চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ২

কথা হচ্ছিল দুটো লেখা নিয়ে। একটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালের ‘দেশ’ পত্রিকায়, পরেরটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে, সেকালে বহুল প্রচারিত, ‘অমৃত’ পত্রিকায়। সত্যজিৎ কথা বলেছিলেন সিনেমার উৎসব নিয়ে।  প্রথম লেখাতে বলেছিলেন, কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক না-হয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব হওয়া দরকার সমস্ত দেশ জুড়ে। বিশেষত যেখানে-যেখানে ছবি তৈরি হয়, সেখানকার বাস্তবচিত্র ও সত্যিকারের পরিস্থিতি দেখে নেওয়া দরকার সারা বিশ্বের তাবড় তাবড় চলচ্চিত্রশিল্পীদের। ভারতীয় ছবি সম্পর্কে যেটুকু যা বলবেন তাঁরা, তার পিছনে সেই বাস্তব ইতিহাস প্রত্যক্ষ করলে, কীভাবে শিল্পের জন্য একটি দেশ কাজ করে চলেছে, সেটাও জানবেন তাঁরা। প্রয়োগ করেছিলেন এক নতুন শব্দবন্ধ---‘চিত্রকর্মী’। চেয়েছিলেন, সিনেমার উৎসব যেন শুধু পর্দায় শোভমান তারাদের মেলা না হয়, তা যেন হয় যথার্থ চিত্রকর্মীদের ভাবের আদানপ্রদানের জায়গা। বলা বাহুল্য, সেই সদুপদেশ আমরা তাঁর জন্মশতবর্ষের উদযাপন-বর্ষে হওয়া এবং এখনো না-হওয়া কোনো চলচ্চিত্র উৎসবেই আমরা শুনব না! এই কথার সুতো ধরেই পৌঁছে যাওয়া যাক আজকের বিষয়ে।

এই প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখনীয়, তাঁর লেখা আরেকটি প্রবন্ধের কথাও। সেটির নাম হল ১৯৭৪ সালে ‘মহানগর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আমাদের সমস্যা’। ছোট্টো প্রবন্ধ--- কিন্তু জরুরি একটি কথা বলেছিলেন তিনি, আমাদের সিনেমা পরিকাঠামো বিষয়ে। তাঁর এই ভাবনাটি দরকারি, সত্যজিতের নিজস্ব ভাবনার বৃত্ত সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে তোলার জন্যেও। যে সত্যজিৎ এক সময়ে, মানে ১৯৫০ সালে লেখা ‘বাস্তবের পথে চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘শুধুমাত্র উৎকৃষ্ট উপাদানই উৎকৃষ্ট শিল্পসৃষ্টির একমাত্র শর্ত নয়, উৎকৃষ্ট পোর্ট্রেট আঁকায় যেমন যথেষ্ট নয় উৎকৃষ্ট ইজেল।’ এরপরেই দুটি প্রায় বাণী-হওয়ার গুণসম্পন্ন বাক্য বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘উপাদান হচ্ছে উদ্দেশ্য সাধনের সহায়ক।’ আর লিখেছিলেন, ‘যদি রুচি না থাকে, যদি কল্পনা পঙ্গু হয়, তাহলে পৃথিবীর সমস্ত সেরা উপাদান একত্র করেও সিদ্ধি হবে না।’

এইখানে যন্ত্র-নির্ভরতার বাইরে একসময়ে সওয়াল করেও, দুই দশকের ব্যবধানে সত্যজিৎ রায়ই বললেন একটি অন্য বিষয়। বললেন, বিশ্বযুদ্ধোত্তর ‘যুগে চিত্রনির্মাণ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় যন্ত্রাদির ব্যাপক উন্নতিসাধন ও নানান নতুন যন্ত্রের আবিষ্কার। যন্ত্রই যখন সিনেমার জন্মদাতা, তখন যন্ত্রের উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার ভাষায় যে একটা রূপান্তর ঘটবে সে তো স্বাভাবিক।’ আর ঠিক সেখানেই বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের ঘাটতি। ঘাটতি দুই জায়গাতে। এক, সেই যন্ত্রপাতি কাজ করতে গিয়ে না-পাওয়া আর দুই, যা পাওয়া যায়, তাকেও শিল্পসম্মতভাবে ব্যবহার করার কাণ্ডজ্ঞানের অভাব। সত্যজিৎ লিখলেন, ‘আজকের দিনে সিনেমা পরিচালককে যান্ত্রিক কৌশলের অভাবে কল্পনাকে সীমাবদ্ধ রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’ আর তারপরেই লিখলেন, কখনো ‘আধুনিক অনেক বিদেশি ছবি দেখেই মনে হয়েছে যে, যন্ত্রের মোহ পরিচালককে এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে ছবির জন্যে অন্য দিক অগ্রাহ্য করে তিনি যেন তাঁর সমস্ত চিন্তা, শ্রম এবং অর্থ কেবল যন্ত্রের ভেলকিতেই প্রয়োগ করেছেন।’ তারপরে লিখলেন একটি অমোঘ অসামান্য শাশ্বত বাক্য--- ‘প্রকৃত শিল্পীই জানেন কীভাবে মাত্রা রেখে সংযমের সঙ্গে এইসব যন্ত্রের সদব্যবহার করা সম্ভব’।

