গল্পমালার মানচিত্র

সত্যজিতের লেখা প্রথম দুটো ইংরাজি গল্প (অ্যাবস্ট্রাকশন আর শেডস অফ গ্রে) বাদ দিলে প্রফেসর শঙ্কুর 'ব্যোমযাত্রীর ডায়রি' দিয়েই সত্যজিতের গল্প লেখার শুরু। ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মাসে, মানে ১৯৬১ সালের শেষে সন্দেশ পত্রিকাতে প্রকাশিত হল সেই গল্প। তার পর অনেকটা সময়ের ব্যবধানে ফেলুদার আবির্ভাব। 

এই মাঝের সময়ের গল্পমালার একটা চকিত সারণি আগে হাজির করা যাক, তারপর দেখা যাক, তার প্রবাহের অঙ্কটি। 

১৩৬৮ আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ: ব্যোমযাত্রীর ডায়রি
১৩৬৮ মাঘ: বঙ্কুবাবুর বন্ধু
১৩৬৮ ফাল্গুন: টেরোড্যাকটিলের ডিম
১৩৬৯ বৈশাখ: সেপ্টোপাসের খিদে
১৩৬৯ আশ্বিন: সদানন্দের খুদে জগৎ
১৩৬৯ অগ্রহায়ণ: অনাথবাবুর ভয়
১৩৬৯ চৈত্র: দুই ম্যাজিশিয়ন
১৩৭০ বৈশাখ: শিবু আর রাক্ষসের কথা
১৩৭০ বৈশাখ: প্রফেসর শঙ্কু ও ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক
১৩৭০ শ্রাবণ: পটলবাবু ফিল্মস্টার
১৩৭০ পুজো: বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম
১৩৭০ পৌষ: প্রফেসর শঙ্কু ও হাড়
১৩৭০ মাঘ: বাদুড় বিভীষিকা
১৩৭১ পুজো: প্রফেসর শঙ্কু ও ম্যাকাও
১৩৭১ ফাল্গুন: প্রফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল
১৩৭২ বৈশাখ: প্রফেসর শঙ্কু ও গোলক রহস্য
১৩৭২ পুজো: প্রফেসর শঙ্কু ও চি চিন
১৩৭২ অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ: ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি
১৩৭৩ বৈশাখ থেকে ১৩৭৪ বৈশাখ: বাদশাহি আংটি
১৩৭৪ পুজো: কৈলাস চৌধুরীর পাথর 

ব্যস। এই অবধি আমাদের দরকার। একদিকে শঙ্কু আর অন্যদিকে ফেলুদা শুরু হচ্ছে, তার মাঝখানে শঙ্কুর গল্পের পাশাপাশি তিনি শুরু করেছেন গল্পমালা। এই সারণিটিকে মন দিয়ে পড়াটুকুই আজকের কাজ। 

আরও পড়ুন
একুশে ফেব্রুয়ারির সত্যজিৎ

আরও পড়ুন
শিশুসাহিত্যপাঠ আর রুকু-টিপু ও গোলাপীবাবুর গল্প

অগ্রহায়ণ ১৩৬৮-তে ব্যোমযাত্রীর ডায়রি শেষ হওয়ার পরে মাঘ মাসে লিখলেন 'বঙ্কুবাবুর বন্ধু'। তারপরেই লিখলেন 'টেরোড্যাকটিলের ডিম আর 'সেপ্টোপাসের খিদে'। মানে তখনো শঙ্কুর গল্পকে কোনো সিরিজের গল্প হিসেবে না ভেবে যদি একটা গল্প হিসেবে ভাবি, তাহলে দেখা যাবে সত্যজিতের প্রথম চারটি গল্পই কিন্তু আসলে বিজ্ঞানসম্পৃক্ত। একভাবে দেখলে তার পরের গল্প 'সদানন্দের খুদে জগৎ'-ও তো তাই-ই। আগের গল্পগুলি কল্প-বিজ্ঞানের হলে, এটা বিজ্ঞান-নির্ভর গল্প। 

