হতেই পারত তোপসে বা প্রফেসর শঙ্কু বা তারিণীখুড়োকে নিয়ে এই লেখা, কিন্তু তারা নয়, অন্য এক ‘আমি’-দের কথা আজকের কিস্তিতে। বেশ বোঝাই যাচ্ছে, কোন সূত্রে তোপসে, শঙ্কু আর তারিণীখুড়ো মিলেছেন এখানে। একদিক থেকে তো তাঁরা তিনজনেই সত্যজিতের সৃষ্ট চরিত্র। কিন্তু অন্য একদিক থেকেও তাদের ভেতরে ভারি অন্তরঙ্গ মিল। এরা তিনজনেই গল্প বলে ‘আমি’ বলে। মানে, ফেলুদার গল্প তোপসে যখন বলছে, সে একজন আমি। সেই গল্প শোনাচ্ছে আমাদের। প্রফেসর শঙ্কুর ক্ষেত্রেও তাই। তিনি যেহেতু নিজের ডায়ারি লিখছেন, ফলে অনিবার্য তাঁর কাহিনিতে ‘আমি’-র উল্লেখ। রইলেন বাকি তারিণীখুড়ো। তিনিও তাঁর খুদে শ্রোতাদের আসরে শোনান তাঁর জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা--- সেও তো তিনি বলেন উত্তমপুরুষেই। ফলে সেখানেও অবশ্যম্ভাবী ‘আমি’ চরিত্রটির উপস্থিতি। এই তিনজনের আমি তিন রকম--- একজন নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া গল্প উপন্যাসের আকারে লিখছে--- সে হল তোপসে। একজন নিজের জীবনের রোজকার ঘটনা অন্য কারো জন্য নয়, নিজের জন্যেই লিখে রাখছেন--- তিনি হলেন শঙ্কু। আর তৃতীয়জন অন্যের জন্য বা নিজের জন্য ‘লিখছেন’ না, তিনি ‘বলছেন’। তিনি হলেন ‘আড্ডাধারী’। এই তিনজনের ক্ষেত্রেই তাই ‘আমি’ একটি দরকারি চরিত্র। এদের ‘আমি’ কেমন--- সে কথা অন্য সময়ে হবে, এখন শুনব সত্যজিতের গল্পমালায় প্রথম থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে হরেক কিসিমের ‘আমি’ চরিত্রের কথা।
‘শেডস অফ গ্রে’ বা ‘বর্ণান্ধ’ গল্পের ‘আমি’ একেবারে প্রথম পর্বের লেখায় এলো। এখানে এই ‘আমি’ এক শিল্পীর শিল্পীবন্ধু। সেখান থেকে তাঁর জীবনের শেষ পর্বে লেখা ‘আমি ভূত’ গল্পের ‘আমি’ যে কে, তা বোঝার জন্যে ওই গল্পের নামটাই যথেষ্ট। এর সঙ্গেই আবার আরেক ধরনের ‘আমি’-কে পাঠক পাবেন ‘পিকুর ডাইরি’ গল্পে। সেখানে এই ‘আমি’ লিখছে গল্প। কিন্তু এই তিন বাদ দিয়েও সত্যজিতের গল্পে ‘আমি’-র শোনানো গল্প নেহাত কম নয়। এই গল্পগুলি বাদ দিলে, গল্পোদ্ধৃত ‘আমি’র ভেতরে একটা কোনো যোগসূত্র রচনা করার কাজটাও সারা যেতেই পারে। একটা মোটের উপরে হিসেব করলে, সত্যজিৎ ওই ‘আমি’-কে দিয়ে ফেলুদা-শঙ্কু ছাড়া অন্য গল্প বলিয়েছেন প্রায় ১৫ খানা। তার ভেতরে গোটা ছয়টিতে এক ধরনের ‘আমি’ আর বাকিগুলিতে ‘অন্য এক ধরনের’ ‘আমির খোঁজ’।
‘দ্য শেডস অফ গ্রে’ কাহিনির ‘আমি’ গল্পের নায়ক নয়। কাহিনির কেন্দ্রে তার শিল্পী বন্ধু। ‘সে শিল্পী আমি তার শিল্পের অনুরাগী।’ কিন্তু সে ধনীর পুত্র, টাকা রোজগারের জন্য তার সেই শিল্পী বন্ধুকে একেবারে চিন্তা করতে হয়নি, অন্যদিকে এই কথক আমি-কে কলেজের পড়ার পরে সামান্য হলেও একটি চাকরি নিতে হয়। এই যে-দুই বন্ধুর একজন আপনমনে ছবি আঁকে, প্রদর্শনীর আয়োজন করে কিন্তু ‘দর্শক একেবারেই না আসায় সেটা খুবই করুণ একটা তামাশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।’ তখনো এই কথক আমি বন্ধুটি তার পাশে ছিল। ক্রমশ দুই বন্ধুর মাঝখানে এলো একটি মেয়ে। শিল্পী বন্ধু প্রেমে পড়ল একজনের--- তার প্রেম বিচ্ছিন্ন করল দুই বন্ধুকে। কথক ‘আমি’ চোখের সামনে দেখতে পেয়েছিল একজন শিল্পীর গড়ে ওঠার পর্ব--- আর তার চোখের আড়ালে ঘটল সেই শিল্পীবন্ধুর সর্বনাশ। দাম্পত্য তার ভয়ংকরভাবে বিষণ্ণ করল তাকে, সে হারিয়ে ফেলল তার স্বাভাবিক বর্ণময় দৃষ্টি। বলা বাহুল্য, তার জীবন থেকে এই সমস্ত রং হারিয়ে যাওয়াটা অর্থবহ। একদিকে তার প্রেমের অন্তঃসারশূন্যতা আর অন্যদিকে তার দৃষ্টির বর্ণান্ধতা--- এক হয়ে যায় বলেই বুঝি কাহিনির মূল নাম ‘দ্য শেডস অফ গ্রে’-তে শেডস্ শব্দটি বহুবচন। বন্ধুটি শেষে বলে, ‘দ্যাখো আমার কাছে জীবনের কী অর্থ? শিল্পের কী অর্থ? যে লোক ধূসর ছাড়া--- হরেক রকমের একঘেয়ে ছাড়া কোনো রংই দেখতে পায় না।’ কাছের বন্ধুর এই পরিণাম প্রতিদিন দেখতে হয়নি তার কাহিনির কথক ওই বন্ধুকে। তার কাছে তাই ওই বন্ধুর পরিণতি প্রত্যক্ষ করার মধ্যেই এক আকস্মিকতা আছে। আর সেই আকস্মিকতা-ই তৈরি করে ছোটোগল্পের অন্তিম চমক। সেদিক থেকেই কথক-হিসেবে ওই ‘আমি’ গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ২
আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ১
ঠিক এই ধরনের কাহিনিতে আবার একজন প্যাসিভ ‘আমি’ চরিত্র ফিরে এলো ‘চিলেকোঠা’ কাহিনিতে। এখানে গল্পের প্রধান দুই চরিত্রের কোনোজনই এই কথক আমি নয়। গল্পের প্রধান দুই চরিত্র ছোটোবেলার দুই বন্ধু আদিত্যনারায়ণ আর শশাঙ্ক। এখানেও সেই ধনী আর দরিদ্রের গল্প আছে। আছে জীবনে অসফল আর সফল হওয়া দুই বন্ধুর কাহিনি। কিন্তু কথক ‘আমি’? সে ওই ধনী এবং জীবনে সফল-হওয়া বন্ধুর নাগরিক বন্ধু। সে চোখের সামনে কেবল প্রত্যক্ষ করে তার বন্ধু আদিত্যর জীবনে তার শৈশবের বন্ধু শশাঙ্কের প্রত্যাবর্তনের কাহিনি। শৈশবের এক বন্ধুর সঙ্গে এই পুনর্মিলনের গল্পের সাক্ষ্য আদিত্যর পরবর্তীকালীন এই কথক ‘আমি’। শৈশবের ঈর্ষাবশত শশাঙ্কর যে-উপহার আদিত্য আত্মসাৎ করেছিল, তা ফিরিয়ে দেওয়ার গল্প এই ‘চিলেকোঠা’। সে তো একটি গল্প--- কিন্তু যে-গল্পটা স্পষ্টত বলা হল না, সেটাই তো ওই কথক ‘আমি’-র কাহিনি। এই কথক ‘আমি’ এখন আদিত্যর ব্যবসাতে ‘অংশিদার এবং বন্ধু’। ফলত ব্যববসার অংশিদার বন্ধুর কাছে নিজের ছেলেবেলায় এক বন্ধুর কাছ থেকে মূল্যবান জিনিস আত্মসাৎ করার কাহিনিটির উন্মোচনও কিন্তু গল্প হিসেবে মন্দ না। সেই দিক থেকেই কি এই কাহিনির ‘আমি’ পুরো কাহিনিটি দেখে মাত্র আর সেই ‘আমি’ মূল ঘটনার পরে পাঠকের কাছে এই গল্পটি বলার মধ্যে কোথাও যেন বুঝিয়ে দেয় নিজের এই ব্যবসায়ী বন্ধুটিকে আরো অধিক ‘বিশ্বাস’ করে সে এখন। এক সময়কার বিশ্বাসভঙ্গ আর এই সময়ের বিশ্বাস-অর্জনের গল্পে সুন্দরতর এই গল্পের প্লট।
আরও পড়ুন
গুগাবাবা-র ত্রয়ী। পর্ব-২
সেই অন্যরকম কথক ‘আমি’ আবার ফিরে এলো ‘অপদার্থ’ কাহিনিতে।
আরও পড়ুন
গুগাবাবা-র ত্রয়ী। পর্ব ১
পাঠক লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই এই ‘আমি’ কথকদের আমরা এখানে প্রতিক্ষেত্রেই বলেছি ‘অন্যরকম’ গল্পের কথক। আসলে আরো দুই ধরনের কথক ‘আমি’ রয়েছে সত্যজিতের গল্পে--- অদ্ভুতভাবে তাদের ভেতরে রয়েছে আরো দুই ধরনের মিল। এক জায়াগায় সেই কথক ‘আমি’-ই হল নায়ক আর অন্য গোত্রে সেই সাদৃশ্যওয়ালা ‘আমি’ কথক মূল কাহিনির সাক্ষী। এই দুই গোত্রের ‘আমি’ কথকের গল্প না হয় তোলা থাক আগামী দুই হপ্তার জন্য।
Powered by Froala Editor