তারিণীখুড়োর অন্য ভূতের

তারিণীখুড়ো, মানে তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে বলা গল্পের একটা বড়ো অংশ জুড়েই শুধু ভূতের গল্প। তিনি নিজেই বলেছিলেন, ভূত কত প্রকার হতে পারে এবং কী কী? আর তিনিই বলেছিলেন ভূতের গল্পের একটা চমৎকার লক্ষণ। মনে আছে নিশ্চয়ই তাঁর বলা, ভূতের রকমফের বিষয়ক কথা। সেই রকমফের নিয়ে এই মানিকলমকারি-র তিপ্পান্ন সংখ্যক কিস্তিতে আমরা আলোচনা করেছিলেম। প্রশ্নপত্রের সাবেক উত্তরের মতো প্রায় উদাহরণ সহকারে দেখানো হয়েছিল, সেই ভূতের রকমফের কতভাবে ফিরে ফিরে এসেছে, তারিণীখুড়োর গল্পে। ‘ধুমলগড়ের হান্টিং লজ’ গল্পে তারিণীখুড়ো ইস্কুল মাস্টারির ধরনে বলেছিলেন, চার রকম ভূতের কথা ‘’এক অশরীরী আত্মা, যাকে চোখে দেখা যায় না, দুই ছায়ামূর্তি, তিন নিরেট ভূত--- দেখলে মনে হবে জ্যান্ত মানুষ, কিন্তু চোখের সামনে ভ্যানিশ করে যাবে, আর চার নরকঙ্কাল--- যদিও সে কঙ্কাল চচলে ফিরে বেড়ায় এবং কথা বলে।’ এই চার রকম ভূতের সঙ্গেই মোলাকাত হয়েছে তারিণীখুড়োর। এই চার রকম ভূতের কোন ধরনের ভূত কোন গল্পে আছে, তার বৃত্তান্তও আমরা আগে শুনিয়েছি। এই ভূতের বাইরে আরেক রকম ভূতের কথাও ভূতের গল্পের সূত্র হিসেবে বলেছিলেন তারিণীখুড়ো। সেটি ছিল ‘ভূত বলতে তো শুধু প্রেতাত্মা বোঝায় না, ভূতের আরো মানে আছে। একটা মানে হল অতীত। অর্থাৎ যা ঘটে গেছে। ভবিষ্যতের উল্টো।’ এ এক চমৎকার সূত্র। ভূতের গল্প শব্দটাকে নতুন করে দেখার একটা পথ। মনে পড়বে, ভূতের গল্প বলতে ঠিক যা বোঝায়, তা তো তারিণীখুড়োর কিছু গল্প নয়। যেমন ধরা যাক, মহারাজ রণজিৎ সিংজির ব্যাট হাত ঘুরে এখনকার একজনের হাতে এসে পৌঁছল আর তার হাতে সে তার চমৎকারি খেল দেখাতে শুরু করল--- এটা ভূতের গল্প হলেও, ঠিক ভয়ের গল্প নয়। আবার একেবারে অন্যভাবে যদি ভাবা যায়, একজন অভিনেতা যখন তাঁর বার্ধক্যে তাঁর যৌবনের একজন সহ অভিনেতাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছেন, সেটাও তো একভাবে তাঁর ভূত-এর সন্ধান। আবার তারিণীখুড়োর একেবারে প্রথম কাহিনিতে একজন হত্যাকারী যখন তার অপকর্মের সাক্ষ্যকেও খুন করতে চায় তখন তো সে তার ভূত বা পুরোনো সময়ের একটা গল্পকেই নষ্ট করতে চাইছে, তাহলে সেও তো এক অর্থে ভূতের গল্প। এই অন্য রকম ভূতের গল্পের কথাও তো বলতে হবে তারিণীখুড়োর গল্পের কথা বলতে গিয়ে। 

কনওয়ে কাসলের প্রেতাত্মা: এক অন্য রকম ভূতের গল্প

 

