মানিকলমকারি – ৮
আগের পর্বে
‘পথের পাঁচালী’ ছবি করার সময় এক গুচ্ছ বই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন সত্যজিৎ। তার অধিকাংশই ছিল ম্যাজিকের বই। ছোটোবেলা থেকেই সত্যজিতের ম্যাজিকের প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। বালক বয়সে এক বিয়েবাড়িতে ম্যাজিকের খেলা দেখেই সেই টানের সৃষ্টি। নাম না জানা সেই জাদুকরের থেকে শিখেছিলেন কিছু কৌশলও। পরে ইতালিয়ান ম্যাজিশিয়ান শেফোলোর জাদুও দেখেছেন। এইসব জাদুকরেরা প্রতিফলিত হয়েছেন তাঁর ‘ধাপ্পা’, 'তারিণীখুড়ো' প্রভৃতি বহু গল্পে।
দুটি গল্প। একটার নাম ‘নতুন বন্ধু’ আরেকটার নাম ‘সহযাত্রী’। সত্যজিৎ রায়ের গল্পসমগ্রে পাওয়া যাবে দুটো গল্পই। কিন্তু সেই গল্প সংসকলনে ‘সহযাত্রী’ গল্পটির সঙ্গে সম্পাদক সন্দীপ রায়ের একটি নোটস উল্লেখনীয়। সেখানে তিনি লিখলেন: ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ‘নতুন বন্ধু’ নামে বাবার একটি গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে। আর তার ঠিক দেড় বছর পরের এক খসড়া খাতা থেকে বেরোল ‘সহযাত্রী’। একই চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে এই দ্বিতীয় গল্পটি লেখার কারণ যে কী হতে পারে, তা আজ অনুমান করা কঠিন। হয়তো লেখার সময় প্রথমটির কথা ভুলে গিয়েছিলেন এবং ‘ফেয়ার’ করতে গিয়ে হঠাৎই মনে পড়ে যায়। সেইজন্যই বোধহয় ‘সহযাত্রী’ অপ্রকাশিত থেকে গেছে।
তথ্যটি বেশ কৌতূহলপ্রদ। এক তো সত্যজিৎ একই গল্প দুবার লিখলেন বলে, তার ওপর তাঁর এই আশ্চর্য ‘সততা’-ও তো মুগ্ধ করে আমাদের। চারপাশে, বহুদিন ধরে চলে আসা এমন কত কাহিনি তো আমাদের জানা, যেখানে লেখকরা একই গল্প ঈষৎ বদলে বিভিন্ন পত্রিকায় দিয়েছেন, এমনও জানা আছে, বহু খ্যাতনামা লেখক দীর্ঘদিনের ব্যবধানে নিজেরই পুরোনো গল্পকে একটু আধটু সাজপোশাক বদলে আরেকভাবে, বাজারি ভাষায়, অন্যত্র ‘চালিয়ে’ দিয়েছেন। এমন উদাহরণও বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে বা হয়ত বড়োদের সাহিত্যেও দুর্লভ নয়, গল্পের নামটুকু বদলে, একই গল্পকে একজন লেখক নিজের বিভিন্ন গল্পসংকলনে জুতে দিয়েছেন। বহুদিন পরে, সেই লেখকের গল্পসংকলন করতে বসে, সম্পাদকের চিন্তার পরত বেড়েছে এইসব ঘটনায়। সে অন্য কথা। তা আমাদের মূলকথা নয়। সে যে-লেখক করেন, তিনি করেন, আমাদের বড়ো ভালো লাগল এটা জেনে যে, আমাদের প্রিয় কথাকার সেই কাজটি করেননি। হতে পারে, সত্যিই তাঁর নিজের মনে পড়েছিল কিংবা হয়ত এই মনে-পড়ার কাজটি সেরে দিয়েছিলেন বিজয়া রায়। যা-ই হোক না কেন, ঘটনাটি বেশ সুন্দর আর সব মিলিয়ে এ অবশ্যই এক ধরনের লেখকের ‘সততা’ তো বটেই। কিন্তু আমরা সেদিক থেকে নয়, ওই দুটি গল্পকে পড়তে চাইছি একটু অন্যদিক থেকে। একই প্লট থেকে কীভাবে দুই বিভিন্ন সময়ে দু-রকম গল্প লিখলেন সত্যজিৎ - সেটাই খোঁজার।
