শতবার্ষিক স্মরণে প্রোফেসর এইচ বি বি- পর্ব ১

একটা কথা মানিকলমকারির পাঠকদের শুরুতেই মনে পড়িয়ে দিই। কারণ, মানিকলমকারির পাঠকরা তো, বলাই বাহুল্য, সক্কলেই দুর্দান্ত সুকুমার রায়ের ‘উগ্র’ এবং ‘মৌলবাদী’ ভক্তও। তাই মনে করিয়ে দিই এই ২০২২ এক মহান আর অভিনব বাংলা সাহিত্যসৃষ্টির একশো বছর। অতএব হে বাঙালি, এই সুযোগটি কখনোই আপনারা মিস করবেন না। সক্কলে একত্রে উঠেপড়ে লাগুন সেই সাহিত্যকৃতির একশো বছর উদযাপনে। সময় আসন্ন। আপনারা উদ্যোগী হউন। বাংলা ১৩২৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ আর ভাদ্র মাসে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় সুকুমার রায় লিখেছিলেন ‘হয়বরল’। আজকের পর্ব সেই একশো বছর উদযাপনেরই একটি অংশ ধরে নিন।   

সত্যজিৎ রায়ের গোটা গল্পটাই ছিল পিতা সুকুমার রায়ের উদ্দেশে পুত্র সত্যজিতের এক আশ্চর্য শ্রদ্ধার্ঘ্য। তবে সেই শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে অন্য দুটো শব্দ একটু মনে করে নেওয়া যাক। দুটো শব্দই সাহিত্য সমালোচনার পরিভাষা। একটি হল অ্যালিউশন, যাকে বাংলায় বলা হয় উল্লিখন আর অন্যটি হল পাস্তিশ। পাস্তিশ হল আগে অন্য কোনো লেখকের হাতে তৈরি একটি চরিত্র অবলম্বনে পরে অন্য কোনো লেখক যখন নতুন কোনো কাহিনি লেখেন। মানে আগের লেখার ভাষা নিয়ে ব্যঙ্গ করে লেখা ঠিক নয়, সেটা তো প্যারোডি। এখানে আগের লেখাটির উদ্দেশে পরবর্তী লেখকের মনের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাই প্রকাশ পাবে। তিনি শুধু আগে তৈরি ওই চরিত্রটিকে নিয়ে বা সেই পূর্বতন লেখাটিকে নিয়ে নিজের মতো করে তৈরি করতে চাইবেন। অন্যদিকে অ্যালিউশন বা যাকে বাংলায়  ‘উল্লিখন’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন অধুনাবিস্মৃত সাহিত্যতত্ত্ববিৎ আচার্য শ্যামাপদ চক্রবর্তী। উল্লিখন হল, একটি লেখার মধ্যে পরবর্তী এক লেখক যখন পূর্বতন কোনো লেখার একটি চরণ বা প্রসঙ্গকে সরাসরি বা সামান্য তির্যকভাবে ব্যবহার করেন। এই দুটি সাহিত্যতাত্ত্বিক পরিভাষাকে পাঠকদের একটু মনে পড়িয়ে রাখলাম আজকের আড্ডায় বসার আগে। কারণ, আজ আমদের আড্ডাতে এমনই এক চমৎকার পাস্তিশ আর উল্লিখন দেখব সত্যজিতের কলমকারিতে। মূল পূর্বতন লেখকটি ছিলেন পিতা সুকুমার আর উত্তরকালে তাঁর রচনায় সৃষ্ট চরিত্রটিকে ফিরিয়ে আনছেন পুত্র সত্যজিৎ। শুধু একটি চরিত্রকে ফেরাচ্ছেন না, সেই গল্পের ভেতরে ভেতরে ছড়িয়ে রাখছেন সুকুমার রায়ের নানা লেখার নানা প্রসঙ্গ। তাই বলছিলাম এ এক আশ্চর্য ট্রিবিউট। সেই যে সত্যজিৎ বাবার সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘আমি তাঁকে চিনেছি তাঁর লেখা আর আঁকার মধ্য দিয়ে’। সেই লেখার মধ্য দিয়েই তো তিনি পেয়েছিলেন ‘হযবরল’-র হিজিবিজবিজকে আর ‘আবোল তাবোল’-এর পালোয়ান ষষ্ঠীচরণকে। এই দুই চরিত্রকে এক্কেবারে নতুন এক চেহারাতে হাজির করলেন সত্যজিৎ।