প্রফেসর শঙ্কুর ডাইরিতেও মনে পড়বে, এইভাবে ভূতের গল্পের একটা ধরনের কথা বলেছিলেন সত্যজিৎ। গল্পের নাম ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত’। সেই গল্প শুরুই হচ্ছে এইভাবে, ‘ভূতপ্রেত প্ল্যানচেট টেলিপ্যাথি ক্লেয়ারভয়েন্স--- এ সবই একদিন না একদিন বিজ্ঞানের আওতায় এসে পড়বে এ বিশ্বাস আমার অনেকদিন থেকেই আছে। বহুকাল ধরে বহু বিশ্বস্ত লোকের ব্যক্তিগত ভৌতিক অভিজ্ঞতার কাহিনি সেই সব লোকের মুখ থেকেই শুনে এসেছি। ভূত জিনিসটাকে তাই কোনোদিন হেসে উড়িয়ে দিতে পারিনি।’ সেই ভাবনা থেকেই প্রফেসর শঙ্কুর গল্পমালায় তাকে দিয়ে সত্যজিৎ তৈরি করিয়েছিলেন ‘স্পেক্ট্রোস্কোপ’--- যেখানে ‘স্পেক্ট্রো’ কথাটা ‘স্পেক্ট্রাম’ বা আলোর বর্ণালী থেকে আসেনি, এসেছে ‘স্পেক্টার’ অর্থাৎ ভূত থেকে। একটি বিশেষ মুহূর্তে যে মারা গেল, সময়ের সরলরেখা ধরে তার অবস্থান কোথায়? সময়ের সরলরেখায় অন্যরা এগিয়ে চলেছে, কেবল সে থেমে আছে একটি বিশেষ মুহূর্তে--- সে-ই তো ভূত! কিন্তু সেই সময়ের বিন্দু থেকে সে যদি আবার আরেকটি সময়ের বিন্দুতে সক্রিয় হয়, তাহলে সে পরের সময়ে জীবন্ত মানুষের কাছে ভূত বলে চিহ্নিত হবে। এমন হলে তো এ এক আশ্চর্য সময়েরই কাহিনি! সেই সময়ের কাহিনি অনুসারেই সেই গল্পে হাজির হলেন প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর পূর্বপুরুষ, তাঁর অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ ঈশ্বর বটুকেশ্বর শঙ্কু। তাঁর জন্মসন ১০৫৬ আর মৃত্যু ১১৩২ সনে। তার মানে খ্রিস্টাব্দের হিসেবে ১৬৪৯ সালে তাঁর জন্ম আর তিনি মারা গিয়েছিলেন ১৭২৫ সালে। ১৬ বছর বয়সে, মানে ১৬৬৫ সালে তিনি গৃহত্যাগ করে উশ্রীনদীর ধারে চলে যান সাধনা করতে। সেই পূর্বপুরুষের সঙ্গে ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর এই নিও স্পেক্ট্রোস্কোপের সাহায্যে যোগাযোগ হল দুই শতাব্দী পরে। তবে এ এক অন্য রকম ‘ভূত’। ইনি স্পর্শযোগ্য। এঁকে স্পর্শ করা যায়। এই গল্পেই শঙ্কু ভূতের চেহারার এক নতুন বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেখানে দেখা গিয়েছিল, যিনি সেই পূর্বতন মানুষটিকে যে অবস্থায় দেখেছেন, সেই পর্যন্ত রূপেই দেখা দেবেন তিনি। মানে, গল্পে দেখা গেল, নবাব সিরাজদ্দৌল্লা শঙ্কুর কাছে দেখা দিচ্ছেন ততটা চেহারাতেই, যতটা শঙ্কু তাঁর ইতিহাস বইয়ের ছবিতে দেখেছেন।    

 

আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর তামাম-জীবন ১

তারিণীখুড়োর ভূতের গল্প মানে তাই শুধু আমাদের চেনা-জানা ভূতের গল্প নয়। সেখানে ভূত মানে অতীত। অতীত কীভাবে উপস্থিত থাকে এই সময়ে--- তারিণীখুড়ো তার গল্পও বলেন। এমনকি, যেখানে আপাতত মনে হচ্ছে প্রচলিত ভূতের গল্পের ছায়া আছে, সেখানেও যে তাকে ভেঙে কীভাবে যুক্তিবাদী গল্পের পরিসরে এনে তাকে আবার প্রচলিত ভূতের গল্পে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই নিরীক্ষাও তো আছে তারিণীখুড়োর গল্পে। গল্প-গড়ার আর গল্প-ভাঙার ক্রমটি একটু মন দিয়ে লক্ষ করতে হবে। প্রথমে গল্পটিকে ঢেলে দেওয়া হল প্রচলিত ভূতের গল্পের ছাঁচে। তারপরে তাকে ভেঙে দেওয়া হল যুক্তিবাদের আলোয়। তারপর একেবারে শেষে আবার সেখানে জুড়ে দেওয়া হল প্রচলিত ভূতের গল্পের ছাঁচ। সেই গল্পটির নামই তো ‘কনওয়ে কাসলের প্রেতাত্মা’। পুনের এক অতি পুরাতন দুর্গের মিথ ছিল, তা অভিশপ্ত। কারণ, সেখানে প্রবেশ করার ছ মাসের মধ্যে সেই দুর্গের সাহেবের স্ত্রী পুত্র মারা যায়, সেই সাহেব নিজেও আত্মহত্যা করে। তখন থেকেই স্বাভাবিকভাবেই সেই বাড়ি অভিশপ্ত বলে পরিচিত। অভিশপ্ত বাড়ির এই কাহিনি পরিচিত। এই অভিশপ্ত বাড়ি নিয়ে আরেকটি মিথ প্রচলিত ছিল। সেই অনুযায়ী, মহারাষ্ট্রের স্বদেশি আন্দোলনের সময় মেজর লিথব্রিজ নামে এক সাহেবকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে যে সন্ত্রাসবাদী দল, তারা নাকি এই পরিত্যক্ত পোড়ো কাসলেই তাদের গুপ্তডেরা তৈরি করেছিল। এই গুপ্ত বিপ্লবীরাই সেখানে জাল নোট ছাপার কাজও করত। এই হল আরেকটি সময়। গল্পে কোনো মানুষ সেখানে যেত না, অভিশপ্ত পোড়ো বাড়ি বলে। কিন্তু যখন তারিণীখুড়ো তার দলবল নিয়ে সেখানে পরে হাজির হয়, তখন তারা সেখানে লক্ষ করে সেখানে তখনো চলছে একটি পুরোনো ছাপার ট্রেডল মেশিন। এক সময়ে সন্ত্রাসবাদীরা নিজেদের মুখপত্র ছাপাবার কাজে বা ওই জাল নোট ছাপানোর জন্য যে মেশিন ব্যবহার করত, এতদিন পরে নিজের ছন্দে কাজ করে চলেছে সেই মেশিনটিও। এই আরেক ভূতের গল্প। কিন্তু, এই ভূতের গল্পটি যে সাজানো--- সেটা যে ভূতে-অবিশ্বাসী আপ্টেকে ভূত সম্পর্কে বিশ্বাস জমানোর জন্য একটা কৌশল সেটা গল্পের উনশেষ অংশে বলে, ভূতের গল্পের মিথটাকে ভাঙা হল যুক্তিবাদ দিয়ে। কিন্তু গল্পের একেবারে শেষে আবার দেখা গেল, সেই কাসলের ঘরে, মাথার ওপরে চলছে একটি সেকেলে হাতে-টানা পাঙ্খা। এখান থেকেই তৈরি হল আরেকটি আসল ভূতের গল্প। যে কাসলের মিথে কখনো সাহেবের পরিবার মারা যাওয়ার কাহিনি থাকে, যে কাসলের মিথে কখনো স্বদেশি আন্দোলনের কাহিনিও থাকে, সেখানে যে গল্প বলা হয় না, এ যেন সেই গল্পের উন্মোচন। গল্পেই দেখা যায়, সে কাহিনি এখানকার ইতিহাস বইতেও থাকে না, থাকে না এখানকার বিদেশিদের হাতে ছাপা সংবাদপত্রেও। স্থানীয় একটি দেশীয় কাগজে ছাপা হয়েছিল সেই খবর। ব্রিগেডিয়ার কনওয়ে তাঁর এক পাঙ্খাবরদারকে বুটের লাথি দিয়ে মেরে ফেলেছিল। সে যুগের অত্যন্ত স্বাভাবিক নাকি এক ঘটনা সেটা!! এই সেকালের অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনাটাই তো উপেক্ষিত ছিল ভূতের গল্পের উপাদান হিসেবে। ঔপনিবেশিক ভূতের গল্পে প্রভুর আর তথাকথিত ভদ্রলোকের মৃত্যুকে মৃত্যু হিসেবে গণ্য করা হয় বলেই না, তাদের ভূত হওয়ার গল্প গড়ে ওঠে। কিন্তু এই নাম-না-জানা পাঙ্খাবরদারদের মৃত্যুও তো মৃত্যু। সেইখান থেকেও তো তৈরি হতে পারে আরেক রকম ভূতের গল্প। তারিণীখুড়োর এই কাহিনি ছোটোগল্পের পরিসরে সেই বড়ো ধরনের এক কাহিনিকেই সামনে নিয়ে আসে। তারিণীখুড়োর ভাবনাতে ভূত যেমন পুরোনো ইতিহাস, ভূত তেমন প্রচলিত ভূত-ও। এই পুরোনো ইতিহাসকে ভূতের গল্পের সঙ্গে এইভাবে মেলাবার একটি দারুণ প্রকল্প তাহলে ফেঁদেছিলেন সত্যজিৎ। যে গল্পটি ছিল সাহেব ভূতের গল্প, সেটাকেই ধীরে ধীরে বদলে দেওয়া হল জাতীয়তাবাদের এক পর্ব থেকে এক সাধারণ পাঙ্খাবরদারের ভূতের গল্পে। লক্ষণীয়, কনওয়ে সাহেবের ভূত বলে কিন্তু আসলে কিছু নেই, সেটা শুধু একটা জনশ্রুতি। স্বদেশি আমলের ভূতের কাহিনি দিয়ে ভয় পাওয়ানোর গল্পটা তো বানানো--- আসল ভূতের গল্প তো ওই পাঙ্খাবরদারের ভূতের গল্পই। এইভাবে স্বীকৃত হল তার মৃত্যু, সেই স্বীকার থেকেই তো তৈরি হল ‘ভূতের গল্প’।’   