বন্ধু, বিশেষ করে, পুরোনো দিনের বন্ধু, তো সত্যজিতের গল্পের একটা পুনরাবৃত্ত ব্যাপার। সেটা নিয়ে আমরা একটা-দুটো পর্বের মানিকলমকারি ফাঁদব নিশ্চয়ই। মজা হল, এই দুই গল্পেও মূল সেই মোটিফটি রয়েছে। বহুদিন পরে দুই বন্ধুর দেখা হওয়া। একজনের অন্যজনকে চিনতে পারা এবং অন্যজনের আরেকজনকে চিনতে না-পারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের পুরোনো সম্পর্কে ফিরে যাওয়া। এই মূল মোটিফে সত্যজিতের সবচেয়ে বিখ্যাত আর অসামান্য গল্প তে নিঃসন্দেহে ‘ক্লাস ফ্রেন্ড’। ১৯৭৯ সালে লেখা সেই গল্পে ক্লাস ফ্রেন্ড শব্দটাই বেশ মজাদার - একদিন যে দুই বন্ধু একই ক্লাসে পড়ত বলে ক্লাস ফ্রেন্ড ছিল, বহুদিনের প্রান্তে পৌঁছে দুজনের শ্রেণিগত অবস্থানে আলাদা হয়ে অন্য অর্থে ‘ক্লাস’-ফ্রেন্ড হয়ে পড়েছে। আজ সমাজের উচ্চকোটিতে প্রতিষ্ঠিত মোহিত সরকার আর সমাজের অন্য শ্রেণিতে রয়ে গিয়েছে তার একদা ক্লাস ফ্রেন্ড জয়দেব বোস। নানা জীবনসংগ্রামে বিধ্বস্ত জয়দেবকে দেখে এতটুকু চিনতে পারে না মোহিত, কিন্তু পরে যেদিন সেই জয়দেবের ছেলে তার কাছে আসে, সেদিন ‘জয়কে দেখে না চিনলেও তার ছেলে সঞ্জয়ের মধ্যে তাঁর ত্রিশ বছর আগের ক্লাস ফ্রেন্ডটিকে ফিরে পেয়েছেন।’ এ এক বহুল পঠিত অসামান্য ছোটগল্প সত্যজিতের।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের গল্পে 'জাদু'
এই পুরোনো বন্ধুকে ফিরে পাওয়ার গল্পই একেবারে অন্য মেজাজে ফিরে এল আলোচ্য গল্প দুটিতে। ‘ক্লাস ফ্রেন্ড’-এ উত্তর প্রজন্মের মুখের ভেতর ফিরে পাওয়া গেল আগের প্রজন্মের মুখ--- এখানে কিন্তু তা নয়। সময়ের ব্যবধানে দুই বন্ধুরই মুখ গিয়েছে বদলে আর এখানে আদৌ ক্লাস বা শ্রেণিগত ব্যবধান কোনো বাধা তৈরি হয়নি। বরং দুই বন্ধুরই শ্রেণিগত অবস্থান প্রায় সমান, তাদের রুচিগত অবস্থানও প্রায় সমান। তবে এখানে ব্যবধান ছিল ছোটবেলার ঘটনাতে আর সেই ছোটবেলার ব্যবধানটাই যেন ঘুচে যায় বহুদিনের ব্যবধানে এই দেখা হওয়ার ঘটনাতে।
দুটি গল্পেই দুই বন্ধুর সামাজিক অবস্থান কাছাকাছি। যেমন ‘নতুন বন্ধু’ গল্পের দুই বন্ধুর একজন বেশ নামজাদা লেখক অমিয়নাথ সরকার। অন্যজন ইলেকট্রিক সাপ্লাই আপিসে কাজ করেন, জয়ন্ত বোস। দুজনেরই বাড়ি ছিল একদা পূর্ববঙ্গে, তবে দুজনেই কলকাতায় মানুষ। অমিয়র বাড়ি ছিল ফরিদপুর, এখন থাকে জনক রোডে, মানে বালিগঞ্জ এলাকা। আর জয়ন্তর বাড়ি ছিল নোয়াখালি, এখন থাকে নিউ আলিপুর। মোটের উপরে সম্পন্ন এলাকাতেই বাসা তাদের। আবার অন্য গল্পটিতে, মানে ‘সহযাত্রী’-তে দুই বাসিন্দার বাড়ি আরো অভিজাত এলাকাতে। এই গল্পের ত্রিদিব ব্যানার্জি পেশাগতভাবে ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির বড়োকর্তা আর তাঁর বাড়ি লি রোডে আর সেই গল্পে ট্রেনে তাঁর সহযাত্রী