গল্পের আমি- ৩

তাহলে দু-ধরনের ‘আমি’-র কথা হল। এক ধরনের ‘আমি’-র গল্পে ‘আমি’ মূলত গৌণ চরিত্র। আরেকদিকে ওই ‘আমি’ চরিত্রটি নিজেই নিজের গল্প বলে। এই নিজেই নিজের গল্প বোলনেওয়ালা ‘আমি’ দুটি গল্পে দুই খুদে--- সদানন্দ আর পিকু। তাদের অনুভূতির কথাও আমরা শুনেছি গত কিস্তিতে। এবারে আরো নানা রকম ‘আমি’-র কথা। এই নানা রকম ‘আমি’ বলতে দশটি চরিত্রের খোঁজ পাওয়া যাবে সত্যজিতের দশটি গল্পে।

‘সেপ্টোপাসের খিদে’ গল্পটাতে যে ‘আমি’, সে একজন লেখক। নাম তার পরিমল। সে গল্পও লেখে আবার শিকার করতেও পারে। তাকে স্কটিশ চার্চ কলেজের বটানির এক প্রাক্তন অধ্যাপক কান্তিবাবু নিজের বারাসতের বাড়িতে ডাকেন এক বিশেষ কারণে। গল্পটা যারা জানেন, তারা তো জানেনই, কান্তিবাবু পরিমলকে ডাকেন তাঁর সংগ্রহের এক অদ্ভুত গাছ সেপ্টোপাসকে দেখার জন্য। মানুষখেকো গাছ সেপ্টোপাস আক্রমণ করে মানুষকে। সেই আক্রমণ থেকে নিজের বন্ধুকে বাঁচাতে গুলি ছুড়তে হয় পরিমলকে। সে-ই প্রত্যক্ষ করে সেপ্টোপাসের মতো এক অভিনব গাছ। এই রকমই আরেক ‘আমি’-কে পাওয়া যাবে ‘অনাথবাবুর ভয়’ গল্পে। গল্পের শুরুর লাইনটাই হল, ‘অনাথবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ ট্রেনের কামরায়।’ এই ‘আমি’-ও লেখক তবে তার পাশাপাশি ওই ‘আমি’ কাজ করে খবরের কাগজে। কাজের চাপে দমবন্ধ হয়ে আসার অবস্থা, তার মধ্যে মাথায় ঘুরছে নতুন গল্পের প্লট। তাই এক ফাঁকে একটু নাম-না-জানা স্থান রঘুনাথপুরে ওই কথক ‘আমি’ রওয়ানা দিল। সেই পথেই তার সঙ্গে আলাপ জনৈক ভূত বিশেষজ্ঞ অনাথবন্ধু মিত্রর। গল্পের ক্লাইম্যাক্সে যে-অনাথবাবু ভূতের খোঁজে রঘুনাথপুরের বাড়িতে হাজির হলেন, তিনিই ভয় পেয়ে মারা গিয়ে, নিজেই ভূত হয়ে দেখা দিলেন গল্প-কথক ‘আমি’-কে। ফলে, এখানে অনাথবাবুর ভয় পাওয়াটা গল্প নয়, গল্প ওই কথক ‘আমি’-র ভয় পাওয়াটা। পরের গল্পতেও আছে ওই কথক ‘আমি’-র ভয় পাওয়ার বিষয়টি। গল্পের নাম      ‘বাদুড় বিভীষিকা’। গল্পের রচনাকাল ১৯৬৩। এই কথক ‘আমি’ গবেষণা করে বাংলার পোড়ামাটির মন্দির নিয়ে। তাই তাকে ঘুরতে হয় সিউড়ি, সুরুল, হেতমপুর, দুবরাজপুর অঞ্চলে। এইভাবেই ঘুরতে গিয়ে সেখানে ওই গল্প-কথক ‘আমি’-র সঙ্গে আলাপ জনৈক বাঙালি খ্রিস্টান জগদীশ পার্সিভাল মুখার্জির। কতকটা তার কথায় আর কতকটা নিজের ভেতরের বাদুড় নিয়ে অস্বস্তি কতখানি এক ভয়ের অনুভূতি তৈরি করে এই কথক ‘আমি’ চরিত্রটির মধ্যে--- সেটাই হল কাহিনি।

নীল আতঙ্ক গল্পের অলংকরণ

 

আরও পড়ুন
গল্পের ‘আমি’-২

এখানে একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষণীয় যে, সত্যজিতের গল্পমালাতে এই ‘বাদুড় বিভীষিকা’-র পর পরই লেখা প্রত্যেকটি কাহিনিই দেখা যাবে ওই উত্তম পুরুষীয় কথকে লেখা--- অর্থাৎ সবকটা গল্পই বলছে একজন ‘আমি’ কথক। ঠিক এর পরের গল্প ‘নীল আতঙ্ক’ বলছে একজন ‘আমি’। তারপরের ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ গল্পটা অবশ্য ‘আমি’ কথক না বললেও, তাকে বাদ দিয়ে তারপরের ‘ফ্রিৎস’, ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’, ‘প্রোফেসর হিজবিজবিজ’,  ‘বাতিকবাবু’, ‘খগম’ সবকটা গল্পই শোনাচ্ছে ওই কথক ‘আমি’। তথ্য হিসেবে উল্লেখনীয়, এই পর্বে লেখা একমাত্র ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ গল্পের কথকই ‘আমি’ নয়।  

