এই পর্বের মানিকলমকারি-র জন্য এই কলমচির আন্তরিক কৃতজ্ঞতা তিন তরুণ তুর্কি সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অয়ন চট্টোপাধ্যায় আর সৌম্যকান্তি দত্ত সম্পাদিত রুচিমান ত্রৈমাসিক ‘বিচিত্রপত্র’-র জানুয়ারি- মার্চ ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি বিশেষ লেখার প্রতি। লেখাটি তৈরি করেছেন ঋদ্ধি গোস্বামী আর রাজীব চক্রবর্তী। লেখাটির নাম ‘খেরোর খাতায় মহাভারত’। সত্যজিৎ রায় নিয়ে যাঁদের বিন্দু-বিসর্গের আগ্রহও আছে, তারাও জানেন সত্যজিতের এই না-হওয়া ছবিটির কথা। সত্যজিৎ নিজে বলেছেন, তাঁর সঙ্গে যুক্ত মানুষের স্মৃতিতে এসেছে বারে বারে সত্যজিৎ একটি ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলেন ‘মহাভারত’ অবলম্বনে। কিন্তু সেই ভাবনাটি তাঁর কী ছিল, সে সম্পর্কে হাতে কলমে তেমন তেমন তথ্য ছিল না আমাদের হাতে। ফলে ‘বিচিত্রপত্র’ পত্রিকার এই লেখাটি সত্যজিৎ-চর্চায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহযোগ্য এবং প্রভূত বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। আজকের মানিকলমকারি সেই লেখাটির সঙ্গে মুদ্রিত সত্যজিতের লেখা অংশটি একবার মন দিয়ে পড়বার চেষ্টা করা আর কী!
প্রথমেই একটা বিষয় পরিষ্কার করে রাখা ভালো, সত্যজিৎ নিজেও বলেছিলেন সে কথা, গোটা মহাভারত চিত্রায়িত করার ভাবনা সম্ভবত সত্যজিতের ছিল না এই ছবিতে। সত্যজিৎ নিজেই তাঁর শ্রীলঙ্কা নিবাসী চিত্রপরিচালক বন্ধু জেমন লেস্টার পেরিসকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন যে কথা, তা জানাচ্ছেন সত্যজিতের জীবনীকার অ্যান্ড্রু রবিনসন। রবিনসন সেই চিঠির কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, এই ছবিতে ‘দ্য কনসেনট্রেশন হ্যাজ্ টু বি অন দ্য পার্সোনাল রিলেশনশিপ--- সো প্রোফাউন্ড অ্যান্ড সো টাইমলেস, অ্যান্ড দ্য রিফ্লেকশনস অন ওয়ার অ্যান্ড পিস, উইথ দেয়ার ইটারনাল ভ্যারাটিজ্’। রবিনসনের লেখা গ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছিল ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে সত্যজিৎ তৈরি করছিলেন এই ছবির খসড়া। অবশ্য আলোচ্য পাণ্ডুলিপিতে তাঁর লেখা-শুরুর দিনটি তাঁর হাতের লেখায় একেবারে নির্দিষ্ট--- সেটি হল ‘১৩।২।