গল্পটা শুনিয়েছিলেন নির্মাল্য আচার্য। নির্মাল্য আচার্য, মানে ‘এক্ষণ’ পত্রিকার অন্যতর সম্পাদকমশাই। পেশাগতভাবে ছিলেন আশুতোষ কলেজের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক। নেশায় ছিল ছবি বা চলচ্চিত্র আর ‘এক্ষণ’ পত্রিকা নির্মাণের পশ্চাৎপটে প্রধানতম ছিল তাঁরই অবদান। সেই নির্মাল্যবাবু গল্পটা শুনিয়েছিলেন ‘এক্ষণ’ পত্রিকার শেষ সংখ্যায়, শারদ ১৪০১ বঙ্গাব্দে বা ১৯৯৪ সালের পুজোর সময়। মানে সত্যজিৎ প্রয়াত হয়েছেন, তার বছর দুই আগে। তারপরে, তাঁর অসামান্যতার নতুন এক পরিচয় পাওয়া গেল, সেই লেখাটিতে। মনে রাখা দরকার, বঙ্গীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্তে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সেই সংখ্যাটি। কারণ, প্রথমত, এই সংখ্যাটিই ছিল পত্রিকার অন্তিম সংখ্যা। একটি গৌরবময় ইতিহাসের অন্ত্যপর্ব। দ্বিতীয়ত, এই পত্রিকার অন্য সংখ্যাগুলিতে সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন ছবির চিত্রনাট্য প্রায়শই প্রকাশিত হয়েছিল। নির্মাল্যবাবু বোধ করি, তাঁর পত্রিকার মারফত পাঠক সাধারণকে দেখাতে চাইছিলেন, সিনেমার চিত্রনাট্যকেও যথাযথভাবে লিখিত হলে, তাকে পাঠযোগ্য করে তোলা যেতে পারে একভাবে।
সত্যজিৎ-চর্চার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত আর বাংলা পত্রিকার ইতিহাসের বিষয়ে যাঁরা ওয়াকিফহাল, তাঁদের কাছে এই ঘটনাটির জ্ঞান নতুন নয়। কিন্তু এই সংখ্যাটিতে, সত্যজিতের চলচ্চিত্রায়িত কোনো চিত্রনাট্য মুদ্রিত হল না। এখানে মুদ্রিত হল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘জীবন যে রকম’-এর ‘চিত্রনাট্যের খসড়া’! মজার বিষয় হল, সত্যজিৎ রায় নিজে কখনো এই উপন্যাস থেকে ছবি করবেন, এমন কথাও শোনা যায়নি। অথচ, তিনি এই চিত্রনাট্যের খসড়া লিখেছিলেন কেন--- সেও তো এক প্রশ্ন! আজ শুনব, সত্যজিতীয় সেই কলমকারির ইতিহাস। পরের কিস্তিতে শুনব, সেই খসড়ার বিষয় আর তার ধরনটি।
সত্যজিতের লেখা সেই খসড়ার শেষে নির্মাল্যবাবু লিখেছিলেন ‘জীবন যে রকম’-এর ‘প্রেক্ষাপট ও পরিচিতি’। এমনিতে এই একই নামে ১৯৭৯ সালে স্বদেশ সরকারের পরিচালনায় একটি ছবি মুক্তি পায়, সেটিও অবশ্যই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই কাহিনি অবলম্বনেই নির্মিত। ঘটনাক্রম লক্ষ করলে, দেখা যাবে, এই ছবির বিষয়টিরই পূর্বসূত্র নির্মাল্যবাবুর বলা কাহিনিটি। মানে, নির্মাল্যবাবু ১৯৭৪ সালে সুনীলের উপন্যাস থেকে যে চিত্রভাষ্য নির্মাণের কথাটি বলেছিলেন, সেই কথারই উত্তরপর্ব ১৯৭৯ সালে নির্মিত ছবিটি। যদিও নির্মাল্য আচার্য মশাই স্পষ্টত জানিয়েছিলেন, ‘প্রথমেই বলতে হবে, এই নামে যে-ছবিটি একদা মুক্তি পেয়েছিল, তার সঙ্গে সত্যজিৎ-কৃত বর্তমান ‘কাঠামো’টির কোনো সম্পর্ক নেই।’ তবে নির্মাল্য আচার্য সেই লেখাতে এটাও জানিয়েছিলেন যে, ছবির প্রযোজকের পক্ষ থেকে যখন এই ছবিটির চিত্রনাট্য লেখার জন্য নির্মাল্যবাবুকে দেওয়া হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল, সেখানে মূল চরিত্রে অভিনয় করবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর ওয়াহিদা রহমান। লক্ষণীয়, ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা সেই উপন্যাস থেকে নির্মিত ছবিটিতেও মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ওয়াহিদা। সৌমিত্রর জায়গায় অবশ্য পরে সেই ছবিতে আসেন রঞ্জিত মল্লিক। সে অন্য কথা। এখানে ফেরা যাক, মূল সত্যজিতের লেখার বিষয়টিতে।
আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর অন্য ভূতের
নির্মাল্য আচার্যকে ১৯৭৪ সালের শেষদিকে যখন এই উপন্যাসটি হাতে দিয়ে বলা হল, সেটা অবলম্বনে চিত্রনাট্য তৈরি করতে হবে, নির্মাল্য রাজি হলেন। তিনি লিখলেনও সেই চিত্রনাট্যের একটি প্রাথমিক খসড়া। পড়ে শোনালেন প্রযোজকদের। তাঁদের মোটামুটি পছন্দও হয়েছিল।
আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর তামাম-জীবন ১
আরও পড়ুন
গীতিকার সত্যজিতের দুটি গান
তবে, নির্মাল্যবাবু আরো সময় চেয়ে নিলেন। তৈরি করলেন ছবির দ্বিতীয় খসড়া। এই দ্বিতীয় খসড়া হাতে নিয়ে নির্মাল্যের ভাষায় ‘সোজাসুজি হাজির হই সত্যজিতের কাছে’। সত্যজিৎকে এই চিত্রনাট্য বানাবার ব্যাপারটা বিস্তারিত বলে, মুখে গল্পের মূল বিষয়টি শোনালেন নির্মাল্য। নির্মাল্যবাবুর মুখে কাহিনি শুনে সেখান থেকে আগেও সত্যজিৎ ছবির বিষয় পেয়েছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসটি নির্মাল্যবাবুর মুখে শুনেই সত্যজিৎ ‘বিশেষভাবে সত্যজিৎ আগ্রহী হয়ে ওঠেন।’ এইসূত্রেই আবার শুনলেন নতুন কাহিনি। রেখে দিলেন নির্মাল্যবাবুর লেখা চিত্রনাট্যের দ্বিতীয় সেই খসড়া, সঙ্গে মূল উপন্যাসটিও। সেই রেখে আসার দিন দুই পরে আবার নির্মাল্যবাবু যখন গিয়েছেন সত্যজিতের কাছে, তখন নির্মাল্যবাবুর কথাতেই, ‘সত্যজিৎ প্রথমে আমার চিত্রনাট্যের কিছু দৃশ্য, ঘটনা ও উদ্ভাবনের প্রশংসা করলেন। তারপর ঘণ্টা খানেক ধরে যা বললেন, তাতে বুঝতে বাকি রইল না যে, চিত্রনাট্যে নানা গলদ আছে।’ নির্মাল্য লক্ষ করলেন, মূল উপন্যাস আর তাঁর লেখা সেই চিত্রনাট্যের খসড়া অত্যন্ত মন দিয়ে পড়েছেন সত্যজিৎ। একদিন নির্মাল্য আচার্যকে পরপর দু-দিন ধরে ‘চিত্রনাট্য বিষয়ে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন--- চিত্রনাট্যকারের দয়িত্ব ও ভূমিকা কী এবং সার্থক চিত্রনাট্য কীভাবে লিখতে হয়’ বুঝিয়ে দিলেন তাও ‘একজন শিক্ষকের’ মতো। দুই দিন সেই ক্লাস নেওয়ার পরে, তৃতীয়দিন আলোচনার শেষে সত্যজিৎ জানালেন, এই চিত্রনাট্যটি কেমন হতে পারে, তার একটা চেহারা তৈরি করেদেবেন তিনি। সত্যজিতের মনে হয়েছিল নির্মাল্য মূল উপন্যাস থেকে কোথাও কোথাও খুব বেশি সরে গেছিলেন চিত্রনাট্যকারের স্বাধীনতা নিয়ে। সত্যজিৎ তা নিতে চাননি। তবু, নির্মাল্যর তৈরি চিত্রনাট্যের ধরনটি রেখে আবার মূলানুগত থেকেও কীভাবে লেখা যেতে পারে এই চিত্রনাট্য--- তার একটা নতুন খসড়া তৈরি করলেন তিনি। এইখানেই এক নতুন সত্যজিতের সঙ্গে পরিচয় আমাদের। ভেবে দেখুন পাঠক, যে ছবি তিনি নিজে তৈরি করবেন না, তাঁকে কেউ সে ছবির চিত্রনাট্য রচনা করতেও বলেনি। চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব যাঁর উপর, তিনি কেবল তাঁর প্রিয় মানুষটিকে বলেছিলেন নিজের লেখাটি দেখতে। তার উত্তরে, কেবলমাত্র তাকে বোঝানোর জন্য, পুরো একটা চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরি করলেন সত্যজিৎ। তৈরি করলেন মানে, কেবল কিছু শব্দ সংকেতে বুঝিয়ে দেওয়া নয়, লেখার মার্জিনে কিছু মন্তব্য সংযোজন নয়, একেবারে পুরো একটি খসড়ার প্রস্তুতি। একটি কাজের প্রতি কতখানি দায়িত্ববোধ থাকলে, জীবনে ওই ব্যস্ততার তুঙ্গ মুহূর্তে একজন এই কাজটি করতে পারেন, তা ভাবলেও শ্রদ্ধাবনত হতে হয় উত্তরকালকে।
আরও পড়ুন
বিশু-শিবু, ভিক্টর আর কেষ্টদা: সিনেমার অন্য মুখ
‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য সত্যজিতের সেই লেখাটি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে সম্পূর্ণত মুদ্রিত করলেন তাঁর পত্রিকায়। নির্মাল্যবাবু স্বভাব-বিনয়ী। তাই তার সঙ্গে অনুষঙ্গ-হিসেবে নিজের লেখা চিত্রনাট্যটি আর প্রকাশ করেননি। লিখেছেন, ‘এটি আপাতদৃষ্টিতে খুব সুখপাঠ্য হয়ত মনে হবে না এবং মূল চিত্রনাট্য জানা না থাকায় সব জিনিস হয়ত ধরাও সহজ হবে না। (অন্তত সুনীলের উপন্যাসটি পড়ে নিলে কিছুটা সূত্র মিলতে পারে। নিজের বাতিল চিত্রনাট্য প্রকাশ করার চেয়ে সেই পরামর্শই আপাতত দিতে পারি।)’
এখানে একটি একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির কলমকারির প্রেক্ষাপটটি বলে নিলাম মাত্র। এর পরের কিস্তিতে অনুমান করে দেখা যাবে সেই ভিন্নধর্মী কলমকারির মূলপাঠটি।
Powered by Froala Editor