সঞ্জয় লাহিড়ি বড়ো বিজ্ঞাপন কোম্পানির কর্তা, বাড়ি মিডলটন রো-তে। মানে দুজনেই মধ্য কলকাতার অভিজাত এলাকার বাসিন্দা। অমিয়- জয়ন্তর মধ্যে মিলমিশের জায়গাটা ফুটবল আর মোহনবাগান আর ত্রিদিব- সঞ্জয়ের কমন আগ্রহের বিষয় ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরে হাজিরা। উভয়েই পুরোনো কলকাতার গল্প করতে ভালোবাসে, তাদের কথাতে ফিরে ফিরে আসে পুরোনো কলকাতার বিলিতি সিনেমা পাড়ার পরিবেশ এখন আর নেই, কলকাতার ট্র্যাফিক জ্যাম, লোডশেডিং ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হল স্কুলের নাম নিয়ে। গল্পটা যাঁদের পড়া তাঁরা জানেন, এই দুই বন্ধুই একই স্কুলে পড়ত এক সময়ে। শুধু একটি গল্পের অমিয় আর অন্য গল্পের ত্রিদিব ছিল ভালোমানুষ ছাত্র আর অমিয়র বন্ধু জয়ন্ত আর ত্রিদিবের বন্ধু সঞ্জয় ছিল ইশকুল জীবনের দুষ্টু ছেলে। ছেলেবেলাতে ভালোমানুষ বন্ধুকে উত্যক্ত করেই এই দুই বন্ধু মজা পেয়েছে, অথচ এতদিন পরে সেই ভালোমানুষ বন্ধুর সঙ্গে ভাব জমিয়েছে সেকালের ওই দুষ্টু বন্ধুই। এই ভাব জমানোর মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে ছেলেবেলার করা যাবতীয় দুষ্টুমির জন্য ক্ষমা চেয়ে-নেওয়া। তবে সেখানেও দুই গল্পে এই দুজনের চিনতে পারার গল্পটাতে স্বাতন্ত্র্য কিন্তু রয়েছে। সে কথায় আসছি।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস-৩
মজার ব্যাপার হল, ভালোমানুষ বন্ধুটি দুই গল্পে দুই ভাবে তার পুরোনো বন্ধুকে গ্রহণ করে নেয়। ঠিক। গ্রহণ করেই নেয় আর ওই দুই পুরোনো বন্ধুর পুনর্মিলনেই গল্প দুটি সুন্দর।
লক্ষণীয়, দুই ছাত্রদের পড়াশোনার জায়গা। অদ্ভুতভাবে ‘সহযাত্রী’ গল্পে সঞ্জয় আর ত্রিদিব দুজনেই ছিল ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের নাইনটিন সিক্সটির ব্যাচ আর ‘নতুন বন্ধু’ গল্পের অমিয় আর জয়ন্তও ছিল সেই ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের মোটামুটি ওই সিক্সটিরই ব্যাচ। খুব আশ্চর্য না! এতদিনের ব্যবধানে, দুটো গল্পে বেশ কিছু অদলবদল হলেও, কীভাবে যেন স্কুলের নাম আর ব্যাচটা মোটামুটি একই। অথচ, সত্যজিৎ নিজে মিত্র-র ছাত্র নন, তিনি তাঁর ছেলেবেলার স্কুল বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুল দিয়েছিলেন ‘ক্লাস ফ্রেন্ড’ গল্পের মোহিত আর জয়দেবকে।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ২
মজার আরেকটা ব্যপার হল, গল্প বলার ধরনও কিন্তু দুটো গল্পে দুই রকম।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ১