৫৯’। সত্যজিৎ এই মহাভারত নিয়ে কোনো চিত্রনাট্য রচনা করেননি। লিখেছিলেন যেটি, সেটি হল, এই ছবি তৈরির একটি একেবারে প্রাথমিক একটি খসড়া। সেখানে, দেখা যাচ্ছে, তিনি ছবিটিকে ভাগ করেছিলেন দুটি ভাগে। প্রথম অংশটিকে লিখেছিলেন ‘পার্ট ওয়ান’ বলে আর দ্বিতীয় অংশটি ছিল ‘পার্ট টু’। প্রথমে থাকবে ঠিক করেছিলেন, ‘ক্রীড়াপ্রদর্শন, জতুগৃহদাহ, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর, রাজসূয় যজ্ঞ, দ্যূতক্রীড়া--- বনগমন।’ আর দ্বিতীয় পর্বে থাকবে, ‘যুধিষ্ঠিরাদির প্রত্যাবর্তন (উত্তরা-অভিমন্যু), উদ্যোগপর্ব, কুরুক্ষেত্র, যুধিষ্ঠিরের অভিষেক’। তার মানে, একভাবে গোটা মহাভারত-ই হল--- তবে অনেক খানি সময়ের ব্যবধানে যেন বোনা হচ্ছে ছবির গল্প। কী ভেবেছিলেন তিনি? কোনো কথক থাকবেন তাঁর ছবিতে? তা না হলে তো, এই বড়ো সময়ের ব্যবধানকে ছবির মধ্যে বাঁধা সম্ভব ছিল না। অথবা অন্য কোনো মাধ্যম ব্যবহার করতেও পারতেন তিনি। ছবিটি কীভাবে শেষ করবেন, তার একটা ইঙ্গিত সেই খেরোর খাতাতে ছিল বলে জানিয়েছেন ঋদ্ধি আর রাজীব। বলেছেন, ‘যুদ্ধের শেষে বিধবা কুরুপত্নীদের সঙ্গে গান্ধারী যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত পরিজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন--- এটাই ছিল শেষ দৃশ্য’।
এই খসড়াতে দেখা যাবে, চিত্রনাট্য তৈরি করার আগে কোন গভীর অভিনিবেশে সত্যজিৎ সন্ধান করছিলেন সেই সময়ের প্রতিদিনের জীবনযাপনের খুঁটিনাটি। পোশাক, লোক সংস্কার, খাদ্য, আচার ব্যবহার, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজকীয় অনুষ্ঠানের আচারপালনের বিচিত্র রীতি--- সবই তিনি খুঁজে দেখছিলেন আর লিপিবদ্ধ করছিলেন মহাভারত গ্রন্থ থেকে। লক্ষ করা যাবে, কালীপ্রসন্ন সিংহ আর রাজশেখর বসুর সারানুবাদ তাঁর হাতের কাছে অবশ্যই ছিল। তাদের থেকে তিনি বেছে নিচ্ছিলেন নিজের জন্য দরকারি তথ্যাদি। মূল গল্পের একটা কাঠামো তো তাঁর মনের ভেতরেই ছিল--- এই নোটসে তিনি লিপিবদ্ধ করছিলেন সেই কাহিনিকে চিত্রবদ্ধ করার খুঁটিনাটি। ছবি তো তৈরি হত--- কিন্তু ছবি তৈরির জন্য এই নোটস যেন সত্যজিতের কাজের পদ্ধতি বোঝার এক চমৎকার পাঠশালা। ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীর জন্য অনুসরণীয়--- তবে এ কথাও জানা যে, এই চিন্তন পদ্ধতি আজও দুর্লভ!
