কোন ভাবনা যে কখন কোন পথে কোথায় গড়িয়ে যায়! বহুদিন থেকেই মনে হচ্ছিল, আচ্ছা যে-গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবিকে আমরা ফ্যান্টাসির গল্প বলে মেনে নিই, সত্যিই কি তা শুধুই ফ্যান্টাসির গল্প? নাকি সেটার মধ্যেও লুকাছুপি করে আছে সায়েন্স ফিকশন। মানে একটা আশ্চর্য মশলা দিয়ে ফ্যান্টাসির সঙ্গে সায়েন্স ফিকশনও যে এখানে হাত ধরাধরি করে আছে, সেটা যেন গল্পের ফ্যান্টাসির চাপে আমাদের আর মনেই থাকে না।
গুপি গাইনের প্রথম ছবিতে জাদুকর বরফি, গুগাবাবা-র দ্বিতীয় ছবিতে জম্বুদ্বীপ থেকে আসা বিজ্ঞানী আর জিজিবিবি-থ্রি-র ব্রহ্মানন্দ আচার্য--- এই তিন চরিত্রের মধ্যেই তো কোনো না কোনো ভাবে লুকিয়ে আছে কল্পবিজ্ঞানের উপাদান। জাদুকর বরফির ছিল গবেষণাগার, গবেষণাগার ছিল হীরক রাজার বিজ্ঞানীরও। ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’ ছবিতে আনন্দগড় কেল্লাতে ব্রহ্মানন্দ আচার্যর গবেষণাগার হয়ে গেছে তাঁর সম্মোহন কক্ষটাই। তবে কয়েকটা মজাদার ব্যাপার আছে, এই তিনজন মানুষের গল্পে। প্রথম দুই বিজ্ঞানী অনেকটাই ক্ষমতার হাতে বশীভূত বা বলা ভালো রাষ্ট্র ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিজ্ঞানী। জাদুকর বরফি আর হীরক রাজার বিজ্ঞানী নিজেরা মেতে আছে বিজ্ঞানের চর্চায়--- তাদের সেই বিজ্ঞানবুদ্ধিকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র।
হাল্লার মন্ত্রী নিজে রাজা হতে চায় বলে, হাল্লার ভালো রাজাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কাজেই হোক বা তার ভেতরের হিংস্র মানুষটাকে জাগিয়ে যুদ্ধ করানোর কাজেই হোক ব্যবহার করে জাদুকর বরফির ওষুধ। তারই মধ্যে রাজ্যের সমস্ত বোবা মানুষের মুখে কথা ফোটানোর জন্য সে তৈরি করে কথা বলানোর ওষুধ। যদিও হাল্লার মন্ত্রী তো আর এমনি এমনি কথা ফোটাবে না তাদের মুখে--- তার দিক থেকে হাল্লার প্রজাদের কথা বলানোর কারণটা ভারি অদ্ভুত নিষ্ঠুর আর এক্কেবারে অত্যাচারী রাজা-গজার মন কি বাত। সেটা হল, দ্যাখো বরফি, হাল্লার প্রজারা যদি তোমার মতো বোবা হয়, তারা যদি মুখ ফুটে তাদের কী দরকার তা না বলে, তাহলে তাদের সেই চাওয়াটাকে না-পাওয়ার পথ বন্ধ করা যায় কি?--- অতএব তাদের কথা বলাও। তারা কথা বলতে পারলে তারা রাজার কাছে চাইবে, আর তাদের সেই চাওয়া থাকলেই তো তাদের তা না-দেওয়ার আনন্দ! সেইজন্যেই দরকার তাদের মুখে কথা ফোটানো। ফলে বরফির বিজ্ঞানচর্চা হাল্লার রাজার হুকুমে--- তার মর্জিমাফিক। ঠিক তেমনই, হীরক রাজার বিজ্ঞানী। সেও যে মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র বানায়--- পাতি বাংলাতে যেটিকে বলা চলে মগজ ধোলাইয়ের যন্ত্র--- সেটাও তো হীরক রাজার দরকার মাফিক বিজ্ঞানীর সরবরাহ। তবে এই জটিল যন্ত্রটি