‘এবারো বারো’ বইয়ের ‘স্পটলাইট’ গল্পটা বেশ অদ্ভুত। কেমন যেন পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্প, মানে সেই যে গল্প থেকে সত্যজিতের ‘মহাপুরুষ’ ছবিটি তৈরি, তার সঙ্গে এর একটা মিল আছে, আবার এই গল্পের সঙ্গে ভেতেরে ভেতরে মিল আছে সত্যজিতের নিজস্ব কাহিনি অবলম্বনে তৈরি ‘নায়ক’-এরও। আর এই গল্পখানা অবশ্যই সত্যজিতের একেবারে নিজস্ব গল্পের প্লট-প্যাটার্নের সঙ্গেও বেশ মিলে যায়। কারণ, সত্যজিতের গল্পের অন্যতম মূলসূত্র হল প্রতিশোধ। কত রকম প্রতিশোধের গল্প সেখানে--- সে একটা বিরাট কিসসা। তার সেই লম্বা ফিরিস্তি নিয়ে একাধিক কলমকারির আড্ডা হতেই পারে। হবেও হয়ত। মোট কথা, এই ‘স্পটলাইট’ গল্পে সেই প্রতিশোধের থিমটাও যে একেবারে অন্যভাবে নেই তা নয়। তবে, তার সঙ্গে আরো অনেক কিছুর গল্প এই কাহিনি।
প্রথমত, এটা এমন এক কাহিনি, যার শুরুতে একটা বাঙালি ছুটির মেজাজের বিস্তারিত উল্লেখ আছে। গল্পটা তো শুরুই হয় সেই ছুটির কথায়। বাঙালির ছুটির বেড়ানোর ধরনটা কেমন ছিল? দলবেঁধে ছুটি কাটানোর জন্য বেছে নেওয়া হল ছোটোনাগপুর অঞ্চলের ছোটো শহর। সেখানে কেউ এসে পৌঁছয় নিজেদের বাড়িতে, কেউ আবার বাড়ি-বাংলো ভাড়া নিয়ে আসেন। গল্পের ভাষায় ‘দিন দশেক’ কাটিয়ে ‘মাস ছয়েক আয়ু’ বাড়িয়ে শহরে ফিরে যেতে হয়। শহরের সঙ্গে যুক্ত বিনোদনের শব্দগুলো ফিকে হয়ে যায় এখানে। ছোটোদের জন্য লেখা গল্পে, একটি আশ্চর্য মন্তব্য করেন সত্যজিৎ। লেখেন, ‘দলে ভারী হয়ে আসি, তাই গাড়ি-ঘোড়া সিনেমা-থিয়েটার দোকানপাট না থাকলেও দশটা দিন দারুণ ফূর্তিতে কেটে যায়।’ শহরে মানুষ যেন ‘একা’--- তাই সেখানে তাকে সঙ্গ দেয় ওই সিনেমা আর থিয়েটার। সেখানে সকলে ব্যস্ত বলেই নিজেদের মধ্যে কাটানো হয় না সময়, তাই সেই ফাঁকের ভেতর দিয়ে কথা বলে শহুরে বিনোদন সিনেমা আর থিয়েটার। অন্যদিকে, এখানে মানুষ হাজির হচ্ছে দল বেঁধে, তাই সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের কথা-বলাটাই বিনোদন। তাই এখানে সময়-কাটানোর গল্পটা অন্য। মজার কথা হল, তার পরের বাক্যটিও। সত্যজিৎ লেখেন, ‘একটা বছরের সঙ্গে আরেকটা বছরের ছুটির তফাত কী জিজ্ঞেস করলে মুশকিলে পড়তে হবে, কারণ চারবেলা খাওয়া এক--- সেই মুরগি মাংস ডিম অড়হড় ডাল, বাড়িতে দোওয়া গোরুর দুধ, বাড়ির গাছের জামরুল পেয়ারা, দিনের রুটিন এক’। এই বাঙালির নিজস্ব ছুটির মেজাজ দিয়ে শুরু হল কাহিনি।