আরও পড়ুন
গল্পের ‘আমি’-১

‘ফ্রিৎস’ গল্পের কথক ‘আমি’ পেশায় একজন স্কুল মাস্টার। সে তার স্কুলবেলার বন্ধু জয়ন্তকে নিয়ে গিয়েছে রাজস্থানের বুন্দি শহরে। পাহাড়ের গায়ে বসানো বিখ্যাত বুন্দির কেল্লা আর সেই শহরটা দেখলেই মনে হয় যেন দর্শক চলে এসেছে এক প্রাচীন রাজপুত আমলে। কথক ‘আমি’-র ছেলেবেলার বন্ধুর এক ছেলেবেলার স্মৃতি অলৌকিক ভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে এই শহরে এসে। প্রথমে তার সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা অবিশ্বাস্য আর গল্পের ক্লাইম্যাক্সে কথক ‘আমি’ নিজেই প্রত্যক্ষ করে সেই অভিজ্ঞতার এক টুকরো--- অবিশ্বাসের আর কোনো জায়গাই থাকে না। পরবর্তী গল্প ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’-তেও তাই। এবারের পটভূমি তখনকার ব্যাঙ্গালোর, মানে এখনকার বেঙ্গালুরু। এই ‘আমি’ আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করে কাজ করে ব্যাঙ্কে আর তার নেশা হল পুরোনো বইপত্র কেনা। সেই পুরোনো বই কিনতে গিয়েই সে পেয়েছিল ১৮৫৮ সালে লেখা ব্রাউন সাহেবের ডায়রি। ব্রাউন সাহেবের ডায়রিতে লেখা তার এক প্রিয় বন্ধু সাইমনের কোথাও হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসার ব্যাপারটা কী রকম, সেটা বুঝতে চেয়ে কথক ‘আমি’-র এই ব্যাঙ্গালোরে ব্রাউন সাহেবের বাংলোতে এসে পৌঁছনো। এরপরে তার চোখের সামনেই ঘটে সেই আশ্চর্য ঘটনা। শুধু একশো তেরো বছর আগে মৃত সাইমনের সঙ্গে কথক ‘আমি’-র দেখা হয় না, তার সামনে দেখা দেন স্বয়ং সেই ব্রাউন সাহেবের ভূতও।

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ২

খগম গল্পের অলংকরণ

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ১

 

যেটা বলতে চাইছি এটাই আসলে এই কথক ‘আমি’-কে দিয়ে গল্প বলাবার মজা। সকলের কাছে অন্য চরিত্রের জীবনের কাহিনি বললে, যে-কাহিনি পাঠকের গল্প মনে হতে পারে, সেখানে কথক যদি ‘আমি’ হয়, তাহলে তা বিশ্বাস না-করার কারণ যেন আর থাকতেই পারে না। এইটাই গল্পের কথক ‘আমি’-র একটা ধরন। সেটা ‘প্রোফেসর হিজিবিজবিজ’ গল্পে একেবারে স্পষ্টত বলেই দেন গল্পকার সত্যজিৎ। কারণ সেই গল্প শুরুই হয় এইভাবে, ‘আমার ঘটনাটা কেউ বিশ্বাস করবে বলে বিশ্বাস হয় না। না করুক--- তাতে কিছু এসে যায় না। নিজে চোখে না দেখা অবধি অনেকেই অনেক কিছু বিশ্বাস করে না। যেমন ভূত। আমি অবিশ্যিভূতের কথা লিখতে বসিনি। সত্যি বলতে কি, এটাকে যে কীসের ঘটনা বলা চলে সেটা আমি নিজেই জানি না। কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে, আমার জীবনেই ঘটেছে। তাই আমার কাছে সেটা সত্যি আর তাই সেটার বিষয় লেখা আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক।’--- এটাই হল, এই ‘আমি’-কথককে দিয়ে গল্প-বলানোর পশ্চাৎপট। এই গল্পে সুকুমার রায়ের ‘হয়বরল’ বইয়ের হিজিবিজবিজ আর ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের সেই বিখ্যাত ষষ্ঠীচরণ পালোয়ান এক্কেবারে মুখোমুখি দেখা দেয় কথক ‘আমি’-কে। পটভূমি গোপালপুরের সমুদ্র সৈকত। ঠিকই তো, সেই গল্পের উদ্ভট-দর্শন মানুষটি জ্যান্ত হতে পারে, এটা যেমন অবিশ্বাস্য, তেমনই অবিশ্বাস্য তার কীর্তিকলাপ। এই সকলের কাছে অবিশ্বাস্যকে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার মোক্ষম উপায় হল কথক ‘আমি’-কে দিয়ে তাদের গল্প বলা। এই যুক্তিতেই তার পরের গল্প দার্জিলিংয়ের পটভূমিতে দেখা ‘বাতিকবাবু’-ও আপাত অবিশ্বাস্য হলেও ওই কথক ‘আমি’-র মুখে বলা হয় বলেই তা বিশ্বাস না করতে মন চাইবে না। এই সিরিজের শেষ গল্প ‘খগম’-তেও সেই অলৌকিক পটভূমি একেবারে চরমে ওঠে--- কথক ‘আমি’ নিজেই প্রত্যক্ষ করে তার বন্ধু ধূর্জটিবাবুর রূপান্তর। সে এক ভয়ংকর কাহিনি! সেই ভয়ংকর অবিশ্বাস্য ঘটনাটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে ওই কথক ‘আমি’-র উপস্থিতি। 

