মানিকলমকারি - ৬৫
আগের পর্বে
সত্যজিতের ছোটোবেলার জীবনজুড়ে ছিল নানা খেলনার সম্ভার। ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ সেইসব খেলনার কথা পাওয়া যায়। খেলনা এবং পুতুলের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর সিনেমাতেও। সেখানে ‘পথের পাঁচালি’-র দুর্গার পুতুল খেলা বা অপুর মুকুট এবং গোঁফ রয়েছে। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এও রয়েছে পুতুলের প্রসঙ্গ। আবার স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘টু’ তৈরি হয়েছে শিশুদের খেলনার জগৎ নিয়েই। তবে এই পুতুলরাই সত্যজিতের গল্পে ফিরে এসেছে সম্পূর্ণ অন্যভাবে। সেখানে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত আতঙ্কের পরিবেশ। প্রফেসর শঙ্কুর গল্পে প্রথম সেই ‘আশ্চর্য পুতুল’-এর সঙ্গে আলাপ। আবার তার বেশ কয়েক বছর পর সত্যজিৎ লিখলেন ‘ফ্রিৎজ’ গল্পটি। সেখানে পুতুলের সঙ্গে যেমন আতঙ্ক মিশে রয়েছে, তেমনই রয়েছে শৈশবকে পুনরাবিষ্কারের রোমাঞ্চও। আবার ‘ভুতো’ গল্পটিতেও রয়েছে একটি পুতুলের প্রসঙ্গ। যে পুতুলের মধ্যেই মানুষের সত্তাও ঢুকে পড়েছে কোনোভাবে।
সত্যজিতের গল্প সম্পর্কে এ এক বহুদিনের অনুযোগ। তাঁর ছবিতে যত নারীর ভুবন, তাঁর গল্পে তো তেমনটা নয়। নিঃসন্দেহে সংগত সে অনুযোগ--- সত্যজিতের গল্পের পাঠিকা তাঁর চরিত্রকে তো সেভাবে খুঁজে পাবেন না এখানে। তবে আবার খুঁজে দেখলে একেবারে পাবেন না, তেমনটাও নয় বোধহয়। প্রথম থেকেই বেশ কিছু মনে রাখার মতো মেয়েচরিত্রও বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবে ঘোরাফেরা করে এই গল্পের ভুবনে। কাহিনিতে তাদের কথাগুলি যদি ধরে রাখা যায় একত্রে? তাদের কথা পরপর সাজানো হলে কি তার ভেতরেও কোনো একটা ধরন তৈরি হয়ে ওঠে, সেই অভিপ্রায়ে।
সত্যজিৎ রায়ের লেখা দ্বিতীয় গল্প, ‘শেডস অফ গ্রে’-তেই ছিল একটি নারী চরিত্র। সরাসরি উপস্থিত নয়, তবে বেশ অদ্ভুতভাবে পুরো গল্পে উপস্থিত সেই মেয়েটি। দুই শিল্পী পুরুষ বন্ধুর মাঝখানে উপস্থিত হয় এক নারী। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর ফ্ল্যাটে একদিন উপস্থিত হওয়ার পরেই তার চোখে পড়ে ক্যানভাসে সে আঁকছে ‘পৃথুলা, লাস্যময়ী একটি নারীমূর্তি’ যে বন্ধু দেখছে সেই ছবি তার মনে হচ্ছে ‘এমনভাবে আমার বন্ধুটি তাকে এঁকে চলেছে যে, রেনোয়ার ছবির কথা মনে পড়ে যায়। মনে হচ্ছিল সে যেন তার সমস্ত কামনা ওই ছবির মধ্যে উজাড় করে দিচ্ছে।’ এই মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে সব কিছু ছেড়েছুড়ে সেই শিল্পীবন্ধু চলে যায় এক দূরের দ্বীপে। যদিও সেই বন্ধুপত্নী মারা যায়, তবে মারা যাওয়ার আগে নাকি পুরোপুরি ছারখার করে যায় সেই শিল্পীর জীবন। সেই হতভাগ্য শিল্পীর গল্পে, তার জীবনকাহিনিতে শেষ পেরেক ঠোকা হল ধীরে ধীরে তার বর্ণান্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনায়। এই এক ধরনের নারী--- কাহিনির ইঙ্গিতে বোঝা যায়, যে প্রকৃত অর্থে হয়ত লোভী, অশান্তিপ্রিয় অথচ এক লাস্যময়ী। কিন্তু এমন চরিত্র পরে আর সত্যজিতের কাহিনিতে ফিরে আসেনি।
তবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এইসব নারীচরিত্ররা। যেমন ছোটোদের গল্প ‘সদানন্দের খুদে জগৎ’-এ সদানন্দের মা থেকে বড়োদের গল্প ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’-র এক বায়োকেমিস্ট বিজ্ঞানীর স্ত্রী নিভা সরকার। অন্যদিকে ‘দুই ম্যাজিশিয়ন’ গল্পে উল্লিখিত এক আশ্চর্য বৃদ্ধা ম্যাজিশিয়ন থেকে ‘অতিথি’ গল্পে খুদে বালক মন্টুর মা। আর ফেলুদার গল্প ‘অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য’-তে সেই বুদ্ধিমতী রুনা থেকে ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’ গল্পে ফেলুদার গল্পের ভক্ত পাঠিকা মেরি শীলা বিশ্বাস। এদের কথাতে আসব, তার আগে প্রসঙ্গত বলে নেওয়া দরকার ‘দুই ম্যাজিশিয়ন’ গল্পের সেই অদ্ভুত এক বুড়ির কথা। যে রাস্তায় দেখাত ভোজবাজির খেলা আর যে আসলে ছিল ওই গল্পের আসল ম্যাজিশিয়ন সুরপতির আসল গুর্বী। সম্ভবত ভানুমতীর খেল থেকে জাদুবিদ্যার উদ্ভব এই মিথ থেকেই হারিয়ে যাওয়া জাদুবিদ্যার বাহক ওই বুড়ির জাদুবিদ্যার বর্ণনা বেশ ফলাও করে লেখেন গল্পকার সত্যজিৎ। লেখেন ‘দিনাজপুর জেলার ছোটো একটি গ্রাম পাঁচপুকুর। শরতের এক শান্ত দুপুর। এক বুড়ি চটের থলি নিয়ে বসেছে বটতলায় মতি মুদির দোকানের ঠিক সামনে। তাকে ঘিরে ছেলেবুড়োর ভিড়। কত বয়স বুড়ির? ষাটও হতে পারে, নব্বুইও হতে পারে। তোবড়ানো গালে অজস্র হিজিবিজি বলিরেখা, হাসলেই সংখ্যায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। আর ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে কথার খই ফুটছে।’ সেদিন সেই বুড়ির কাছে যা দেখেছিল গল্পের জাদুকর, তা সে ‘কোনোদিন ভোলেওনি, ভুলবেও না। তার নিজের ঠাকুরমার বয়সও তো পঁয়ষট্টি, ছুঁচে সুতো পরাতে গেলে সর্বাঙ্গ ছকঠক করে কাঁপে। আর ওই বুড়ির কোঁকড়ানো হাতে এত জাদু! চোখের সামনে নাকের সামনে হাত দু-হাতের মধ্যে জিনিসপত্তর সব ফুসমন্তরে উধাও করে দিচ্ছে’। অনেক সময়েই মনে থাকে না আমাদের এই আশ্চর্য ক্ষমতাধারী জাদুকরও তো এক বৃদ্ধাই।
আরও পড়ুন
পুতুলের স্বল্প-গল্প
আরও পড়ুন
রেসকিউইং ফ্রম ওবলিভিয়ন: এক অন্য ছবির গল্প
এঁর যেমন অদ্ভুত ক্ষমতা, তার উল্টোদিকে নিতান্ত চেনাজানা নারীচরিত্রও তো আছে গল্পের মানচিত্রে। ওই ‘সদানন্দের খুদে জগৎ’ গল্পে সদানন্দের মা তো প্রথমে চমকে উঠেছিলেন তাঁর ছেলে সহজ সদানন্দ নাকি কারো মাথা ফাটিয়ে এসেছে! তিনি এই খবর সদানন্দের বাবাকে দেন, সত্যিই তো তাঁরা আর কী করে বুঝবেন, সদানন্দের সঙ্গে পিঁপড়েদের সখ্যের কাহিনি। তাই অসুস্থ ছেলেকে ভালো রাখতে চেয়ে তিনি সপাটে মেরে ফেলেন ছেলের পাশে ঘুরঘুর করতে থাকা পিঁপড়েকে। তিনি তো আর শুনতে পাননি সেই পিঁপড়ের গান--- সদানন্দের মতো। এমনই নিতান্ত সাদাসিধা ছিলেন পটলবাবুর গিন্নি। গল্পের নাম ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’। পটলবাবু সিনেমায় অভিনয় করতে যাচ্ছেন বলে না জানি তাঁর স্ত্রীকে কত আশা নিয়ে বলেছিলেন, এইবারে তেমন অভিনয়ের সুযোগ না থাকলেও ‘এ তো সবে সিঁড়ির প্রথম ধাপ! কী বলো অ্যাঁ! মান যশ প্রতিপত্তি খ্যাতি, যদি বেঁচে থাকি ভবে, হে মোর গৃহিণী, এ সবই লভিব আমি।’ পটলবাবুর এই রোমান্টিক আবেগাতিশয্যে জল ঢেলে গিন্নি বলেন, ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল--- সাধে কি তোমার কোনোদিন কিচ্ছু হয় না?’ ‘অতিথি’ গল্প, মানে যেখান থেকে সত্যজিতের বহু পরের ছবি ‘আগন্তুক’ তৈরি হবে, সেই গল্পেও ছিলেন এক নারীচরিত্র--- গল্পে তার নাম ছিল সুহাসিনী। সেই সুহাসিনী ছবিতে যেমন সংবেদনশীল, গল্পে তো তেমনটি ছিলেন না। সেখানে বহুদিন পরে হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া মামাকে সে-ই সন্দেহ করে। এই সুহাসিনীর মনের প্রশ্নগুলোই গল্পে সংক্রমিত হতে থাকে খুদে মন্টুর ভেতরেও। এমন গড়পড়তা একটা ধরনেই একদিকে বাঁধা সত্যজিতের গল্পের আরেক শ্রেণির নারী চরিত্ররা।
