগানো যাক ঝুপড়ি-বস্তি মহল্লাগুলোর দিকে।
এক উত্তাল ঝোড়ো সময় ও তার ফলস্বরুপ ভয়ঙ্কর বিপর্যয় কোনোক্রমে পেরিয়ে এই সংখ্যালঘু মহল্লায় এসে ওঠার পর সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছিল এটা দেখে যে সেই বিধ্বংসী আগুনে ঝড়ের আঁচটুকু পর্যন্ত লাগেনি মধ্য কোলকাতার এইসব পাড়ার গায়ে। বহু রাত পর্যন্ত জেগে থাকে পার্ক সার্কাসের মুসলিম মহল্লার এইসব অলিগলি আর তাদের দোকানগুলো। বিশেষত সস্তা ‘চুলিয়া’ হোটেল আর পান-সিগারেটের দোকান। এদের সবার ঝাঁপ ফেলতে ফেলতে নিদেনপক্ষে বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা। তবে এদের সবার মধ্যে রেকর্ড সৃষ্টিকারী সামসুল হুদা রোডে মুমতাজ ভাইয়ের পান-সিগারেটের দোকান। বছরকয়েক আগেও খোলা থাকত রাত দুটো অবধি। ইদানিং সেটা একটায় এসে ঠেকেছে। নিমতলা আর ক্যাওড়াতলা শ্মশান চত্বরটা বাদ দিলে মুমতাজ স্টোরস-এ শহরে সবচেয়ে গভীর রাত অবধি খোলা থাকা পান-সিগারেটের দোকান। মুমতাজ ভাই, পুরো নাম মুমতাজ আলম। অত্যন্ত সুদর্শন চেহারার মানুষটি। নিপাট ভদ্রলোক, মৃদুভাষী এবং স্বল্পবাক। ইদানিং ধর্মকর্মে মন দেওয়ায় মাথায় গোল নামাজি টুপি আর একগাল শ্বেতশুভ্র দাড়ি। মুখে সদাসর্বদা একটা মিষ্টি এবং উদার সন্তসুলভ হাসি। আমি নিজে প্রায় পঞ্চাশ বছর ওঁকে ওই একইভাবে দোকানে বসে থাকতে দেখছি রোজ, ভোর ছটা থেকে দুটো। দুপুরে বাড়িতে খেতে যাওয়ার ঘণ্টাদুয়েক বাদ কেবল। মুখের হাসিটা টসকাতে দেখিনি একমুহূর্তের জন্য। রাত সাড়ে এগারোটা বারোটায় শহরের অন্যান্য পাড়াগুলো যখন অপার নীরবতায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ঠিক তখনি মুমতাজ ভাইয়ের দোকানের সামনে সন্ধে ছটার গিজগিজে ভিড়। ইদানিং বয়সের কারণে আর অতটা সময় দিতে পারেন না। ছেলেরা দোকানের দায়িত্ব নিয়েছে অনেকটাই। দোকানেরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে প্রচুর। পান সিগারেটের পাশাপাশি কোল্ড ড্রিঙ্কস আর রকমারি স্টেশনারি গুডসের ছড়াছড়ি দোকানে। তবু নিয়ম করে সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা, দুপুরের নামাজের সময় না হওয়া পর্যন্ত, রোজ এসে বসা চাই দোকানে। পঁচাত্তর পেরোনো ব্র্যান্ড পেটেন্ট হাসিটা আজও অটুট ঠোঁটের কোণে।
এহেন মুমতাজ ভাইকে নিয়ে একটা উল্লেখযোগ্য স্মৃতি রয়েছে এই অধমের। সেটা ৯৪ কি ৯৫ সাল। চাকরি করি একটা সামাজিক সমীক্ষা সংস্থায়। গভীর রাত অবধি অত্যন্ত জরুরি একটা কাজ চলছিল হিন্দুস্তান রোডের অফিসে। পরদিন অফিস আওয়ার্স শুরু হবার আগেই মুম্বাই হেড অফিসে পাঠাতে হবে রিপোর্টটা। এরকম একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাত একটা দেড়টা নাগাদ চুড়ান্ত ধূমপায়ী আমার দুই বসের সিগারেটের স্টক গেল খতম হয়ে, এবং আমারও। এত রাতে কোথায় পাওয়া যাবে বুদ্ধির গোড়ায় ধূম্র্রপ্রদানকারী সে মহার্ঘ বস্তু, আর সেটা না পেলে কীভাবেই বা কাল সকালের মধ্যে মুম্বাই আপিসে রিপোর্টটা পাঠানো যাবে, এইসব নানাবিধ চিন্তায় যখন যারপরনাই উদ্বিগ্ন আমার দুই ঊর্ধ্বতন, ভুতের রাজার ন্যায় হেসে “হঁবে হঁবে সঁব হঁবে ধুঁম হঁবে পাঁন হঁবে” বলে বরাভয় প্রদান করেছিল এই অধম। অতঃপর চরম বিস্মিত দুই বসকে সঙ্গে নিয়ে ওদেরই মধ্যে একজনের গাড়িতে চেপে সটান এসে হাজির হয়েছিলাম সামশুল হুদা রোডে মুমতাজ স্টোর্সের সামনে। ওই অত রাতেও