তৈরির মধ্যে নিশ্চয়ই বিজ্ঞানীর কাজের আনন্দ আছে--- সেই কাজের আনন্দেই তো বিজ্ঞানী তৈরি করে তা। যে কাজের আনন্দে সে কৃত্রিম উপায়ে এক্কেবারে আসলের মতো ফুল বানায়, সেই একই আনন্দে সে বানায় ওই মগজধোলাই যন্ত্র। সে যে আনন্দে বলে, ‘বাগান করুন এ ফুল ঝরে না, মরে না, পোকা ধরে না’ সেই আনন্দেই সে বলে ‘এ এমন কল, যাতে রাজকার্য হয়ে যায় জল। এর সাহায্যে রাজভক্তি প্রকাশে নারাজ যে, তাকে করে তোলা একান্ত রাজভক্ত--- মোটে নয় শক্ত।’ বিজ্ঞানীর কাছে দুটোই আবিষ্কার--- দুটোই তার বিজ্ঞানবুদ্ধির সৃজন। রাজা তাকে কীভাবে নেবে সে রাজাই জানে। অবশ্য বলা ভালো রাজা তাকে একভাবে ব্যবহার করবে মগজধোলাই রূপে।
আরও পড়ুন
একই সময় একই নাম গল্প দুটি আর 'তিন রকম' বই
অন্যদিকে গুগাবাবা তাকেই ব্যবহার করবে আরেক ধরনের মগজধোলাই যন্ত্র রূপে। রাজা যে যন্ত্রের ভেতরে পুরে দেবে কৃষক আর শ্রমিকদের বশ করার মন্ত্র, গুগাবাবা তার মধ্যেই পুরে দেবে রাজার মন্ত্র। রাজা আর তার মন্ত্রিবর্গ নিজেরাই বলবে, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান’। এখানেই বিজ্ঞানের খেলা--- একই যন্ত্র কখন যে কার হয়ে কাজ করছে--- দেবাঃ ন জানন্তি!
আরও পড়ুন
সুহাসিনী, মেরি শীলা, রুনা, বিবি-রা
লক্ষ করবেন দুই বিজ্ঞানীই, ওই বরফি আর জম্বুদ্বীপ থেকে আসা বিজ্ঞানী--- কিন্তু বেশ রাগী। তারা এমনিতে রাজার কাছে, যিনি তাদের বিজ্ঞানচর্চার স্পনসরর তাদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে বিনয়ের অবতার। এখানে জাদুকর বরফির ভূমিকায় হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আর হীরকরাজার বিজ্ঞানীর ভূমিকায় সন্তোষ দত্তের অসামান্য অভিনয় প্রতিভা সত্যজিতের উদ্দেশ্যটিকে যথাযথ অভিমুখ দিয়েছে। কিন্তু তার কাজ নিয়ে হাল্লার মন্ত্রী সংশয় প্রকাশ করে হাল্লার মন্ত্রী যখন বলে, ‘যা দেখছি, তোমার তুলনায় তাদের, মানে গুপিবাঘার বিদ্যবুদ্ধি কিছু কম নয়’ তাতে এক্কেবারে খেপচুরিয়াস হয়ে উঠে ঝপঝপ করে মাথা বদলে ফেলে বরফি! তার সেই রাগ দেখে মন্ত্রী বলে, ‘আহা চটছ কেন বরফি! চটছ কেন?’ মন্ত্রী নাকি তার সঙ্গে একটু মস্করা করছিল। সত্যিই কি মস্করা করছিল সে, নাকি তাকে খেপিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে মন্ত্রী পেতে চাইছিল সব সৈন্যকে একসঙ্গে খেপিয়ে তাদের দিয়ে যুদ্ধ অভিযান করানোর ওষুধ! রাষ্ট্র তো কখনো পুরস্কার দিয়ে, কখনো বন্দি করে, কখনো তিরস্কার করে, কখনো বকাবকির ভান করে আসলে তার ভেতরের প্রতিভাকে আরো উসকে দিয়ে আখেরে নিজের কাজটাই করায়।
আরও পড়ুন
পুতুলের স্বল্প-গল্প