আরও পড়ুন
প্রতিকৃতির গল্পতত্ত্ব
তৃতীয় আরেকটি ধরন আছে সত্যজিতের কাহিনিতে। আর সেই তৃতীয় ধরনের মধ্যেই পড়বে ফেলুদার গল্পের তিন খুদে মেয়ে-চরিত্র--- বিবি, রুনা আর মেরি। ‘অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য’ গল্পের রুনা আর ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’ কাহিনির মেরি শীলা বিশ্বাসের প্রধান সাধারণ লক্ষণ--- দুজনেই ফেলুদার গল্পের একনিষ্ঠ পাঠিকা। অম্বর সেনের ভাইঝি রুনার কথা বেশ স্পষ্ট, সে-ই তো তোপসেকে সরাসরি বলেছিল, ‘তোপসে এত মিথ্যে কথা বলে কেন?’ এমনই মন দিয়ে তার ফেলুদার গল্প পড়া যে সেই তো বলেছিল, ‘একটা বইয়ে লিখেছে ফেলুদা ওর মাসতুতো ভাই আরেকটায় লিখেছে জ্যাঠতুতো ভাই।’ এই গল্পেই ছিলেন অম্বর সেনের স্ত্রী--- রুনার মতো তিনিও ফেলুদার গল্পের পাঠক। তিনিও গল্পের ভাষায় ‘রীতিমতো সুন্দরী মহিলা, তার উপর যাকে বলে ‘ব্রাইট’। বয়স চল্লিশের উপর হলেও দেখে বোঝার জো নেই।’ ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ কাহিনিতেও ছিলেন এমনই ব্যক্তিত্বময়ী এক নারীচরিত্র--- মহেশ চৌধুরির ছোটো ছেলে প্রীতীন্দ্রর স্ত্রী নীলিমা। তার উপরে সেখানেই ছিল সেই বছর পাঁচেকের ছোট্টো মেয়ে এই প্রীতীন্দ্র- নীলিমার কন্যা বিবি। সে কথা বলতে ভালোবাসে ধাঁধায়। তেমনই অন্যদিকে আরেক ফেলুদা কাহিনির ভক্ত ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’ কাহিনির মেরি শীলা। গল্পে সে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, চারপাশের অনেকেই যখন অভিনেত্রী শকুন্তলা দেবীর মহামূল্যবান কণ্ঠহারটিকে কেবল বিক্রয়মূল্যে দেখেছে, তখন সে-ই একমাত্র তাকে রক্ষা করতে চেয়েছে তার দিদিমার স্মৃতি হিসেবে। তার কাছে সেই কণ্ঠহারের সৌন্দর্য আর পারিবারিক মূল্যটাই প্রধান। লক্ষ করার মতো বিষয়, আসলে নয় নয় করেও একটা ধরন ফেলুদার গল্পের বিভিন্ন নারী চরিত্রের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে, তারা সকলেই বুদ্ধিমতী ব্যক্তিত্বময়ী এবং সৎ আর স্পষ্টভাষী। গল্পের সীমানায় গল্পের প্লটে তাদের ব্যবহার আর উল্লেখ কম থাকলেও সত্যজিৎ যে কজন মহিলা চরিত্র তাঁর গল্পমালায় এনেছেন, তাঁদের সামান্য উপস্থিতিতেই একটি গভীর সদর্থক ছাপ রেখে যায় পাঠকদের মনে। হয়ত, যে ভাবনা থেকে পরিবারের সকলের জন্য তিনি গল্প লিখছিলেন, সেখানে নারীচরিত্রের অবস্থানগুলিকেও সেই সদ-ভাবনা থেকেই প্রয়োগ করেছেন। তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, উত্তরকালের পাঠক তা নিয়ে তাঁদের অনুযোগ ঘনাতে পারেন, তবে সত্যজিতের দিক থেকে কিন্তু এই চরিত্রগুলি ছোট্টো হলেও গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবাহী। এবার একটু ভেবে দেখুন, সত্যজিতের লেখা দুটি চিত্রনাট্য ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ আর ‘নায়ক’-ও কিন্তু সরাসরি ছবির জন্যেই লেখা গল্প--- এও তো তাহলে প্রাথমিকভাবে এক কলমকারি। সেখানে কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্র মনীষা আর অদিতি--- আচ্ছা সত্যজিতের গল্পের নারী বলতে তো কই আমরা তো তাদের কথা মনে রাখি না!
Powered by Froala Editor