সত্যজিতের এই কাহিনিটির কথা তেমন তো কেহ বলে না। বিজ্ঞাননির্ভর বা বলা ভালো কল্পবিজ্ঞানের গল্পের সীমানাতে ফেলে রাখা আছে তা। কিন্তু কাহিনি-হিসেবে সত্যজিতের কলমে এই গল্পটা বেশ ব্যতিক্রমী। গল্পটার নাম ‘সবুজ মানুষ’। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে কলকাতা আকাশবাণী থেকে রাত আটটার সময় সম্প্রচারিত হয়েছিল এই কাহিনি। তবে এই কাহিনি যতখানি কল্পবিজ্ঞানের গল্প, তার চেয়েও বেশি বোধহয় একটি অদ্ভুতস্বরের মানবিক কাহিনি। তবে এই কাহিনির বিষয়ে কথা বলার আগে এই বিষয়ে অন্য একটা প্রসঙ্গ সেরে নেওয়া দরকার। ‘সবুজ মানুষ’ কি একটা গল্প? নাকি একটা গল্পমালার অংশ? এই ধরনের ‘সবুজ মানুষ’-কে নিয়ে তখনকার চারজন লেখক লিখলেন চারটি গল্প। চারজন গল্পকার হলেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, দিলীপ রায়চৌধুরি আর সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ তাঁর ‘তিন রকম’ বইটিতে প্রথমে আর পরে ‘পিকুর ডায়রি ও অন্যান্য গল্প’-তে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এই গল্পটি। ‘সবুজ মানুষ’ গল্পমালায় প্রথমে ওই তিনজন গল্পকার লেখেন, চতুর্থ গল্পকার ছিলেন সত্যজিৎ। সেইজন্য সত্যজিতের লেখা ‘সবুজ মানুষ’ পড়ার মজা তো আছেই, তবে তাছাড়াও সেইদিকটি বাদ দিয়েও ওই তিনজনের লেখা গল্পের সূত্রে সত্যজিতের লেখা ‘সবুজ মানুষ’ পড়ার একটা অন্য মজা আছে। এই দুই-ফের্তা পড়ার কথা নিয়েই আজকের কিস্তি।
সত্যজিতের কাহিনিটি প্রথমে শুনে নেওয়া যাক। এই গল্পটাও উত্তম পুরুষে লেখা। মানে এখানেও আছেন একজন উত্তম-পুরুষীয় কথক--- যার জবানিতে, যার অভিজ্ঞতা থেকে গল্পটা শুনি আমরা। এই আমি-র নাম অবনীশ--- তিনি একজন বটানিস্ট, উদ্ভিদতত্ত্ববিদ। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন ‘আমি যে জগৎটাকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জানি এবং ভালোবাসি, সেটাকে সবুজ বলা বোধহয় খুব ভুল হবে না। আমার জগৎ হল গাছপালার জগৎ।’ তিনি সবুজ- সজীব গাছেদের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসেন। এহেন সংবেদনশীল গাছ-প্রিয় একজন বিজ্ঞানীর কাছে এলেন তাঁর পূর্বপরিচিত একজন দার্শনিক--- নাম তাঁর প্রফেসর নারায়ণ ভাণ্ডারকার। তিনি অবনীশের সঙ্গে বছর দশেক পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ যখন ছিলেন, তখন এই ভাণ্ডারকার পড়াশোনা করেছিলেন শান্তিনিকেতনে। গভীরভাবে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমৈত্রীর ভাবনা আর তাঁর জীবনদর্শন প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। এই দার্শনিক মানুষটি সুইডেনের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে ফিরে দেখা করতে এলেন পুরোনো বন্ধু অবনীশের সঙ্গে। সেই সুইডেনে নাকি তিনি এমন একজন মানুষের দেখা পেয়েছেন, যাঁর চিন্তাধারা এতটাই গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে ভাণ্ডারকারকে, যার ফলে তার ভাবনার জগৎটা পুরো বদলে গিয়েছে। এইবারে ভাণ্ডারকার ব্যক্ত করে তার ভাবনা। সে এক ভয়ংকর ভাবনা। যে ভাণ্ডারকার আগে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমৈত্রীর ভাবনায় নিষ্ণাত ছিল, সে পুরো বদলে যাওয়া এক মানুষ। তার প্রতি কথায় ঝরে পড়ে হিংসা- প্রতিহিংসা- আর পারস্পরিক অবিশ্বাসের দর্শন। এখন সে মনে করে, ‘মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে সৌহার্দ্যে আমি আর বিশ্বাস করি না।’ সে স্পষ্টত বলে, ‘আমরা মানবিকতা বলে বলে একটা জিনিসে বিশ্বাস করি, যেটার আসলে কোনো ভিত্তিই নেই।’ সারা বিশ্বজোড়া মানুষকে সে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে চাইছে, গায়ের রঙের ভিত্তিতে সকলকে আলাদা করছে, এলাকার ভিত্তিতে সকলকে পৃথক করছে--- এবং সে বিশ্বাস করছে মানুষের মধ্যে কোনো ধরনের সৌহার্দ্যই আসলে সম্ভব নয়। এক ভয়ংকর দর্শনে জারিত হয়েছে ভাণ্ডারকার। সে বিশ্বাস করে, এবারে তার লক্ষ্য হল, তার সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের কাছে এই দর্শনটিকে পৌঁছে দেওয়াই হবে তার প্রধান লক্ষ্য। সে তাদের বুঝিয়ে ছাড়বে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট-ই হল একমাত্র সত্য। মানবিক বলে কিচ্ছু হয় না--- এই মানবিকতা, সাম্য ইত্যাদি সবটাই হল আসলে একটা বিরাট বড়ো ভাঁওতা। ‘বিশ্বমৈত্রীর ধোঁয়াটে অবাস্তব বুলিতে যারা বিশ্বাস করে, তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে’ এই কথা বলে, সে যাওয়ার সময়ে প্রায় হুমকি দিয়ে বলে যায়, ‘আমরা আছি, আমরা থাকব। আর আমাদের সংখ্যাই দিনে দিনে বাড়ছে এবং বাড়বে। আমরাই হবো পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি।’
ভাণ্ডারকার যাওয়ার সময়, তার বাঁ হাতটা ঘষে গেল একটা ফণিমনসার খোঁচায় আর বিজ্ঞানী অবনীশ লক্ষ করলেন তার ওই ছড়ে যাওয়া অংশে যে রক্তটা বেরিয়ে এসেছে, তার রং হল সবুজ। গল্পের শুরুতে সবুজ পৃথিবী বলতে যে সজীব পৃথিবীর ছবিটা তৈরি হচ্ছিল, সেটা যে মুহূর্তে মানুষের রক্তের রং হয়ে গেল, সেই মুহূর্তে একটা অদ্ভুত ভয় যেন ছড়িয়ে গেল কাহিনির ভেতরে। সেই ভয়টাই আরো জোরালো আর ভীতিপ্রদ হয়ে উঠল পরের দিন। কারণ, পরের দিন দেখা গেল, ওই ভয়ংকর ‘সবুজ মানুষের’ স্পর্শ পেয়েছিল বলেই বুঝি গোটা গ্রিনহাউজ্-এর সমস্ত গাছগুলি নিষ্প্রাণ মৃত--- বর্ণহীন। সমস্ত সবুজ গাছগুলির ‘প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সবুজ রংটিও যেন কে শুষে নিয়েছে। যা রয়েছে, সেটা পাংশুটে--- ভস্মের রং’।
বিশ্বমৈত্রীর ভাবনা বদলে গেছে যে মানুষের, সেই হয়ে গেছে এক সবুজ মানুষ! তাই সবুজ মানুষ--- এক ভয়ংকর মানুষ। সবুজ পৃথিবী যেমন এক প্রাণময় অস্তিত্বের ইঙ্গিত, তেমনই এই সবুজ মানুষের স্পর্শ নিষ্প্রাণ করে দেয় গাছের সবুজকেও! সত্যজিতের কল্পনাতে ‘সবুজ মানুষ’ এমনটাই।
আরও পড়ুন
রতনবাবু আর গল্পের এক অন্য ‘আমি’-২
