সত্যজিতের জন্মের বছর ছয়েক আগেই চলে গেলেন তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি। সত্যজিৎ পরে লিখেছিলেন, ‘উপেন্দ্রকিশোর রায় আমার রকম আত্মীয় হলেও তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমার জন্মের ছ বছর আগে ৫২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।’
সত্যজিৎ তাঁর বাবা আর ঠাকুর্দা দুজনকেই পেয়েছেন তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে। বাবাকে নিয়ে সত্যজিতের লেখা আমাদের কাছে যতখানি পরিচিত, ঠাকুর্দাকে নিয়ে নাতির মূল্যায়ন সেভাবে আমরা লক্ষ করি না। অথচ দু-দুটি লেখা আর ‘যখন ছোট ছিলাম’ গ্রন্থমধ্যে সত্যজিৎ কথা বলেছেন ঠাকুর্দাকে নিয়ে আর বলেছেন ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রের ভাষ্যে। সেগুলি একত্র করলে দেখা যাবে, কী গভীর শ্রদ্ধা ও কত গভীরতর এক অবলোকন ছিল তাঁর সেই উজ্জ্বল পূর্বজ সম্পর্কে রায়-পরিবারের উজ্জ্বলতম উত্তরসূরির। শৈশবে তিনি দেখেছেন তাঁদের গড়পার রোডের বাড়িতে ঠাকুর্দার কাজের ঘর। ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ ছিল, ‘ঠাকুরদার কাজের ঘর, যেটা আমি জন্ম থেকেই খালি দেখেছি, সেটাও ছিল এই তিনতলায়। এই ঘরের একটা জিনিস পরে আমার হয়ে গিয়েছিল, সেটা হল একটা কাঠের বাক্স। এই বাক্সে থাকত ঠাকুরদাদার রঙ, তুলি আর তেলরঙের কাজে ব্যবহারের জন্য লিনসীড অয়েলের শিশি।’ বাড়ির তিনতলায় ছিল উপেন্দ্রকিশোরের কাজের ঘর আর দোতলায় থাকতেন তিনি। দোতলায় পশ্চিমের ঘরে থাকতেন বিধুমুখী দেবী--- উপেন্দ্রকিশোরের স্ত্রী, সত্যজিতের ঠাকুমা। ঠাকুমা বিধুমুখীকেও সত্যজিৎ হারিয়েছিলেন শৈশবেই। তিনি বলে গিয়েছিলেন, ‘ঠাকুমা মারা যান আমি গড়পারে থাকতে থাকতেই’। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরের সহধর্মিণী তিনি--- তিনিই প্রথম বুঝি তাঁর পরিবারে সেই খুদে সদস্যের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন মুদ্রণশিল্পের। সত্যজিৎ লিখেছেন, এই ঠাকুমার সঙ্গেই ‘আমার অনেকটা সময় কেটেছে ঝুড়ি থেকে পুরোনো সন্দেশের ছবির ব্লক বাছাই করে ঝেড়ে পুঁছে আলাদা করে রাখতে।’ সেই ঘটনার একশো বছরের দূরত্ব থেকে দেখলে বিধুমুখীর সেই কাজটি বেশ কৌতূহলপ্রদ। নাতিকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে কী করতেন বিধুমুখী? পুরোনো সন্দেশের ছবির ব্লক বাছাই! তার মানে পুরোনো সন্দেশে তো ছাপা হত তাঁর স্বামী উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা সব ছবিই, কে না জানে, সেই সব ছবির ব্লক তৈরি করতেন তিনি নিজে হাতে। তার মানে, স্বামীর মৃত্যুর পর কি বিধবা বিধুমুখী আসলে সেই ব্লকগুলির ভিতরেই খুঁজতেন মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে প্রয়াত সেই গুণী মানুষটির কীর্তিচিহ্নগুলি? লক্ষণীয়, তিনি শিশু নাতিটিকে নিয়ে শুধু পুরোনো ছবির ব্লক বাছাই করতেন না, সেগুলো সযত্নে ‘ঝেড়ে পুঁছে আলাদা করে রাখতেন’।
