একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করলাম কিছুদিন আগে। ১৯৮৫ সালে লেখা সত্যজিৎ রায়ের গল্পগুলির ভেতর রয়েছে একটা আশ্চর্য প্যাটার্ন। সালটা মনে রাখার ১৯৮৫। সত্যজিৎ ১৯৮৪ সালের পর দীর্ঘ সময় শারীরিক অসুস্থতার জন্য সরে আছেন এই সময়। ১৯৮৪-র ‘ঘরে বাইরে’-র পর পাঁচ বছর বাদে আবার ১৯৮৯ সালে সত্যজিৎ তৈরি করবেন তাঁর পরবর্তী পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছায়াছবি ‘গণশত্রু’। এই মাঝের সময়ে ১৯৮৫ সালে সত্যজিৎ যে গল্পগুলি লিখছেন, সেই প্রায় প্রতিটি গল্পগুলির পটভূমি সিনেমা-জগৎ। ১৯৮৫-র এপ্রিল মাস নাগাদ লিখলেন দুটি গল্প ‘টলিউডে তারিণীখুড়ো’ আর ‘জুটি’। আর সেই বছরেরই পুজো সংখ্যাতে লিখলেন ‘মাস্টার অংশুমান’ আর তার পরের বছরের পুজোতে প্রকাশিত হল ফেলুদার কাহিনি-হিসেবে ‘দার্জিলিং জমজমাট’। লক্ষ করার মতো, পরপর এই সব কটি গল্পেই ফিরে ফিরে এসেছে শুধু সিনেমা-পাড়া নয়, সিনেমা -পাড়ার এক-একটি স্বল্প-জানা দিক। লক্ষণীয়, শুধু সিনেমাপাড়ার এই এলাকাগুলি স্বল্প-জানা তা-ই নয়, বরং আরো নির্দিষ্ট করে বললে, সিনেমাপাড়ার এই গল্পের সঙ্গে জুড়ে আছে নানা ধরনের উপেক্ষার গল্পও। এই সঙ্গেই সত্যজিতের গল্প-কাহিনির মনোযোগী পাঠক মনে পড়িয়ে দেবেন সত্যজিতের বহু আগে লেখা আরো দুটি গল্পের কথা। একটি ছিল ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ আর অন্যটি ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’। সত্যজিতের গল্পমালায় পটলবাবুর গল্প আমরা শুনেছি ১৯৬৩ সালে আর ফেলুদার গল্পে জটায়ুর কাহিনি থেকে সিনেমা বানাবার গল্প আমরা পড়েছি ১৯৭৬-এ।
নির্বাক ছবি থেকে এলো সবাক ছবির যুগ। তিরিশের দশকে বাংলা ছবিতেও সেই সবাক যুগের শুরু। ছবির এই যুগান্তরের সঙ্গে সঙ্গে একেবারে বাতিল হয়ে গেল নির্বাক যুগের জাঁদরেল অভিনেতা শরৎ কুণ্ডু। নির্বাক যুগের অসম্ভব জনপ্রিয় জুটি--- শিবু বিশু-র দুই অভিনেতা রতন রক্ষিত আর শরৎ কুণ্ডু-র মধ্যে রতন টিঁকে গেলেন তাঁর গলার স্বরও ভালো ছিল বলে। অন্যদিকে গল্পের সাক্ষ্যে জানা যায়, ভয়েস টেস্টেই বাতিল হয়ে গেলেন শরৎ। তারপরে তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কি না, সেই খবরটাও রাখেনি টালিগঞ্জ। তাঁর খোঁজ করতে নেমে জানা যায়, কী ভাবে ধীরে ধীরে একেবারে বাতিল হয়ে গেলেন তিনি, কী ভাবে এক সময়ের দুঁদে অভিনেতা, যে এক সময়ে হাস্যকৌতুক শিল্প দিয়ে জমিয়ে রেখেছিল নির্বাক ছবির দুনিয়া, সেই শরৎ কুণ্ডু পরিণত হলেন সামান্য একজন এক্সট্রাতে--- এখনকার ভাষায় তিনি স্টার থেকে হয়ে গেলেন জুনিয়র আর্টিস্ট। শরৎ কুণ্ডুর এই করুণ পরিণতির গল্পই তো ‘জুটি’। অন্যদিকে রতন সসম্ভ্রমে ছবি থেকে অবসর নিয়ে ধীরে ধীরে খুঁজে বের করেন তাঁদের সেই শিবু-বিশুর ছবির পুরোনো প্রিন্ট আর নিজের বাড়িতে চালিয়ে দেখতে থাকেন তা। এই দুই শিল্পী বন্ধুর দুই ধরনের পরিণতির কাহিনি