কথা চলছিল গুগাবাবা-র চিত্রনাট্য লেখার আগে সত্যজিতের কলমকারিতে পুরো গুপি গাইন বাঘা বাইন গল্পটা লেখার বিষয়ে। কথাটা এসেছিল সেই ভূতের রাজার কাছে গুগাবাবা-র বর পাওয়ার ঘটনাটা পর্যন্ত। এরপরে সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠা, তাদের নিজেদের চমৎকার গান গাওয়া, খেতে বসা, তারপরে যখন তারা একটা বাসস্থানের বর চাওয়া হয়নি বলে আক্ষেপ করছে, ঠিক তখনই একজন গায়কের সঙ্গে দেখা হওয়া, সেই গানের দলের একজনের কাছ থেকে শুন্ডির রাজার গানের প্রতিযোগিতার খোঁজ পাওয়া--- সমস্ত ঘটনা একই রকম। এমনকি, শুন্ডির নাম ভুলে ঝুন্ডিতে পৌঁছোনো আর সেখানে হাড়হিম করা বরফে এসে আছড়ে পড়া পর্যন্ত সবটাই এক রকম। শুধু লক্ষণীয়, সত্যজিৎ তখন কেমন ভেবেছিলেন, গুপিবাঘার হাততালি দিয়ে অন্য কোথাও উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি, সেটা শোনা। সত্যজিৎ সেই প্রথম পাণ্ডুলিপিতে লিখেছিলেন, ‘Bagha and Goupi shoot up into the air like rockets--- leaving a smoke behind them. They soar through the air, which the greatest of ease and the landscape below them move so fast that it becomes a blur in their eyes.’ তবে সেই খসড়াতে শুধু বরফের দেশ ঝুন্ডি ছিল--- হুন্ডি ছিল না। তারপরেই তারা পৌঁছে গেল শুন্ডি। শুন্ডিতে পৌঁছে তারা দেখে সে এক ছবির মতো দেশ। চারপাশে ছোটো ছোটো পাহাড়। তার মাঝে ছোটো ছোটো বাড়ি। একজন বৃদ্ধ মানুষ একটা কুয়ো থেকে জল তুলছে। তাকে জিগেস করে তারা নিশ্চিত হল যে এই দেশের নাম শুন্ডি--- কিন্তু সে কথা বলে না কোনো। তারা যায় একটি বাজার এলাকায়। সেখানেও সব নিস্তব্ধ, সেখানে শুধু নানা ধরনের চলাফেরার শব্দ আর পশুপাখির শব্দ। সেখান থেকে তারা রাজদরবার যায়, সেখানে তাদের দিকে কেউ ভালো করে তাকায় না বলে, তারা সেই খসড়াতে দেখি সেখানেই তালি দিয়ে পরে নেয় রাজপোশাক। ছবি যারা দেখেছেন, তারা জানেনই, গুগাবাবার রাজপোশাক পরার দৃশ্য ছবির একেবারে শেষে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপিত। কিন্তু এই খসড়াতে এখানেই শুন্ডির সভাতে তারা ঢোকে রাজপোশাক পরে। ফলে আগে যে-সান্ত্রি তাদের দিকে তাকাচ্ছিলই না, এবারে সে যত্ন করে তাদের ভেতরে নিয়ে যায়। সেখানে সকলের গান গাওয়া, সেই গানে রাজার ঘুমিয়ে পড়া আর তারপরে হঠাৎ উঠে গুগাবাবার গান শোনানো পর্যন্ত ছবির মতোই। তবে, তাদের এই সভাগায়ক পদলাভের পরে একটি ছোটো অংশ ছিল সেই খসড়াতে। সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ‘One man among the courtiers--- a very suspicious-looking man in a heavy beard coldly surveys the proceeding and quietly slips out of the hall.’
