১৯৬৪ সালে আর ১৯৭০ সালে প্রকাশিত দুটি লেখায় সত্যজিৎ রায় কিছু কথা বলেছিলেন সিনেমা উৎসবের বিষয়ে। তিনি বলেছিলেন, প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায় পরেরটি প্রকাশিত হয়েছিল সেকালে বহুল প্রচারিত ‘অমৃত’ পত্রিকায়। পরে সত্যজিতের লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বিষয় চলচ্চিত্র’-তে সংকলিত হয়েছিল লেখা দুটি। এখন সত্যজিতের ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ বইতেও পাওয়া যায় লেখা দুটি। তার মানে আশা করা যায়, পড়েছেন অনেকেই। কিন্তু, মন দিয়ে কথাগুলি লক্ষ করেননি বোধ করি অনেকেই এবং বলা বাহুল্য, সেই কথাগুলি যারা পড়েছেন, তাঁরাও বিশেষ কেউ মন দিয়ে শোনেনি। সত্যজিতের ছবি নিয়ে কথা বলা হয়, সত্যজিতের লেখাপত্র নিয়েও কথা বলা হয়, কিন্তু সত্যজিতের মননলোক নিয়ে আলোচনা বড়োই কম। তিনি নিজেও অনেক সময়েই সহজ কথার ছলে অনেক কথা বলে চলেন। ফলে, সেভাবে সেই কথাগুলি যে লক্ষণীয়, সেটাই অনেকে লক্ষ করেন না। মুশকিল হল, স্রষ্টা সত্যজিৎ নিয়ে আমাদের কথাবার্তা চলতে থাকে, কিন্তু তাঁর মনন নিয়ে, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ভাবনালোক নিয়ে আমাদের দিক থেকে সাড়াশব্দ বড়ো কম। সত্যজিৎ-মনন-চিন্তনের এমনই একটি উপেক্ষিত দিক নিয়ে কিছু কথা আজকের আড্ডাতে পাড়া যাক।
যে কথা হচ্ছিল, ১৯৬৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর সত্যজিৎ লিখলেন ‘ছায়াছবির মেলা’। সময়টি গুরুত্বপূর্ণ কেন, তা বুঝতে পারবেন প্রবন্ধের প্রথম লাইন থেকেই। তিনি লিখলেন, ‘ভারতবর্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ছায়াছবির মেলা বসতে চলেছে। দেশ বিদেশ থেকে ছবি আসছে। ছবির সঙ্গে যাঁরা সংশ্লিষ্ট--- শিল্পী, সমালোচক বা ব্যবসায়ী, তাঁদেরও অনেককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।’ এই প্রথম লাইনটি থেকেই স্পষ্ট বুঝতে পারা যাবে, সত্যজিৎ ঠিক কোন চোখে দেখতে চাইছিলেন একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে। এক চমৎকার উদার আর বৃহৎ প্রেক্ষাপটে ছিল তাঁর সেই চলচ্চিত্র উৎসব-ভাবনা। লক্ষণীয়, সারা পৃথিবীর সিনেমা আসছে সেটা যেমন বড়ো কথা, তেমনটাই বড়ো কথা তাঁর কাছে ওই ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের একত্র হওয়ার ঘটনাটি। ক্রমশ আমরা ওই দ্বিতীয় পথটি ভুলেই গিয়েছি। এখন ছবির উৎসব মানে ক্রমশ আমাদের দেশে, তা জাতীয়ই হোক বা তার আমাদের বঙ্গীয় সংস্করণই হোক, হয়ে দাঁড়িয়েছে, বেশ কিছু ছবির মেলা--- ছবির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের মহোৎসব নয়। মহোৎসব নয়, নামী এবং দামী--- বহুল পরিচিত, বহুল শ্রুত, বহুল প্রকাশিত