মানিক রায়ের এক অন্যরকম কলমকারির সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল গত কিস্তিতে। ‘এক্ষণ’ পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল সেই লেখা। ‘এক্ষণ’-এর সম্পাদকমশাই নির্মাল্য আচার্য প্রথমে লিখেছিলেন একটি চিত্রনাট্য। সেই চিত্রনাট্যের কিছু সমস্যা বোঝাতে গিয়ে সত্যজিৎ নিজেই একটি গোটা লেখা তৈরি করে দিলেন তাঁকে। যে-চিত্রনাট্য নিজে লিখছেন না, যে-চিত্রনাট্য থেকে তিনি নিজে কোনো ছবিও করবেন না--- কেবল অনুজপ্রতিম বন্ধুকে বিষয়টি বোঝাবার জন্য গোটা একটা চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরি করলেন সত্যজিৎ। তখন তিনি নিজে খ্যাতির শিখরে, ব্যস্ততা তাঁর পাহাড়প্রমাণ, তাও এই ধরনের এক কলমকারি সারলেন তিনি। গত কিস্তিতে সেই লেখা তৈরির পশ্চাৎপট বিষয়ে কিছু কথা বলা গিয়েছে, এই কিস্তিতে সেই লেখার কথা বলা কথা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে প্রস্তুত এই চিত্রনাট্যের খসড়া। ‘এক্ষণ’-এর পাতায় লেখা হয়েছিল ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনীর ছায়ায়’ ‘জীবন যে রকম’ তারপরে তৃতীয় বন্ধনীর ভিতর সত্যজিতের হাতের লেখায় ‘চিত্রনাট্যের কাঠামো’। লক্ষণীয় শব্দটি--- ‘চিত্রনাট্যের কাঠামো’। কী যত্নে লেখা এই কাঠামো--- সংকেতের মতো কেবল, নিজে বুঝতে পারব, এমন লেখা নয়। একেবারে টানা একটা চিত্রনাট্যের খসড়া। যথাযথ তার লিখন পদ্ধতি--- ঘটনাকালের স্থান, কাল, সময় এমনকি কে কী ধরনের কাজ করছে, কে কোথায় হাঁটছে বা চলছে, প্রয়োজনমতো টুকটাক সংলাপের নমুনা আর কোথাও শুধুই সংলাপের ইঙ্গিত। তবে সামান্য কিছু বিষয় অবশ্যই এখানে আছে, যেখানে, তিনি নির্মাল্য আচার্য-র মূল চিত্রনাট্যের সূত্রটুকু ব্যবহার করেছেন বলেই বোধহয় সেখানটা আর ডিটেলস লেখেননি। বিশেষ করে ‘ছয় রিপু’-র দলের ভূমিকা, পরে দেখব, একেবারেই স্পষ্ট করেননি সত্যজিৎ। তখন মনে হয়, নির্মাল্যবাবু যদি তাঁর স্বভাবোচিত বিনয় পরিত্যাগ করে, নিজের লেখা চিত্রনাট্যটিও এখানে ছেপে দিতেন, তাহলে পরবর্তী সত্যজিৎ-চর্চাতে এই দুই পাঠের সম্পূরণ আরো স্পষ্ট হতে পারত। এই কোথাও কোথাও প্রসঙ্গ স্পর্শ করে চলে যাওয়ার ব্যাপারটিতে মনে রাখতেই হবে যে, এই চিত্রনাট্য সত্যজিৎকে নির্মাল্য আচার্যমশাই দিয়েছিলেন একটু দেখে দেওয়ার জন্য। এক অর্থে এই চিত্রনাট্যের একটি প্রথম খসড়াতে প্রযোজক সংস্থা মোটের উপর তাদের সম্মতি জানিয়েছিল।
