১৯৮২-র পুজো সংখ্যার ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল ‘অঙ্ক স্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু’ গল্পটা। পরে সেটাই ‘এবারো বারো’ বইতে ঢুকে গেল। সে গল্প যা, সে গল্প তো আছেই, তবে তার চেয়েও বড়ো কথা, সেই কাহিনি যেন আসলে শিশুসাহিত্যের পাঠ নিয়ে সত্যজিতের একটা ভাবনার রূপরেখা। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমারের উত্তরাধিকার তাঁর কাঁধে, লীলা মজুমদার তাঁর পিসি, অন্যদিকে সুবিমল রায়চৌধুরি তাঁর কাকা--- এহেন উত্তরাধিকার যাঁর, সেই তিনি যেন এই কাহিনিতে করলেন শিশুকিশোর সাহিত্যের এক আশ্চর্য তরফদারি। শিশু-কিশোর গল্পের বাস্তবতাকে কীভাবে দেখা দরকার, বড়োদের চোখে শিশু-কিশোর গল্পের জগৎ কীভাবে নষ্ট হয়ে যায়, এ কাহিনি যেন সেই গল্প বলে চলে। মনে পড়বে, এই গল্প লেখার কিছুদিন আগেই সত্যজিতের সিনেমাতে এক শিশুচরিত্রের মুখে আমরা শুনেছি, ‘সব সত্যি, মহিষাসুর সত্যি, হনুমান সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি, টারজান সত্যি, অরণ্যদেব সত্যি, হিজবিজবিজ সত্যি।’ বলা বাহুল্য, ছবির নাম ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ আর সেই শিশু চরিত্রের নাম রুকু। এই যে একজন খুদের কাছে, তার কল্পনার জগতের নিজস্ব বাস্তবতা, তা বড়োদের চোখে অ-বাস্তব, গাঁজাখুরি, সবটাই বানানো আর মিথ্যা। এই বড়োদের চোখ দিয়ে দেখা বনাম ছোটোদের মন দিয়ে পড়ার দ্বৈরথের গল্পই হল ওই ‘অঙ্ক স্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু’। এইভাবেই এখন পড়তে ইচ্ছে হল এই গল্পটাকে।
গল্পের নায়ক খুদে টিপু পড়াশোনার পাশাপাশি ভালোবাসে গল্পের বই পড়তে। সে এক শীতকালের দুপুরে টিফিনের সময়ে জানলার ধারে বসে পড়ছিল ‘ডালিমকুমার’-এর গল্প। বইয়ের নাম দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার মশাইয়ের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। ছাত্রের কাছ থেকে নিজের হাতে বইটা নিলেন মাস্টারমশাই, কড়াসুরে অভিযোগের স্বরে জানালেন, ‘হাঁউ মাঁউ কাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ, হিরের গাছে মোতির পাখি, শামুকের পেটে রাজপুত্তুর--- এসব কী পড়া হচ্ছে শুনি? যত আজগুবি ধাপ্পাবাজি।’ বড়োদের চোখে এ যতই আজগুবি আর ধাপ্পাবজি বলেই মনে হোক না কেন, খুদে পাঠকের চোখে এরা সব সত্যি-সত্যি গল্প। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর রুকু আর এই গল্পের টিপুর গল্প-পড়ার ভাবনাতে একটা সুন্দর স্বাতন্ত্র্য আছে। রুকু ওই শিশি-কিশোর সাহিত্যের সমস্ত অদ্ভুতকে সত্যি বলেই মানে আর অন্যদিকে এই টিপু জানে তারা গল্প--- সেই গল্পের সত্যিটাকে আরেক রকম সত্যি বলে মানে। জানে সেই গল্পের ভেতর কল্পনাকে আস্বাদন করারও একটা স্বাদ আছে। তাই রুকু যেমন বলেই দিয়েছিল ‘সব সত্যি’, তেমনটা কিন্তু ‘সব সত্যি’ কথাটা বলেনি টিপু। তাকে তার সেই অঙ্কের টিচার যখন বললেন, ‘এসব পড়লে অঙ্ক মাথায় ঢুকবে কেমন করে?’ তার উত্তরে টিপু জানায়, এ তো গল্প স্যার! তার উত্তরে অবশ্য আরো ঝাঁজালো হয়ে ওঠে অঙ্কস্যারের ধমক, ‘গল্প? গল্পর তো একটা মাথামুণ্ডু থাকবে, নাকি যেমন তেমন একটা লিখলেই হল?’ টিপু সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নয়, সে পাল্টা যুক্তি সাজায়, রামায়ণেও তো হনুমান, জাম্বুবানের কথা আছে বলে, বলে মহাভারতের বক রাক্ষস আর হিড়িম্বার কথা। এর উত্তরে অঙ্কের স্যারের মুখে চমৎকার একটা কথা বসান লেখক সত্যজিৎ। অঙ্কের স্যার নরহরিবাবু বলেন, ‘ওসব হল মুনিঋষিদের লেখা, দু-হাজার বছর আগে।’ এমনকি তিনি আবার যোগ করে দেন, মানুষের গায়ে হাতির মাথা বসানো গণেশের গল্প, মা দুর্গার দশটা হাতের কথা। মুনিঋষিদের কথা এক রকম আর এখনকার লেখকরা সেই কল্পনা আজকের মতো সাজালে তা বড়োদের চোখে গাঁজাখুরি! তাই, এই বিংশ শতাব্দীর ছেলেপুলেদের ওইসব অবাস্তব কাহিনি পড়ার চেয়ে কী পড়া দরকার, তারও একটা লিস্ট তৈরি করে দেন অঙ্কস্যার। বললেন, ‘মনীষীদের জীবনী, ভালো ভালো ভ্রমণকাহিনি, আবিষ্কারের কথা, মানুষ কী করে ছোটো থেকে বড়ো হয়েছে সেইসব কথা।’ এই অঙ্কস্যারের ভাবনা বেশ অন্য রকম। তিনি আবার এই বকুনির সূত্রে কিশোর টিপুর থেকে জেনে নিতে চান, তার ক্লাসে আর কে কে এই ধরনের গল্পের বই পড়ে। উদ্দেশ্য অবশ্যই তাদেরও বেপথু পড়া থেকে পথে-আনানোর সবক শেখানো।
১৯৮২ সালে লেখা গল্পে এই প্রশ্নের যে উত্তর টিপু জানালো, সেটিও পরবর্তীকালীন বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্য পড়ার অভ্যাস বদলের একটা তাৎপর্যপূর্ণ সংকেত। সে বলে, সত্যি বলতে কী আর কেউই বিশেষ পড়ে না এসব। বরং, তার জনৈক বন্ধু শীতল একবার তার কাছ থেকে নিয়েছিল ‘হিন্দুস্থানি উপকথা’ নামক সেকালের বিখ্যাত বই। লেখিকা ছিলেন সীতা দেবী, শান্তা দেবী। কিন্তু শীতল বই তো নিল, তারপর? তারপর, কয়েকদিন পরেই সে বই ফেরত দিয়ে বলেছিল, ‘ধুর, এর চেয়ে অরণ্যদেব ঢের ভালো।’ বাঙালি ছেলেমেয়েদের গল্পের বই পড়ার অভ্যাস বদলে যাচ্ছে, দেশীয় গল্প পড়ার থেকে মন সরে যাচ্ছে বিদেশি গল্পকথায়। গল্পের বই পড়ার অভ্যেস ক্রমশ বদলে যাচ্ছে কমিকস পড়ার নতুনতর অভ্যাসে! সত্যজিৎ একটা গল্পের মধ্যে হলেও স্পর্শ করে রাখলেন, বাঙালি শিশু-কিশোরের পাঠরুচি বদলের সেই প্রসঙ্গ।
আরও পড়ুন
পিতামহ তর্পণ-২
এহেন অঙ্কস্যার ধীরে ধীরে টিপুর গল্পের বই পড়ার অভ্যাস বন্ধ করে দিতে চান। সরাসরি দরবার করেন টিপুর বাবার কাছে। একদিন সন্ধ্যাবেলা তিনি টিপু ওরফে তর্পণ চৌধুরির বাবার কাছে হাজির হলেন নরহরি। টিপুকে তার দাদু যে সাতাশটা বই উপহার দিয়েছেন, সেগুলো আনতে হল তাকে। সেই সব বই উল্টেপাল্টে দেখে টিপুর বাবাকে নরহরি জানালেন, ‘দেখুন মিস্টার চৌধুরি, আমি যেটা বলছি, সেটা আমার বহুদিনের চিন্তা-গবেষণার ফল। ফেয়ারি টেইল বলুন, আর রূপকথাই বলুন এর ফল হচ্ছে একই--- ছেলেমেয়েদের মনে কুসংস্কারের বীজ বপন করা। শিশুমনকে যা বোঝাবেন, তাই তারা বুঝবে।’ ফল হল সাংঘাতিক। টিপুর সব গল্পের বই বড়োদের হাতে বাজেয়াপ্ত হল। সব বই বাবার আলমারিতে চাবি-বন্দি হল। বাবা নিজে কী মনে করেন, তার থেকেও বড়ো হল, মাস্টারমশাই বলেছেন। অতএব, তা মেনে চলাই সমীচীন। টিপুর মা খুশি হন না মাস্টারমশাইয়ের এই সিদ্ধান্তে বাবার বলা হ্যাঁ-তে। তিনি বলেন, ‘যে লোক এমন কথা বলতে পারে, তাকে মাস্টার করে রাখা কেন বাপু?’ মা ছেলেকে বলেন, তিনি তাঁর মা, মানে টিপুর দিদিমার কাছে কানে-শোনা অনেক গল্প বলে-বলে শোনাবেন। নাই বা পড়তে পারল--- শুনুক অন্তত। কিন্তু মায়ের এই স্নেহের কথায় টিপুর মনে হল তিনটে কথা। এক, মা-এর কাছে এই গল্পগুলো আগে তার বহুবার শোনা। দুই, মায়ের ভাঁড়ারে গল্পের সংখ্যা সীমিত। আর তিন নম্বর, ‘বই পড়ার মজা মুখে শোনা গল্পে নেই। বইয়ে ডুবে যাওয়া একটা আলাদা ব্যাপার। সেখানে শুধু গল্প আর তুমি--- মাঝখানে আর কেউ নেই।’ পাঠক, বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই, কেন বলছিলাম, গল্প তো এখানে যা-আছে, তা আছেই। তার চেয়েও বড়ো হল, এই শিশু-কিশোর সাহিত্যের নানা তত্ত্বকথার গল্পগত সন্ধান।
আরও পড়ুন
পিতামহ-তর্পণ: ১
আরও পড়ুন
সত্যজিতের লেখা নাটিকা
এরপরে গল্পের একটা পরিণতি আছে। অঙ্কস্যারকে বিশ্বাস করতে হয়, গল্পের ওই তথাকথিত গাঁজাখুরিও সত্যিকারের সত্যি হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর এক সহকর্মী বিষ্ণুরামবাবুর বাড়ি থেকে তাঁর পেগ্যাসাস নামের ঘোড়াটির পিঠে চড়ে বের হওয়ার পর, সেই পোষা-ঘোড়াটাই যখন সত্যিকারের গ্রিক পুরাণের পিঠে ডানাওয়ালা ঘোড়া হয়ে উড়তে থাকে আকাশপথে, তখন প্রত্যয় হয় টিপুর অঙ্কস্যারের। তার ফলস্বরূপ টিপুর গল্পের বই ফেরত এলো টিপুর টেবিলে। কিন্তু, এহো বাহ্য। আসল কথাটা লুকিয়ে আছে অন্যত্র। নরহরিবাবু নয় বুঝলেন গল্পের সত্যির ধরনটা। কিন্তু সেটাই কি টিপুর দিক থেকে আরো একভাবে দেখলেন না সত্যজিৎ? আমরা আগেই বলেছিলাম, টিপুর বিশ্বাসের জগৎ আর রুকুর বিশ্বাসের জগৎটা আলাদা। রুকু মনে করত সব সত্যি আর টিপু বলেছিল, এগুলো গল্পের সত্যি। আচ্ছা, টিপুর দেখা বন্ধু ‘গোলাপীবাবু’ তো তার সামনে চাক্ষুষ সত্যি। তার চোখের সামনে দেখা বিষ্ণুরামবাবুর ঘোড়া হয়ে গেল পেগ্যাসাস! তাহলে, এই গল্পের সীমানায় শুধু তো বদলে গেলেন না অঙ্কস্যার, এই অভিজ্ঞতা থেকে কি আমাদের টিপুও এরপরে বলে উঠবে না, ‘সব সত্যি, হাঁউ মাঁউ খাঁউ সত্যি, হনুমান-জাম্বুবান সত্যি, সব রূপকথার গল্প সত্যি, উড়ুক্কু ঘোড়া পেগ্যাসাস সত্যি, গোলাপীবাবুও সত্যি।’ তাহলে গল্পের শেষে ঠিক কাশীর ঘোষালবাড়ির রুক্মিনীকুমার ওরফে রুকুর অনুভূতিতেই পৌঁছে গেল এই গল্পের টিপু। সেটাও একটা আসল কাহিনি।
আরও পড়ুন
ছন্দের জাদুকর সত্যজিৎ
Powered by Froala Editor