এই বইয়ের পাঠ লেখার অনেক আগে--- অনেক আগে বলতে প্রায় বছর পঁচিশেক আগেই অবশ্য এই স্মৃতিটির কথা তিনি বলেছিলেন। কারণ, যে-বছর সবে ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পেল, সেই বছরেই, তখনকার স্কুল অফ প্রিন্টিং টেকনোলজি, মানে এখন যেটি রিজিওনাল ইন্সটিটিউট অফ প্রিন্টিং টেকনোলজি নামে পরিচিত, তার মুখপত্রেও সত্যজিৎ তাঁর সেই শৈশব-স্মৃতির কথা লিখেছিলেন। তার সঙ্গে জানিয়েছিলেন ঠাকুরদার ছবি নিয়ে আরো কিছু কথা। সেখানে স্পষ্টত সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, সেই সব ব্লকের ছবিগুলি যে ঠাকুরদারই আঁকা ছিল সে কথাও। বলেছিলেন, ‘ঠাকুরদার আঁকা সেসব ছবি বৈঠকখানার দেওয়ালে টাঙানো থাকত তার প্রতিটি তুলির টান আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। রামায়ণ মহাভারতের প্রধান চরিত্রগুলিকে ঠাকুরদাদা যে-রূপ দিয়েছিলেন, এখনও সেইরূপেই তাদের কল্পনা করতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে।’ উপেন্দ্রকিশোরের ছবির সঙ্গেই প্রথম পরিচিত হলেন সত্যজিৎ, পরিচিত হলেন তাঁর নিজের হাতে তৈরি ব্লকের সঙ্গে। যে-সত্যজিৎ পরে হয়ে উঠবেন বাংলা মুদ্রণশিল্পের অন্যতম প্রধান চিত্রকর ও প্রচ্ছদ অলংকরণশিল্পী, তাঁর জীবনে এই তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ ওই তথ্যটিও যে, ঠাকুরদাদার আঁকা চেহারাতেই শিশু-সত্যজিতের মনে গড়ে উঠেছিল রামায়ণ আর মহাভারতের চরিতাবলির অবয়ব। সত্যজিৎ শৈশবে দেখেছিলেন ঠাকুরদাদার আঁকা ছবি আর পড়েছিলেন শিশুতোষ কাহিনিগুলি। তাঁর লেখা গল্পগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় তখন থেকেই ছিল ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ আর ‘কেনারাম বেচারাম’ গল্প। তখনকার ছোট্টো সত্যজিৎ লক্ষ করেননি, নিজেই বলেছেন, ‘উপেন্দ্রকিশোরের বহুমুখী প্রতিভার বিচার করার ক্ষমতা তখন ছিল না। সেটা সম্ভব হয়েছিল আরও পরিণত বয়সে।’ এইবারে স্পষ্ট করলেন ‘শিশুসাহিত্য রচনায়, কাহিনির ইলাস্ট্রেশনে, সংগীত রচনায় এবং প্রাঞ্জল ভাষায় জটিল বৈজ্ঞানিক তথ্য বর্ণনে ও বিশ্লেষণে তাঁর সমতুল্য এদেশে কমই আছে।’ লক্ষণীয়, উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিভার প্রতিটি প্রান্তকে সেই ১৯৫৫ সালেই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, মুদ্রণশিল্পে তাঁর অবদানের কথা। সেখানেই বলেছিলেন, ‘মুদ্রণশিল্পে তাঁর দান যে কত বিস্ময়কর সেটা হয়তো সকলের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। একাধারে মহৎ শিল্পী ও মহৎ বৈজ্ঞানিক না হলে এ জাতীয় প্রচেষ্টায় ব্রতী হওয়া সম্ভব নয়, সফল হওয়া তো দূরের কথা। উপেন্দ্রকিশোরের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও শিল্পীর মহৎ সমন্বয় ঘটেছিল।’ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আর ঐতিহাসিক এই মন্তব্য। একই সঙ্গে শিল্পীর দক্ষতা আর বৈজ্ঞানিক কারিগরি তাঁর অন্তরস্থ। বিজ্ঞানী হিসেবে উপেন্দ্রকিশোরের সেইসব অসামান্য চিন্তাভাবনার কথা সেই যুগে বিলেতের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল, সেই তথ্যটুকু সত্যজিৎ দিলেন আবার ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রের ভাষ্যে। বহু পরে, উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু শতবর্ষের প্রাক্কালে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে, তাঁর সেই সব লেখাগুলি একত্র করে প্রকাশিত হল। এই যথার্থ কারিগর-শিল্পী ও মুদ্রণতত্ত্ববিদ উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে তো প্রথম পরিচয় করিয়ে দিলেন সত্যজিৎই।
আরও পড়ুন
রামকুমার আর নিকুঞ্জ সাহা
আরও পড়ুন
‘সবুজ মানুষ’-এর অদ্ভুত কাহিনি
আর তার সঙ্গে পরিচিত করলেন একজন শিল্পীর। লক্ষণীয়, তিনি জানতেন, কথাকার শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোরকে উত্তরকাল চিনবেই। হবে তাঁর সাহিত্যের আলোচনা। কিন্তু ওই মুদ্রণতত্ত্ববিদ আর শিল্পী উপেন্দ্রকিশোরকে যেন আরো বেশি দরকার উত্তরকালের। তাই ১৯৬৩ সালে ‘জলসা’ পত্রিকায় উপেন্দ্রকিশোরকে নিয়ে লেখাটিতে সত্যজিৎ উন্মোচিত করলেন ঠাকুরদাদার শিল্পগুণ। উপেন্দ্রকিশোরের ছবির গুণপনা--- তার বিষয় ও আঙ্গিক বিশ্লেষণ হয়ে উঠল তাঁর এই প্রবন্ধের বিষয়। এই বিষয়টি অত্যন্ত দরকারি একটি আলোচনা--- অথচ সেভাবে চোখে পড়ে না আমাদের। দুটি স্বতন্ত্র অনুচ্ছেদে সত্যজিৎ সাজালেন তাঁর ভাবনায় উপেন্দ্রকিশোরের শিল্পীস্বভাব। একটি অনুচ্ছেদে লিখলেন উপেন্দ্রকিশোরের শখে আঁকা তৈলচিত্র নিয়ে। যে ছবিগুলি তিনি মূলত দেখেছেন তাঁদের বাড়িতে বা অন্য কারো সংগ্রহে। আর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে লিখলেন উপেন্দ্রকিশোরের ইলাসট্রেশন নিয়ে। বাংলা বইয়ের ছবি নিয়ে যে লেখাটিকে আমরা সংগতকারণেই অগ্রণী রূপে গণ্য করি, সেই ১৯৭৩-এ কমলকুমার মজুমদারের ‘বঙ্গীয় গ্রন্থ চিত্রণ’ প্রকাশিত হওয়ার, আরো দশ বছর আগেই তাহলে অলংকরণ সম্পর্কে কথা বলেছিলেন সত্যজিৎ। উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা তৈলচিত্রের মুখ্য বিষয় নিসর্গচিত্র। নাতির স্মৃতিতে মনে পড়ে, এঁকেছিলেন গিরিডির শালবন, উশ্রী নদী, দার্জিলিংয়ের পাহাড়, পুরীর সমুদ্র। সত্যজিৎ লিখলেন ‘এর সবগুলোতেই লক্ষ করার বিষয় হল যে প্রকৃতির একটি বিশেষ রূপ ভাব বা mood-ই যেন তাঁকে বার বার মুগ্ধ করেছে--- এবং প্রকাশভঙ্গিও একটা অনুরূপ শান্তভাব লাভ করেছে।’ তিনি বললেন এই ছবিগুলিতে রয়েছে একটা ‘Devout ভাব’। তাকে ব্যাখ্যা করে লিখলেন, ‘শিল্পীর ভাষা যেন, আমি এখানে কিছুই নয়, প্রকৃতিই সব’।