পুরো ছবিটি মোট আটদিনের ঘটনায় সাজানো। এই আটটি দিন একেবারে স্পষ্টত উল্লিকিত চিত্রনাট্যে। প্রথম দিন ছবির শুরুতেই লেখা ‘বিজ্ঞাপনের আপিস। সকাল।’ গল্পের প্রধান চরিত্র নীলু এই আপিসে আসে--- এই আপিসের মালিক রমেন দত্ত-ই তাকে আসতে বলেছেন, তাদের সম্পর্কের কথা বলতে কেবল লেখা, ‘মালিক রমেন দত্তকে নীলু এককালে চিনত রাজনীতির সূত্রে’। এমনভাবে তাদের পরের কথাগুলো লেখা, যেখান থেকে বোঝা যাবে, তারা এই সময়ে কী কথা বলবে, কী তাদের আলাপের বিষয় হবে। এমনকি, এমন একটি ছোট্ট প্রসঙ্গের উল্লেখ করলেন এখানে সত্যজিৎ, যা দিয়ে বেশ পরিষ্কার বোঝা যাবে, তাদের সম্পর্কের ধরনটির মধ্যে যে এক ধরনের ইনফর্মাল একটা ব্যাপার আছে, তাও। সত্যজিৎ লিখেছেন, ‘নীলু রাজনীতি ছাড়াও জার্নালিজম করেছে, কবিতা লিখেছে ইত্যাদি। রমেন তার লেখার সঙ্গে পরিচিত। নীলুর চাকরির দরকার বলে সে রমেনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে দেখা করতে এসেছে।’ লক্ষ করার মতো প্রতিটি বাক্য। একেবারে যথার্থ চিত্রনাট্য-লিখিয়ের কলমে লেখা প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি প্রসঙ্গ। এই কটি বাক্যই তো উঠে আসবে তাদের সংলাপে। এই বাক্যগুলি থেকে তাদের দেখা করার বিষয়টি স্পষ্ট করেই, এক লহমায় তাদের সম্পর্কের ভেতর যে ঠিক মালিক-চাকুরে সম্পর্ক নয়, তাদের মধ্যে যে একটা আন্তরিক দিকও আছে, সেটাও স্পষ্ট হয় পরের প্রসঙ্গেই। রমেনের আপিসের সুন্দরী অবাঙালি রিসেপশনিস্ট শান্তাকে দেখতে পাই। শান্তাকে দেখে একটু হকচকিয়ে যায় নীলু। তারপরেই, রমেন নীলুকে বলে, ‘তোমাকে মাঝে মাঝে মডেল-এর কাজেও লাগিয়ে দেব--- তোমার চেহারা ভালো’। নীলু তার উত্তরে বলে, ‘একটি মডেল তো ঢুকবার সময়েই দেখলাম’। কী চমৎকার একটি সংলাপ। রমেন-নীলুর সম্পর্কও দর্শকের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল--- সবচেয়ে বড়ো কথা, মূল গল্পের প্রস্তাবনাও হয়ে গেল। কারণ, গল্পে দেখা যাবে, এই আপিসে নীলুর সঙ্গেই শান্তার একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠবে। আর তারপরেই উন্মোচিত হবে, শান্তার বিষয়ে আগ্রহী কোম্পানির মালিক রমেনও। এই তিনজনের সম্পর্কের কাহিনি যেমন এই ছবি, তেমনই এই গল্প অবশ্যই নীলু আর তার বাড়ির লোকেরও। এই দারিদ্র থেকে কীভাবে সে এগিয়ে নিয়ে যাবে শান্তার সঙ্গে তার সম্পর্ক, শান্তাও যে কীভাবে নীলুর সঙ্গে সম্পর্কটি মেনে নেবে আনন্দের সঙ্গে, রমেনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেড়ে--- এ কাহিনি তো তার আখ্যানও। একটু ভেবে দেখুন, সত্যজিৎ এই ধরনের একেবারে মেইনস্ট্রিম ছবির গল্প তো নিজের জন্য বাঁধেন না, তবু কী চমৎকার এক বাঁধুনিতে গল্পটিকে ধরলেন তিনি। সত্যজিতের এই অন্য রকম চিত্রনাট্যীয় কলমকারির সন্ধান নিঃসন্দেহে তাঁর সহকারী নিত্যানন্দ দত্ত-র জন্য লেখা ‘বাক্স বদল’-এর চিত্রনাট্যও। এই ধরনের চিত্রনাট্য তিনি নিজের জন্য না-ই লিখুন, একেবারে তখনকার মূলধারার ছবির জন্য চিত্রনাট্যের ধরনটিও যে তাঁর বেশ জানা ছিল--- এই ‘বাক্স বদল’-এর পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্য আর ‘জীবন যে রকম’-এর ‘চিত্রনাট্যের খসড়া’ তার বড়ো প্রমাণ।