যেমন জুটি, তেমনই আসলে প্রথমে এই দুই বন্ধুর সেকালের গল্প বলে, রতনের সেই পুরোনো বন্ধুকে সন্ধানের আর তাদের অদ্ভুত পুনর্মিলনের গল্পও তো জুটি। গল্পের আসল পরিণতি যাঁরা জানেন, তাঁরা তো জানেনই, যাঁরা জানেন না, তাঁদের আগে থেকে পরিণতি বলে, গল্পপড়ার মজা নষ্ট করব না। শুধু মনে রাখতে বলব, এ কাহিনি বস্তুত সিনেমার জগতের এক পর্ব থেকে অন্য পর্বে উত্তরণের সঙ্গে কখনো কখনো যে তা কোনো শিল্পীর জীবন-পরিবর্তনের গল্পও হয়ে যেতে পারে, সেই কথাটি।
‘টলিউডে তারিণীখুড়ো’ গল্পে গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো তাঁর এক সময়ে যে পেশায় যুক্ত থাকার গল্প শোনান, সেটি হল প্রোডাকশন কন্ট্রোলার। ছবি তৈরিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ--- কিন্তু সাধারণভাবে লোকে চেনেই না তাকে। গল্পে তাই তারিণীখুড়ো তাঁর খুদে শ্রোতাদের প্রথমে জানিয়ে দেন, এই পদটির কাজের ধরন। বলেন, ‘কাজটা নেহাত ফেলনা নয়, একটা ছবি হলে পরে সবাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, খরচের হিসাব রাখা, আর্টিস্ট আর কর্মীদের পেমেন্ট করা, এমনকি ছুঁচ থেকে হাতি পর্যন্ত যা কিছু একটা ছবিতে লাগবে সব কিছু জোগাড় করার ভার আমার উপর।’ ছবির জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতযুক্ত কিন্তু সাধারণ্যে অপরিচিত নতুন একটি চরিত্রের গল্প এই কাহিনি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত এই কাহিনি অন্য এক খাতে বয়ে যায়, কিন্তু সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আরও পড়ুন
গল্পমালার মানচিত্র
আরও পড়ুন
একুশে ফেব্রুয়ারির সত্যজিৎ
ঠিক এই রকমই আরেকজন মানুষ স্টান্টম্যান। পর্দায় নায়ক যত দুঃসাহসী মারপিটের দৃশ্য করেন, যত লম্ফঝম্প করেন তার পিছনে রয়েছেন এই শিল্পীটি। এমন একজন অভিনেতা যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে সেই দুঃসাহসী কার্যকলাপ তো করেন, কিন্তু পর্দায় তাঁর কেরদানি আর কসরতের প্রশংসা পায় নায়ক। ছবির জগতের এই অদ্ভুত মানুষটির কথা নিয়েই তো এক সময়ে ফেলুদার ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ গল্পে সত্যজিৎ এনেছিলেন ভিক্টর পেরুমল চরিত্রটি। তিনিও ছিলেন একজন স্টান্টম্যান ও ফাইট মাস্টার। তার কাজের প্রতি যত্ন ফ্লোরে ছিল লক্ষ করার মতো। আর গল্পের পরিণতিতে এই ভিক্টর পেরুমলই আশ্চর্যভাবে রক্ষা করে ফেলুদা অ্যান্ড কোং-কে আসল দুষ্কৃতীর হাত থেকে। ছোট্ট চরিত্র, কিন্তু এই ফেলুদা ভিক্টর পেরুমল সম্পর্কেই পরিচালক পুলক সান্যালকে বলে, ‘আপনার ছবিতে জেট বাহাদুর আখ্যা একমাত্র ভিক্টর পেরুমলই পেতে পারে।’ বস্তুত, এই ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ একটি সিনেমার পিছনে যে নায়ক আর পরিচালকের বাইরেও কত ধরনের মানুষ থাকেন, তাদের সঙ্গে পরিচিতির এক কাহিনিও যেন। ১৯৭৬-এ এই গল্প লেখার পরে, আলোচ্য কালপর্বেও ফিরে এলেন সেই স্টান্টম্যান চরিত্রটি। এবারে গল্পের নাম মাস্টার অংশুমান আর সেই কাহিনিতে স্টান্টম্যানের নাম কেষ্টদা। কলকাতার কৃষ্ণপদ সান্যাল মুম্বইতে গিয়ে হয়ে গেছে কৃষ্ণন। কারণ, বাঙালি স্টান্টম্যানকে মুম্বইতে কেউ পুছবে না--- অতএব কৃষ্ণনের জন্ম। সে বলে, ‘ওখানে ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর ইংরেজি বলি, কথা তো বলতে হয় না বেশি--- আমাদের কথায় কেউ কান দেয় না, শুধু দেখে কাজটা ঠিক হচ্ছে কি না।’ ওই ‘আমাদের কথায় কেউ কান না’ বাক্যে অভিমান আছে, সেটা বলা বাহুল্য। এই কেষ্টদার সঙ্গে শিশু শিল্পী মাস্টার অংশুমানের বন্ধুত্বের একটি আশ্চর্য কাহিনি এই গল্প। ফেলুদার বাইরে দুটি শিশু-কিশোরপাঠ্য উপন্যাসেরই মূল বিষয় অসমবয়সী দুই মানুষের বন্ধুত্বের গল্প। ‘ফটিকচাঁদ’-এ হারুন অল রসিদের সঙ্গে ফটিকচাঁদের বন্ধুত্ব আর ‘মাস্টার অংশুমান’-এ অংশুমান আর এই কেষ্টদার বন্ধুত্বের গল্প। কেষ্টদা অংশুমানকে বলে, সে কোন্নগরের ছেলে, এক পণ্ডিত বাড়ির ছেলে। তার বাবা ছিলেন স্কুলে সংস্কৃত আর অঙ্কের মাস্টারমশাই আর সেই বাপের ছেলে হয়ে কৃষ্ণপদ ছিল স্কুল-পালানো ছেলে। সে হিন্দি ছবি দেখে আর মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে দারুণ সব মারপিটের দৃশ্য। নিজেই তার মকশো করে, নিজেই নিজেকে তৈরি করে। সে এই শরীরচর্চার গুণ পেয়েছে তার ঠাকুর্দার থেকে। তিনিও শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু তার সঙ্গে করতেন শরীরচর্চাও। তবে এমনি শরীরচর্চার সঙ্গে স্টান্টম্যানের শরীরচর্চার ধরনটা আলাদা। কেষ্টদা বলে, ‘আমিও ব্যায়াম করেছি, তবে মাসল বেশি টাইট হলে স্টান্টের ব্যাপারে অসুবিধা হতে হয়। বডিটা হবে স্প্রিংয়ের মতো। মাটিতে পড়ার সময় হাড়গোড় সব আলগা করে দিতে হবে, তাতে হাড়ে চোটটা কম লাগবে। কম করে পাঁচশো বার পড়েছি ঘোড়ার পিঠ থেকে গত দশ বছরে। চোট যে একেবারে লাগেনি তা নয়, সারা গায়ে ছড়ে যাওয়ার দাগ রয়েছে। কিন্তু শটের সময় কেউ কোনোদিন বুঝতে পারেনি চোট লাগল কি না।’ তার জানা, মারপিটের দৃশ্য দেখে কেউ কোনোদিন জানতে চাইবে না, সেই মারপিটের দৃশ্যটা আসলে করল কে? লোকে হাততালি দেবে হিরোর জন্যেই। এই দুঃখ নিয়েই কৃষ্ণন বা কেষ্টদা কাজ করে চলেন। মুম্বই এসেছিল অভিনয় করবে বলে, পরিণত হল একজন স্টান্টম্যানে! এই মানুষটির কাহিনিই শোনালেন সত্যজিৎ মাস্টার অংশুমান কাহিনিতে।
আরও পড়ুন
শিশুসাহিত্যপাঠ আর রুকু-টিপু ও গোলাপীবাবুর গল্প
আরও পড়ুন
স্পটলাইটের আলো-কাড়ার কাহিনি
সত্যজিৎকে শারীরিক কারণে সরে আসতে হয়েছিল সিনেমা বানানো থেকে ১৯৮৪ সাল থেকে। আর এই সময়েই তাঁর কাহিনিতে পটভূমি হিসেবে ফিরে ফিরে এলো সিনেমার আনদেখি আনশুনি দুনিয়া। সিনেমার যে দুনিয়া সকলের জানা, তার বাইরে এক অন্য জগতের গল্প শোনান সত্যজিৎ। সত্যজিতের পাঠকদের জন্য এ কি এক অদ্ভুত সমাপতন নয়?
Powered by Froala Editor