পুতুলের স্বল্প-গল্প

মানিকলমকারি - ৬৪
আগের পর্বে

সাধারণভাবে একটি লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর তাতে আর বড়ো ধরনের পরিবর্তন করতেন না সত্যজিৎ। তবে ‘যখন ছোট ছিলাম’ একটি ব্যতিক্রম। ১৯৮২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগেই ১৯৮০-র পুজো সংখ্যা ও ১৯৮১-র বৈশাখ সংখ্যার সন্দেশ পত্রিকায় দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হয় লেখাটি। তবে প্রথম কিস্তির লেখা দেখলেই বোঝা যায় দ্বিতীয় কিস্তির পরিকল্পনা তখন ছিল না। এমনকি দুই কিস্তির পরেও বইতে জায়গা পেয়েছে নানা ঘটনা। অনেক ঘটনার আগুপিছুও করেছেন সত্যজিৎ। তবে পরিবর্তন শুধু এটুকুই নয়। পত্রিকাপাঠ আর গ্রন্থপাঠের সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তন তার অলঙ্করণে। পত্রিকাপাঠের মোওট ২০টি ছবির মধ্যে ১১টি বইয়ের জন্য নতুন করে আঁকা হয়েছিল। তবে বাকি ৯টি ছবি হারিয়েই গিয়েছে।

‘যখন ছোট ছিলাম’-এ সত্যজিৎ শুনিয়েছিলেন তাঁর ছেলেবেলাতে সাহেবদের দোকান হোয়াইটআওয়ে লেইডল-এ বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। এখন অনেকেই জানেন, সুরেন ব্যানার্জি রোডের ঠিক মুখে যে বিরাট বড়ো ঘড়িওয়ালা বাড়িটি এখনো দৃশ্যমান তার রাজকীয় বৈভবময় চেহারা নিয়ে--- এই দোকান হল সেই বাড়িটি। সেকালে তার দোতলাটা পুরো বড়োদিনের সময় হয়ে যেত ‘টয়ল্যান্ড’। সত্যজিৎ শৈশবে সেই বড়োদিনের সময়ে গিয়েছিলেন বেড়াতে। সেখানেই তিনি প্রথম চড়েন লিফটে আর দেখেন বিলিতি হরেক খেলনার পসরা। এর বাইরে তাঁর শৈশবসঙ্গী ছিল বাড়ির তৈরি দিশি খেলনা--- সেখানে ঘুড়িও ছিল, ছিল বাড়ির কাজের লোকের ছেলে ছেদির হাতে বানানো রঙিন ফানুস, ‘চাবি পটকা’ আর ‘রঙিন আলোকমালা’, আবার ছিল ‘স্টিরিওস্কোপ’ ‘ম্যাজিক ল্যান্টার্ন’-ও। তাঁর ছোটোবেলার ছবিতে দেখা যাবে তাঁর আশেপাশে কত রকম খেলনা আর পুতুলের আসা-যাওয়া। যেমন ১৯২৩ সালে তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, খুদে সত্যজিতের সামনের টেবিলে আছে একটি ছোট্টো নতুন রকম খেলনা। দেখা যাবে ১৯২৫-এ হাজারিবাগে তোলা একটি ছবিতে তাঁর দুই তুতো দিদি নলিনী দাশ আর লতিকা রায়ের হাতে রয়েছে দুটি জোড়া পুতুল। এই পুতুলের দলই ফিরে এলো সত্যজিতের গল্পমালায়।