হযবরল-তে হিজিবিজবিজ। শিল্পী সুকুমার রায়।

 ‘হয়বরল’-তে হিজিবিজবিজ হাজির হয়েছিল তার একটানা হাসি আর কয়েকটা অদ্ভুত প্রশ্ন নিয়ে। সেই প্রশ্নগুলো মনে আসাতে নাকি হাসি আর তার থামতেই চাইছিল না। প্রশ্নগুলো কী? সে বলে, ‘কেন হাসছি শুনবে? মনে করো, পৃথিবীটা যদি চ্যাপ্টা হত, আর সব জল গড়িয়ে ডাঙায় এসে পড়ত, আর ডাঙার মাটিঘুলিয়ে প্যাচপ্যাচ কাদা হয়ে যেত আর লোকগুলো সব তার মধ্যে ধপাধপ আছাড় খেয়ে পড়ত, তাহলে--- হোঃ হোঃ হোঃ হো---’ তার ভাবনাগুলো অদ্ভুতুড়েই বটে। সে মনে করে, ‘মনে করো, একজন লোক টিকটিকি পোষে, রোজ তাদের নাইয়ে খাইয়ে শুকোতে দেয়, একদিন তাদের রামছাগল এসে সব টিকটিকি খেয়ে ফেলেছে--- হোঃ হোঃ হোঃ হো’। তাকে দেখতে কেমন? সুকুমারের ভাষায়, হিজিবিজবিজ হল, সে ‘একটা জন্তু--- মানুষ না বাঁদর, প্যাঁচা না ভূত, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না--- খালি হাত পা ছুড়ে হাসছে’। সেই হিজিবিজবিজকে সত্যজিৎ ফিরিয়ে আনলেন এক অদ্ভুত চেহারাতে। লক্ষণীয় পুত্রের কলমে হিজিবিজবিজের প্রত্যাবর্তনের বছরটিও ‘হয়বরল’ লেখার ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে। ‘আনন্দমেলা’-র ১৯৭১ সালের পুজোসংখ্যাতে সত্যজিৎ লিখেছিলেন ‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ’। সেখানে বেরিয়েছিল তাঁর আঁকা রঙিন ছবি। সেই ছবি তো আর পরে দেখতে পাই না আমরা। কারণ, সেই গল্পটি পরে যখন ‘আরো এক ডজন’ গল্পের বইতে আসে, তখন তাতে সত্যজিৎ আঁকেন নতুন সাদা-কালো ছবি, ছাপার সুবিধার্থে। তারপরে ‘গল্প ১০১’-এ যখন লেখাটি আবার আসে, সেখানে ‘আনন্দমেলা’-র ছবিগুলি ফিরে এলেও তাও হয়ে যায় সাদা-কালো।

আরও পড়ুন
পিতামহ তর্পণ-২

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ গল্পের অলংকরণ। শিল্পী সত্যজিৎ রায়।

