যখন ছোট ছিলাম: পত্রিকাপাঠ আর গ্রন্থপাঠ

মানিকলমকারি - ৬৩
আগের পর্বে

সত্যজিতের গল্পের শিল্পীরা প্রায় প্রত্যেকেই প্রতিকৃতিশিল্পী। তাছাড়া তাঁরা শিল্পের ধারা হিসাবে প্রত্যেকেই বাস্তবমূখী। বাস্তবে যা চোখে দেখছেন, তাই ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন তাঁরা। বিমূর্ত শিল্পের প্রতি যেন এক ধরনের ঠেস দেওয়া হয়েছে গল্পগুলিতে। আসলে সত্যজিৎ নিজের শিল্পভাবনাকেই তুলে এনেছেন গল্পের মধ্যে। তবে শিল্পী হিসাবে সত্যজিতের প্রথম পরিচয়, তিনি একজন অলংকরণশিল্পী। বাংলায় অলঙ্করনশিল্পীরা প্রায় কেউই সেই অর্থে মর্যাদা পান না। সত্যজিৎ অন্য কারণে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন বলে তাঁর এই পরিচয়টি নিয়েও অল্পবিস্তর খোঁজ রাখা হয়। অলংকরণশিল্পীদের প্রতি সেই উপেক্ষার কথাই ১৯৮৩ সালে ‘মানপত্র’ গল্পে লিখেছিলেন তিনি।

সাধারণভাবে সত্যজিৎ রায় তাঁর লেখা কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর আর বড়োসড়ো কাটাটকুটি করেন না বইতে প্রকাশিত হওয়ার সময়। এই ব্যাপারে এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম ‘যখন ছোট ছিলাম’ বই। সন্দেশ পত্রিকায় দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হওয়ার পরে লেখাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল ১ বৈশাখ ১৩৮৯-তে, মানে ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে। তার আগে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় ১৯৮০ সালের পুজো সংখ্যায় আর ১৯৮১ সালের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এই লেখা। প্রকাশের ধরন দেখে মনে হয়, প্রথমে দুই কিস্তি লিখবেন বলে ভাবেননি তিনি। ভেবেছিলেন, পুজোতেই লিখবেন নিজের ছেলেবেলার কথা। কারণ, ওই কিস্তির শেষে ‘ক্রমশ’ বা ধারাবাহিক হবে এমন কোনো ইঙ্গিত ছিল না। বরং লেখা ছিল ‘শেষ’। কিন্তু শেষ হল না তার মাস ছয়েক বাদে নতুন বাংলা বছরের শুরুর সংখ্যাতেই প্রকাশিত হল ‘যখন ছোট ছিলাম-২’। এই দুই কিস্তির কথা বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন সত্যজিৎ। লিখেছিলেন ‘এই স্মৃতিকথা প্রথম বেরোয় সন্দেশ মাসিক পত্রিকার দুই সংখ্যায়। তারপরে আরো কিছু ঘটনা ও মানুষের কথা মনে পড়ায় এই বইয়ে তাদের জন্য জায়গা করে দেওয়া হল।’ এই কথা থেকেই স্পষ্ট সত্যজিৎ পত্রিকাপাঠের পরে আরো কিছু যোগ অবশ্যই করেছিলেন বইয়ের পাঠে।