দোকানের সামনে কমপক্ষে জনাপনেরো খদ্দেরের ভিড়। যা দেখে আক্ষরিক অর্থেই যাকে বলে চক্ষু চড়কগাছ দুজনের। বিস্ময়ের মাত্রা আরো কয়েকগুণ বেড়েছিল যখন আমার কাছে জেনেছিলেন, ভোর ছটা থেকে রাত দুটো অবধি ওই একইভাবে ঠায় বসে খদ্দের সামলান মুমতাজ ভাই। “ইয়ে জাদু কা রাজ কেয়া হ্যায় জনাব?” আমার ঊর্ধ্বতনদের মধ্যে অন্যতম, কলকাতা অফিসের ব্রাঞ্চ চিফ সৌম্যকান্তি চক্রবর্তী, আদতে বেনারসের মানুষ, জানতে চেয়ছিলেন চোস্ত উর্দুতে, চরম বিস্মিত গলায়। জবাবে ঠোঁটের কোণে সেই পেটেন্ট মৃদু হাসিটা আরেকটু চওড়া হয়েছিল শুধু। “রাজ কুছ নহি সাহাব। সব উপরওয়ালে কি মর্জি হ্যায়।” দুঃখিত মুমতাজ ভাই, ইশ্বর আল্লা, গড, কোনো উপরওয়ালাতেই বিশ্বাস নেই। তবে যে অগাধ অটুট বিশ্বাসে আপনার ওপরওয়ালার ওপর ভরসা রেখে কথাটা বলেছিলেন, সেই বিশ্বাস দীর্ঘজীবী করুক আপনার মত মানুষকে! এছাড়া আর কীই বা চাওয়ার থাকতে পারে আজীবন কেঠো এই নাস্তিকের।
আরও পড়ুন
ক্রিকেট, হকি, ফুটবল – কলকাতার খেপ খেলার দুনিয়ায় একমেবাদ্বিতীয়ম রিচার্ড হুপার
সংখ্যালঘু মহল্লার অন্যতম আরো দুটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, যে-কোনো বিষয়ে অনুকরণপ্রিয়তা এবং দোকানের চরিত্রবদল। প্রথমে আসি অনুকরণ প্রসঙ্গে। ধরুন মহল্লায় কেউ একজন রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকান দিল এবং লাভের মুখ দেখল। ব্যস! ওমনি ফুটপাতে ওই দোকানটার আশপাশ ঘিরে মিটারবিশেকের মধ্যে অনতিবিলম্বে গজিয়ে উঠল আরো গোটাবিশেক চায়ের দোকান। ফল যা হবার তাই হল। বেজায় অসুস্থ এই কাঁকড়া কম্পিটিশনের চক্করে পড়ে সবকটা দোকানই ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হল একসময়। এপাড়ায় বসবাসের এই দীর্ঘ সময়কালে এধরণের ঘটনা চাক্ষুষ করবার অভিজ্ঞতা হয়েছে একাধিকবার, বিশেষত বিভিন্নপ্রকার ফুটপাত ব্যবসার ক্ষেত্রে। অতঃপর বিষয় - দোকানের চরিত্রবদল.। আজ থেকে চারযুগেরও বেশি সময় আগে যখন এই মহল্লায় আসি তখন আমার বাড়ির উল্টোদিকে ছিল এক ডাক্তারবাবুর চেম্বার। কিছুদিনের মধ্যে সেটা হয়ে যায় চুলিয়া হোটেল। অতঃপর একে একে গোমাংসের দোকান, মুদিখানা, মোটর পার্টস শপ, চপ্পল অ্যান্ড সু স্টোরস, এস টি ডি বুথ, ভিডিও পার্লার, তেলের মিল, সাইবার কাফে, মোবাইল স্টোর্স, কেবল অপারেটরের অফিস ইত্যাদি একাধিক রূপ ও চরিত্রে রূপান্তরিত এবং পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমানে একটি গ্লাস অ্যান্ড প্যানেল ফিটিং স্টোরসে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েদের দেখে দমবন্ধ ভাব; সুন্দরী দেখার অভিজ্ঞতা পার্ক সার্কাসে এসেই
এই অবধি পড়ে যাদের কাছে ব্যাপারটা ব্রজবুলির সেই বিখ্যাত ব্রজদার গুল্পের মতো ঠেকছে, তাদের উদ্দেশ্যে বলি - একবার দয়া করে আসুন আমার মহল্লায়। এক নয় এরকম একডজন হাতেগরম নমুনা দেখিয়ে দেব। বলা যায় না, ততদিনে ওই কাঁচের দোকান ব্রয়লার চিকেন শপে বদলে গেলেও যেতে পারে।
আরও পড়ুন
বিপ্লব অসমাপ্ত রেখে, রেসের মাঠেই ঘুমিয়ে পড়েছে বুনো ঘোড়া
অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা
আরও পড়ুন
খাওয়ার মাঝখানে বরের মামাকে কান ধরে টেনে তুললেন সাধনকাকা, তেড়ে এল বরযাত্রীরা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কে সি দাসের দোকানে নিয়ে গিয়ে রসগোল্লা খাওয়াল ‘কিং কং’