সিনেমার নির্মাণে যন্ত্রের অগ্রগতির সঙ্গে টালিগঞ্জের পিছিয়ে পড়া নিয়েও কথা বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘আমরা যারা বাংলা দেশে কাজ করি, তারা এইসব আধুনিক আবিষ্কৃত আলো, লেন্স, ফিল্ম ইত্যাদি ব্যবহার করার সামান্যই সুযোগ পাই।’ শেষে আক্ষেপ করে লিখলেন, ‘যন্ত্রপাতির এই দৈন্য দূর না হলে বাংলা ছবির উৎকর্ষ শুধুমাত্র একটি সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকবে এবং এই গণ্ডির বাইরে বিচরণের স্পর্ধা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এই দৈন্য দূর না হলে, অনেক কাহিনি, অনেক ভাব, অনেক রস চলচ্চিত্রে ব্যক্ত হতে পারবে না। বা হলেও এমনভাবে হবে, যার চেয়ে না হওয়াই ভালো।’ আমাদের মনে হয়, চিন্তন ও কল্পনার এই আধুনিক পরিসরের সঙ্গে ওতপ্রোতযুক্ত সত্যজিতের ওই চলচ্চিত্র উৎসব ভাবনাতে আন্তর্জাতিক ‘চিত্রকর্মী’-দের একত্র হওয়ার প্রকল্পটি। কারণ, সেই সংযোগ, সেই দ্বিরালাপ, সেই ভাবনার আদান-প্রদানই একমাত্র এখানকার সংকীর্ণ কাজের পরিসরে বাইরের হাওয়ার একটা ঝলক আনতে পারে। বাইরের রোদ এইভাবেই এসে পড়তে পারে টালিগঞ্জের ঘেরাটোপে।

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ১

বিতর্কিত সেই ও.কে ছবির দৃশ্য

 

আরও পড়ুন
গুগাবাবা-র ত্রয়ী। পর্ব-২

নিবিড়ভাবে তাঁর চিন্তাসূত্রটিকে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, বস্তুত দুই দিক থেকে ভাবছেন তিনি। একদিকে ভাবছেন, বাইরের থেকে আসা মানুষরা জানুন, প্রত্যক্ষ করুন কোন পরিস্থিতিতে আমাদের এখানে কাজ করতে হয় আবার অন্যদিকে আমরাও জেনে নিই কোন কোন উদার সম্ভাবনা ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে বিশ্ব চলচ্চিত্রের উদার উঠানে। বিশ্বের ছবি দেখে যেমন তার একটা হদিশ পাওয়া যাবে, হয়ত সেই নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার কলাকুশলীদের সঙ্গে আলাপ--- জানাবে সেই লক্ষ্যপূরণের নানা উপাদান- উপকরণের খোঁজ। এই যাতায়াতটা তাঁর কাছে দরকারি মনে হয়েছিল। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে একটি নৈমিত্তিক উৎসব হিসেবে দেখতে চাননি তো তিনি বা তাঁর সময়ের কেউই।          