‘নতুন বন্ধু’ গল্পে সেকালের দুষ্টু বন্ধু নিজেই পুরোনো ভালোমানুষ বন্ধুকে চিনতে পেরে নিজের ছেলেবেলার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে নিজের নাম একটু বদলে তার কাছে এসে আলাপ জমায়। নিজের নাম কৌশিক মিত্র হলেও, বন্ধুকে নিজের নাম বলে সঞ্জয়, এমনকি তাকে নিজের স্কুলের নামও একটু আলাদা বলে। মিত্র স্কুলের ছেলে হলেও সে বলে সে নাকি পড়েছে সাউথ সাবার্বান মেইন থেকে--- লক্ষণীয়, এ-ও একই মহল্লার স্কুল। ভবানীপুর এলাকাতে, হরিশ পার্কের এপারে আর ওপারে দুই স্কুল। এখানে গল্পের শেষে কৌশিকই একটি চিঠি লিখে বন্ধুকে জানায় নিজের পরিচয়। বলে, ‘আমার আসল পরিচয়টা জানলে তোর সঙ্গে বন্ধুত্বটা হত না আর সেইসঙ্গে আমার প্রায়শ্চিত্তটাও হত না।’ অন্যদিকে আর ‘সহযাত্রী’ গল্পে ট্রেনের দুই সহযাত্রীর কথোপকথন থেকে সম্পর্কটা এগোয় আর তাদের মধ্যে স্কুলের ব্যাপারে তো কোনো কথাই হয় না প্রথম আলাপে। পরে কলকাতায় ফিরে যখন দ্বিতীয়বার দেখা হল তাদের, সেই সময়, স্কুলের ভালোমানুষ বন্ধুটি, কথা প্রসঙ্গে চিনতে পারে তার পুরোনো বন্ধুকে। তবে, সেই পুরোনো শত্রুতার কথা আর মনে না-রেখেই এই নতুন বন্ধুত্বে এগোয় সে। এই ‘সহযাত্রী’ গল্পে ত্রিদিবই চিনতে পারে শৈশবের দুষ্টু ছেলে ফটিক ওরফে সঞ্জয়কে। কাহিনি শেষে ত্রিদিবই ঠিক করে, ‘কী অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটেছে ফটিকের! এর সঙ্গে কি বন্ধুত্ব করা যায়? বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ত্রিদিববাবু স্থির করলেন যে, সঞ্জয় আজ আর সে সঞ্জয় নেই, একেবারে সভ্যভব্য নতুন মানুষ হয়ে গেছে।’ দুই গল্পেরই শেষ লাইনটা অদ্ভুতভাবে একই ছন্দে বাঁধা। ‘নতুন বন্ধু’ গল্পের শেষ লাইনটা হল, ‘আমরা দুজনেই এখন অন্য মানুষ, স্কুল হল সুদূর অতীতের ব্যাপার। এই নতুন সম্পর্কটাই আসল, পুরোনোটা কিছু নয়।’ আর ‘সহযাত্রী’ গল্পের লাইনটা হল ‘অতীতকে চাপা রাখাই ভালো, আজ যেটা সত্যি, সেটাকেই মানতে হবে।’ সাধারণভাবে স্কুলের নস্টালজিয়াতে বড়োদের গল্প শেষ হয়, এখানে স্কুল কোনো নস্টালজিয়া নয়, বরং আজকের নতুন সম্পর্কের ভিত্তিতেই আগামীর গল্প শুরু হয়--- সেটাই এই দুই গল্পের মজা।
আচ্ছা, তাহলে সত্যিই কি গল্প দুটো একই রকম ছিল? মোটিফটা একই নিঃসন্দেহে--- তবুও দুটো গল্প কি সত্যিই এক গল্প? দুই স্বতন্ত্র পরিবেশে, দুটো আলাদা মেজাজে, দুই আলাদা ধরনের চরিত্র তৈরির মধ্যে দুটো গল্পের গতিও তো অনেকটাই আলাদা। তবু সামান্য একটা মিল ছিল বলে, গল্পকারের সততা বজায় রাখতে সত্যজিতের ‘নতুন বন্ধু’ প্রকাশিত গল্প আর ‘সহযাত্রী’ তাঁর কাছে অন্তত অপ্রকাশিত রাখারই গল্প। ধন্যবাদ গল্প ১০১-এর সম্পাদক, সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়কে। ভাগ্যিশ তিনি পাণ্ডুলিপি থেকে দুটো গল্পই আমাদের জন্য এনে দিলেন। নাহলে আমরা বুঝতাম কী করে, একই গল্পের উপাদান থেকে গল্পকার সত্যজিৎ দুই ভিন্ন সময়ে কীভাবে দুটো ভিন্ন গল্প লেখেন!
আরও পড়ুন
প্রদোষ ‘মিত্র’ নয়, ফেলুদা-র পদবি ‘দত্ত’ ভেবেছিলেন সত্যজিৎ!
Powered by Froala Editor