অন্যদিকে জম্বুদ্বীপের বিজ্ঞানী রাগ করে গুগাবাবার কথায়। কিন্তু কোন কথায়? কোন কথায় সে তার ভয় দেখানো যন্ত্র বন্দুকের ইস্তেমাল করে? মনে করে দেখুন, যখন বাঘা তাকে বলে, ‘তুমি তো রাজার দলে?’ ঠিক সেই কথাটায় বেজায় রকম খেপে যায় সেই বিজ্ঞানী। অদ্ভুত একটা কথা বলে সে। সে বলে, ‘আমি একক। আমি একমেবাদ্বিতীয়ম্ গবেষক।’ ঠিক--- ঠিক এখানেই তার অহংকার। এখানেই তার দম্ভ। সে বিশ্বাস করে এটাই। সে আসলে বিজ্ঞানী--- তার বিজ্ঞানের কাজকর্ম করার জন্য দরকার ছিল স্পনসরর--- হীরক রাজা তার সেই স্পনসররমাত্র। হতে পারে সে তার দরকারমতো মাল-মেটিরিয়াল সাপ্লাই করছে--- তবু তার কাছে বিজ্ঞানচর্চাই পহেলা নম্বরের কাজ। তা মানুষের ভালোর জন্যই হোক আর মন্দের জন্য--- মগজধোলাই যন্ত্রটা তো যন্ত্রই। সেই এলাহি যন্ত্রটা ব্যবহার যেই করুক আর যেভাবেই করুক--- তৈরি করতে পারে একমাত্র বিজ্ঞানী। সেই কাজেই তার আনন্দ! এই গর্বেই সে বলে ‘আমি একক’। তার কোনো দল নেই, তার কোনো কোন্দল নেই। এই গর্বেই সে বলতে পারে ‘আমি একমেবাদ্বিতীয়ম্ গবেষক’। ব্রাহ্ম সত্যজিৎ জানেন এই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ শব্দটি কোন অসামান্য তাৎপর্যে উচ্চারিত। স্বয়ং ব্রহ্ম সম্পর্কে এই অমোঘ আশ্চর্য শব্দটি ব্যবহৃত। তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে বিজ্ঞানীর সম্পর্কে তাকে দিয়ে বলালেন, বিজ্ঞানীও ‘এক’ এবং ‘অদ্বিতীয়’। বিজ্ঞানী বিজ্ঞানভুক্ত--- তিনি কোনো দলভুক্ত নন। প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলি, এই সঙ্গেই দেখুন, ‘একক’ আর ‘গবেষক’ শব্দ যে অসামান্য একটা অন্ত্যমিল হতে পারে--- তা ছন্দোগুরু সত্যজিৎ ছাড়া আর কে কবে ভাবতে পেরেছে!
আরও পড়ুন
যখন ছোট ছিলাম: পত্রিকাপাঠ আর গ্রন্থপাঠ
আচ্ছা, এই বিজ্ঞানীকে সে তো ‘রাজার দলে’ কথাটা কে বলেছিল, মনে আছে? প্রশ্নটা বাহুল্য--- কারণ সক্কলের মনে আছে, কথাটা বলেছিল বাঘা। সংলাপ রচনা আর চরিত্ররচনার কোন গভীরতা থেকে এই কথাটা বাঘাকে দিয়ে বলালেন সত্যজিৎ, সেটাও বিচার্য। গুপী নিজের প্রতিভা সম্পর্কে একটু উদাসীন আর বাঘার প্রতি মুহূর্তে নিজের অবস্থান আর নিজের প্রতিভা সম্পর্কে একেবারে, যাকে বলে, জ্ঞানের নাড়ি টনটনে। দেখবেন, তাই যে-বাঘা হীরকরাজার বর্ষপূর্তি উৎসবে রাজসভায় উপরে বসে মৃদু মৃদু হেসে কথা বলে, সেই বাঘাই ‘এসে হীরক দেশে’ গান গাইতে এসে কী অদ্ভুত এক স্বরে বলে ‘আমার ঢোল’! সে যাকে বলে, অহংকারী শিল্পীর এক তলব যেন। সে নিজে এই রকম বলেই সে জানে কোন মন্ত্রে বশ হবে বিজ্ঞানীও। তারও লক্ষ্য বিজ্ঞানীকে নিজের দিকে--- মানে ভালোর দিকে নিয়ে আসা। তাই সে-ও বিজ্ঞানীর আঁতে ঘা দেয়। বলে, ‘তুমি তো রাজার দলে?’ মজাটা দেখুন, হাল্লার মন্ত্রী বরফির আঁতে একভাবে ঘা দিয়ে তাকে দিয়ে আরো শক্তিশালী ওষুধ বানিয়ে নেয় আর বাঘা ঠিক সেইপথেই আরেকভাবে বিজ্ঞানীর অহংয়ে আঘাত করে তাকে টেনে আনে মন্দ-পক্ষ থেকে ভালোর দিকে।
