প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের প্রথম গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি’। গল্পটির এটাই প্রথম পরিচয়। সাধারণভাবে আমরা তো সেইভাবেই চিহ্নিত করে থাকি এই গল্পটিকে? মানে একটি চরিত্রভিত্তিক গল্পমালার প্রথম গল্প। সেই চরিত্রটিকে নিয়ে আরো অনেক লেখা হবে। কালক্রমে বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ চরিত্র হয়ে উঠবে প্রফেসর শঙ্কু। তবে, কেই বা আর না জানে, সত্যজিৎ নিজেও তো কতবার বলেছেন, প্রফেসর শঙ্কুকে নিয়ে একটা সিরিজ বানাবেন এমন কোনো ভাবনা আদতে তাঁর ছিল না। পরে সেটা হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে দেখলে, এই ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়ারি’ একটা আলাদা গল্পও তো বটে। অথচ, সেই আলাদা গল্প হিসেবে একে আমরা তো দেখি না সেভাবে। মনের অজান্তেই, একটি গল্পমালার প্রথম হিসেবে পড়াটা আমাদের অভ্যাস। যদি তা না হত, তাহলে এই গল্পটির পড়া বোধ হয়, অন্য রকম হতেই পারে। সেই পড়াটার যুক্তিপট কেমন হতে পারে, সেটার একটু সন্ধান হতে পারে আজ?
অদ্ভুতভাবে, এই গল্পে আছে দুজন আমি। একজন ‘আমি’ আমাদের কাছে শঙ্কুর ডায়রির কথা জানায়, আরেকজন 'আমি' হলেন প্রফেসর শঙ্কু নিজেই। গল্পে যেখান থেকে ডায়েরি শুরু হল, সেখান থেকে সেই ডায়েরির লেখক তো শঙ্কুই। শঙ্কুর কথায় পরে আসব, আগে দরকার যিনি এই ডায়রির খোঁজ পেলেন তাঁর কথা। তিনি একজন পত্রিকার আপিসের কর্মী। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে জনৈক তারক চাটুজ্যে। এই তারক চাটুজ্যেই খুঁজে পেয়েছেন প্রফেসর শঙ্কুর ডায়রিটা। সুন্দরবনের মাথারিয়া অঞ্চলে মহাকাশ থেকে ছিটকে আসা একটি উল্কাখণ্ড নাকি তৈরি করেছিল এক বিরাট গহ্বর, সেই গহ্বরের ভেতর পাওয়া গিয়েছিল প্রফেসর শঙ্কুর ডায়েরি। তার লেখার রং বদলের কথা, তার পাতা কোনোক্রমেই না ছিঁড়তে পারার কথা, আগুনের তাপে সেই পাতা না-পোড়ার কথা, সেগুলো তো আমাদের জানা। কিন্তু, প্রশ্নটা হল, ওইখানে ওই ডায়েরি এলো কী করে? প্রফেসর তো বহুদিন হল নিরুদ্দেশ। বহুদিন মানে বছর পনেরো হল তিনি বিলকুল লা-পাতা। আসলে এই কোনো এক না-জানা উল্কাখণ্ড আর ওই বছর পনেরো শব্দ দুটির মধ্যেই যে আসল একটা গল্প আছে, সেটা আমরা লক্ষ করি না।
গল্পে যেখান থেকে শঙ্কুর ডায়রির সূচনা, সেখানে জানা যায় সক্কলের চক্ষের অলক্ষ্যে শঙ্কু আবিষ্কার করেছিলেন একটি মহাকাশযাত্রার রকেট। শুধু আবিষ্কার করেননি, তিনি আর তাঁর কিছু সঙ্গী সেই রকেটে চড়ে করেছেন ব্যোমযাত্রা। তাঁর ব্যোমযাত্রার সঙ্গীরা কে? একজন তাঁর ভৃত্য প্রহ্লাদ, একজন তাঁর পুষ্যি নিউটন নামধারী মার্জার আর বিধুশেখর--- তাঁর আবিষ্কৃত এক অদ্ভুত যন্ত্রমানব বা রোবট। তারা প্রথমে মঙ্গল গ্রহে যায়, সেখানে তাদের দিকে যখন ধেয়ে আসে সেখানকার আশ্চর্য সব প্রাণীর দল, তখন কোনোক্রমে তারা সেই রকেট চড়ে আবার ব্যোমযাত্রার পথে এগিয়ে চলে। আর তখন সেই ব্যোমযাত্রীর লক্ষ্য হয় আমাদের সূর্য থেকে ভিন্ন কোনো সূর্যের অন্য এক গ্রহ। সেই গ্রহের নাম টাফা। এ আসলে এক সাংঘাতিক ব্যোমযাত্রীর অভিজ্ঞতার বিবরণ। সেখানকার মানে সেই টাফা গ্রহের প্রাণীদের সঙ্গেই মিশে যান প্রফেসর শঙ্কু। কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখক সত্যজিৎ লেখেন সেই চমৎকার লাইন: বিজ্ঞানী শঙ্কু যখন টাফাগ্রহের বাসিন্দা পিঁপড়ের মতো প্রাণীদের বললেন, "কই হে, তোমাদের বৈজ্ঞানিক টৈজ্ঞানিকরা সব কোথায়?" তার উত্তরে তারা বলে, "ও সব বিজ্ঞান টিজ্ঞান দিয়ে আর কী হবে? যেমন আছেন থাকুন না। আমরা মাঝে মাঝে আপনার কাছে আসব। আপনার সহজ সরল কথাবার্তা শুনতে আমাদের ভারী ভালো লাগে।" তাদের সেই কথাকে শঙ্কুর মনে হল ন্যাকামো। আসলে টাফা গ্রহের বাস্তবতা আর আমাদের পৃথিবীর 'উন্নততর' বাস্তবতার ধারণাই যে আলাদা।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সংলাপ-ভাবনা
আরও পড়ুন
এক চিত্রনাট্যের ‘খসড়া’-বৃত্তান্ত!