এরপরে গুপি-বাঘাকে নিজেদের ঘরে পৌঁছোনো আর সেখানে শুন্ডির রাজার আসার দৃশ্যটি ছিল। তবে সেখানে রাজাকে কথা বলতে শুনে গুপি বিস্মিত হয়, রাজা কথা বলতে পারেন শুনে। আর বাঘার বিস্ময়ের অন্য একটা কারণ ছিল সেখানে। গুপি বলে, ‘বাট ইউ ক্যান স্পিক!’ আর বাঘা বলে, ‘অ্যান্ড বেঙ্গলি টু!’ একটি মহামারির কারণে তাঁর প্রজারা তাদের বাকশক্তি হারায় সেটা যেমন বলেন শুন্ডির রাজা, তেমনই তিনি বলেন, তিনি ও তাঁর পরিবারের সকলে তখন সপরিবার ছুটি কাটাতে দূরে কোথাও গেছিলেন। এরপরে বাঘা জিজ্ঞাসা করে, ‘হাউ ইজ্ ইট দ্যাট ইউ স্পিক মাই ল্যাঙ্গুয়েজ?’ তার উত্তরে রাজা বলেন, ‘ওহ, আই স্পিক মেনি ল্যাঙ্গয়েজেস। দ্য কিং হ্যাজ্ এ লট অফ ফ্রি টাইম, ইউ নো।’ রাজা তাহলে অবসর সময়ে ভাষা শেখে। পরের সংলাপেই রাজা বলে, আমি নিজেও যুদ্ধ ভালোবাসি না, আর যারা যুদ্ধ-যুদ্ধ করে তাদেরও ভালোবাসি না।
এইবারে দেখা যায়, ওই শুন্ডির রাজদরবার থেকে যে লোকটি সরে এলো, সে আসলে হাল্লার রাজার দূত। সে শুন্ডির সব খবরাখবর দিল। তারপরে আবার ছবির মতোই সব। শুন্ডির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শান্তরূপের হাল্লা রাজাকে উত্তেজিত করল হাল্লার মন্ত্রী। তবে সেখানে রাজাকে উত্তেজিত করার ধরনটি অন্য রকম। মনে আছে সকলেরই, ছবিতে হাল্লার মন্ত্রী আর জাদুকর বরফি একসঙ্গে গেছিল হাল্লারাজের কাছে। আর বরফির বানানো ওষুধ খাইয়ে হাল্লারাজকে হিংস্র করে তোলে মন্ত্রী। এই খসড়াতে ছিল অন্য ধরন। এখানে কিন্তু বরফি নেই--- মন্ত্রী নিজেই একটি সুতোয় বাঁধা চকচকে মাদুলি দোলাতে থাকে রাজার চোখের সামনে। আর সেই দোলানির সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় হাল্লার রাজার মুখ--- শান্ত থেকে হিংসায়।
আরও পড়ুন
গুগাবাবা: চিত্রনাট্য লেখার আগের গল্প!
আরও পড়ুন
না-হওয়া ছবির প্রস্তুতিপর্ব-২
শুন্ডির রাজার কাছে হাল্লার রাজার চিঠিতে যুদ্ধের হুমকি আসে। রাজা সংজ্ঞা হারান। রাত্রে গুগাবাবার সঙ্গে কথা বলাতে বোঝা যায়, রাজার উদ্বেগের কারণ। রাজা যুদ্ধ ভালোবাসেন না, তাই তিনি রাজ্য ছাড়তে তত দুঃখী নন, তিনি চিন্তিত রাজ্য তাকে ছাড়তে হবে হাল্লার রাজার কাছে। এই রাজাটি ভালো নয়, তার শাসনে ভালো থাকবে না প্রজারা, এটাই তাঁর চিন্তা। লক্ষণীয়, ছবিতে এখানেই কিন্তু শুন্ডির রাজা আর হাল্লার রাজা যে সহোদর ভাই, তার স্বভাবও যে কোমল, এই কথাগুলো পরে যোগ হয়েছিল। এখানে কিন্তু সে ভালো রাজা নয়--- এই কথাটাই বড়ো হয়ে থাকে। গুপিবাঘা যুদ্ধ থামাতে বের হবে শুনে, ছবি দেখিয়েরা মনে করে দেখবেন, রাজা এখানেই বলেন, তোমরা যদি যুদ্ধ থামাতে পারো, তাহলে তোমাদের একজনের সঙ্গে আমি আমার কন্যার বিবাহ দেব। সেই উৎসাহে তারা দুজনে বেরিয়ে পড়ে। প্রথম খসড়াতে অন্য রকম ছিল ব্যাপারটা। সেখানে, এরা যুদ্ধ থামাতে হাল্লা যাচ্ছে শুনে শুন্ডির রাজা বলেন, ‘মাই ডটার উইল স্পেশালি প্রিপেয়ার সাম সুইটস ফর ইউ।’ এই তারা রাজকন্যার কথা শোনে, উৎসাহিত হয়। রাজা বলেন, গুপিবাঘার গান শুনেছে তাঁর মেয়ে--- তাদের গান-বাজনা ভারি পছন্দের সেই রাজকন্যার। গুপিবাঘা দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে বেরিয়ে পড়বে ঠিক করে পরদিন সকাল সকাল।
আরও পড়ুন
না-হওয়া ছবির প্রস্তুতিপর্ব