আরও পড়ুন
গীতিকার সত্যজিতের দুটি গান

ব্যাট যখন ভূত, খেলোয়াড় তারিণীখুড়ো গল্পের অলংকরণ।

 

আরও পড়ুন
বিশু-শিবু, ভিক্টর আর কেষ্টদা: সিনেমার অন্য মুখ

শেষে একটি কথা। সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘তারিণীখুড়োর কীর্তিকলাপ’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। সেখানে তারিণীখুড়োর তখনো পর্যন্ত লেখা মোট আটটি কাহিনি ছিল, ‘ডুমনিগড়ের মানুষখেকো’, ‘কনওয়ে কাসলের প্রেতাত্মা’, ‘শেঠ গঙ্গারামের ধনদৌলত’, ‘লখনউয়ের ডুয়েল’, ‘ধুমলগড়ের হান্টিং লজ’, ‘খেলোয়াড় তারিণীখুড়ো’, ‘টলিউডে তারিণীখুড়ো’ আর ‘তারিণীখুড়ো ও বেতাল’। এরপরেও যে আরো সাতটি কাহিনি প্রকাশিত হল তারিণীখুড়ো সিরিজে সেগুলি একত্র করে ফেলুদা সমগ্র, শঙ্কু সমগ্র-র মতোই একটা তারিণীখুড়ো সমগ্র কি প্রকাশ করা যায় না? সেখানে পুরোনো গল্পগুলিরও পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিগুলো ছাপা হোক তাদের আলাদা আলাদা হেডপিসসুদ্ধ আর লেখার দিক থেক সেখানে একত্রে যুক্ত হয়ে থাক তারিণীখুড়োর সমস্ত গল্প পরপর!   

আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর পঞ্চভূত

Powered by Froala Editor