খবরের কাগজের মুচমুচে পেজ থ্রি-তে বা বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় ছবির খবরাখবর সম্বলিত ফিল্মি ম্যাগাজিনের কভার স্টোরিতে যাদের কথা লেখা হয়, তাঁদের নিয়ে একটা মোচ্ছব করাই হয়ে দাঁড়িয়েছে এখনকার ছায়াছবির মেলা! ক্রমশ সিনেমা যে ঠিক কী? এবং সিনেমা যে কেন এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, সেটাকে ধীরে সুস্থে মানুষের মন থেকে ভুলিয়ে দেওয়ারই একটি অচিন্ত্যপূর্ব প্লাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে এইসব ফিল্মোৎসব। ঘটানাটি উদ্বেগজনক।
যাঁরা মূলধারার পাশাপাশি ছবি করতেন, তাঁদের গল্প বাছার সাহসিকতা, তাঁদের সেই গল্পকে পর্দায় বলার নিরীক্ষা--- এইগুলিই বস্তুত যেকোনো দেশের বা পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে চলে। সেই সত্যকে ক্রমশ ভুলিয়ে দেওয়ার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া মূলধারার ছবি চিরকালই করে এসেছে--- চলচ্চিত্র উৎসব তার নতুন অবতারে, সেই ক্রমিক বিস্মরণকে ঝট করে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন
গুগাবাবা-র ত্রয়ী। পর্ব-২
সত্যজিৎ তাঁর সেই ছোট্টো প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘একটা বছরে পৃথিবীতে ভালো ছবি যে খুব বেশি সংখ্যায় তৈরি হয় তা নয়, এবং যে কয়টি হয়, তার মধ্যেও কোনটা এই প্রদর্শনীতে এসে পৌঁছবে, তাও জানা নেই।’ কিন্তু সেটা ছিল দরকারি। আর দরকারি ছিল, ‘বিভিন্ন দেশের চিত্র-কর্মীদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের’ একটা সুযোগ ঘটানো। তিনি চেয়েছিলেন, বিভিন্ন দেশের চিত্র-কর্মীরা একত্র হোন। বলেছিলেন, ‘চিত্র-কর্মীরা ভিন্ন দেশবাসী হলেও তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে একটা সহজ আত্মীয়তা বোধ করেন।’ খুব গুরুত্বপূর্ণ কথার সূচনা করলেন এই একটি লাইনেই। একে লক্ষ করুন, সত্যজিতের কলমকারি একটা নতুন শব্দের জন্ম দিলেন বাংলা ভাষায়--- ‘চিত্র-কর্মী’। সিনেমার প্রযোজক পরিচালক অভিনেতা থেকে একেবারে জুনিয়র আর্টিস্ট পর্যন্ত সকলকে একটিমাত্র শব্দে চিহ্নিত করলেন। একটি শব্দ একটি একাত্মবোধ তৈরি করুক। ছবির সঙ্গে যুক্ত যেকোনো মানুষই ‘চিত্র-কর্মী’। ডাক্তারিতে বড়ো নামজাদা ডাক্তার থেকে ওয়ার্ড বয় পর্যন্ত সকলেই যেমন এখন স্বাস্থ্যকর্মী, কতদিন আগে সত্যজিৎ সিনেমার সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষকে সমন্বিত করেছিলেন একটিমাত্র শব্দে--- ‘চিত্র-কর্মী’। শব্দটির বহুল প্রচার প্রয়োজন। পরের কথাটি হল, সাহিত্য-উৎসবে বিভিন্ন প্রান্তের লেখকদের মধ্যে ব্যবধান রচনা করতে পারে ভাষা--- এমন একটা ইঙ্গিত করে, তিনি সিনেমাকে স্থাপন করলেন একটি অন্য মাত্রায়। বললেন, ‘কাব্য-উপন্যাসের ভালো অনুবাদেও যে-দূরত্বটা থেকে যায়--- একাত্মবোধের যে অসুবিধেটা আমরা বোধ করি, ছবিতে নিশ্চয়ই তা করি না। অথবা করলেও, ছবিতে আর-কিছু উপাদান থাকে, যা নাকি সে দূরত্ব সত্ত্বেও আমাদের আকর্ষণ করে।’