আরও পড়ুন
স্পটলাইটের আলো-কাড়ার কাহিনি

এরপর ঠিক পরেই শুরু হল তাঁর অলৌকিক গল্পের ধারা, ১৩৬৯-এর অগ্রহায়ণে প্রকাশিত, 'অনাথবাবুর ভয়' গল্প দিয়ে। সেই ধারাতে তারপরে লিখলেন 'দুই ম্যাজিশিয়ন' আর 'শিবু আর রাক্ষসের কথা'। মজা হল এই শিবুর গল্প আর শঙ্কুর 'ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক' গল্পটি একসঙ্গেই প্রকাশিত বৈশাখ ১৩৭০-এ। তাহলে দুটো গল্পধারা এলো, একদিকে বিজ্ঞান-বিষয়ক আরেকদিকে অলৌকিক। এরপরেই ১৩৭০-এর শ্রাবণে পেলাম 'পটলবাবু ফিল্মস্টার'। ওই বিজ্ঞানের অ্যাডভেঞ্চার আর অলৌকিকের চমক বাদ দিয়ে সত্যজিতের গল্প এবার এলো এক মানবিক গল্পের সীমানায়। সেই সূত্রেই ঠিক তার পরের গল্প 'বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম'-এও তো আসল বিষয় মানবিক। 

আরও পড়ুন
একটি দৃশ্য কয়েকটি সংলাপ

এইখানে এরপরের কাহিনিতে এক অর্থে প্রফেসর শঙ্কুর গল্প যে সত্যজিতের কলমে এবার একটা সিরিজ হবে, তার ইঙ্গিত এলো। গল্পের নাম, 'প্রফেসর শঙ্কু ও হাড়'। 'ব্যোমযাত্রীর ডায়রি'-তে শঙ্কুর যে ডায়রি পাওয়া গেছিল, যারা সেই গল্পের পাঠক তাঁরা জানেন, শঙ্কুর সেই ডায়রি তো ওই গল্পের শেষে ধ্বংস হল, শ খানেক বুভুক্ষু ডেঁয়ো পিঁপড়ের খাদ্য হিসেবে। তাহলে, পাঠকের মনে হওয়া স্বাভাবিক, তার পরের কাহিনি ওই ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক-র গল্পের যে ডায়রি, তা এলো কোথা থেকে? তার এক কৈফিয়ত দিয়েই যেন প্রফেসর শঙ্কু ও হাড়-এর শুরুতেই বলা হল শঙ্কুর গিরিডির বাড়ি থেকে পাওয়া তাঁর কাগজপত্র আর একুশখানা ডায়রির কথা। সেখানে "প্রত্যেকটিতেই কিছু না কিছু আশ্চর্য অভিজ্ঞতার বিবরণ আছে। তার মধ্যে একটি নীচে দেওয়া হল। ভবিষ্যতে আরও দেওয়ার ইচ্ছে রইল।" এই বাক্যেই স্পষ্ট নতুন গল্পমালা সচেতনভাবে শুরু করবেন তিনি। লক্ষ করার মতো ওই 'প্রফেসর শঙ্কু ও হাড়' বেরোলো ১৯৬৩-র শেষে। আর গোটা ১৯৬৪ আর ১৯৬৫-তে লেখা সবকটি গল্পেরই নায়ক প্রফেসর শঙ্কু। প্রকাশিত হল সেই ম্যাকাও, আশ্চর্য পুতুল, গোলক আর চি-চিংয়ের কাহিনি। আর ঠিক তার পরেই ১৩৭২-এর অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ মাসে প্রকাশিত 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি'। এখানেও বেশ লক্ষ করার মতো ব্যাপার হল, ফেলুদার এই প্রথম গল্প শেষ হল মাঘ ১৩৭২-এ। তারপরেই ঠিক দুই মাসের ব্যবধানে ফেলুদার দ্বিতীয় গল্পের প্রকাশ শুরু হয়ে গেল। এইবার একেবারে উপন্যাস। গোটা ১৩৭৩ সন জুড়ে ১৩৭৪-এর বৈশাখ পর্যন্ত প্রকাশিত হল 'বাদশাহী আংটি'। এমনকি বৈশাখ মাসের পর আর কোনো লেখা নেই, পুজোতে প্রকাশিত 'কৈলাস চৌধুরীর পাথর'। পরপর প্রকাশে একভাবে তৈরি হয়ে গেল ফেলুদার গল্পের একটা প্রবাহ। আর এইবার লক্ষ করার বিষয় হল, আগের ওই বিজ্ঞান-বিষয়ক আর অলৌকিকতা-বিষয়ক গল্পের সঙ্গে যুক্ত হল গোয়েন্দা গল্প। পূর্ণ হল সত্যজিতের মূল তিনটি গল্প বলার ধরন। এই গল্প প্রকাশের ধারাবিবরণী আসলে গল্পকার সত্যজিতের একটি থেকে আরেকটি ধরনে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশের কাহিনি যেন ধরিয়ে দেয়। লক্ষ করতে বলে, তাঁর গল্পগুলি যেমন পড়ার, তাঁর গল্প প্রকাশের গল্পটাও যেন একটা গল্প হতে পারে। 