আরও পড়ুন
এক অন্য সত্যজিতের কথা
এই ‘খসড়া’ থেকে একেবারে প্রথম দৃশ্যেই তিনি সামান্য কথায় নীলুর বাড়ির পরিস্থিতি, তাকে কোন অবস্থার মধ্যে বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও এই বিজ্ঞাপনের কপি-লেখার কাজটি নিতে হচ্ছে, সবটাই স্পষ্ট করে দেন ‘খসড়া’-লেখক সত্যজিৎ।
আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর অন্য ভূতের
নীলু সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আসে যখন, তার আগেই দেখা যায়, তার দিদি অপর্ণা তার স্বামীর কাছ থেকে বঞ্চিত প্রতারিত হয়ে ফিরে এসেছে বাপের বাড়ি। নীলু জানায় বাবাকে, ‘রোজগার যখন করতেই হবে, তখন এ বাজারে কম্প্রোমাইজ্-টাও প্রায় অবশ্যম্ভাবী।’ ছেলের এই কথায় বাপ রাসমোহনের প্রতিক্রিয়াটি কী, তাও উল্লেখ করে দেন সত্যজিৎ। লেখেন, ‘রাসমোহন মন্তব্য না করে কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে’। নীলুর ভাই দীপুর গল্পটি আরেক রকম--- সে উদ্দেস্যহীনভাবে শহরে ঘুরে বেড়ায়, কোনো এক ছয় রিপু-র দলের মধ্যে সে পড়ে আছে পাকেচক্রে। সে দিশাহীন। যদিও আগেই বলেছি, এই ছয় রিপুর দলের ধনঞ্জয়, সুকুমার, ভূপে-দের ঠিক চিনতে পারা যায় না। কেবল সত্যজিৎ লেখেন, ‘ছয় রিপু। এদের সঙ্গে দীপুর সম্পর্ক এস্টাব্লিশড হয়। দীপু এদের কাছাকাছি থেকেও এদের দলে নেই--- যদিও এরা দীপুকে দলে টানার চেষ্টা করে। দীপু সহজে প্রলুব্ধ হয় না, প্রোভেকড-ও হয় না--- এটাই দীপুর বিশেষত্ব।’
আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর তামাম-জীবন ১
নীলু-শান্তার সম্পর্কটি কীভাবে গড়ে উঠবে--- কীভাবে পুনেতে বড়ো-হওয়া শান্তাকে কলকাতার এক অন্য ছবি দেখাতে দেখাতে নীলুর সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে--- তাও উল্লিখিত ডিটেলসে। নীলু তাকে মার্বেল প্যালেস দেখায়, নীলুর সঙ্গে এই ধনাঢ্য প্যালেস দেখে যেমন বিস্মিত হয় শান্তা--- তেমনই শান্তাকে বামপন্থায় বিশ্বাসী নীলু তাকে চেনায় এক অন্য কথাও। কলকাতার বাবুয়ানির এক ভিন্ন ইতিহাসও। সত্যজিতের খসড়াতে দেখি সে বলে, ‘নীলু বোঝায় এই অ্যাফ্লুয়েন্স বাবুয়ানা, অর্থবৈষম্য ইত্যাদির সঙ্গে আজকের অশান্তির যোগসূত্র কোথায়। শান্তা বলে, তাকে এসব কেউ কোনোদিন বোঝায়নি, কারণ তাদের পারিবারিক জীবনের সঙ্গে এ ধরনের রাজনীতির কোনো সংস্রব ছিল না।’ এরপরেই সত্যজিৎ লেখেন, ‘নীলু স্বভাবতই মার্ক্সিজম-এর প্রসঙ্গও এনে ফেলে।’ তাদের সম্পর্ক এগোতে থাকে এক উদাসীনতায়। নীলু শান্তাকে জানায়, সে একজনকে ভালোবাসত, সে এখন বিয়ে-টিয়ে করে সংসার করছে। শান্তাও জানায়, ‘তাকেও একজন বোধহয় ভালোবাসে--- কিন্তু এখনও সে সেটা প্রকাশ করেনি। প্রকাশ করলে মুশকিল হবে। কারণ শান্তা তাকে ভালোবাসে না--- যদিও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ আছে।’ এই ব্যক্তিটিই যে তাদের কোম্পানির মালিক রমেন--- সেটি পরে বোঝা যাবে। মার্বেল প্যালেসের উল্টোদিকে নীলু শান্তাকে বলে, ‘চলো এবার আরেকটা ইন্টারেস্টিং বাড়ি দেখাই।’ সেই ইন্টারেস্টিং বাড়িটা হল, নীলুর নিজের বাড়ি। সাতের দশকে সত্যজিতের কলকাতা-ত্রয়ীর সম্পূরক-ও তো হতেই পারত এই ‘খসড়া’ ছবিটিও।
আরও পড়ুন
গীতিকার সত্যজিতের দুটি গান
কাহিনির আরেকদিকে লক্ষ করি আসে, নীলুর দিদি অপর্ণার এক পূর্ব প্রেমিক অনিমেষের ফিরে আসার কাহিনি আর সবচেয়ে অদ্ভুত হল তার বাপ রাসমোহনের কোনো গোপন তথ্য জানিয়ে দেওয়ার নাম করে তাকে ব্ল্যাকমেল করে চলা নিতাইয়ের আখ্যান। একদিকে এই কাহিনির অংশাবলি, আরেকদিকে নিজের পূর্বপ্রেমিকা শুভ্রার কাছে সামান্য সময়ের জন্য হলেও মনের আশ্রয়ের সন্ধানে নীলুর ফিরে যাওয়া।
একেবারেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নিজস্ব কাহিনি বলার ধরন, এই ‘জীবন যে রকম’, তাকে চিত্রনাট্যায়িত করার খসড়াটুকু করছেন সত্যজিৎ। ইঙ্গিতে এমনভাবেই বাঁধছেন সেই ছবি, যে সেই খসড়া পড়েই অনেকটা যেন পাঠক দেখতে পাচ্ছেন সেই সিনেমার গল্প।
ছবির ক্লাইম্যাক্সের আগে নীলু-শান্তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দ্বিধা আর ক্লাইম্যাক্সে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর্ব--- সবটাই সংলাপে পুরোপুরি লেখা। এমনকি, শেষে রয়েছে আবহসংগীতের ইঙ্গিতও। শেষ দৃশ্যের বর্ণনায় লেখেন, মিউজিক রাইজেজ্--- আনন্দ বিষাদ মেশানো ভোরের রাগিণী। তারপরে ক্যামেরা মুভমেন্টের ইঙ্গিত। লেখেন, ‘ক্যামেরা দরজার মুখ থেকে জুম করে রাসমোহনের খাটের দিকে এগিয়ে যায়। মশারির ভেতর থেকে রাসমোহনের একটা চিত করা হাত বাইরে বেরিয়ে আছে। হাতের পাশে টেবিল, টেবিলের উপর ঘুমের ওষুধের খালি শিশি, খালি জলের গেলাস।’ এক বিষাদান্তক পরিণতির আবহ সংগীতে ঘেরা চিত্রময় বর্ণনা। সত্যিই আশ্চর্য হতে হয়, যে ছবি তিনি করবেন না, যে ছবির চিত্রনাট্যও তাঁকে কেউ লিখতে বলেনি--- তার জন্য এইভাবে এত যত্নে একজন মানুষ এত নিখুঁত করে লিখতে পারেন--- নেহাত-ই একটি চিত্রনাট্যের ‘খসড়া’!!
Powered by Froala Editor