মানিকলমকারি - ৬৮
আগের পর্বে
গুপি গাইন বাঘা বাইনের গল্প কি সত্যিই ফ্যান্টাসির গল্প? নাকি ফ্যান্টাসির মোড়কে সেখানে রয়েছে কল্পবিজ্ঞানের উপাদানও? লক্ষ্য করার মতো বিষয়, সিরিজের প্রথম দুটি গল্পেই রয়েছে দুই বিজ্ঞানীর কথা। তৃতীয় গল্পে বিজ্ঞানী না হলেও তান্ত্রিকের চরিত্রের মধ্যে রয়েছে কল্পবিজ্ঞানের উপাদান। প্রথম দুটি গল্পে বিজ্ঞানীরা নিজেদের গবেষণাতেই মত্ত। তাঁদের আবিষ্কার হাল্লার মন্ত্রী বা হীরকের রাজা ব্যবহার করেন একভাবে। আবার সেই একই আবিষ্কার গুপি-বাঘা ব্যবহার করে অন্যভাবে। তবে তৃতীয় গল্পের ব্রহ্মানন্দের চরিত্র অনেকটাই আলাদা। তিনি বরং নিজের ক্ষমতার জালে জড়িয়ে রেখেছেন ভালো রাজাকে। আবার এই প্রসঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে বৌদ্ধ তন্ত্রের কথাও। প্রফেসর শঙ্কুর গল্পেও তো তেমনটাই দেখা যায়।
গুপি-বাঘা সিরিজের দুই বিজ্ঞানী জাদুকর বরফি আর হীরক রাজার সেই বিজ্ঞানীকে নিয়ে অনেক কথাই হয়, সেই তুলনায় ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’ ছবির ব্রহ্মানন্দ আচার্য সম্পর্কে তত কথা বলা হয় না। হয়ত এই ছবিটি নিয়ে অনেকের অনেক মত থাকার কারণেই সে কথা সেভাবে আলোচিত হয় না। কিন্তু মনে রাখতেই হবে, এই চরিত্রটিও সত্যজিতের তৈরি--- এবং সেই কারণেই এই চরিত্রটিও মানিকলমকারির অন্যতম উপাদান হতে কোনো বাধা নেই।
কে-ই বা না জানে, গুগাবাবার এই তিন নম্বর ছবিটিতে এসেছিল এই জনৈক পিশাচসিদ্ধের শিষ্য যোগী ব্রহ্মানন্দের কথা। ছবির প্রথম দৃশ্যেই দেখতে পাই, ব্রহ্মানন্দ প্রথমজীবনে ছিল ডাকাত কিন্তু পরবর্তীকালে সন্ন্যাস নেয় সে--- সন্ন্যাস নিলেও যেহেতু সে রত্নের লোভ ছাড়তে পারেনি, সে যেহেতু তার কাছে সকলের অলক্ষ্যে তার জীবনের ডাকাতির পর্বে লুণ্ঠিত রত্নমাণিক্য জমিয়ে রেখেছিল, তাই তাঁর গুরু তাঁকে অমরত্বের উপায় বলে যাননি। ফলে অমরত্ব লাভের ইচ্ছেতেই ব্রহ্মানন্দের আনন্দপুর নগরীতে আগমন। মূল কথায় ঢোকার আগে এই আনন্দপুর সম্পর্কে টুক করে একটা কথা সেরে নেওয়া যাক। সত্যজিতের মনের ভিতর এই আনন্দ শব্দটি একটি অদ্ভুত তাৎপর্যে কি অন্বিত হয়েছিল? মনে করে দেখুন, এই আনন্দপুর নগরীর পুরোনো রাজা বিক্রম ছিলেন এক চমৎকার ভালো রাজা--- গোটা আনন্দপুরের যে সমৃদ্ধি সে-ও নাকি তাঁর আমলেই। তাই তাঁর নামে পরবর্তীকালে গোটা আনন্দপুরের অনেক প্রজাই তাঁদের সন্তানদের নাম রাখেন বিক্রম। মোটের উপরে সেই পর্বেই লেখা সত্যজিতের আরেকটি চিত্রনাট্য ‘শাখা প্রশাখা’-তেও দেখবেন--- ওই পরিবারের কর্তার নাম আনন্দমোহন মজুমদার এবং সেই আনন্দমোহনের কৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর নামেই গড়ে উঠেছে আনন্দপুর নামে এক উপনগর। ‘শাখা প্রশাখা’ আর ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’ দুটি ছবিতেই পটভূমির নাম আনন্দপুর। দুটি উপনগরীরই পিছনে আছেন দুই ব্যক্তি। এক আশ্চর্য সমাপতন।
যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক ‘গুপিবাঘা ফিরে এলো’-তে অমরত্বের বর না পেয়ে ব্রহ্মানন্দ তো হাজির হলেন আনন্দপুর গ্রামে। গুপিবাঘার এই তিন নম্বর ছবি তৈরি হচ্ছে ১৯৯০-৯১-তে। তার বছর এগারো বারো আগে, ১৯৭৭ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় তিন কিস্তিতে বেরিয়েছিল প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের একটি অন্যতম অসামান্য গল্প ‘হিপনোজেন’। লক্ষ করার মতো ব্যাপার বছর দশ-এগারো আগে লেখা এই ‘হিপনোজেন’-এর সঙ্গে ‘গুপিবাঘা ফিরে এলো’-র আশ্চর্য সাদৃশ্য।
মিলের হিসেবটা বাইরে থেকেই শুরু করা যাক--- ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে পড়া যাবে। ‘হিপনোজেন’ গল্পের দুষ্টু বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ক্রাগের চেহারাটা মনে আছে? গল্পে তাঁর দুটি ছবি ছিল--- সেই দুটি ছবিতেই দেখা যাবে, মোটের উপরে শীর্ণ চেহারা, মাথায় মাথার সামনের দিকের চুল পাতলা হয়ে এসেছে, পিছনের দিকে নেমেছে চুলের ঢল। সাধারণভাবে নিরীহ হলেও অকস্মাৎ জেগে ওঠেন তেজের সঙ্গে। বলা বাহুল্য, এই চেহারা আর মনের এই ধরনটাই ফিরে এসেছে ব্রহ্মানন্দের মধ্যে।
আরও পড়ুন
গুগাবাবা-র ত্রয়ী। পর্ব ১
আরও পড়ুন
একই সময় একই নাম গল্প দুটি আর 'তিন রকম' বই
ব্রহ্মানন্দ থাকেন আনন্দপুরের এক প্রান্তে অবস্থিত আনন্দগড় কেল্লায়। সে এক এলাহি কেল্লা। তার জাঁকজমক দেখে বাঘার মনে হয়েছিল, ‘ঠিক যেন বাদশা’! অন্যদিকে ‘হিপনোজেন’ কাহিনিতে আলেকজান্ডার ক্রাগের বাসস্থানটি কেমন? ক্রাগের আমন্ত্রণে নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে বেশ কিছুটা দূরে যেখানে তার বাড়িতে পৌঁছয় শঙ্কু, তার বর্ণনা শঙ্কুর কলমে এই রকম, ‘কী আশ্চর্য এক জায়গায় এসে হাজির হয়েছি সেটা বলা দরকার। কারণ এই বাসস্থান--- রাজপুরীও বলা চলে--- এই মানুষের একার তৈরি। মধ্যযুগীয় কেল্লার ঢঙের বাড়ি, দেখে মনে হবে বয়স সাত-আটশো বছরের কাছাকাছি, কিন্তু আসলে তৈরি এই বিংশ শতাব্দীতেই।’ ব্রহ্মানন্দের কেল্লা আর ক্রাগের কেল্লা তাদের দুই মালিকের মতোই চেহারাতেও এক। ওদিকে ব্রহ্মানন্দের ছিল সারা পৃথিবীর মণিমাণিক্য জমাবারো লোভ আর ক্রাগ সাহেবের লোভ কীসে? তাঁর ওয়েটিংরুমের চেহারা দেখে শঙ্কুর তো চক্ষুস্থির! তিনি প্রায় বাকরুদ্ধ! কারণ সেখানে ‘চোখধাঁধানো বাহার’। চারদিকে দেখে শুধু চোখে পড়ে পৃথিবীর বিখ্যাত সব শিল্পীদের অসাধারণ সব পেন্টিং। ‘এই একটি ঘরে যা পেন্টিং রয়েছে, তারই দাম হবে কয়েক কোটি টাকা।’ তার মধ্যে রেমব্রাঁ, ফ্রাগোনার থেকে টিনটোরেটো ছবিও আছে। এই আলেকজান্ডার ক্রাগের আসল লক্ষ্য কী? তার লেখা ডাইরি থেকে শঙ্কু জানতে পারে, সে লিখেছে, ‘সারা পৃথিবীর অধিপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত’ করতে চায় সে। তার ইচ্ছে ‘সারা বিশ্বের লোক থাকবে তার পায়ের তলায়, জগতের যেখানে যত মিউজিয়ম, যত লাইব্রেরি, যত সংগ্রহশালা, যত আর্ট গ্যালারি আছে, তার অমূল্য সম্পদ এসে যাবে তার আওতার মধ্যে।’ আর সেটা সম্ভব হবে কী করে? ডাইরিতে লেখে ক্রাগ, ‘এই জিনিসটা সম্ভব হবে ওই হিপনোজেনের সাহায্যে’। তার পরিকল্পনা হল, হিপনোজেন গ্যাস ছড়িয়ে গোটা শহরের লোককে এক বছরের জন্য হিপনোটাইজড বা সম্মোহিত করে ফেলতে পারলে শহরের কোনো ক্ষতি হবে না--- অথচ ‘সেই শহরের লোকের মন দখল করতে পারলে তাদের ওপর কর্তৃত্ব করতে অসুবিধে কোথায়?’ ক্রাগের এই ‘সাংঘাতিক পরিকল্পনা’-র সঙ্গে ওই সম্মোহনের হিসেবে মিলে যাবে ব্রহ্মানন্দের পরিকল্পনাও। সেও আনন্দপুরের এগারোজন বারো-বছরের বিক্রম নামক বালককে সম্মোহিত করে রেখেছে নিজের কেল্লায়।
আরও পড়ুন
সুহাসিনী, মেরি শীলা, রুনা, বিবি-রা
এইখানেই দুই গল্পের দুই নম্বর ভেতরের মিল। পিশাচসিদ্ধ গুরু ব্রহ্মানন্দকে অমর হওয়ার বর দেননি, শুধু ব্রহ্মানন্দ জেনে নিয়েছে, তার বিনাশের কারণ হবে আনন্দপুরের বারো বছরের এক বালক, যার নাম বিক্রম। সে তাই উল্টো পথ বেছে নিয়েছে। সে আনন্দপুরের বারো বছরের বালক বিক্রমকে সম্মোহিত করে রেখে নিজের ভৃত্য বানিয়ে রেখেছে। লক্ষ্য হল, তার বিনাশের কারণ যে, সে-ই যদি তার কাছে সম্মোহিত হয়ে থাকে, তাহলে তো সে কার্যত অমরত্বই পেল। এই অমরত্বই তো চাইছিল ‘হিপনোজেন’ গল্পের আলেকজান্ডার ক্রাগও। ক্রাগ জানায়, তার জন্ম হয়েছিল নেপোলিয়ন যেদিন মারা যান সেদিন--- অর্থাৎ ১৮২১ সালের ৫ মে। গল্পে জানা যায়, তার মানে ঘটনার সময় তার বয়স প্রায় দেড়শো--- তার উপরেও সে আরো বেঁচে থাকতে চায়। সেই বেঁচে থাকার লোভ থেকেই সে ডেকে এনেছে শঙ্কু আর তার মতো তিন বিজ্ঞানীকে। তাদের সাহায্যেই সে বস্তুত অমরত্ব লাভ করবে মৃত্যুর পরেও। তারাই ক্রাগের দেওয়া নির্দেশমতো ঠিকঠাক কাজগুলি করলে ধীরে ধীরে ক্রাগের মৃতদেহে সঞ্চারিত হবে প্রাণ। সেই অমরত্বের লোভ! ব্রহ্মানন্দ আর ক্রাগ একদিকে ওই সংগ্রহ আর অমরত্বের লোভে নিকটাত্মীয়। বস্তু সংগ্রহের অত্যন্ত নেশা আর চিরকালের জন্য আয়ু সংগ্রহ--- যেন একই লোভের দুটি দিক।
আরও পড়ুন
পুতুলের স্বল্প-গল্প
এই দিক থেকেই দুই গল্পের ভেতর দিকের তিন চার আর পাঁচ নম্বর মিল চোখে না পড়ে যায় না পাঠকের! ব্রহ্মানন্দের সেই সম্মোহনকক্ষ আর ক্রাগের অমরত্বলাভের গবেষণাকক্ষ সমার্থক আর ক্রাগের দুই রোবট-দাস গুপি বাঘার গল্পে হয়ে যায় ব্রহ্মানন্দের দুই বিশ্বস্ত অনুচর দুন্দুভি আর ডম্বরু। শেষে এটাও চোখে না পড়ে যায় না যে, দুই গল্পেই ছিল ক্রাগ আর ব্রহ্মানন্দের এই কাজে যে-সহায়ক হবে, তাকেই নিজের বশীভূত করে রাখার চক্রান্ত। ব্রহ্মানন্দ গুপি বাঘাকে সম্মোহিত করে রাখতে চায় আর হিপনোজেন গল্পে ওই হিপনোজেন গ্যাস দিয়ে শঙ্কুকেই বশীভূত করতে চায় ক্রাগ। ব্যাপারটা কী অদ্ভুত না! দশ এগারো বছরের ব্যবধানে, যে গল্প সত্যজিৎ বেঁধেছিলেন একটা সায়েন্স ফিকশনের গল্পের গড়নে, সেই গড়নটাই অন্যভাবে ফিরে এলো ফ্যান্টাসির গল্পের ভেতরে আরেকটু অন্য গড়নে।
Powered by Froala Editor