ছোট্টো আন-প্রসঙ্গে গিয়ে একটা কথা বলেই ফেলি। লক্ষ করে দেখেছেন নিশ্চয়ই, জম্বুদ্বীপ থেকে আসা বিজ্ঞানীর সঙ্গে আমাদের প্রোফেসর শঙ্কুর চেহারার একটা আশ্চর্য মিল। এমনকি শঙ্কুর পোশাকের সঙ্গেও মিল আছে ওই বিজ্ঞানীর পোশাক পরিকল্পনায়। এখন কি মনে হয়? যদি কখনো সত্যজিৎ প্রোফেসর শঙ্কু থেকে ছবি করতেন, তাহলে কি তিনি সন্তোষ দত্তকেই নিতেন প্রোফেসর শঙ্কুর চরিত্রে? মনে করে দেখুন, ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’ ছবির ‘মহাপুরুষ’ অংশেও কিন্তু আলাভোলা বিজ্ঞানীর চরিত্রে তিনি নিয়েছিলেন সন্তোষ দত্তকেই। এই সন্তোষ দত্তকেই হয়ত এক্কেবারে সপ্রতিভ প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর চরিত্রে আমরা পেতে পারতাম এক নতুন রূপে। কী জানি মনে হয়, সন্তোষ দত্তের প্রয়াণে হয়ত শুধু আমরা জটায়ুকেই হারাইনি--- হয়ত হারিয়েছিলাম শঙ্কুকে পর্দায় পাওয়ার সম্ভাবনাও।
পুনরপি মূল পথে ফেরা যাক। গুগাবাবা সিরিজের ওই দুই বিজ্ঞানীর থেকে একেবারে আলাদা ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’-র ব্রহ্মানন্দ আচার্য। আগের দুই গল্পে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করছিল বিজ্ঞানীর বুদ্ধি আর মেধাকে। এইবারে বিজ্ঞানবুদ্ধি যেন ব্যবহার করছে ভালোরাজাকে। কেউ বলবেন, ব্রহ্মানন্দ বিজ্ঞানী কেন হবেন? তিনি তো তান্ত্রিক। কথাটা ঠিক। কিন্তু সত্যজিতের মন-চিত্রে কেমন এক রসায়নে তন্ত্র-মন্ত্র- ব্ল্যাক ম্যাজিক- জাদুবিদ্যা আর বিজ্ঞানচর্চা যেন এক হয়ে আছে। প্রোফেসর শঙ্কুর প্রথদিকের গল্পগুলি আলোচনা করার সময়ে আমরা এই মানিকলমকারির সংশ্লিষ্ট কিস্তিতে তা নিয়ে আড্ডা দেওয়া গেছে আগেই। গুগাবাবার এক নম্বর ছবিতে জাদুকর বরফির অদ্ভুত চেহারাতে আর তার ছবিওয়ালা লেখার চিহ্নভরা সব কাগজে ছিল তিব্বতি বৌদ্ধতন্ত্রের নানা মোটিফ। গুগাবাবার তিন নম্বরে এলো পিশাচসিদ্ধ যোগীর কাছে শিষ্যত্বগ্রহণ করা এক সন্ন্যাসীর কথা। সে প্রথমজীবনে ছিল ডাকাত কিন্তু পরবর্তীকালে সন্ন্যাস নেয় সে--- কিন্তু সন্ন্যাস নিয়েও রত্নের লোভ সে ছাড়তে পারেনি, তাই তাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা অমর হওয়ার বর দিতে পারেন না পিশাচসিদ্ধ গুরু। এই অমরত্বের গল্প, এই তন্ত্রের গল্প কীভাবে জিজিবিবি-থ্রিতে ফিরে এলো আর কীভাবেই বা আগে এসেছিল প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনিতে--- তার প্রস্তাবনা সারতে সারতেই আজকের কিস্তি খতম। তাই আজকে এই অবধি থাক আর সেটা নিয়েই না হয় বসুক পরের দিনের আড্ডা। তাহলে হয়ত ওই শুরুর লাইনটা আবার নতুন করে বোঝা যাবে, দেখা যাবে সত্যিই ‘কোন ভাবনা যে কখন কোন পথে কোথায় গড়িয়ে যায়!’
Powered by Froala Editor