মূল সেই পত্রিকাপাঠের সঙ্গে গ্রন্থপাঠ মেলাতে গিয়ে বেশ আশ্চর্য হতে হল। দেখা গেল, শুধু নতুন অংশই যে যোগ করেছেন তা-ই নয়, মাঝে মাঝেই আগের লেখা পরে পাঠিয়েছেন, পরের অংশ আগে এনেছেন। কখনো সামান্য বদল করেছেন একটা-আধটা শব্দ। পত্রিকাপাঠ থেকে বইতে বাদ কোনো অংশ যায়নি অবশ্য। এমন দুই-একটি সূত্র ধরিয়ে দেওয়া দরকার ভবিষ্যতের সিরিয়াস সত্যজিৎ গবেষণার জন্য। যেমন ধরা যাক, বইয়ের শুরুতেই যে দীর্ঘ অংশ--- ‘আমাদের ছেলেবেলায় এমন অনেক কিছু ছিল যা এখন আর নেই’ থেকে ‘ক্যাপসুল আসার পর থেকে ওষুধ জিনিসটা যে বিস্বাদ হতে পারে সেটা ভুলে গেছি আমরা।’ এই দীর্ঘ অংশ, প্রথম প্রায় পাঁচটি অনুচ্ছেদই পত্রিকাতে ছিল না--- এর পুরোটাই গ্রন্থ প্রস্তুতির সময়ে সংযোজিত। মানে, পত্রিকা পাঠ শুরু হয়েছিল একেবারে অন্যভাবে। তখন ছিল ‘একেবারে শিশু বয়সের কথা মানুষের খুব বেশি দিন মনে থাকে না। আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স আড়াই বছর। সে ঘটনা আমার মনে নেই’- দিয়ে। ঠিক তারপরেই, গিরিডির যে ঘটনায় সেই তাঁদের বাড়ির বৃদ্ধ ভৃত্য প্রয়াগের কথা আছে, সেখানে এখন দেখা যায় তারা বালি খুঁড়েছিলেন ‘খেলনার দোকানে কেনা কাঠের খোন্তা’ দিয়ে, অথচ, পত্রিকায় ‘কাঠের খোন্তা’ ছিল ‘কাঠের খোন্তার মতো’ কথাটা আর তারপরে লিখেছিলেন, সেটা ছিল ‘এখন ভাবলে মনে হয় পিংপং ব্যাট, কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই ভুল’। এরপরে, ওই অধ্যায়েই নিজের ছেলেবেলার পড়াশুনার যে দীর্ঘ কথা--- সেই মা সুপ্রভা রায়ের উপহার দেওয়া কোনান ডয়েলের গ্রন্থ, পিসিদের কাছে সত্যজিতের ছেলেবেলায় ইংরাজি পড়া বা স্যর জগদীশচন্দ্রের বাড়িতে মাঝে মাঝে বেড়াতে যাওয়ার সমস্ত কথাগুলিই কিন্তু গ্রন্থভুক্ত সংযোজন। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে সারা দুপুর জুড়ে জনলার ভেতর দিয়ে আসা আলোতে রাস্তার উল্টো ছবি পড়ছে, সেটা দেখার কথা, স্টিরিওস্কোপের কথা, ‘ম্যাজিক ল্যান্টার্ন’-এর কথা এই সবই বইতে লেখার সময় যুক্ত করেন তিনি। এর কোনো অংশই পত্রিকাপাঠে ছিল না।

অন্য আরেক ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে পত্রিকা আর গ্রন্থপাঠে। সেটি হল শৈশবে সত্যজিতের শেফালোর আর এক বাঙালি জাদুকরের ম্যাজিক দেখার অংশ আর কলকাতা শহরের কার্নিভ্যালের গল্পগাছা এবং সবচেয়ে বড়ো কথা সিনেমা দেখার কাহিনি পুরোটাই পত্রিকা থেকে গ্রন্থে একেবারে নতুন করে সাজিয়ে লিখলেন সত্যজিৎ। একেবারে নতুন করে সাজিয়ে নিয়ে পুনর্লিখন করলেন মামাবাড়ির কথা, দিদিমার কথা আর কলকাতার স্বদেশী মেলা দেখার কথাগুলি। এর পরের অংশে এখন দেখা যায়, শান্তিনিকেতনে মায়ের সঙ্গে সত্যজিতের যাওয়ার কথা আর সেখানে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সেই বিখ্যাত সই-সংগ্রহের স্মৃতি। মজা হল, এই শান্তিনিকেতনের স্মৃতি পত্রিকাপাঠে এই অংশে ছিলই না। এই অংশটি তখন লিখেছিলেন, পরের কিস্তিতে--- অর্থাৎ বৈশাখের কিস্তিতে। এইভাবেই ছেলেবেলায় সত্যজিতের যুযুৎসু শেখার অংশটিও পরে লেখা বৈশাখের পর্ব থেকে এগিয়ে আনলেন আগে। তারপরে ধরা যাক, সত্যজিতের শৈশবে সুন্দরবন ভ্রমণের অংশটিও পত্রিকাতে লেখা হয়েছিল বৈশাখ কিস্তিতে। যদিও এটিও এগিয়ে এলো পূর্ববর্তী ‘ছুটিতে বাইরে’ অধ্যায়ে সংগত কারণে।

পত্রিকাপাঠের অলংকরণ


আরও পড়ুন
রেসকিউইং ফ্রম ওবলিভিয়ন: এক অন্য ছবির গল্প

পত্রিকা পাঠের অলংকরণ

 ‘যখন ছোট ছিলাম’-এর প্রথম কিস্তি শেষ হয়েছিল সত্যজিতের স্কুলে ভর্তির প্রসঙ্গটি দিয়ে। পরে সেই অংশটি যখন তিনি ‘ইস্কুলে’ বলে আলাদা একটি অধ্যায় লিখলেনই, তখন সেটি সরে গেল সেখানে। আর অবশ্য ওই ‘ইস্কুলে’ অধ্যায়টি মোটের উপর প্রায় একই ছাপা হয়েছে গ্রন্থপাঠে। কেবল এখনকার বইয়ের উনশেষ পর্বে বেলতলার যে বন্ধুদের কথা পাওয়া যায়, সেই অংশটি ছিল না তার পত্রিকাপাঠে।

আরও পড়ুন
প্রতিকৃতির গল্পতত্ত্ব


আরও পড়ুন
সন্ধানে ধন্ধায় সকলে!