যাঁরা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ দেখেছেন, তাদের মনে থাকবে, তোপসে বড়ো বয়সেও বেনারসে বেড়াতে গিয়ে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল একটি মজার খেলনা। ফেলুদা যখন হোটেলের ঘরে নানা জটিল ধাঁধার ভেতর নিজের মাথা খাটাচ্ছে, তখন দেখি তোপসে একদৃষ্টে লক্ষ করছে সেই খেলনাটিকে। সেই খেলনার মোটিফটিকেই তো সত্যজিৎ ব্যবহার করেছিলেন ওই ছবির টাইটেল কার্ডে। একটি চুম্বক চারটি চাকতির দিকে এলোমেলো ভাবে এদিক ওদিক করতে থাকে--- মনে পড়বেই ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির টাইটেল কার্ড বা নামপত্রেও কাশীর একটি পৌরাণিক মানচিত্রের উপরে ছিল চারটি সেই রকমই চাকতি আর ওই চুম্বকটির মতোই এলোমেলো ভাবে একটির পর একটিতে লেখা হচ্ছিল ছবির বিভিন্ন কুশীলবের নাম। এ যেমন এক পুতুল, তেমনই সেখানে ঘোষালবাড়ির খুদে সদস্য রুক্মিণীকুমার বা রুকুর ঘরেও ছড়িয়ে ছিল হরেক কিসিমের খেলনা। আর বড়োবাড়ির ছেলেদের খেলনা আর সাধারণ দরিদ্র বাড়ির শিশুর খেলনার জগৎ নিয়ে তো গোটা একটা অসামান্য ছবিই তৈরি করেছিলেন তিনি--- ‘টু’। সেখানে খেলনা কীভাবে দুই ভিন্ন মেরুর দুই ভিন্ন শ্রেণির অবস্থান আর একের উপরে অন্যের আধিপত্যের গল্প বলতে চায়, তার এক অসামান্য নিদর্শন। ছোটো ছবি ‘টু’-তে আর পূর্ণাঙ্গ ছবি ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ আর ‘পথের পাঁচালি’-তেও ছড়িয়ে রয়েছে পুতুল আর খেলনার গল্প। ‘পথের পাঁচালি’-তে দুর্গার পুতুলখেলা আর অপুর নিজের জন্য মাথার মুকুট আর যাত্রায় দেখা গোঁফ বানানো--- সেও তো একটা খেলারই অংশ।

জয় বাবা ফেলুনাথের খেলনা আর টাইটেল কার্ড

 

এই খেলনার জগৎই বেশ অন্যরকমভাবে ফিরে এল সত্যজিতের লেখা গল্পমালায়। সেখানে শঙ্কু সিরিজের ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল’, যেমন আছে, তেমনই আছে ‘আরো এক ডজন’ বইয়ের ‘ফ্রিৎস’, ‘আরো বারো’ বইয়ের ‘ভুতো’ আর ‘একের পিঠে দুই’ বইয়ের ‘কুটুম কাটাম’। একেবারে ভিন্ন তাৎপর্যে অবশ্যই বলতে হবে ‘আরো এক ডজন’ বইয়ের ‘বাতিকবাবু’ গল্পটিও। সর্বত্রই পুতুলরা বেশ ভয়ের বিষয়। প্রথমেই বলা দরকার শঙ্কু সিরিজের বিখ্যাত গল্প ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল’-এর কথা। সেখানে হুবহু একজন মানুষের প্রতিরূপ তৈরি করে ফেলেন নরওয়ের শিল্পী গ্রেগর লিন্ডকুইস্ট। বিভিন্ন মানুষের এক্কেবারে এক প্রতিরূপ। ক্রমশ উন্মোচিত হয় আসল রহস্য, জানা যায়, এই লিন্ডকুইস্ট শিল্পী নয় আসলে সে এক ভয়ংকর বিজ্ঞানী--- যে নিজস্ব উপায়ে যেকোনো জ্যান্ত মানুষকে বানিয়ে ফেলে মাত্র ছয় ইঞ্চির একটা পুতুল। সেই ভয়ংকর মানুষটির হাত থেকে বেঁচে ফেরার গল্পই তো এই কাহিনির অ্যাডভেঞ্চারের অংশ। একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ হলেও, এখানে আড্ডাচ্ছলে বলে নেওয়া ভালো যে, গত কয়েক বছর আগে, ২০১৫ সাল নাগাদ, যে ছোটো ছবিটি সারা ভারতে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল, তার নাম ছিল ‘অহল্যা’--- বানিয়েছিলেন বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক সুজয় ঘোষ। সেই গল্পটি যে শঙ্কু সিরিজের এই গল্পটি থেকেই অনুপ্রাণিত, সেই কথাটুকু জানানোর সৌজন্য প্রকাশ করেননি সে ছবির চিত্রনির্মাতারা!