আরও পড়ুন
ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি- অন্যভাবে পড়া
কী লিখছিলেন সত্যজিৎ? লিখছিলেন, ‘মহাভারতে বিবাহ’ কেমন ছিল? লিখছেন সেই ‘বিবাহসভার বর্ণনা’ কীভাবে রয়েছে সেখানে? ধরা যাক, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভাতে মহাভারত উল্লিখিত কন্যাপ্রার্থীদের পোশাক পরিচ্ছদের বর্ণনা কেমন পাওয়া যায়। সেখানে উপস্থিত হওয়ার সময় দ্রৌপদীর পোশাক কেমন ছিল বলে, মহাভারতে বলা হয়েছে? যেভাবে সত্যজিৎ সাজাচ্ছেন এই অংশটি, সেটি ছবির ভাষা--- সেখানে কোন শব্দ কখন আসবে, কোন শব্দ কখন বন্ধ হয়ে নতুন কোন শব্দ যোগ হবে, তার একটি সানুপুঙ্খ বর্ণনা। একটু শোনা যাক সেই লেখা--- সত্যজিৎ লিখছেন, ‘যথাসময় শুভমুহূর্তে সুবসনা সর্বাভরণভূষিতা কন্যা হাতে একগাছি পুষ্পমালা বা কাঞ্চনমালা লইয়া প্রবেশ করিলেন--- তূর্যধ্বনি--- পুরোহিত সভামণ্ডপে কুশণ্ডিকা করিয়া অগ্নিতে বেদমন্ত্রে ঘৃতাহুতি দিলেন। ব্রাহ্মণগণ সমস্বরে স্বস্তিবচন পাঠ করিলেন। কর্তৃপক্ষের আদেশে তূর্যধ্বনি বিরত হইল। সভা নিঃশব্দ। কন্যার ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন সমাগত পাণিপ্রার্থীদের প্রত্যেকের নাম ও গোত্র উল্লেখ করিয়া ভগিনীর নিকট পরিচয় করাইয়া দিল।’ এর অনেকটা পরে আছে, কেমন হবে এই স্বয়ম্বর সভা, কোথায় তার অবস্থান--- তার বর্ণনা। সত্যজিৎ লিখেছেন, মূল মহাভারত অবলম্বনে, ‘নগরের ঈশানকোনে সমভূমির উপর চতুর্দিকে প্রাসাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত সভাগৃহ। প্রাকার এবং পরিখাযুক্ত, দ্বার, তোরণ প্রভৃতির দ্বারা মণ্ডিত।’ বিবরণ আরো আছে। তাহলে, ছবির ভাষা অনুসারে আরেকবার পড়ে দেখুন পাঠক, দেখবেন, প্রথমে বহুদূর থেকে দেখা গেল স্বয়ম্বরসভা। ভেসে আসছে হয়ত আবাহসংগীত। সেই আবহসংগীতের সঙ্গেই আমরা গেলাম সভার ভেতরে, দেখতে পেলাম সভায় উপস্থিত সকলকে। বেজে চলেছে সেই আবহসংগীত, আবহের সুর বদল হল, দেখা গেল সভায় প্রবেশ করলেন দ্রৌপদী। এবারে সেই আবহের সুর ছাপিয়ে সভাতে বেজে উঠল তূর্যধ্বনি। তার সঙ্গেই রাজকন্যার পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল যজ্ঞকর্মের কাজ। অর্থাৎ, সেই শব্দে যুক্ত হল বেদমন্ত্রপাঠের গম্ভীর নিনাদ। এই বেদমন্ত্র পাঠ শুরু হওয়ামাত্র রাজার লোকের আদেশে স্তব্ধ হল তূর্যধ্বনি। এবারে শুধু শোনা যাচ্ছে ব্রাহ্মণদের স্বস্তিবচন। দ্রৌপদী এগিয়ে এসে নিজের জায়গায় পৌঁছলেন। প্রাথমিক সেই স্বস্তিবচনের পরে কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। নিশ্চয়ই সেই সময়ে দ্রৌপদীর রূপ দেখে উপস্থিত পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। তারপরে রাজপুত্র, দ্রৌপদীর অগ্রজ ধৃষ্টদ্যুম্ন একে একে জানাতে লাগলেন উপস্থিত সকলের পরিচয়। কী বলবেন একে, এ কি তাঁর মনের ভেতর জাগরুক একটি চিত্রভাষার বর্ণনা নয়?
