সত্যজিতের গল্পে 'জাদু'

মানিকলমকারি – ৭

আগের পর্বে

সত্যজিৎ শুধু সিনেমা বানানো শেখাতে চাননি। সিনেমা পড়তে পারার একটা ক্লাস নিয়েছিলেন তাঁর প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে। দুই বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব বাণিজ্যে চলচ্চিত্রে বদল এসেছিল অনেক। আমরা যে বাস্তবতাকে সিনেমায় দেখি, তা যন্ত্রনির্ভর। কিন্তু ভাল শিল্পসৃষ্টির একমাত্র শর্ত উৎকৃষ্ট উপাদান নয়, বলেছিলেন সত্যজিৎ। একটি ইংরাজি প্রবন্ধে সত্যজিৎ লিখেছিলেন, প্রত্যেক দেশের জাতিসত্তার একটি নিজস্ব বাস্তবতার রূপ থাকে। সিনেমায় সেই বাস্তবতাকেই ধরতে হয়। হলিউডের নিজেকে বদলানোর পিছনে যে এশিয় এবং ইউরোপীয় ছবির ভূমিকা রয়েছে তাও বলেছিলেন সত্যজিৎ। কী সিনেমা আর কেমন সিনেমা। এই দুটি গণ্ডির থেকে বের করে এনে সত্যজিৎ পরিচয় করিয়েছিলেন চলচ্চিত্রচর্চার ডিসিপ্লিনের সঙ্গে। এমনকি শিশুদের জন্যও লিখেছেন ‘সিনেমার কথা’ ধারাবাহিক।

সত্যজিতের গল্পের একটা জাদু আছে, সেটা নতুন কথা নয়। সে জাদু তাঁর গল্পের বিষয়ে আছে, বলার ধরনে আছে, চরিত্র সৃজনের চমৎকারিত্বে আছে, নতুন কথা নয় সে কথাটাও। আসলে বলছিলাম গল্পের বিষয় হিসেবে জাদুবিদ্যার থাকার ব্যাপারটা। তাঁর নিজের অন্যতম পছন্দের বিষয় এই ম্যাজিক আর তিনি ম্যাজিক ব্যাপারটা নিয়ে অন্যতম আগ্রহী বাঙালিও ছিলেন নিঃসন্দেহে। সত্যজিৎ নিজেই বলেছিলেন, 'পথের পাঁচালী' ছবি করার সময়ে নিজের যে সব বই তিনি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার একটা বেশ বড়োসড়ো অংশ ছিল ম্যাজিক বিষয়ক গ্রন্থ সংগ্রহ। জাদুবিদ্যার নানা কৌশল নিয়ে আর বহু জাদুকরের জীবনী নিয়ে তাঁর ছিল চমৎকার এক সংগ্রহ। একটিমাত্র হাত সাফাইয়ের বই রেখে সেই সবই তাঁকে বিক্রি করতে হয়। তিনি বলেছিলেন, "ম্যাজিক নিয়ে আমার আগ্রহ অ্যামেচারের। এটা আমার শখ বা হবি।"