আরও পড়ুন
 যখন ছোট ছিলাম: পত্রিকাপাঠ আর গ্রন্থপাঠ

ফ্রিৎস গল্পের অলংকরণ

 

আরও পড়ুন
রেসকিউইং ফ্রম ওবলিভিয়ন: এক অন্য ছবির গল্প

ওই ‘আশ্চর্য পুতুল’ গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৯৬৪ সালে আর ১৯৭০-৭১-এ লিখলেন ‘ফ্রিৎস’। একটি সাঁইত্রিশ বছরের মানুষের কাছে তার সাত বছরের স্মৃতিতে থাকা একটি সুইস পুতুলের কাহিনি। সেই পুতুলের নামই ছিল ফ্রিৎস। সেই পুতুলটির সূত্রে নিজের ছেলেবেলার সময়ে পৌঁছে যাওয়ার আর সেই সময়ের সঙ্গে সখ্য পাতাবার গল্প যেমন এটি, তেমনই এই কাহিনি একটি শিশুর সঙ্গে তার সেই ছেলেবেলার একটি পুতুলের সম্পর্কের গল্পও বটে। সেই সম্পর্কের একদিকে যদি থাকে তাদের নিজেদের মধ্যে নানা সময়ে গল্পকরার কথা, তেমনই একটি বাচ্চার চোখের সামনে তার সেই প্রিয় পুতুলটিকে নিয়ে দুটি কুকুর কামড়াকামড়ি করলে বাচ্চাটির ভেতরে কোন অনুভূতি হয়, এ গল্প যেন সেই অনুভূতির কথাও বলে।

আরও পড়ুন
প্রতিকৃতির গল্পতত্ত্ব

ভুতো গল্পের অলংকরণ

 

আরও পড়ুন
সন্ধানে ধন্ধায় সকলে!

‘ভুতো’ গল্পটির কেন্দ্রেও আছে একটি পুতুল। এক জাদুকরের পুতুল। তার নামই ভুতো। কথা বলা পুতুল নিয়ে এ এক জাদুকরের কাহিনি যেমন, তেমনই এই কাহিনি জাদুবিদ্যার দুই প্রজন্মের দুই জাদুকরের গল্পও। কিন্তু সেও বাহ্য। আসলে প্রথমে যুবা জাদুকর ওই সিনিয়র জাদুকরকে কীভাবে হেয় করতে চায় সেই কাহিনি থেকে গল্পটার মোড় ঘুরে যায় সিনিয়র জাদুকরের হাতে নবীন জাদুকরের অপদস্থ হওয়ার দিকে। একদিন সিনিয়র জাদুকরকে হেয় করার জন্য নিজের বানানো কথাবলা পুতুলটিকে নবীন জাদুকর বানায় ওই প্রবীণ জাদুকরের চেহারায়। তা লক্ষ করেই পরে বয়স্ক জাদুকর আসেন যুবা জাদুকরের ঘরে। সরাসরি বলেন, ‘তোমার হাতের পুতুল বানিয়ে দিলে আমাকে?’ এই নিজের-মতো-দেখতে ওই পুতুলকে দিয়েই এবারে এক অদ্ভুত পাল্টা-আক্রমণে যায় বয়স্ক জাদুকর। দূর থেকে তো শুধু কথা বলার বিদ্যে নয়, দূর থেকে অনেক কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন বয়স্ক জাদুকর। ‘কুটুম কাটাম’ গল্পের মধ্যে এলো জোড়-পুতুলের একটির থেকে আরেকটিকে আলাদা করলে, মানুষের দিকে সেই জোড়-বিচ্ছিন্ন পুতুলের আকস্মিক আক্রমণের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার গল্প। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের করা কুটুম কাটাম ছিল বাতিল জিনিস দিয়ে খেলনা বানানোর এক নিরীক্ষা, সত্যজিতের গল্পে কুটুম আর কাটাম হল জোড় পুতুলের নামান্তর। নিতান্ত যা ছিল খেলার পুতুল, সত্যজিতের গল্পে তা-ই কিনা হয়ে দাঁড়াল কাহিনিগ্রন্থনের ভয়ংকর এক উপকরণ। 

Powered by Froala Editor

Latest News See More