‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ গল্পের রতনবাবু একা বেড়াতে যেতে ভালোবাসেন। তাঁর সেই একক নির্জন ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় এমন একজনের যিনি কিনা চেহারাতে, স্বভাবে তো তাঁর মতোই। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে রতনবাবুর জন্মের তারিখ, দুজনের সঙ্গে ঘটে চলা ঘটনা-পরম্পরা সেই সবটাই এক। এর নাম রতন, তো অন্যজনের নাম মণিলাল। এ উঠেছে মহামায়া হোটেলে তো, ও উঠেছে কালিকা হোটেলে। আগের কিস্তিতে এই দুই মানুষের একসঙ্গে দেখা হওয়ার গল্পের মুখরাটা সেরে নেওয়া গেছে। দেখা গেছে, দুজনের দেখা হওয়ার মুহূর্তটিকে একটি আশ্চর্য জ্যামিতিতে গড়ে তুলেছেন গল্পকার সত্যজিৎ। দিগন্তবিস্তৃত দুটি সমান্তরাল রেললাইন, তার উপরে তাকে ভেদ করে যায় একটি ওভারব্রিজ। সেখানে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে সেই ওপর থেকে যখন একটি ধাবমান রেলকে দেখছেন রতনলাল তখন তার কাছে হাজির হলেন তার সেই জোড়া-মানুষ মণিলাল। গত কিস্তিতে বলেছিলেম, এই জ্যামিতিটিও গল্পটি গেঁথে তোলার ব্যপারে একটা দরকারি উপকরণ হিসেবে সাজিয়েছেন সত্যজিতের গল্পকার সত্তা। লক্ষণীয়, এই জ্যামিতির মধ্যে রয়েছে ওই রেললাইনের একটি অনুভূমিক তল, আর সেই রেললাইন থেকে এই ওভারব্রিজের একটি উল্লম্ব তল। ওই অনুভূমিক তলে ধাবমান রেলগাড়িটি যখন এই ওভারব্রিজের নীচ দিয়ে যাচ্ছে, তখন ওই দুই তলের ভেতর একটা কাটাকাটি হচ্ছে--- দুটি তল যেন মিশছে একের সঙ্গে অন্য। আর সেই মেলাটা তৈরি করছে কে? না, তা তৈরি করছে একটি মানুষের দৃষ্টি। এই উপরে দাঁড়িয়ে-থাকা রতনবাবুর দৃষ্টিতে মিশে যাচ্ছে পরস্পর নব্বই ডিগ্রিতে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি তল। আর ঠিক যে মুহূর্তে এই দুই তলের কাটাকাটি, সেই মুহূর্তেই তাঁর সঙ্গে আরেকটি এমন মানুষের দেখা হচ্ছে, যারা আসলে চেহারাতে দুই হলেও আসলে তারা এক। এই জ্যামিতি কীভাবে এই গল্পের ভেতর ফিরে আসে, এইবার সেই অঙ্কটি কষে ফেলা যাক।
গল্পটা যাঁদের পড়া, তাঁদের বলা বাহুল্য, আর যাঁদের পড়া নেই, তাঁদের জন্য কাহিনির সূত্র ধরাবার জন্য অনিবার্য স্পয়লার দেওয়াতে মার্জনা চেয়ে নিয়ে বলে নিচ্ছি, এই রতনবাবু গল্পের উনশেষে তাঁর জোড়া-মানুষ মণিলালকে হত্যা করবেন ওই রেললাইনের ওভারব্রিজ থেকে ঠেলে নীচে ফেলে দিয়ে।
সে এক ভয়ংকর মুহূর্ত। ওভারব্রিজটাতে এসে পৌঁছলেন ‘দুই ভদ্রলোক’। রতনবাবু এই ফাঁকে একবার নিজের হাতঘড়ি দেখে নিলেন, ছটা বাজতে বারো মিনিট--- তাঁর প্রথম মনে হল, ‘ট্রেনটা নাকি খুব টাইমে যাতায়াত করে। আর বেশিক্ষণ নেই। রতনবাবু তাঁর জড়ভাবটা ঢাকবার জন্য’ একটা হাই তুলে কথা শুরু করলেন। মণিলাল তাঁকে নিজের পকেট থেকে সুপুরির কৌটো থেকে সুপুরি বের করে খেতে দিলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে নিলেন। এমন সময়ে দূরে দেখা গেল ট্রেনের আলো। দুটো তলের জ্যামিতি মিলতে চলেছে। ট্রেনটি এগিয়ে আসছে। এমন সময়ে আরেকটি জ্যামিতি। এই ওভারব্রিজের এক প্রান্ত থেকে ধেয়ে আসছে একটি সাইকেল। সাইকেলের আরোহী যদি এখানে দাঁড়ায়, তাহলে রতনবাবুর প্ল্যান বানচাল। কিন্তু সেই সাইকেল ‘লোকটা তাঁদের পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে সাইকেল চালিয়ে উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।’ আবার দুজন এই উল্লম্ব তলে ‘একা’! এই সময়ে একটি তলে ‘প্রচণ্ড দাপটে’ ধেয়ে আসছে সেই ট্রেন--- ‘ট্রেনের শব্দে কান পাতা যায় না’। মণিলাল ট্রেনটা দেখার জন্য রেলিংয়ের ধারে এসে দাঁড়ালেন আর তাকে ঠিক সেই মুহূর্তে উপর থেকে ঠেলা দিলেন রতন। গল্পের ভাষায় ‘একটা বিদ্যুতের চমক--- আর সেই সঙ্গে সঙ্গে রতনবাবু তাঁর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দু-হাত দিয়ে মণিলালবাবুর পিঠে মারলেন ধাক্কা। তার ফলে মণিলালবাবুর দেহটা দুহাত উঁচু কাঠের রেলিংয়ের উপর দিয়ে উল্টে সটান চলে গেল নীচে একেবারে রেললাইনের দিকে।’ ট্রেনটা যাওয়ার সময়ে তার প্রচণ্ড গতির আবেশে কাঁপিয়ে দেয় ওভারব্রিজটাকেও। কাহিনিতে তা আগেও উল্লিখিত--- এখানেও সেই কথাটি ফিরে এল। ঠেলে ফেলার পরের মুহূর্তটি সম্পর্কে লেখা হল, ‘ঠিক সেই মুহূর্তেই রতবাবু বুঝতে পারলেন যে, ওভারব্রিজটা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।’ তাঁর প্রাথমিক অনুভূতিটি কী রকম? গল্পকারের ভাষায়, ‘কাঠের ব্রিজটার মতোই তাঁর মধ্যেও একটা কাঁপুনি শুরু হয়েছে’। দুই তলের জ্যামিতি যে মিশে গেছে--- তাই এর উপমান অন্যটিতে চেপে বসেছে জাঁকিয়ে।
আরও পড়ুন
রতনবাবু আর গল্পের এক অন্য ‘আমি’
কিন্তু জ্যামিতির শেষ তো তখনো হয়নি! ওভারব্রিজের উপর থেকে মণিলালকে নীচে ঠেলে ফেলার পরে এইবার প্রথম আবার এলেন রতনবাবু। সেই সন্ধ্যার মুখটিতে এবার আবার সেই মানুষ সেই একই জায়গায়। ওভারব্রিজের উপরে রতনবাবু দেখতে পেলেন রেলিংয়ের কাঠের ফাটলে ‘কী যেন একটা জিনিস চকচক করছে’। সেটা মণিলালের সেই সুপুরির কৌটোটা। দুটি তলকে যুক্ত করার সময়ে একটি তলের একটি চিহ্ন রয়ে গিয়েছে অন্য তলে। রতনলাল এই সুপুরির কৌটোখানা ছুড়ে ফেলে দিলেন নীচে রেললাইনের দিকে। ‘ঠুং করে একটা মৃদু শব্দও পেলেন তিনি। কদ্দিন ওইখানে পড়ে থাকবে ওই সুপুরির কৌটো কে জানে!’ কাহিনিটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের মনে আছে, এরপরেই গল্পের সেই তুঙ্গ-মুহূর্ত। রতনলালকেও যেন কেউ ঠেলে ফেলে দেয় উপর থেকে আর তারপরের লাইন ‘মেল ট্রেনটা সশব্দে ব্রিজ কাঁপিয়ে চলে গেল পশ্চিম দিকে, যেদিকে আকাশে রক্তের রং এখন বেগুনি হয়ে এসেছে।’ এরপরে ছোটোগল্পের বহুকাঙ্ক্ষিত সেই অন্তিম লাইন, ‘রতনাবাবু এখন আর ব্রিজের উপরে নেই, তবে তাঁর চিহ্নস্বরূপ একটি জিনিস এখনো রেলিংয়ের কাঠের একটা ফাটলে আটকে রয়েছে। সেটা সুপুরি আর এলাচ ভরা একটি অ্যালুমিনিয়ামের কৌটো।’ যে-জ্যামিতি তৈরি হয়েছিল, সেই জ্যামিতিকে ভাঙতে চেয়েছিলেন রতনবাবু, কিন্তু দুটি তলকে মেলাবার মতো জ্যামিতিক গঠন আবার ফিরে এলো ওই গল্পের ভেতরেই।
আরও পড়ুন
গল্পের আমি- ৩
এ যেমন একদিক, তেমনই গল্পের আরেকটি দিকও তো আছে। সেটা ভারি নিষ্ঠুর এক একাকী ‘আমি’-র গল্প। মণিলালকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার পরে রতনবাবুর অনুভূতিগুলি কেমন ছিল? একবার তাঁর মনে হয়, ‘আবার তিনি একা এবং অদ্বিতীয়। তাঁর সঙ্গী নেই, সঙ্গীর কোনো প্রয়োজনও নেই। তিনি এতকাল যেমনভাবে কাটিয়েছেন, আবার ঠিক সেইভাবেই কাটাবেন। এর চেয়ে আরাম আর কী হতে পারে।’ নিজে শেষবার রেলব্রিজে যাওয়ার আগে মনে মনে আর কী ভাবেন তিনি? ভাবেন, ‘খোলা প্রান্তরের মাঝখানের পথে আজ তিনি একা। মণিলালবাবুর সঙ্গে আলাপ হবার আগেও তিনি নিশ্চিন্ত মানুষ ছিলেন, কিন্তু আজ তাঁর নিজেকে যেমন হালকা মনে হচ্ছে, তেমন হালকা এর আগে কখনো মনে হয়নি।’ এ এক অদ্ভুত অভূতপূর্ব দর্শন। একা হতে হতে, সকলের থেকে আলাদা হতে হতে, নিজের সঙ্গে নিজের থাকাটাও যদি কারো কাছে একাকিত্বের পরিপন্থী হয়ে ওঠে! কী ভয়ংকর এক একাকিত্ব তা। অন্যের সঙ্গে মিশতে না পারার কারণ যদি রুচির বিরোধ হয়, তার সঙ্গে ভিন্নতাই যদি হয় তার সঙ্গে না-মেশার কারণ, তাহলে তো একদিন নিজের সঙ্গে নিজের থাকাটাও হয়ে যাবে এক 'অপর'-এর সঙ্গে থাকা। নিজের চিরচেনা পরিচিত ‘এক’গুলিও যে হয়ে যাবে ‘অন্য এক আমি’। সেই ‘আমি’-র সঙ্গেও কি থাকতে পারবে আধুনিক জটিল ‘একলা’ মানুষ। গল্পের বাইরের প্লটের গভীর অন্দরে এই জীবনদর্শনের এক কাহিনিই হল ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’। সেখানেই গল্পটি জটিলতর থেকে জটিলতম হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন
গল্পের ‘আমি’-২
কিন্তু দেখুন কাণ্ড! আমরা তো এই ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ গল্পটাকে একটা বিশেষ ধারাবাহিকতায় দেখতে শুরু করেছিলাম। পরপর তথ্য দিয়ে বলেছিলাম, যে-সময়ে সত্যজিতের সমস্ত গল্পের কথক ছিল ‘আমি’--- মানে পরপর লেখা ‘বাদুড় বিভীষিকা’, ‘নীল আতঙ্ক’, ‘ফ্রিৎস’, ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’, ‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ’, ‘বাতিকবাবু’, ‘খগম’ সবকটি গল্প পাঠককে বলছে একজন ‘আমি’ চরিত্র। সেখানে ‘নীল আতঙ্ক’ আর ‘ফ্রিৎস’-এর মাঝখানে লেখা একমাত্র এই ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ গল্পটাই হল সেই গল্প যেটির কথক ‘আমি’ নয়। ‘আমি’ কথক হিসেবে বলছে না এই গল্প। সত্যিই ‘আমি’ হয়ত নেই--- কিন্তু ‘আমি’-ই একমাত্র থাকব আর ‘আমি’-ই তো এই গল্পের মূলসুর। সেদিক থেকে কি আসলে এই গল্পটাও ওই পরম্পরাতে ‘আমি’-র গল্পই নয়?
আরও পড়ুন
গল্পের ‘আমি’-১
একেবারে শেষে, এই গল্প সম্পর্কে একটি টিপ্পনী।
রতনবাবুর গল্প বলার মূল সুর আর মূল-উদ্বেগটিকে গল্পকার সত্যজিৎ বেঁধেছেন, আমাদের মতে, জ্যামিতি দিয়ে। সেটা দেখাবার একটা চেষ্টাও করা গেল গোটা লেখাতে। এটা নিশ্চয়ই কাকতালীয় নয় যে, ‘সন্দেশ’-এর কার্তিক-অগ্রহায়ণ ১৩৭৭ সংখ্যাতে, মানে ১৯৭০-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যাতে বেরিয়েছিল রতনবাবুর গল্প আর তার তার পরের বছরেই ‘দেশ’ পত্রিকার শারদ সংখ্যাতে বেরোবে ফেলুদার গল্প ‘সোনার কেল্লা’। ফেলুদা-ফ্যানদের মনে করানো বাহুল্য, সেই গল্প শুরুই হবে যে-বাক্য দিয়ে, সেটি হল, ‘ফেলুদা হাতের বইটা সশব্দে বন্ধ করে টক টক দুটো তুড়ি মেরে বিরাট হাই তুলে বলল, ‘জিয়োমেট্রি।’’ তারপরে ফেলুদাই তো বলবে, ‘সমস্ত জীবনটাই জিয়োমেট্রি।’ আর নানা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে থাকবে, কেমন ভাবে চারপাশে আসলে ছড়িয়ে আছে জ্যামিতির নানা গড়ন। সব বোঝাতে বোঝাতে ফেলুদা বলবে, ‘ব্যাপারটা এমন তাজ্জব যে ভাবলে কূলকিনারা পাবি না।’ সেই জ্যামিতিই কত অন্যভাবে হানা দিয়েছিল এক বছর আগে লেখা এক কাহিনিতে।
Powered by Froala Editor