হবি তৈরি হয়েছিল ম্যাজিক দেখেই। 'যখন ছোট ছিলাম'-এ সত্যজিৎ জানিয়েছেন, প্রথমে তখনকার এম্পায়ার থিয়েটারে (পরে যার নাম হয় রক্সি) তিনি দেখেছিলেন ইতালীয় জাদুকর শেফোলোর ম্যাজিক শো। সেও সুন্দর, তবে সেখানে কথার ফুলঝুরি ছিল, আলোর কসরত ছিল। এই ম্যাজিকের চেয়ে বালক বয়সে যাঁর করা ম্যাজিক তাঁকে সত্যিকারের মুগ্ধ করে দিয়েছিল, তাঁর দেখা তিনি পেয়েছিলেন একটা বিয়েবাড়িতে। এলগিন রোড, মানে এখনকার লালা লাজপত রায় সরণিতে সেই বাড়িটি এখনো আছে। এখন যেখানে ফোরাম শপিং মল, তার ঠিক আগেই এই বাড়িটি, দেখে মনে হয়, যেন কোনো জাহাজ। তাই 'জাহাজ বাড়ি' নামেই বিখ্যাত সেই বাড়িটি। এখানে ১৯৩৪-৩৫ সাল নাগাদ এক বিয়েবাড়িতে যে আশ্চর্য জাদুর খেলা দেখলেন, তার বিস্তারিত বিবরণ আছে তাঁর আত্মজীবনীর পাতাতে" এই ভদ্রলোক ম্যাজিক দেখালেন প্যান্ডেলের তলায় ফরাসের উপর বসে, তাঁর চারদিক ঘিরে চার পাঁচ হাতের মধ্যে বসেছেন নিমন্ত্রিতরা। এই অবস্থাতে একটার পর একটা এমন খেলা দেখিয়ে গেলেন ভদ্রলোক, যা ভাবলে আজও তাজ্জব বনে যেতে হয়।" 

কেমন ছিল সে খেলা? "ফরাসের উপর দেশলাইয়ের কাঠি ছড়িয়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক। নিজের সামনে রেখেছেন একটা খালি দেশলাইয়ের বাক্স। তারপর 'তোরা আয় একে একে' বলে ডাক দিতেই কাঠিগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে এসে বাক্সে ঢুকছে। আমাদেরই চেনা এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে চেয়ে নিলেন একটা রুপোর টাকা আর আরেকজনের কাছ থেকে একটা আংটি। প্রথমটাকে রাখলেন হাত চারেক দূরে আর দ্বিতীয়টাকে নিজের সামনে। তারপর আংটিটাকে উদ্দেশ করে বললেন, যা টাকাটাকে নিয়ে আয়। বাধ্য আংটি গড়িয়ে গেল টাকার কাছে, তারপর দুটো একসঙ্গে গড়িয়ে এল ভদ্রলোকের কাছে।"

এই নাম-না-জানা জাদুকর ভদ্রলোকের প্রতি নিজের মুগ্ধতা সম্পর্কে সত্যজিৎ লিখেছিলেন: "আমার ম্যাজিকের ভীষণ শখ, মনে মনে আমি তাঁর শিষ্য হয়ে গেছি।" শুধু মনে মনে শিষ্যত্ব গ্রহণ নয়, ভবানীপুরে একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হতে সরাসরি তাঁর কাছে ম্যাজিক শিখতেও চেয়েছিলেন কিশোর সত্যজিৎ। যদিও শেষমেশ তাঁর কাছে ম্যাজিক শেখা হয়নি, তখনই একটা হাত সাফাইয়ের খেলা শিখিয়ে চলে গেছিলেন তিনি, ছেলেবেলায় কিশোর সত্যজিতের তখন মনে পড়েনি, তাঁর ঠিকানা রাখার কথা। কিন্তু মনে মনে গুরু মেনে-নেওয়া এই নাম না-জানা ম্যাজিশিয়নকেই ওই ঘটনার প্রায় তিন দশক পর অমর করে রাখলেন তাঁর এক অসামান্য গল্পের চরিত্র রূপে ফিরিয়ে এনে। গল্পের নাম 'দুই ম্যাজিশিয়ান', সেই নাম না-জানা জাদুকর গল্পে হলেন ত্রিপুরাচরণ মল্লিক। এই ত্রিপুরাবাবুও ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন এক বিয়েবাড়িতে। সেই গল্পে ম্যাজিক দেখাবার পরিবেশ, খেলার আশ্চর্য সব ধরন সবটাই সত্যজিতের সেই ছোটবেলাতে দেখা ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অদ্ভুত ব্যাপার হল, এখানেও এল সেই শেফাল্লোর ম্যাজিক শো-এর কথা। শুধু ঘটনাটির ক্রম গেল উল্টে। 

আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস-৩

 দুই ম্যাজিশিয়ন গল্পের অলংকরণ 

 