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সংলাপ-ভাবনা
এছাড়াও কত ধরনের কথা নোটস হিসেবে রেখেছেন সত্যজিৎ। পোশাক হিসেবে পড়তে পড়তে যেমন যেমন তথ্য পেয়েছেন লিখে গেছেন তা--- লিখেছেন দ্রোণ আর কৃষ্ণ পরবেন সাদা রঙের ধুতি। কর্ণ পরবেন পীত বা হলুদ রঙের ধুতি, অশ্বত্থামা আর দুর্যোধনের পরনে থাকবে নীলরঙের কাপড়। লিখে রেখেছেন, যুদ্ধের সময় বীরগণ ‘রক্তবস্ত্র পরতেন’। লেখা আছে, ‘পুরুষদের মাথায় লম্বা চুল’--- তবে দুর্যোধনের থাকবে বেশ প্রলম্বিত চুল আর অর্জুনের থাকবে বেণী। এক জায়াগায় লেখা--- ‘ভিন্ন ভিন্ন কাজের সময় ভিন্ন ভিন্ন বস্ত্র’। তৈরি করছিলেন খাদ্যতালিকাও। লক্ষ করেছেন, ভাতের সঙ্গে ‘পিঠা, গুড়, দুগ্ধ, ঘৃত, তিল, মৎস্য, মাংস, শাক আর তরকারি’ খাবার যেমন চল ছিল, তেমনই ছিল ‘আচারস নানাজাতীয় টক, সরবত’ খাওয়ার রীতি। উল্লেখ করা হয়েছে, ‘প্রায় সকলেই মাংস খাইতেন। বরাহ ও হরিণের মাংস।’ ‘মাছের ব্যবহার কম ছিল।’ তার সঙ্গে উল্লিখিত, ‘সুরাপানের বাড়াবাড়ি--- অভিজাত ঘরের কুলবধূগণ সুরাপানে অভ্যস্ত ছিলেন’--- যেমন, দ্রৌপদী, সুভদ্রা, উত্তরা-র সুরাপানের কথা তিনি পাচ্ছেন মহাভারতে।
আরও পড়ুন
এক চিত্রনাট্যের ‘খসড়া’-বৃত্তান্ত!
আসলে প্রাচীন মহাভারতীয় জীবন সংস্কৃতির একটি বর্ণাঢ্য চিত্র যেন নিজের মধ্যে তৈরি করতে চাইছিলেন সত্যজিৎ। মেথড অ্যাক্টিং যেমন একটি পদ্ধতি--- তেমনই লেখারও যে একটা মেথোডলজি থাকতে পারে, এই অনুশীলন যেন তারই পাঠশালা। লেখক পাঠ-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজেকে জারিয়ে নিচ্ছেন সেই সময়ের সঙ্গে, তারপরে হয়ত শুরু করবেন তার চিত্ররূপময় গল্প-লেখার কাজ। সত্যজিৎ রায় মহাভারত করে যেতে পারেননি, এ নিয়ে শুধু বাঙালির কেন, তামাম চলচ্চিত্রমোদী মানুষের আক্ষেপ এতদিন ছিল কতকটা নৈর্বক্তিক। মুখচলতি কথায়, সত্যিই আরেকটা ভালো কিছু পেলাম না--- তার আক্ষেপ। কেউ অবশ্যই ভাবেন, সত্যজিতের পরিচালনায় সত্যিই তো আকিরা কুরোসাওয়ার প্রিয় অভিনেতা তোশিরো মিফুনে-কে দুর্যোধন চরিত্রে না দেখতে পাওয়ার দুঃখও তো কম নয়! তার সঙ্গে এই ছোট্ট খসড়ার কয়েক পাতা থেকে সম্প্রতি, তাঁর শতবার্ষিকীতে সেই দুঃখ আর বেদনাবোধ যেন আরো গভীর হয়ে উঠল। এই বেদনাবোধ, এই না-পাওয়াকে যথার্থ অনুমান করতে পারার কষ্ট সেই না-হওয়া ছবি সম্পর্কে সত্যজিৎপ্রেমীদের কষ্টকে আরো সহস্রগুণ করে দিল--- সেই বেদনাবোধই হয়ত বা সেই স্রষ্টার শতবার্ষিকীতে আমাদের অন্যতম সেরা পাওনা।
আরও পড়ুন
এক অন্য সত্যজিতের কথা
Powered by Froala Editor