ব্রাউন সাহেবের বাড়ি গল্পের অলংকরণ

 

এটাই তার মানে একটা সাধারণ সূত্র--- কথক নিজে যত অবিশ্বাস্য কাহিনিই বলুক না কেন, সে নিজে যখন সেটা প্রত্যক্ষ করেছে, তখন সেটা অবিশ্বাস করা মুশকিল। এই সূত্র মেনেই প্রোফেসর শঙ্কুর ডায়ারি কল্পবিজ্ঞানের গল্প হলেও সত্যি আবার তারিণীখুড়োর অদ্ভুত গল্পগুলিও যতই অদ্ভুত শোনাক, সেগুলিও সত্যি। তাই প্রোফেসর শঙ্কুর গল্প লেখা হয় উত্তম পুরুষে ডায়রির ফরম্যাটে আর তারিণীখুড়ো তাঁর গল্প শোনান ‘আমি’ কথকের জবানিতে তাঁর খুদে শ্রোতাদের কাছে।

এই ‘আমি’-র মুখে অবিশ্বাস্য গল্প শোনানোর বিষয়টিকে সত্যজিৎ একেবারে বদলে দিলেন দুটি কাহিনিতে। এক, ‘নীল আতঙ্ক’ আর দুই, ‘আমি ভূত’। দুটি গল্পেই কথক ‘আমি’ নিজেই অলৌকিক উপাদান হয়ে ওঠে। লক্ষণীয়, দুটো গল্পেরই শুরুর লাইনটা প্রায় একই রকম। ‘নীল আতঙ্ক’ গল্প শুরুই হচ্ছে ‘আমার নাম অনিরুদ্ধ বোস। আমার বয়স উনত্রিশ।’ আর ‘আমি ভূত’-এর সূচনাবাক্য হল, ‘আমি ভূত। আজ থেকে ঠিক সাড়ে তিন বছর আগে আমি জ্যান্ত ছিলাম।’ ‘নীল আতঙ্ক’-র কাহিনিতে বক্তা অনিরুদ্ধ বসু নিজেই এক রাত্রে আস্তে আস্তে বদলে যায় একশো বছর আগেকার এক নীলকর সাহেবের চেহারাতে। মানে, এখানে, কথক ‘আমি’ নিজেই অলৌকিক। আর ‘আমি ভূত’-এ তো নামেই প্রমাণ--- অলৌকিকের দিক থেকে লৌকিক পৃথিবীটাকে দেখার কাহিনি এটা। হয় কথক ‘আমি’ নিজের অভিজ্ঞতার গল্প বলে পাঠকের কাছে তাকে প্রতীতীযোগ্য করে তোলে নয়ত গল্প কথক ‘আমি’ নিজেই হয়ে ওঠে ‘অলৌকিক’।     

অনাথবাবুর ভয় গল্পের অলংকরণ

 

এই কথক ‘আমি’ নিজে হাজির না থাকলেও ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ বস্তুত একটা অদ্ভুত ‘আমি’-সত্তার গল্প। তাই আমরা যে সময়পর্বটির কথা বলছিলাম, যেখানে পরপর সত্যজিৎ ‘আমি’ কথককে দিয়ে তাঁর গল্পগুলি বলছিলেন, সেই পর্বে লেখা হয় এই গল্পটি। এখানে কথক ‘আমি’ নয়, কথক শোনাচ্ছে জনৈক রতনবাবুর গল্প। রতনবাবু এমনিতে একা থাকার লোক--- সেই একা থাকার মানুষটির এই একাকিত্ব আর তার এক একেবারে ‘নিজের মতো’ সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার গল্পই হল ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’। এটা নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ রায়ের জটিলতম গল্পগুলির মধ্যে একটি। তাই এই গল্পটি কেন আসলে এক জটিল ‘আমি’-র গল্প সেই কথা হোক আগামী কিস্তিতে। ‘আমি’-র গল্প কীভাবে এক অন্য ‘আমি’-র গল্পে গড়িয়ে যায়, হবে তখন সেই কথা।  

Powered by Froala Editor