এই ব্যোমযাত্রীর অভিজ্ঞতা আমরা পড়ছি কবে? ১৯৬১ সালে। ঠিক তার আগের বছর মানবসভ্যতা পৌঁছেছে মহাকাশে। ১৯৬০-এ ইউরি গ্যগারিনের মহাকাশ অভিযান আর ঠিক তার পরের বছরেই শঙ্কুর কলমে ছোটদের জন্য প্রফেসর শঙ্কুর ব্যোমযাত্রীর ডায়রির প্রকাশ। নিল আর্মস্ট্রংয়ের চন্দ্রাভিযান তখনো বছর সাত আটের দূরের ব্যাপার। ১৯৬০-এ মহাকাশযাত্রার ইতিহাস হলেও, ইনি যে প্রফেসর শঙ্কু! তিনি বা ঘনাদারা কি আর পশ্চিমি মানুষের অভিযানের পরে এমন অভিযান করতে পারেন? এখানেও তার ইঙ্গিত তো ছিল। লক্ষ করার মতো ব্যাপার হল, ১৯৬১-তে তো ওই ডায়রি পাওয়া গেল। তার বছর পনেরো আগেই তো শঙ্কু নিরুদ্দেশ। তার মানে, ১৯৪৫ সাল নাগাদ শঙ্কুর ব্যোমযাত্রা সম্পূর্ণ। অনেকে অনেক রকম ভাবতেই পারে এই গল্পসূত্র। কারণ, সেই গল্পের শুরুতে বলা হয়েছিল, আসল কথাটি হল, মানবসভ্যতার মহাকাশ যাত্রার পনেরো বছর আগেই প্রফেসর শঙ্কুর ব্যোমযাত্রার পর্ব সম্পন্ন হয়েছে। আর শঙ্কু নিরুদ্দেশ হয়ে আছেন এই মহাবিশ্বের অন্য কোনো সৌরজগতে। ফলত, সেই মহান নিরুদ্দেশের গল্প এটি। আচ্ছা তাহলে, ওই সুন্দরবনের মাথারিয়া অঞ্চলে মহাকাশ থেকে ছিটকে আসা উল্কাখণ্ডটি তাহলে কী ছিল? তা কি ওই টাফা গ্রহ থেকে পাঠানো প্রফেসর শঙ্কুর অন্য কোনো আবিষ্কার? সে কথা তো আর বলেননি গল্পকার। সেই উল্কাখণ্ড কি আসলে পৃথিবীতে ফিরতে না-চাওয়া নিরুদ্দিষ্ট প্রফেসর শঙ্কুর নিজের হাতে লেখা ডায়রি পাঠাবার একটি উপায়? সে কাহিনিও সত্যজিতের কলমকারিতে স্পষ্ট করা নেই। পাঠক হিসেবে আমরা যদি সেভাবে পড়তে চাই, অসুবিধার কী আছে?
আরও পড়ুন
এক অন্য সত্যজিতের কথা
পুনশ্চ: প্রেমেন্দ্র মিত্র বিশ শতকের শুরুতেই লিখেছিলেন এক আশ্চর্য উপন্যাস পিঁপড়ে পুরাণ।অদ্ভুত ভাবে সেই উপন্যাসে আছে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কীভাবে পিপীলিকাকুল তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করল, তার বৃত্তান্ত। সেদিক থেকে দেখলে ওই পিঁপড়ে পুরাণ আর টাফা গ্রহের পিঁপড়ের কাহিনি এক আশ্চর্য ধারাবাহিকতায় যেন অন্বিত হয়ে আছে। তাই না?
আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর অন্য ভূতের
Powered by Froala Editor