তারপরেই এলো বিশ শতকের কলকাত্তাই বাঙালির আরেক নিজস্ব জীবনের গল্পসূত্র। তা হল, শহুরে বাঙালি কোন উন্মাদনাতে দেখে সিনেমা আর তার নায়ককে। এখানে নায়কের নাম, অংশুমান চ্যাটার্জি। যার মুখে এই গল্পটা শোনা যাচ্ছে, সেই কথক বালকটির অবশ্য তত পছন্দ নয় সেই নায়ককে। কিন্তু, তার বোন শর্মির কাছে সে এক স্বপ্নের নায়ক। শর্মি কী করে? সে তার বঙ্গলিপি খাতার পাতায় বানিয়েছে তার স্বপ্নের নায়কককে নিয়ে এক অ্যালবাম। এখনকার পাঠকের কাছে বঙ্গলিপি খাতা কথাটার আর মানে বোঝা যাবে না, সেই বিংশ শতাব্দীর সাত-আট দশকে রেশনের চাল-গমের সঙ্গেই পাওয়া যেত পাতলা খাতা। খাতার ওপরে পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপ থাকত আঁকা। ব্র্যান্ড ছিল বঙ্গলিপি। সেকালে কলকাতার স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের কাছে থাকতই থাকত এই বঙ্গলিপি খাতা। খবরের কাগজের সিনেমার পাতায় আর ফিল্ম ম্যাগাজিনের পাতায় প্রিয় নায়কের ছবি বেরোলেই তা কেটে কেটে রাখার একটা পাগলামো ছিল। সিনেমার নায়কের ছবি কাটত শহরের কিশোরী-যুবতীরা আর তখনকার ছেলেদের কাছে কাগজ থেকে আর খেলার পত্রিকা থেকে কাটা হত প্রিয় খেলোয়াড়ের ছবি। তাদের কাছে মুখস্থ নায়কের পছন্দের খাবার কী? সাংবাদিকের কাছে আগ্রহের বিষয়, যে মানুষটা বছরে তিনশো সাতষট্টি দিন শুটিং করে, সে কাজ থেকে ছুটি পেল কী করে? অন্যদিকে নায়ক নিয়ে উন্মাদনায় তখনকার ছেলেপুলেরা নকল করত হিরোর চুল কাটার কেতা, নায়কের কথা বলার ধরন, তার শার্ট-পরার স্টাইল। এই নায়ক যখন শহরে বেরোন তখন শহরের চেহারাটা কেমন হয়? গল্পের ভাষায় কথক বলে, ‘সেবার আন্দামান যাবার সময় দেখেছিলাম আমাদের জাহাজ ঢেউ তুলে চলেছে আর আশেপাশের ছোটো নৌকোগুলো সেই ঢেউয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছে। অংশুমান-জাহাজ বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরোলে এখানকার পানসে নৌকো বাঙালি চেঞ্জারদের সেই অবস্থা হয়--- ছেলে বুড়ো মেয়ে পুরুষ কেউ বাদ যায় না।’ শহুরে মানুষ চায় উন্মাদনা। সেই উন্মাদনার ইন্ধন জোগায় এই নায়কের আকস্মিক উপস্থিতি।
‘নায়ক’ ছবি তো শুধু নায়ক অরিন্দম মুখার্জির গল্প নয়, নায়কের আকস্মিক উপস্থিতি আর তাকে ঘিরে কিছু শহুরে মানুষের প্রতিক্রিয়াও তো ‘নায়ক’ ছবির কাহিনি। এখানেও সেই গল্পের একটা আভাস। কিন্তু নায়কের ওপরে আটকে-থাকা স্পটলাইটের গল্প তো ‘স্পটলাইট’ নয়, বরং নায়কের ওপর থেকে সেই স্পটলাইট অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার গল্পই তো এটি। সেই এক হুজুগ থেকে অন্য হুজুগে সরিয়ে নেওয়ার জন্য শহরে আসেন আরেক হুজুগের উপাদান কালীকিঙ্কর ঘোষাল। গোটা শহরে রটে যায়, তাঁর নাকি তখন বয়স ১২৬! রবীন্দ্রনাথের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো, সিপাহি বিদ্রোহের এক বছর আগে নাকি তাঁর জন্ম। তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেননি, তবে হেদুয়ার পাশে দেখেছেন বিদ্যাসাগর মশাইকে। হিন্দুমেলায় যেদিন তরুণ রবীন্দ্রনাথ কবিতা পড়লেন, সেদিন তিনি উপস্থিত ছিলেন। দূর থেকে দেখেছেন তাঁকে। তার মানে, সেটা হল ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫ সালের কলকাতায় হিন্দুমেলার নবম অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন এই কালীকিঙ্কর ঘোষাল। সেখানে তিনি তেরো বছর ন-মাসের কিশোর রবীন্দ্রনাথকে জনসমক্ষে নিজের কবিতা পড়তে শুনেছিলেন। সকলে বিস্মিত। গল্পকথকের বাবা তো বলেই ফেলেন, ‘সে তো বিখ্যাত ঘটনা।’ কেন সে ঘটনা বিখ্যাত? কারণ, সেদিনই তো রবীন্দ্রনাথ প্রথম সর্বজনসমক্ষে প্রথম নিজের কবিতাপাঠ করলেন। বহুদিন পর্যন্ত জানা ছিল রবীন্দ্রনাথ সেই সভায় ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ কবিতাটি বলেন, পরে প্রমাণিত হয় সেদিন তিনি এই কবিতাটি নয়, বলেছিলেন ‘হোক ভারতের জয়’ কবিতাটি। সে অন্য কথা। তবে এই গল্পের জন্য মূল কথাটা হল, রবীন্দ্রনাথ যেদিন সভায় প্রথম কবিতা আবৃত্তি করেন, সেদিন নাকি সেই সভায় হাজির ছিলেন এই কালীকিঙ্কর।
আরও পড়ুন
একটি দৃশ্য কয়েকটি সংলাপ
আরও পড়ুন
শতবার্ষিকী স্মরণে : প্রোফেসর এইচ- বি- বি- ২
এখান থেকেই কাহিনিতে লাগল মোচড়। সেই ছোট্টো শহরের যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্র সরে গেল নায়ক অংশুমান থেকে কালীকিঙ্করে--- স্পটলাইট সরে গেল নায়ক থেকে দীর্ঘায়ু মানুষের জল্পনায়। এই কথক রঞ্জুর বাড়িতেও আগে সাংবাদিক মানুষটি তার খবর শেষ পর্যন্ত করল ওই নায়কের বদলে, এই কালী ঘোষালকে নিয়ে। কথকের যে-মামা বিলিতিমতে জ্যোতিষের চর্চা-করতেন, তিনি আগে ভেবেছিলেন, নায়কের যশের রেখাটা দেখবেন, এখন কালী ঘোষালকেই বলে বসলেন, ‘আপনার হাতখানা যদি একবার দেখতে দেন। শুধু একটিবার চোখ বুলব।’ এমনকি, আগে যে-কথা হচ্ছিল নায়ককে নিমন্ত্রণ করিয়ে খাওয়াবার, তার বদলে নিমন্ত্রণ পেলেন ১৩৬ বছরের কালী ঘোষাল। তবে কথকের ছোড়দা সুরঞ্জন, সে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে, গল্পের কথায়, ‘ভয়ংকর সিরিয়াস ছেলে’। তার কাছে ওই বাংলা ছবির হিরো নিয়ে মাতামাতিটাও খারাপ আবার এই দীর্ঘায়ু-বৃদ্ধ নিয়ে হুল্লোড়টাও বাড়াবাড়ি। এই হল স্পটলাইটের শিফ্টিংটা এই কাহিনির দ্বিতীয় পর্যায়। কহানি মেঁ টুইস্ট তখনো বাকি আছে। সেটাই কাহিনির তৃতীয় পর্যায়।
আরও পড়ুন