সত্যজিতের জীবনে শেফাল্লোর শো দেখা আগে আর পরে ওই আশ্চর্য জাদুকরকে দেখে তাঁর উপলব্ধি, শেফাল্লোর শোয়ে কারিকুরি জাঁকজমক থাকলেও, সামান্য বা প্রায় কোনো উপকরণ ছাড়াই ওই সামান্য জাদুকর ভদ্রলোকই অসামান্য। আর গল্পের নায়ক, এখনকার বিখ্যাত জাদুকর, সুরপতি প্রথমে ত্রিপুরাবাবুকে দেখেছে, পরে দেখেছে শেফাল্লোর ভরপুর ম্যাজিক শো। সেই সাফল্য, খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা অর্জনের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা সুরপতিকে যান্ত্রিক কলাকৌশলপূর্ণ ম্যাজিকের দুনিয়াতেই নিয়ে গেল তাকে। ভারতীয় প্রকৃত জাদুবিদ্যা সাধনার বিষয়, তা শিখতে বছরের পর বছর সাধনা করতে হয়, তা কেবল কারিকুরি আর যন্ত্র নির্ভর নয়। আর ম্যাজিক বলতে তো শুধু হাত সাফাই নয়, সম্মোহন, ভোজবাজি, মাদারি কা খেল, ভেন্ট্রিলোকুইজম, মনের কথা পড়ে ফেলা একের পর এক সবটাই আছে। আর সেই সব ধরনের জাদুর কথাই কিন্তু নিজের গল্পের ভেতর একটি একটি করে ধরে রেখেছেন সত্যজিৎ। যেমন, ওই গল্পের মধ্যেই আছে, সুরপতির চোখে মাদারি কা খেল দেখার অভিজ্ঞতা। আরো বহুদিন পরে লেখা তারিণীখুড়োর গল্পমালাতে আসবে মন-পড়ে-ফেলার খেলা নিয়ে এক আশ্চর্য প্রতিশোধ নেওয়ার কাহিনি। এমনকি, ফেলুদা সিরিজের সোনার কেল্লা-র হিপনোটিজম আর ফেলুদার শেষ দিকের কাহিনি ইন্দ্রজাল রহস্য-তেও আসবে এক নবীন সফল জাদুকরের সঙ্গে এক প্রবীণ বৃদ্ধ, একদা সফল কিন্তু বর্তমানে অবসর-নেওয়া আরেক জাদুকরের কাহিনি। অবশ্য এখানে এই প্রবীণ জাদুকর তাঁর কর্মক্ষেত্রে সফল আর বরং ওই নবীন জাদুকরেরই বাচনভঙ্গিতে ছিল উচ্চারণগত দুর্বলতা। এই দুর্বলতাই তার সফল না হওয়ার কারণ। জাদুবিদ্যার সঙ্গে ভেতরের প্রতিভা আর বাইরের উপকরণের আয়োজন বাহুল্য সমস্ত জীবনেই যেন সত্যজিতের এই জাদু বিষয়ক কাহিনিমালার একটি ফিরে ফিরে আসা উপাদান। 

আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ২

ম্যাজিশিয়ন সকলকে ধাপ্পা দেয়, কিন্তু ম্যাজিশিয়নকেই ধাপ্পা দেওয়ার গল্প কি তাহলে থাকবে না এই গল্পক্রমে। বেশ নাম করে ফেলার পরে ছোটবেলার বন্ধুকে তেমন পাত্তা না-দেওয়ার ফলে, সামান্য একটু হাত সাফাই জানা বন্ধুও যে বড়ো জাদুকরকে ধাপ্পা দিয়ে তার পুরোনো বন্ধুর কথা মনে করিয়ে দিতে পারে, সত্যজিতের লেখা 'ধাপ্পা' সেই জাদুকরকেই ধাপ্পা দেওয়ার গল্প। 

তারিণীখুড়ো ও ঐন্দ্রজালিক গল্পের অলংকরণ 

 

আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ১

এইসঙ্গে গল্পের পর গল্প জুড়ে থাকল গুরুশিষ্য পরম্পরার কাহিনি। গুরুকে অস্বীকার করার প্রতিস্পর্ধা বুনে দিলেন তিনি একের পর এক কাহিনিতে। ত্রিপুরাচরণ মল্লিক দেখাতেন হাত সাফাইয়ের বিচিত্র সব খেলা, ঠিক তেমনি ভেন্ট্রিলোকুইজমের খেলাতে পারঙ্গম অক্রূর চৌধুরির গল্প শোনা যায় ‘ভুতো’ গল্পটিতে। অক্রূরবাবু গলার কারসাজির খেলা শেখাতে রাজি হননি বলে, নবীন জাদুকর নবীন নিজের কথা-বলা-পুতুলের চেহারাতে অক্রূরবাবুর মুখ বসিয়ে তাকে অপমানিত করতে চায়। অক্রূরবাবু তার সঙ্গে দেখা করে প্রথমে বলেন, আমাকে তোমার হাতের পুতুল বানিয়ে ফেললে। আর গল্পের মধ্যে সেই কথা বলা পুতুলের ভেতরেই নিজের সত্তাকে আরোপ করে এক ভয়াবহ প্রতিশোধের কাহিনি হয়ে ওঠে এটি। লক্ষণীয়, এও তো জাদুর গল্পই এবং সেই গুরুশিষ্য পরম্পরাতে গুরুকে অস্বীকার করে নিজেকে বড়ো করার গল্প। আমাদের অনেকেরই আবার মনে পড়বে আটের দশকের মাঝামাঝি দিল্লি দূরদর্শন থেকে সম্প্রচারিত সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস ধারাবাহিকে এই অক্রূরবাবুর চরিত্রে উৎপল দত্তের অসামান্য অভিনয়ের স্মৃতি। 

যে ম্যাজিক তাঁর এত পছন্দের আর ভালোবাসার একটা বিষয়, যাকে নিয়ে সারা জীবন কত ধরনের কাহিনি লিখলেন, সেই ম্যাজিক সম্পর্কেই সত্যজিৎ রায় একবার একটি সাক্ষাৎকারে আমাদের সকলের প্রিয় শৈলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, তিনি কখনো তাঁর সিনেমার বিষয় হিসেবে আনবেন না জাদু বিদ্যার কোনো ঘটনাই। অদ্ভুত ভাবে ম্যাজিকের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তাঁর মনে হয়েছিল, "সিনেমাতে ম্যাজিকটা মজা করে হয় না। কারণ সিনেমা জিনিসটাই ম্যাজিক।" তিনি খুব সচেতন একটা ব্যাপারে যে, ফিল্মের সম্পাদনা দিয়ে একটা ম্যাজিক করা যায় তার স্বভাবধর্ম স্বতন্ত্র। তাতে ম্যাজিকের মজা জমে না কিছুতেই। গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবি জুড়ে তো সেই সম্পাদনার জাদু। তালি মেরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া, নিমেষে থালা ভর্তি খাবার আসা, বাহারি পোশাক বদল এই সবটাই তো সিনেমার জাদু। সেখানে আসল জাদুর স্থান কোথায়? একমাত্র গুপিবাঘার তিন নম্বর ছবিতে সরাসরি ওই জাদুর খেলা দেখানো আছে। নানা জাদুকর তাঁদের খেলা দেখাচ্ছিলেন আনন্দপুর রাজসভায়। লক্ষণীয়, এখানে জাদুর খেলা দেখানোর সময় কোনো কাট নেই, প্রতিটি টানা দৃশ্য। না হলে, জাদুর মহিমা তৈরি হবে কী করে? সত্যজিতের সেইজন্যই মনে হয়েছিল বুঝি, ম্যাজিক লাইভ শো আর সামনাসামনি উপভোগের বিষয়, সিনেমা তার নিজস্ব ম্যাজিক দিয়ে আসল ম্যাজিকের গরিমা ধারণ করবে কী করে?

Powered by Froala Editor