আরও পড়ুন
গুগাবাবা-র ত্রয়ী। পর্ব ১

‘অমৃত’ পত্রিকায় প্রকাশিত অন্য লেখাটির নামই ছিল ‘চলচ্চিত্র উৎসব কোনদিকে চলেছে?’ একটি চিঠি এটি। লেখাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে, ‘এবারের চলচ্চিত্র উৎসব ভন্ডুল হয়ে যাবার কারণ জিজ্ঞেস করেছেন আপনি।’ এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা দরকার এখানেই। রবীন্দ্র-রচনাবলী করার সময়ে যে আন্তরিক ও মেধাবী যত্নে ও প্রযত্নে তার কাজ করা হয় বা হতো, আশ্চর্যভাবে, সেই মনোযোগ কিন্তু আমরা লক্ষ করি না সত্যজিতের রচনা সংগ্রহ প্রস্তুতির কালে। তার বহুবিধ উদাহরণ এই ‘মানিকলমকারি’-র বহু লেখাতেই ইঙ্গিতে আবডালে বলতে চেয়েছি। এখানেও লক্ষণীয়, এই চিঠির ওই ‘আপনি’ কে? কোন প্রসঙ্গে এই লেখাটির অবতারণা, সেই প্রসঙ্গটি তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ--- পরে এই রকমটাই দেখব আমরা। অথচ, এই ধরনের জরুরি কোনো ধরনের টীকা দেওয়ার রেওয়াজই নেই সত্যজিতের ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’-তে। যাই হোক, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ ফলত প্রসঙ্গান্তরে তার বিস্তার প্রয়োজন। ওই প্রবন্ধে উল্লিখিত বিষয়টি ছিল এই রকম--- একটি জার্মান ছবি ‘ও-কে’-তে দেখানো হয়েছিল ‘কয়েকটি মার্কিন সৈনিক ভিয়েতনামের কোনও গ্রামে কতিপয় অসহায় নারীর উপর পাশবিক অত্যাচার করছে। এই দৃশ্য দেখে নাকি আপত্তি তুলেছেন বিচারকমণ্ডলীর মার্কিন সদস্য ও সভাপতি প্রবীণ পরিচালক জর্জ স্টিভেন্স। তিনি বলেছেন, এ হেন ছবি উৎসবের জন্য নির্বাচন করে কর্তৃপক্ষ উৎসবের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করেছেন, কোনও দেশের লোককে হেয় প্রতিপন্ন করে যে ছবি, সে ছবি নাকি চলচ্চিত্র উৎসবে স্থান পেতে পারেন না।’ পরিস্থিতির ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ--- কারণ আমরা জানি, এই মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে সেবার বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সেবার শেষ হওয়ার আগেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছিল। পরিস্থিতি এমনই হয়ে ওঠে যে, বিচারকমণ্ডলী এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উৎসবের প্রধান উদ্যোক্তা পদত্যাগ করেন।

আরও পড়ুন
একই সময় একই নাম গল্প দুটি আর 'তিন রকম' বই

এই উৎসবকেন্দ্রিক বিশৃঙ্খলা ক্রমশ অন্য বিভিন্ন ঘটনাতে বিস্তারিত হচ্ছিল এবং সেই অনুসারে ধীরে ধীরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আঙ্গিকগত পরিবর্তন ঘটছিল--- সত্যজিৎ সচেতন ছিলেন তা নিয়েও। লক্ষ করেছিলেন, ভেনিস বা কান-এর চলচ্চিত্র উৎসব কীভাবে এরপরেই আস্তে আস্তে নবীন চলচ্চিত্রকারদের ঠিকানা হয়ে উঠতে থাকল, কীভাবেই বা পুরস্কারের সঙ্গে উৎসবের সম্পর্কের বিভিন্ন স্তর তৈরি হয়ে উঠল--- তিনি লক্ষ করছিলেন তা-ও। তবে এত কিছু সত্ত্বেও একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল লক্ষ্য যে কী, সেটা সম্পর্কে সত্যজিতের ধারণা নির্দিষ্ট। আর সেটা ছিল, তাঁর ভাষায়, ‘‘আন্তর্জাতিক উৎসবের যেটি সবচেয়ে মূল্যবান কাজ--- অর্থাৎ দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দেওয়া--- সেটা মনে হয়, নানান বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও অটুট থাকবে।’’ এই ছিল তাঁর সিনেমা- উৎসব ভাবনার পরিসর। আরো একটি ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হল, আসন্ন আরো একটি কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসব--- সেই ফাঁকে এই পুরোনো কথা কয়েকটি বলা বোধ হয় দরকার ছিল। আমাদের দিক থেকে আসলে গোয়েন্দা ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কু-র কাহিনিকার--- এই জনপ্রিয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে সত্যজিতের চিন্তালোককে নতুন করে সন্ধান করা দরকার। কে না জানে, তাঁর পিতামহকে জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক তকমায় সীমাবদ্ধ করে তাঁর সাংগীতিক প্রতিভা আর তাঁর বিজ্ঞান ও কারিগরিবুদ্ধিকে আমরা অবহেলা করেছি, ভুলে গিয়েছি যন্ত্রবিদ ইউ রে অ্যান্ড সন্সকে। তাঁর পুত্র সুকুমার রায়কেও কেবল ‘আবোল তাবোল’ আর ‘খাই খাই’-এর কবি চিহ্নিত করে ভুলে গেছি মুদ্রণতত্ত্ববিদ সুকুমার রায়কে আর বিস্মৃত হয়েছি কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞানচর্চায় তাঁর অবদান। চর্চা ধারাবাহিক না হলে, ভয় হয়, সত্যজিৎ-ও কালক্রমে কেবল একজন জনপ্রিয় গোয়েন্দাকাহিনি ও কল্পবিজ্ঞান কাহিনির লেখক হিসেবে না চিহ্নিত নন--- ভবিষ্যতের আত্মবিস্মৃত বাঙালি হিসেবে আমরা ভুলে না যাই এক চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক সত্যজিৎ রায়কে!  

Powered by Froala Editor