পত্রিকাপাঠে প্রকাশিত নন্দলাল বসুর সেই ছবি

 অবশ্যই লক্ষণীয়, এই পত্রিকাপাঠের ছবি। পত্রিকার পাঠের সঙ্গে সমস্ত ছবিই ছিল আলাদা, বই হওয়ার সময় সেই সব ছবিই নতুন করে আঁকা হয়। প্রসঙ্গত সেই ছবিগুলি তো হারিয়েই যাবে এরপর, তাই এখানে তা নিয়েও দু-কথা বলে রাখা ভালো। দুই কিস্তিতে দশটি আর দশটি--- মোট কুড়িটি ছবি ছিল পত্রিকাপাঠে। এর ভেতরে প্রথম কিস্তির পাঁচটি আর দ্বিতীয় কিস্তির ছটি ছবির বিষয় পত্রিকাতে আর বইতে একই। শুধু তা আঁকা হয় নতুন করে। এছাড়া বাকি ছবিগুলি পরে আর বইতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তার মধ্যে যেমন ছিল শিশু সত্যজিতের লাটাই ধরার ছবি, নন্দলাল বসুর সামনে বসে ছেলেবেলায় সত্যজিতের তাঁর ছবি আঁকা দেখার ছবি পিসেমশাই অরুণনাথ চক্রবর্তীর সেই বিখ্যাত সবুজ রঙের ওভারল্যান্ড গাড়ির ছবি ইত্যাদি। এর সঙ্গে আরো দুটি জিনিস পত্রিকাপাঠে ছাপা হয়েছিল, সে দুটির কথাও বিশেষভাবে উল্লেনীয়।

আরও পড়ুন
নির্মীয়মাণ ‘বাগানবাড়ি’-র গল্পরেখা


পত্রিকা পাঠে নন্দলাল বসুর কাছে শিশু সত্যজিৎ

 প্রথমত, ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নিনিদিদি, মানে নলিনী দাসকে লেখা আট বছরের শিশু সত্যজিতের একটি চিঠির অংশে শিশু সত্যজিতের হাতের লেখার নমুনা আর দ্বিতীয়ত, শিশু সত্যজিতের খাতায় নন্দলাল বসুর আঁকা সেই বাঘের ছবি। ‘মানিকলমকারি’-র সচেতন পাঠক আমাকে মনে করিয়ে দেবেন, ‘যখন ছোট ছিলাম’-এও তো নন্দলালের সেই ছবিটি আছে। নন্দলালের আঁকা বাঘের ছবি একটা ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ আছে ঠিকই কিন্তু সেটাই সত্যজিৎকে আঁকা নন্দলালের ছবি কি? ‘সন্দেশ’-এ আঁকা, যে-ছবি সেখানে নন্দলালের সই আছে, যদিও তারিখ নেই। চিত্রপরিচিতিতে লেখা আছে সেটি ১৯২৫-এ অঙ্কিত। অথচ ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ে ছাপা ছবিটির নীচে নন্দলালের সইয়ের সঙ্গে তারিখ লেখা আছে ’১৩ পৌষ ১৩৬০’। মানে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাস। তাহলে কী করে বলা চলে, এই ছবিটি ১৯২৫-এ নন্দলালের আঁকা? তা তো তাহলে কোনোভাবেই সত্যজিতের খাতায় নন্দলালের আঁকা বাঘের ছবি নয়। গ্রন্থটির সঙ্গে চিত্রপরিচয়ের এই বিষয়টি একটু মন দিয়ে দেখা দরকার। এই পত্রিকাপাঠ আর তার ছবিগুলি দেখতে দেখতে মনে হল, সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে একটু যত্ন নিয়ে কি ‘যখন ছোট ছিলাম’-এর একটি সুসম্পাদিত, পত্রিকাপাঠ-সহ একটি সটীক সংস্করণ প্রস্তুত করা যায় না? মনে তো হয় করা উচিত!

পত্রিকা পাঠের সঙ্গে প্রকাশিত শিশু সত্যজিতের চিঠি

 কৃতজ্ঞতা: রূপক চট্টরাজ

Powered by Froala Editor