গত হপ্তায় কথা হচ্ছিল ‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ’ গল্পটা নিয়ে। আড্ডা দিতে দিতে এই কথাটাই বলছিলাম যে, আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে প্রকাশিত ‘হয়বরল’ গল্পটির প্রতি তো বটেই, আরেকভাবে বললে, পিতা সুকুমার রায়ের প্রতি উত্তরকালের এক আশ্চর্য শ্রদ্ধার্ঘ্য যেন সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ’ গল্পটি। সাহিত্যতত্ত্বের পরিভাষায় ‘হয়বরল’ প্রকাশের আধ শতাব্দী পরে প্রকাশিত এই কাহিনি যেন ওই গল্পের আর ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের চরিত্রগুলির এক সুন্দর অভিনব পাস্তিশ। এই কাহিনির উপস্থাপনার ধরনটাই এমন যেখানে সুকুমার রায়ের লেখা খেয়ালখুশির জগৎটা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে এক হাড়হিম-করা গল্পের আবহে। হযবরল-র হিজিবিজবিজ এখানে এমন এক গবেষক যে কাজ করে চলেছে সুকুমার রায়ের লেখা অদ্ভুতুড়ে সব প্রাণীদের সত্যিই গড়ে তোলা যায় কি না তাই নিয়ে। তার মনে হয়, আজকাল যখন ‘একটা মানুষের হৃৎপিণ্ড আরেকটা মানুষের শরীরে বসিয়ে দিচ্ছে’ তখন ‘আর একটা জানোয়ারের আধখানামাত্র কান একটা মানুষের কানের ওপর’ বসানো কী এমন কঠিন কাজ? সেই বিজ্ঞানীর নিজের কানটাই সেই রকম, তার নিজের কান আর একটা বনবেড়ালের কান একসঙ্গে মিলিয়ে বানানো! সে তার গবেষণাগারে একটি গিরিগিটিয়াও প্রায় বানিয়ে ফেলেছিল, শুধু ওই ‘খিচুড়ি’ কবিতার সূত্র মেনেই তাদের দুজনের খাদ্যরুচি আলাদা হওয়ার কারণে সেটা বাঁচেনি। না হলে, এমনিতে ভালোই ছিল। তার বাড়ির নির্মাণ প্রকৌশল দেখে গল্পের কথকের মনে পড়ে আবোল তাবোল গল্পের সেই ‘বুড়ির বাড়ি’-র গঠন! এমনকি, হিজিবিজবিজ-এর একনিষ্ঠ ভৃত্যটির চেহারা দেখলেই মনে পড়ে যায় সে খাস বহুদিনের চেনা লোক আবোল তাবোল গ্রন্থের ‘পালোয়ান’ গল্পের সেই বিখ্যাত ষণ্ডামার্কা ষষ্ঠীচরণ। ক্রমশ একদিকে সুকুমার রায়ের আশ্চর্য জগৎ চোখের সামনে জেগে উঠছে আরেকদিকে পড়ার ভেতর যে দুনিয়া ছিল মজার, তা চোখের সামনে জেগে উঠছে এক ভয়ংকর আবহ তৈরি করতে করতে।
এই খ্যাপা বিজ্ঞানীই গিরগিটিয়া তৈরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে, তাঁর ভাষায়, ‘ধড়ে মুড়ো সন্ধিটা ছেড়ে অন্য এক্সপেরিমেন্ট ধরেছি’। মানে সে বুঝেছে, ধড় আর মুড়ো যোগ করা যোগ করার একটা পর্যায় হলে সেই জোড়াতাড়ার আরেকটি পর্যায় হল একটি প্রাণীর শরীরে আরো একটি নয়, আরো বিভিন্ন ধরনের প্রাণীদের শরীরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জুড়ে দেওয়া। সে বলে, সে সব কিছুই জোগাড় করে ফেলেছে, শজারুর কাঁটা, রামছাগলের সিং, সিংহের পেছনের দুটো পা, ভাল্লুকের লোম--- কিন্তু তাঁর নতুন প্রাণীর খানিকটা অংশ যে মানুষেরও! ঠিক তেমনটি একটি মানুষ এবারে তাঁর দরকার। গল্পের কথক প্রথমে ততটা বুঝতে পারেন না--- আস্তে আস্তে সেই খ্যাপা বিজ্ঞানীই মনে পড়িয়ে দেয় এখন সে কোন কিম্ভুতকে বানাতে চাইছে তার ল্যাবরেটরিতে। তার টেবিলে পড়ে রয়েছে ‘আদ্যিকালের আবোল তাবোল’-এর একটি সংস্করণ। সেখানে ‘ভয় পেয়ো না’ কবিতার সেই বহুবার দেখা ছবি। মন দিয়ে তাকালেই বোঝা