আরও পড়ুন
রতনবাবু আর গল্পের এক অন্য ‘আমি’-২
আরও পড়ুন
রতনবাবু আর গল্পের এক অন্য ‘আমি’
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করার মতো ব্যাপার, এই ভাবটি মনের গভীরে থেকে গেল সত্যজিতের। ছোটোবেলায় দেখা ঠাকুরদার আঁকা ছবির ভাষা কোন অদ্ভুত সৌন্দর্যে ফিরে এল নাতির তৈরি ১৯৮০ সালের একটি ছবিতে। ছবির নাম ‘হীরক রাজার দেশে’। গুপি বাঘা বেরিয়ে পড়েছে পায়ে হেঁটে। লক্ষ্য হীরক রাজ্য। কিন্তু দীর্ঘ দশ বছর ঘরে থাকার পর তারা পায়ে হেঁটে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে চলেছে হীরক রাজ্যের দিকে। এই যাত্রাপথের চিত্র-বর্ণনায় ছবির কাহিনিকার- চিত্রনাট্যকার- গীতিকার আর সুরকার সত্যজিৎ যুক্ত করলেন চারটি দৃশ্য চারটি গান। ‘আহা কী আনন্দ’, ‘আহা সাগরে দ্যাখো চেয়ে’, ‘এ যে দৃশ্য দেখি অন্য’ আর ‘এবারে দ্যাখো গর্বিত বীর’। চারটি দৃশ্যে ফিরে এলো ঠাকুরদার আঁকা চারটি নিসর্গ দৃশ্য। ঠাকুরদার এই চারটি ছবির কথাই তো বলেছিলেন সত্যজিৎ। নদী- সাগর- বন- পর্বত। লক্ষ করে দেখুন, গানের ভাষা আর সুর। সেখানেও মুখ্য হয়ে আছে ওই নিবেদনের ভাবটি। প্রথমে নদীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে গুপি গানে থাকে তাদের ঘর থেকে মুক্ত হওয়ার কথা। গায় ‘আজকে মোদের বড়োই সুখের দিন, আজ ঘরের বাঁধন ছেড়ে মোরা হয়েছি স্বাধীন’। সেখানে কথায় সুরে উচ্ছ্বাস আছে, কিন্তু পরের তিনটি গানে গম্ভীর প্রকৃতির বর্ণনা--- ওই নিবেদন--- ওই নিসর্গ প্রকৃতির কাছে বিনম্র আত্মসমর্পণ। অরণ্যের গানে তাই শুনি, ‘হেথা ঊর্ধ্বে উঁচায়ে মাথা দিল ঘুম যত আদিম মহাদ্রুম’। সাগরের গানে শুনি ‘দ্যাখো আকাশে জলেতে মিশে হল একাকার, কী বাহার কী বাহার’। আর পর্বতের সামনে গাওয়া গানে শুনি ‘এবারে দ্যাখো বীর, চিরতুষার মণ্ডিত শির, অতি ধীর, গুরু গম্ভীর, কত যোগী, কত ঋষি, কত সাধক পূজিত শাশ্বত অধৃত বীর। বিশ্বজনের বিস্ময়, দুর্লঙ্ঘ্য দুর্জয়, হিমালয়’। সেই শৈশবে দেখা ঠাকুরদার আঁকা নিসর্গচিত্র মনের ভেতরে যে ভাবটি গেঁথে দিয়েছিল সেই ভাবটিকেই যেন এক নতুন চিত্রমাধ্যমে ফিরিয়ে আনলেন সত্যজিৎ। মনে হয়, ঠাকুরদার লেখা গুপি গাইন বাঘা বাইন কাহিনি অবলম্বনে নাতি তৈরি করেছিলেন ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবি। সেই সিরিজের দ্বিতীয় ছবির কাহিনি ঠাকুরদার না লেখা হোক, চরিত্র দুটি তো ঠাকুরদার থেকেই পাওয়া। তাই কি সেই দুই চরিত্রের এই ভ্রমণের গানে, ঠাকুরদার আঁকা ছবিকে সকলের চোখের আড়ালে স্মরণ করলেন উপেন্দ্রকিশোরের পৌত্র সত্যজিৎ? এও কি এক পরমাশ্চর্য বিনম্র নিবেদন নয়? উপেন্দ্রকিশোরের অলংকরণ বিষয়ে সত্যজিতের ভাবনালোক নিয়ে আড্ডাতে বসা যাবে না হয় আগামী হপ্তায়।
Powered by Froala Editor