 ‘হযবরল’-র সেই হিজিবিজবিজ গল্পের হিজিবিজবিজ হল যখন, তখন বদলে গেল তার খোলনলচে। সমস্ত মজাদার প্রসঙ্গগুলোকে হুবহু এক রেখেও যে একটি অমন হাসিখুশি চরিত্রকে হঠাৎ এমন ভয়ংকর করে তোলা যায়--- এই গল্প তারও এক অদ্ভুত নমুনা বটে। গল্পের পটভূমি গোপালপুরের সমুদ্রসৈকত। মূল গল্পে হিজিবিজবিজকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তার নাম কী? তাতে কে না জানে, সে শুনিয়েছিল, তার নাম হিজিবিজবিজ, তার ভায়ের নাম হিজিবিজবিজ, তারা বাবার নাম পিসের নাম, সবটাই হিজিবিজবিজ। এই কাহিনিতেও শুরুতেই আসে গোপালপুরের সেই অদ্ভুত মানুষটির নামের প্রসঙ্গ। সে জানায়, ‘নাম দিয়ে কী হবে মশাই। নাম একটা ছিল এককালে। সেটার আর প্রয়োজন নেই বলে বাদ দিয়েছি।’ নামের প্রয়োজন নেই কেন? সে বলে, সে এখন একা থাকে, তার সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসে না, সেও কারো সঙ্গে দেখা করে না, তার সঙ্গে যে কাজের লোকটি থাকে, সেও বোবা--- তাই তারও দরকার হয় না বাবুর নাম বলার জন্য। তাই নামটাই সে বাদ দিয়েছে তার জীবন থেকে। একজনের ছিল সব্বার এক নাম, আরেকজন বাদই দিয়েছে নামটা!

আরও পড়ুন
পিতামহ-তর্পণ: ১

আরও পড়ুন
রামকুমার আর নিকুঞ্জ সাহা

খিচুড়ি-র গিরগিটিয়া

 

আরও পড়ুন
‘সবুজ মানুষ’-এর অদ্ভুত কাহিনি

সমুদ্রসৈকতে এই ভদ্রলোকের বাড়িটা কেমন? আর তাকে দেখতেই বা কেমন? তার বাড়ির চেহারা হল, ‘তেরপলের তাপ্পি মারা’ সেই বাড়ি। বাড়িটা কাছ থেকে দেখলে দেখা যাবে, ‘শুধু তেরপল নয়, বাঁশ, কাঠের তক্তা, মরচে ধরা করুগেটেড টিন এমনকি পেস্ট বোর্ডের টুকরো পর্যন্ত বাড়ি মেরামতির কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।’ বাড়িটার বর্ণনা শুনলেই মনে পড়বে ‘আবোল তাবোল’-এ ‘বুড়ির বাড়ি’-র নির্মাণ প্রকৌশল। সেই লোকটির কানের কাছটি দেখলে চমকে উঠতে হয়, কারণ, সেখানে তার কানটি ঠিক মানুষের মতো নয়, সেটা অনেকটা শেয়াল কুকুরের মতো, কানের উপর দিকটা গোল না হয়ে ছুঁচোলো। সেই ভদ্দরলোক নিজের মাথার পরচুলোটা সরাতেই দেখা গেল, একেবারে অবিকল তাঁর চেহারা সেই হিজিবিজবিজের মতো! তাঁর ঘরে সেই হিজিবিজবিজের ছবিও আছে, তাই সে তার সঙ্গে যে দেখা করতে আসে, তাকে বলে, ইচ্ছে হলে মিলিয়ে নিতে পারেন। এইবারে সেই প্রোফেসর হিজিবিজবিজ আলাপ করিয়ে দেয় তার সেই ভৃত্যের সঙ্গে। ভৃত্যটিকে দেখতে কেমন? গল্পকারের ভাষায়, ‘ষণ্ডামার্কা’ চেহারা তার, ‘লোকটার গায়ে ডোরাকাটা ফতুয়া আর খাটো করে পরা ধুতি। পায়ের গুলি, হাতের মাসল, কবজির বেড়, বুকের ছাতি, দর্দানের বহর দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। অথচ লম্বায় লোকটা পাঁচ ফুট দু-তিন ইঞ্চির এবশি নয়।’ তাকে দেখিয়ে হিজিবিজবিজ জিজ্ঞাসা করে, ‘কারুর কথা মনে পড়ছে কি আমার চাকরকে দেখে?’ এ হল সেই ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের ষষ্ঠীচরণ পালোয়ান। তাহলে, একে একে সব মিলে যাচ্ছে।