এখান থেকে শেষ পর্যন্ত মোটের ওপর একেবারে ছবির সঙ্গে এক সেই খসড়াখাতার গল্প। সেই রওয়ানা হওয়ার পরের মুহূর্তে বারান্দায় রাজকন্যা দেখতে পাওয়া থেকে একেবারে মিষ্টির বৃষ্টি নামিয়ে যুদ্ধ থামানো আর সেখান থেকে হাল্লার রাজাকে নিয়ে শুন্ডিরাজার আকছে বন্দি করে আনা পর্যন্ত। এখানেও আছে জাদুকর বরফি। তার বর্ণনা এই রকম, ‘a man with a pointed beard and a pointed cap and a pair of dark glasses. This is Physician-Magician who is practically blind.’ এই অংশ মোটের ওপর এক নয়, একেবারে হুবহু এক--- সেখানে বর্ণনার ধরন একেবারে ছবির মতো পরপর দৃশ্যানুসারী। মজা ঘটে, হাল্লারাজাকে নিয়ে শুন্ডিরাজার কাছে এসে পৌঁছবার পরে।
আরও পড়ুন
ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি- অন্যভাবে পড়া
এখানেও হাল্লারাজা একমনে খেয়ে চলেছে হাঁড়ি-ভর্তি মিষ্টি, তাকে দেখে এগিয়ে আসে শুন্ডিরাজা। কিন্তু হুন্ডির রাজা তার দিকে এগিয়ে এসে তাকে কী বলে ডাকে জানেন পাঠক? শুনলে আশ্চর্য হবেন সেই ডাক শুনে। সত্যজিৎ তো সারা জীবন নানা ভাবে পিতা সুকুমারের লেখা আর ছবির নানা সুর-ছন্দ-রেখাকে নিজের সৃষ্টিতে ব্যবহার করে পিতাকে মনে করেছেন, এই সম্বোধন সেখানে এক অ-সামান্য সংযোজন। ঠাকুর্দা উপেন্দ্রকিশোরের লেখা গল্প, ছবির জন্য লিখছেন নাতি সত্যজিৎ, মাঝখানে কি কোনোভাবেই থাকবেন না সুকুমার? এই খসড়াতে দেখা গেল, শুন্ডির রাজা, হাল্লার রাজাকে দেখে চিৎকার করে ডেকে উঠলেন, ‘উধো’! তা শুনে হাল্লার রাজা চিৎকার করে উঠল ‘বুধো’ বলে। এই দুই নামে, উপেন্দ্রকিশোরের গল্পে মিলে গেল সুকুমারের হযবরল-র জগৎ। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে তারা। অতঃপর, একদিকে গুগাবাবা-র আনা ওষুধে প্রজাদের গলার স্বর ফিরে আসার ঘটনা আর সেই রাজকন্যার প্রসঙ্গ। এখানেও শুন্ডির রাজা নিজের লম্বা মেয়ের জন্য গুপিকে বাছে, আর তা শুনে বাঘার সেই বিখ্যাত আফশোস শুনে হাল্লার রাজা এই খসড়াতে বলে, ‘আর ইউ লুকিং ফর এ শর্ট প্রিন্সেস?’ শুধু ছোটোখাটো চেহারার রাজকুমারী নয়, সেই রাজকুমারী যে আবার বাঘার ঢোলের গুণমুগ্ধ সে কথাটাও জানা যায় হাল্লার রাজার কথায়। হাল্লার রাজা বলেন, বাঘার ঢোল যে রাজকুমারীর ভালো লাগে, সে কথাটা আবার সে নাকি তার বাবাকে বলেওছে!!
প্রথম খসড়ায় আরেকটি সুন্দর প্রসঙ্গ ছিল জানেন? পুরো ছবি দেখে অনেকেরই এক আফশোসের কারণ সেই প্রথম পাণ্ডুলিপিতে ছিল না অন্তত। কারণ, অনেকেই ছবি দেখে বলে থাকেন, গুপি বাঘার এই রাজত্বলাভে গুপির যে-বাবাকে আমরা প্রথমে দেখেছিলাম, সেই কানু কাইন কোথায় হারিয়ে গেল? মজার ব্যাপার হল, সেই প্রথম খসড়া শেষ হয়েছিল সানাইয়ের সুর আর দুই রাজকন্যার সঙ্গে গুগাবাবার বিবাহের দৃশ্য দিয়ে। সেই বিবাসভায় উপস্থিত শুন্ডি আর হাল্লার দুই রাজা আর তার সঙ্গে সেখানে আছে গুপির সেই বাবা কানু কাইন। সেই বিবাহসভায় আরেকজনের অবিশ্বাস্য উপস্থিতির কথাও সেই প্রথম খসড়াতে ছিল। তিনি কে জানেন? তিনি হলেন, স্বয়ং আমলকির রাজা। এই ছিল সেই প্রথম খসড়ার গল্প, সত্যজিৎ রচনাবলি কখনো যথাযথ বের হলে, নিশ্চয়ই এই পাঠ সকলের সামনে হাজির হবে--- সেটা থেকে একটা পুনর্লিখিত গল্পও যে কত সুখপাঠ্য হতে পারে, ভিনদেশি ভাষায় লেখা সত্যজিতের গল্প যে শুধু তাঁর প্রথম দুই গল্পই নয়, সেটাও আরো স্পষ্ট হবে ক্রমশ। দেখবেন আমাদের সত্যজিৎ-এর কলমকারিকে জানা-চেনা আর তাকে পাওয়ার কাজ এখনো অনেক বাকি আছে!
Powered by Froala Editor