আরও পড়ুন
গুগাবাবা-র ত্রয়ী। পর্ব ১
সাহিত্যিক আদান-প্রদান সম্পর্কে তাঁর এই ভাবনা নিয়ে সাহিত্যিকরা--- বিশেষত রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যাঁরা ‘বিশ্বসাহিত্য’-এর কারবারি বা বুদ্ধদেব বসুর মনন-চিন্তনে যাঁরা ‘তুলনামূলক সাহিত্যের’ গুণিজন, তাঁরা কিছু আপত্তি তুলতেই পারেন, সে অন্য প্রসঙ্গ। তবে ছবির বিষয়ে কথাটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন
একই সময় একই নাম গল্প দুটি আর 'তিন রকম' বই
আরও পড়ুন
সুহাসিনী, মেরি শীলা, রুনা, বিবি-রা
তাছাড়া, ওই বাক্যের শেষে কোন সে দিক, যেদিক থেকে আমাদের একটা বাড়তি আকর্ষণ তৈরি হতে পারে--- সেটিও একেবারে স্পষ্ট করলেন তিনি। বললেন, ‘শিল্পের দিকটা বাদ দিলেও, অপরিণত ছবিতেও, একটা দেশের আচার-ব্যবহার, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ইত্যাদির পরিচায়ক হিসেবে অন্য দেশের দর্শকের কাছে তার একটা মূল্য থাকবেই।’ ঠিক এই জায়াগা থেকেই ছবি-করিয়েদের জন্য একটি দরকারি পরামর্শ দিয়ে রাখে সত্যজিতের নন্দনতত্ত্ব। তা হল, ‘শিল্প-রচনা ছাড়াও চিত্রনির্মাতার আর-একটি দায়িত্ব এসে পড়ে, সেটা হল নিজের দেশের অবিকৃত রূপটিই ছবিতে তুলে ধরার চেষ্টা করা, না হলে ছবির মধ্যে দিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা পরিবেশনের আশঙ্কা থেকে যায়।’ এক অসামান্য চেতাবনি।
বিশেষ করে, এখন অনেকেই দেশীয় গল্প বলার ভান-ভণিতা করে যখন জনপ্রিয় হিন্দি ছবি, দক্ষিণি ছবি আর হলিউডি ছবির দৃশ্যকল্প চুরি করেন, বাঙালিয়ানার গল্প, ভারতীয়ত্বের গল্প বলার বাজারচলতি লবজটি বলে আসলে দেশীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কাহিনিকে ধ্বংস করেন, সেই ভয়ংকর প্রবণতা সম্পর্কে কবেই সাবধান করে গিয়েছিলেন এই মহান চিন্তাবিদ। তিনি তাঁর মতো করে লক্ষ করেছিলেন অশনি সংকেত।
তিনি সত্যিই আরো গভীরে গিয়ে ভেবেছিলেন ছবি নিয়ে--- ছবির উৎসব নিয়ে। আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে এই ভারতীয় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অন্যতম উপকরণ হিসেবে চেয়েছিলেন আরেকটি অসামান্য জিনিস। তা হল, তখন প্রতি বছর চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হত দিল্লিতে। এই বিষয়ে একটা দরকারি কথা বললেন তিনি। লিখলেন, ‘উৎসব হচ্ছে দিল্লিতে, অর্থাৎ যাঁরা আসছেন, তাঁরা দিল্লিতে উৎসবে যোগদান করে দেশে ফিরে যাবেন। আমার মনে হয়, এঁরা যদি ভারতবর্ষের যে সব জায়গায় ছবি তৈরি হয়, সেসব জায়াগায় গিয়ে আমাদের স্টুডিয়োর পরিবেশ সম্বন্ধে একটা ধারণা করে যেতে পারতেন, তাহলে ভালো হত।’ তথাকথিত উন্নত একটি অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর মধ্যে বসে, সেখানকার ওই গজদন্তমিনারবাসীরা বুঝতেই পারবেন না কোন পরিকাঠামোতে তৈরি হয় ভারতীয় সিনেমা। আক্ষরিক অর্থে অনেক ঘাম ঝরিয়ে তৈরি হয় ভারতীয় ছবি। অনেক বাধার মধ্যে, বহুবিধ সীমিত ব্যবস্থা আর বন্দোবস্তের মধ্যে তৈরি হয় ভারতীয় ছবি। সেই খবরটিও তো পৃথিবীর তাবড় তাবড় চলচ্চিত্র সমালোচকদের রাখতে হবে। না হলে, বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে যে ভারতীয় ছবির বিচার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এখনকার প্রেক্ষাপটেও কথাটি দরকারি।
মুম্বই বা দক্ষিণ ভারতীয় একজন চিত্রনির্মাতা যে সুবন্দোবস্তের মধ্যে ছবি তৈরি করেন, বাংলার একজন চিত্রনির্মাতা যে তার সিকিভাগও পান না। পরিকাঠামোর হ্রস্বতা, ছবি তৈরির দিন-বিষয়ক স্বল্পতা--- সবটাই তো এখানে আছে। এখানে বা অন্যত্রও ন্যূনতম আয়োজনও যে ছবি বানানোর নেপথ্যকাহিনি রচনা করে, সেই প্রেক্ষাপটটিও যে ছবি-করিয়েদের বিচার করার জন্য না হোক, তাদের ইতিহাস রচনা করার জন্য জরুরি, সেই কথাটি ইঙ্গিতপূর্ণভাবে প্রকাশ করলেন সত্যজিৎ। তিনি বলেছিলেন, ওই ছবি তৈরির পরিবেশটি লক্ষ করলেই, ভারতীয় ছবির ভালো আর খারাপ দুটি দিকেরই হদিশ পেতেন বিশ্ব-সিনেমার তত্ত্ববিদ ও কারিগররা।
এই প্রসঙ্গে একটি ছোটো অনুষঙ্গ-কথা। কত যথাযথ একটি কথাও তুলে দিলেন তিনি। কেবল দেশের রাজধানী বলেই যে দিল্লি ভারতীয় ছবির উৎসবের অনুষ্ঠানস্থল হতে পারে না, বলে দিলেন সেই কথাটিও। কোনো দেশের রাজধানী হওয়া একটি দেশের আন্তর্জাতিক ছবির উৎসব আয়োজনের একমাত্র কারণ হতে পারে না। ভারতীয় ছবিকে বুঝতে গেলে তার আঞ্চলিক বৈচিত্র দিয়েই তাকে অনুভব করতে হবে। সেই সত্যটি ভারতীয় ছবিকেও বুঝতে হবে, আঞ্চলিক ছবিকেও মনে রাখতে হবে। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা!
ছবির উৎসবকে কী মাত্রায় দেখতে চেয়েছিলেন আমাদের পূর্বজরা--- আমরা তাকে কোন খণ্ডতায় পর্যবসিত করছি! সত্যজিতের নামে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার চালু করতে পারি আমরা, তাঁর ছবি না হয় বড়ো বড়ো হলে দু-একবার দেখিয়েও দিতে পারি আমরা তাঁর জন্মশতবর্ষের আনুষ্ঠানিকতায়। কিন্তু আমাদের সেই নিবেদন নৈমিত্তিকমাত্র। তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকা-র এ এক নতুন গল্পমাত্র। ১৯৬৪-র লেখাটির কথা বলতেই আজকের পর্বশেষ। পরের দিন অন্য লেখাটির কথায় আসা যাবে।
Powered by Froala Editor