শতবার্ষিক স্মরণে প্রোফেসর এইচ বি বি- পর্ব ১
পুজোর ছুটি সেরে কলকাতায় ফিরে ওই সিরিয়াস ছাত্র ছোড়দাই জোগাড় করল একটা পুরোনো ফিল্ম ম্যাগাজিন। আগেই শুনেছিলাম, সে নাকি বাংলা ছবি নিয়ে কঠিন গবেষণা করছে, তা নিয়ে কড়া একটা থিসিস লিখবে সে। হয়ত বা, সেই পড়াশোনার জন্যেই সে হাতে পেয়েছে একটা পুরোনো সিনেমা পত্রিকা, নাম ‘বায়োস্কোপ’। সেখানেই দেখা গেল, ছবিটা। ১৯২৪ সালের পত্রিকাতে ছাপা হয়েছিল নির্মীয়মাণ ছবি ‘শবরী’-র ছবি। রামচন্দ্রের ভূমিকায় নবাগত নায়ক কালীকিঙ্কর ঘোষাল। সেই প্রথম আর সেই শেষ। পর্দায় একেবারে ফ্লপ কালীকিঙ্কর। ছবি থেকে বোঝা যায়, জন্ম ১৯০০ সাল নাগাদ। তার মানে ১৯৮০ সালে তাঁর বয়স, তাঁকে দেখে যা মনে হয় তা-ই। একাশি-বিরাশি! যে গল্প একাংশে ছিল নায়কের কাহিনি, তা দ্বিতীয় পর্যায়ে হল বিরিঞ্চিবাবার কাহিনি, সেটাই শেষে পৌঁছল সত্যজিতের নিজস্ব গল্পের ধরনে। সেই প্রতিশোধের গল্প। একদিন পর্দায় জনপ্রিয় হতে না-পারা উঠতি নায়ক কালীকিঙ্কর এতদিন পরে আরেক পর্দার জনপ্রিয় নায়ককে জনপ্রিয়তায় হারিয়ে দিলেন স্রেফ একটা মিথ্যা বলে। গল্পে সিনেমার নায়কদের সম্পর্কে একটা কথা বলা হল, তারা নাকি সব ‘শুটিং স্টার’, ‘আজকে আছে কালকে নেই। ফস করে খসে পড়বে আকাশ থেকে আর বায়ুমণ্ডলে যেই প্রবেশ করল অমনি পুড়ে ছাই। তখন পাত্তাই পাওয়া যাবে না তার।’ একদিন নায়ক হতে গিয়ে নায়ক না-হতে পেরে কালীকিঙ্কর হয়েছিলেন শুটিং স্টার আর আজ যুগের হুজুগের খেলায় বৃদ্ধ কালী ঘোষাল, শুটিং স্টার করে দিলেন নায়ক অংশুমান চ্যাটার্জিকে! এ এক আশ্চর্য কাহিনি!
আরও পড়ুন
পিতামহ-তর্পণ: ১
অথচ, এ হেন চমৎকার-গল্পটিকে সারা ভারতের দর্শক সাধারণ, সম্প্রতি সম্প্রচারিত একটি ওয়েব-সিরিজে এক্কেবারে অন্য একটা গল্পের চেহারায় দেখল। সত্যজিতের ১০০ বছরে তাঁর উদ্দেশে নিবেদিত চিত্ররূপে তাঁর কাহিনিকে পুরোপুরি বদলে ফেলা হল, অথচ বলা হল, সেই গল্পের লেখক নাকি সত্যজিৎ! এখনকার ভারতীয় দর্শকের তথাকথিত জনরুচির কাছে জনপ্রিয় করার সস্তা চটুল ভাবনায় সত্যজিতের একটি গল্পের আগাপাশতলা বদলে তাঁকে অসম্মানিত না করলেই বোধহয় ভালো হত! ভুলে গেলে কী করে চলবে, তিনি জনরুচি তৈরি করতে চেয়েছিলেন তাঁর লেখায়, তাঁর ছবিতে। তিনি জনরুচির স্রোতে গা-ভাসাতে চাননি--- অথচ তাঁরই জন্ম শতবর্ষে তাঁকেই কিনা সেই প্রচলিত জনরুচির মাপে বসানোর এই অপচেষ্টা নিয়ে আম-বাঙালি চুপ করে রইল! কেউ বলল না, ছবি করার জন্য গল্প বদলাতে হয় সকলেই জানে এবং মানেও, তবে কিনা সে বদল এ বদল নয়! ভারী আশ্চর্য!!
Powered by Froala Editor