২
এইবারে একবার ঘুরে আসা যাক, সত্যজিতের আগে যে তিনজন গল্পকার এই ‘সবুজ মানুষ’ সিরিজের গল্পগুলি লিখেছিলেন, তাঁদের কথায়। প্রথম লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে দ্বিতীয় আর তৃতীয় দুই লেখক, যথাক্রমে অদ্রীশ বর্ধন আর দিলীপ রায়চৌধুরি, সকলেই ওই ‘এভিল সোল’ ‘সবুজ মানুষ’-এর সন্ধান করেছেন ভিনগ্রহীদের আক্রমণের কাহিনিতে। তাঁদের লেখাতে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখা দিচ্ছে ‘সবুজ মানুষ’-এর দল। যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন এমন সব সবুজ মানুষের কথা, যাদের সঙ্গে এই গ্রহের মানুষের কোনো এক মুহূর্তে দেখা হলেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় পার্থিব-সদস্যরা। তার ফলে, তারা যে এসেছিল, কীভাবে এসেছিল, তারা কেমন, কোনো কিছু জানারই উপায় নেই আমাদের কোনো জীবিতবান পার্থিব মানুষের কাছে! অদ্রীশ বর্ধনের কাহিনিতেও ছিল এমন সবুজ মানুষের খোঁজ তাদের সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যার, সে বলে যায়, ‘পৃথিবীর ঘোর বিপদ। শত্রু এসেছে সৌরজগতের বাইরে থেকে। তারা মানুষের মতো দেখতে হলেও মানুষ নয়--- তারা আাঁদের সবুজ শত্রু। তাদের প্রধান হাতিয়ার টেলিপ্যাথি।’ মানে তারা মানুষের মনের ভেতর ঢুকে পড়ে, পড়ে ফেলছে মানুষের মন--- সেখান থেকে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারা। এমনটাই একটা ইঙ্গিত দিয়ে শেষ হয় অদ্রীশ বর্ধনের কাহিনি। দিলীপ রায়চৌধুরির গল্পেও ছিল বহিরাগত এই সবুজ শত্রুদের কাহিনি। সত্যজিৎ-এর আগে লেখা তিনটি কাহিনিতেই সবুজ মানুষ কোনো না কোনো একটি বিপদের সংকেত ঘনিয়ে তোলে। সকলেই সৌরজগতের বাইরে থেকে আসা এক-একটি এভিল সোল। তাদের গায়ের রঙে বা হাতের রঙে সবুজের ছোঁয়া। লক্ষণীয়, সত্যজিতের কাহিনিতেই দেখি বাইরে থেকে আসে না কোনো সবুজ মানুষ। এই সবুজ মানুষ আমাদের চারপাশেই আছে। আরো ভয়াবহ হল, যে মানুষ আমাদের মতোই ছিল, সেই ক্রমশ হয়ে যেতে পারে একজন সবুজ মানুষ--- এমন একটা সংকেত গল্পকে আরো বাস্তব করে তোলে। করে তোলে মানবিক। শুধু, বাইরের সবুজ রং নয়, ভেতরের রক্তের রং সবুজ করে এই সবুজ মানুষকে চেনার পথটা আরো জটিল করে দিলেন গল্পকার। সবচেয়ে বড়ো কথা--- কোনো বাইরের বিষয় নয়, মানুষের ভেতরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের বিপদ সংকেত যারা ঘনিয়ে তোলে, তারাই আজকের ‘সবুজ মানুষ’। তারা এতটাই ভয়ংকর এক ‘সবুজ মানুষ’ যে, তাদের সংস্পর্শে এমনকি ধূসর হয়ে যায় পৃথিবীর সবুজ সজীব সবীজ গাছপালাও। তারা শুধু নিজেরা ভয়াবহ নয়, তারা আগ্রাসী। তাদের আগ্রাসনে নিষ্প্রাণ হয়ে যেতে পারে পৃথিবী। ভেবে দেখুন তো, সত্যিই কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলার ছলে হলেও সত্যজিৎ এমন গল্প কি আর কখনো লিখেছেন?
আরও পড়ুন
রতনবাবু আর গল্পের এক অন্য ‘আমি’
Powered by Froala Editor