আরো মিল বাকি! হিজিবিজবিজ জানায়, তার ওই অদ্ভুত কানের কথা। সেটা আসলে, ‘একটা বনবেড়ালের কান আর আমার ওরিজিন্যাল কান মিশিয়ে তৈরি’। এই আশ্চর্য বিজ্ঞানচেতনা তার ভেতরে এসেছে কোত্থেকে? হিজিবিজবিজ বলে, ডাক্তারি আর বিজ্ঞানের বই ছাড়া সে জীবনে আর মাত্র দুটো বই পড়েছে, একটার নাম ‘আবোল তাবোল’ আরেকটার নাম ‘হযবরল’। সে ক্রমশ বুঝেছে, আর সকলে যেটা আজগুবি বলে ভাবে, তার কোনো কিছুই আসলে আজগুবি নয়। জানায়, ‘আমি ছেলেবেলায় মোমবাতি চুষে খেতাম জানেন। দিব্যি লাগত খেতে। আর মাছি যে কত খেয়েছি তার কোনো গোনাগুনতি নেই।’ সেই বই পড়েই এই লোকটির মনে হয়েছিল, ‘শুধু ছবি দেখে মন ভরত না। খালি ভাবতাম এমন জানোয়ার যদি সত্যি করে থাকত। কোথাও যে আছেই ওইসব প্রাণী, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু আমি চাইছিলাম আমার ঘরের মধ্যে আমার চোখের সামনে--- বুঝেছেন?’ ‘আবোল তাবোল’ আর ‘হযবরল’-র জগৎটা ক্রমশ ভয়ের একটা আবহ তৈরি করে তুলছে। সময়ের অন্তরে বলার ধরন বদলে দিয়েছেন বলেই গল্পের সংরূপ বদলে গিয়েছে। পিতার কলমে যা ছিল খেয়াল খুশির কাব্য, পুত্রের কলমে তা হয়ে উঠছে হাড় হিম করা একটা ভয়ের গল্প। কারণ, সেই ডাক্তার বলে, সে একসময়ে নাকি নিজে হাতে বানিয়েছিল ‘গিরগিটিয়া’। টিয়াপাখির মুড়ো আর গিরগিটির লেজের দিকটা জুড়ে দিয়েছিল। তারা জোড়াও লেগে গিয়েছিল। শুধু সেটা বাঁচল না যে, তার কারণটাও তো ওই বইতেই লেখা ছিল। কবিতায় ছিল, ‘পোকা ছেড়ে শেষে কি গো খাবে কাঁচালঙ্কা’। ঠিক সেটাই হল, ‘খেতেই চায় না কিছু। না খেলে বাঁচবে কী করে?’ হিজিবিজবিজ সেখান থেকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছে যে, ‘শরীরে শরীর মিলে গেলেও মনের সন্ধিটা হতে চায় না। তাই এখন ধড়ে-মুড়ো সন্ধিটা ছেড়ে অন্য এক্সপেরিমেন্ট ধরেছি।’ সেই অন্য পরীক্ষার জন্য সে জোগাড় করেছে নানা জন্তু-জানোয়ারের নানা ধরনের শরীরের অংশ। মনে পড়ছে ‘আবোল তাবোল’? প্রথমে ‘খিচুড়ি’-তে ধড়ে-মুড়ো সন্ধি থাকলেও, পরে দেখি ‘কিম্ভুত’ কবিতা। সেখান থেকে নানা ধরনের জন্তুর শরীরের নানা অংশ জুড়ে তৈরি হয় একটা প্রাণীর চেহারা। ‘আবোল তাবোল’-এর সেই শারীরবিজ্ঞান মেনে তাই, এরপরেই প্রোফেসর হিজিবিজবিজ বলবে, তার কাছে সব কিছু জোগাড় করা আছে। শজারুর কাঁটা, রামছাগলের সিং, সিংহের পিছনের দুটো পা, ভাল্লুকের লোম--- সব। ছড়াতে যা ছিল হাসির আর মজার উপকরণ, গল্পের দুনিয়াতে তার হাওয়াবদল ঘটছে। সেই হাওয়াবদলের কাহিনি নিয়েই বসা যাবে আগামী সপ্তাহে।   

Powered by Froala Editor

Latest News See More