যাবে তার সুকুমারীয় অ্যানাটমি। মিলে যাবে হিজিবিজবিজের বলা জোগাড়-করা মাল-মেটেরিয়ালের অঙ্ক। এই জন্তুর পিছনে শজারুর কাঁটা, পায়ের দিকে সিংহের পিছনের দুটো পা, গায়ে ভাল্লুকের লোম, মাথায় রামছাগলের সিং। খ্যাপা বিজ্ঞানী বলে এখন তার দরকার ওই সিং যে মুন্ডুটার ওপরে বসবে, সেই মুন্ডুটা তো একটা অদ্ভুতদর্শন মানুষের। সেই মানুষের মুখখানা এবারে দরকার তার। কথক ভদ্দরলোক তেমন কোনো মানুষকে দেখেছেন কি না--- তার খোঁজও নেয় হিজিবিজবিজ। তেমন মানুষ বিজ্ঞানী নিজেও খুঁজছে, খুঁজছে তার চাকর ষষ্ঠীচরণও। কারণ, এমন একটা মানুষ না পেলে যে তার বিজ্ঞানচর্চা সম্পূর্ণ হবে না।
গল্পে আস্তে আস্তে ভয় ঘনিয়ে আসে। আশঙ্কা তৈরি হয় শুধু বানাতে-চলা কিম্ভুতুড়ে প্রাণীটির চেহারা নিয়ে নয়, আশঙ্কা ঘনালো এমন লোক পাওয়া গেলেও, সেই মানুষটাকে যে কেটেকুটেই নতুন একটি প্রাণী বানাতে হবে সেই ভয়টাতেও! ভাবতে পারছেন পাঠকমশাই! শুধু একটা লোককে মেরে ফেলা এক রকমের ভয়! তার থেকে বহুগুণের ভয়ের এলিমেন্ট একটি লোককে মেরে, তাকে কেটেকুটে, তার মাথাটাকে একটা ভাল্লুকের ধড়ে বসানো আর সেই মানুষের মাথায় রামছাগলের সিং বসিয়ে আরেকটা চেহারা বানানোর প্রক্রিয়ায়। ‘ভয় পেয়ো না’ কবিতার লোকটি ছাতা হাতে ছুটে পালাচ্ছিল কিম্ভুতুড়ে প্রাণীটিকে দেখে আর সে বলছিল, ‘ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না’। আর এইদিকে নতুন দিনের গল্পে সেই প্রাণীটি তৈরিই হয়নি, তার তথাকথিত প্রক্রিয়াকরণের কল্পনাতেই জমে উঠছে গল্পের ‘ভয়াবহ’। কতটা ভয়াবহ সেটা আরো বোঝা যাবে হিজিবিজবিজের কথায়। ওই ছবি দেখিয়ে কথক ভদ্দরলোক যখন জিজ্ঞাসা করেন, ‘অত গোল গোল চোখ কি মানুষের হয়?’
আরও পড়ুন
শতবার্ষিক স্মরণে প্রোফেসর এইচ বি বি- পর্ব ১
সেই প্রশ্নের উত্তরে হিজিবিজবিজের উত্তরটা কী? সে লাফিয়ে উঠে বলে, ‘আলবত! চোখ তো গোলই হয়! চোখের পাতা দিয়ে গোলের অনেকটা ঢাকা থাকে বলে, অতটা গোল মনে হয় না!’ কথাটা সাংঘাতিক! তার মানে, এই খ্যাপা কী করবে? সে যে লোকটি পাবে, তার চোখের ওই পাতাটাকে পুরো খুলে নেবে, তারপর তার ভেতর থেকে অক্ষিগোলকটিকে বার করে বসাবে মুখে। তার মানে, আর সকলের মতো, ওই গোল গোল চোখটা এই খ্যাপার কাছে সমস্যা নয়, তাকে পেতে হবে শুধু বাকি মুখটা। এইবার সত্যজিৎ কীভাবে দেখেছিলেন ওই ‘ভয় পেয়ো না’ কবিতার প্রাণীটিকে বোঝা যাবে--- বোঝা যাবে কত মন দিয়ে তিনি দেখেছিলেন এইসব বাবার আঁকা ছবি।
আরও পড়ুন
পিতামহ তর্পণ-২
গল্পের পটভূমি ওই গোপালপুরেই তেমন দেখতে একটি মানুষের দেখা পান গল্পের কথক। তবে ঠিক করেন, এই কথা না জানালেও চলবে ওই খ্যাপা বিজ্ঞানীকে। কারণ তাহলে তার পরিণতি হবে সাংঘাতিক। লোকটি গল্পেরই এক চরিত্র, সেই গোপালপুরেই বেড়াতে আসা অন্য একটি চরিত্র। নাম তার ঘনশ্যামবাবু। ঘনশ্যামবাবুর দিকে চোখ পড়তে, কথক হিমাংশু চৌধুরির মনে হয়, ‘এ যে সেই আবোল তাবোলের মুখ--- যে মুখের খোঁজ করছেন ওই উন্মাদ প্রোফেসর হিজিবিজবিজ!’ কেমন দেখতে ঘনশ্যামবাবুকে? গল্পের বর্ণনা অনুসারে, ‘সেই থ্যাবড়া নাকের নীচে দুপাশে ছিটকে থাকা লম্বা পাকা গোঁফ, লম্বা গলার দুপাশে ঠিক ছবির মতো করে বেরিয়ে থাকা শিরা, এমনকি চ্যাপটা থুতনির নীচে কয়েক গোছা মাত্র চুলের ছাগলা দাড়িটা পর্যন্ত।’ ভেবে দেখুন, কী সাংঘাতিকভাবে কথক হিমাংশুর মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়েছে হিজিবিজবিজ--- একটি মানুষের মুখের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাদ গেল তার চোখের কথাটাই। কারণ, চোখের জন্য সেই ভয়ংকর সমাধান তো আছেই। মুখের বর্ণনা বলতে চোখের পরে, মুখের বাকি অংশের বর্ণনা।
আরও পড়ুন
পিতামহ-তর্পণ: ১
আরও পড়ুন
রামকুমার আর নিকুঞ্জ সাহা
গল্পের ভিতর এই ঘনশ্যামবাবুকেই তুলে নিয়ে যায় প্রোফেসরের ষণ্ডা-পালোয়ান ষষ্ঠীচরণ। সেই অনুযায়ী চিঠি এসে পৌঁছয় হিমাংশুর কাছে। তার মূল কথা, সন্ধের দিকে আসার আমন্ত্রণ, কারণ ‘সিংহের পশ্চাৎভাগের সহিত শজারুর কাঁটা এবং ভাল্লুকের লোম নিখুঁতভাবে জোড়া লাগিয়াছে। মুদ্গরও একটি তৈয়ার হইয়াছে চমৎকার। শৃঙ্গ তিনটি মস্তকের অপেক্ষায় আছে।’ এবারে বাকি কাজও প্রায় শেষের মুখে। ‘অতএব সন্ধ্যায় একবার কিংকর্তব্যবিমূঢ়ে পদর্পণ করিলে যারপরনাই আহ্লাদিত হইব।’ সত্যিই তো, হয়বরল-তে তো এই হিজিবিজবিজই বলেছিল ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ নামের একটা বাড়ির কথা। সেই এক মাথার ব্যামোওয়ালা লোক যেই তার বাড়ির নাম রেখেছিল ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ অমনি ভূমিকম্প হয়ে তার বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছিল। সেই বাড়ির নাম ফিরে এলো এখানেও আর ওই আমন্ত্রণকর্তার নাম হল এইচ বি বি। হিজিবিজবিজ-এর মুণ্ডমাল এইচ বি বি-ই হয় বটে। আর যেহেতু তিনি প্রোফেসর, তাই এটাই স্বাভাবিক, মুণ্ডমাল শব্দ দিয়েই সে পরিচিত হবে--- যেমন প্রোফেসর মাধব চক্কোত্তি হবেন এম বি বা প্রোফেসর যাদব সরকার হবেন জে-এস, সেই যুক্তিতেই প্রোফেসর হিজিবিজবিজ হল এইচ-বি-বি।
কাহিনির শেষে সেই প্রাণী তৈরি হলেও তার সঙ্গে কথক হিমাংশুর দেখা আর হয়নি। কোনো এক অজ্ঞাতকারণে সেই প্রাণী তৈরি হওয়ার পরে যেতে শুরু করল সমুদ্রের দিকে। যার মুখ মানুষের মতো, চেহারাতে সিংহ- শজারু- ভল্লুকের উপকরণ--- সে যে কেন জলের দিকে গেল, সে কথা বুঝতে পারেনি প্রোফেসর এইচ-বি-বি। তবে সে যে তৈরি হয়েছিল, তার প্রমাণ, বালির উপরে পড়ে থাকা পা নয়, থাবার ছাপ। সে ছাপ একেবারে টাটাকা। দুটো বইয়ের নানা প্রসঙ্গ আর চরিতাবলি আর অনুষঙ্গ জুড়ে এমন গপপো এমন এক পাস্তিশ সাহিত্য হিসেবে অভিনব আর অভিনবতর এই পিতৃতর্পণ। অথচ এই যে গল্পের ভেতর লেখা হয়েছিল হিজিবিজবিজের টেবিলে থাকা ‘আদ্যিকালের আবোল তাবোল’ বইটার কথা--- তার সঙ্গে তো সত্যজিতের অন্য এক স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। অন্য কেউ যখন ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের কথা লেখে আর সত্যজিৎ যখন এই বইটির কথা লেখেন, তার তাৎপর্য আলাদা। সেই যুক্তিতেই বুঝতে হবে ১৯৭১ সালে কেন সত্যজিৎ লিখলেন ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের ‘আদ্যিকালের সংস্করণ’-এর কথা। সে এক অন্য কাহিনি। পরের হপ্তায় ওই ‘আদ্যিকালের আবোল তাবোল’ নিয়ে বসা যাবে গল্প করতে।
Powered by Froala Editor