সত্যজিতের কথাতে আমরা প্রায়ই শুনেছি, তিনি ফেলুদাকে ঠিক একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি করে তুলবেন, এমনটা প্রথমদিকে ভাবেননি। সেটা আস্তে আস্তে হয়ে উঠল। এই বাক্যের প্রেক্ষাপটে তাই ফেলুদার প্রথম গল্প পড়ার একটা অন্য ধরন হতে পারে কি না, সেটাও তো ভাবা দরকার। এবার সেটা একটু পড়ে দেখা যাক। 

ফেলুদার প্রথম গল্পে ফেলুদা তো কোনো ব্র্যান্ড চরিত্র হিসেবে তৈরি হয়নি, তাই এই কাহিনি যতখানি ফেলুদার ততটাই তোপসের। আর তার চেয়েও বড়ো কথা, এই গল্প আসলে একটা বন্ধুত্বের ভেতরে থাকা পুরোনো ক্রোধের কাহিনি। এই মোটিফখানি তো সত্যজিতের গল্পের এক পুনরাবৃত্ত বিষয়। ছেলেবেলার কোনো ঘটনার কথা মনে করে, এখন সেই পুরোনো বন্ধুকে শাস্তি দেওয়ার গল্প এটি। ফেলুদা যেমন বুদ্ধিমান ততটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় গল্পের আসল অপরাধী তিনকড়িবাবুর চরিত্রেও। বস্তুত তিনকড়ি-ই তো গল্পের বেশিরভাগ অংশে ফেলুদার কাজকর্ম পদক্ষেপ বুঝে ফেলেন। এমনকি বন্ধুকে ভয় দেখিয়ে, তিনি বেরিয়েও যান দার্জিলিং থেকে। ফেলুদা তাঁকেও ধরতে পারেনি। ধরতে পারেনি রাজেনবাবুকে তাঁর সেই ভয় দেখানোর মোটিভটিও। সেটাও তো তিনকড়িই লিখে জানিয়েছেন বলেই জানা গিয়েছিল। তাই এই গল্প আসলে ততটা গোয়েন্দাগিরির গল্প নয়, তার চেয়েও বেশি এটি একটি এমনিই গল্প, যার অন্যতম প্রধান চরিত্র হল একজন গোয়েন্দা। মজার ব্যাপার হল, আমাদের মনেই থাকে না যে, জটায়ু আসার আগেই এই গল্পে এসেছিলেন গুপ্তচর ছদ্মনামধারী একজন তুখোড় গোয়েন্দাগল্পের লেখক। যাঁর সব লেখা নাকি পড়ে ফেলেছে স্বয়ং ফেলুদা, সে গুপ্তচর নামধারী লেখক তিনকড়িবাবুকে বলে, "আপনার সব কটা উপন্যাস যে আমার পড়া। বাংলায় আপনার ছাড়া আর কারুর রহস্য উপন্যাস আমার ভালো লাগে না।" জটায়ুর একেবারে উল্টো এই গুপ্তচর। তবে ফেলুদার পছন্দের সেই ঔপন্যাসিক নিজেই কি না ফেলুদার প্রথম গল্পের 'অপরাধী! তারপর ধরা যাক, বাবার কাছ থেকে দূরে চলে-যাওয়া ছেলে আর তার ফিরে-আসার গল্পটিও তো এখানে শুরু হল। শুরু হল, ফেলুদার গল্পের অন্যতম চেনা মোটিফ বাপ ছেলের দ্বন্দ্ব, সেটাও তো এসে গেল এই গল্পে। আসলে ফেলুদার গল্পে পরে যেসব উপাদান পরে ফিরে আসবে, তার টুকরো ইঙ্গিত ছড়িয়ে আছে এই গল্পের ভেতরেই।

Powered by Froala Editor