রেসকিউইং ফ্রম ওবলিভিয়ন: এক অন্য ছবির গল্প

মানিকলমকারি - ৬২
আগের পর্বে

সত্যজিতের গল্পে বারবার উঠে এসেছে শিল্পীদের কথা। ছোটোগল্পে তো বটেই, এমনকি ফেলুদার গল্পে পাবো চন্দ্রশেখর নিয়োগীর কথা। প্রফেসর শঙ্কুর গল্পে আছেন শিল্প সংগ্রাহক আলেকজান্ডার ক্রাগ। সুকুমার রায়ের ‘কালাচাঁদের গল্প’-তে যেমন একই ছবির নানা রূপ ফুটে উঠেছিল, তেমনটাই আবার দেখা যাবে সত্যজিতের প্রথম গল্প ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’-এ। তবে বাংলা ছোটোগল্পে বারবার উঠে এসেছে প্রতিকৃতি শিল্পীদের কথা। সত্যজিতের নিজের কালি-কলমেও তো কম প্রতিকৃতি ধরা দেয়নি। শিল্প সম্বন্ধে নিজের ভাবনাকেই যেন নানাভাবে গল্পের মধ্যে বুনেছেন তিনি। আর সেইসব গল্পে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে সমসাময়িক পাশ্চাত্য শিল্পের নানা পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্যের বাস্তববাদী শিল্পের ঐতিহ্যের সংঘাত।

সত্যজিৎ রায়ের গল্পে উল্লিখিত যে সব চরিত্ররা ছবি আঁকেন, তাঁদের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁরা বেশিরভাগই প্রতিকৃতিশিল্পী। সত্যজিতের গল্পে উল্লিখিত যেসব চরিত্ররা ছবি আঁকেন, তাঁদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য তাঁরা প্রায় সকলেই ছবি আঁকার ব্যাপারে একেবারে বাস্তববাদী। যেমন- যেমন দেখছেন, তাকে রঙে রেখায় নিজের মতো করে তুলে ধরার পক্ষপাতী তাঁরা। বিমূর্ত ছবির চর্চা তারা করে না। বা বলা ভালো, এই গল্পগুলিতে ওই বিমূর্ত ছবির চর্চা নিয়ে বেশ বিপরীতধর্মী ভাবনাই পোষণ করেন এইসব গল্পের শিল্পীকুল। এই গল্পগুলিতে ছবি আঁকা যদি একটা থিম হয়, তাহলে বিমূর্ত ছবি আাঁকার কথা যাঁরা বলেন বা বিমূর্ত ছবির চর্চার ব্যাপারটা প্রায় সব গল্পেই ফিরে ফিরে এসেছে একটা উল্টো-স্বর হিসেবে। সেখানে ওই চর্চার তেমন সমর্থন নেই--- সেখানে বারেবারে ওই চর্চা নিয়ে বরং বেশ ইঙ্গিতধর্মী ঠেস দেওয়াই আছে। বিষয়টি বিতর্কসাপেক্ষ--- কিন্তু সে বিতর্কের স্থান ভিন্ন। আপাতত এটাই লক্ষণীয় যে, সত্যজিৎ নিজে যেমন ধরনের ছবির পক্ষপাতী, তাঁর গল্পের চরিত্র হিসেবে উঠে আসা শিল্পীকুলের শিল্পভাবনাও কতকটা সেই রকমই। তাই লক্ষ করে দেখবেন, এইসব গল্পগুলিতে বারেবারে পুনরাবৃত্ত হয়েছে ওই প্রতিকৃতিশিল্পীদের কথা, তাঁরা সআদ বদলের জন্য নিসর্গ-প্রকৃতির ছবি আঁকেন, কিন্তু সেই অর্থে তাঁরা কেউই বিমূর্তশিল্পের চর্চা করেন না। এই জায়গা থেকেই আগের কিস্তিতে দেখেছিলাম, প্রতিকৃতি আঁকার নানাদিক কী ভাবে সত্যজিৎ রায়ের ছবি-বিষয়ক গল্পের প্রধান একটা বিষয় হয়ে উঠেছে নানা বিচিত্র কোণ থেকে।

ঠিক সেইরকমই আরেকটি দিকের কথা ওই ছবি-বিষয়ক গল্প সম্পর্কে না বললেই নয়। সত্যজিৎ নিজে যেমন সারাজীবন নানা লেখার সঙ্গে প্রচুর প্রতিকৃতি এঁকেছেন, তেমনই তিনি শিল্পী হিসেবে মূলত একজন প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী। বলা দরকার, বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সেটাই তো ছিল তাঁর প্রথম পরিচয়। শান্তিনিকেতন কলাভবনের ছাত্রাবস্থায় তাঁর সেই পরিচয়ের শুরু--- ১৯৪১ সালে। আর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর, ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি ধারাবাহিক যে কাজটি করেছেন, সেটি হল প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্প। সেই পিতা সুকুমার রায়ের ‘পাগলা দাশু’ বইয়ের এম সি সরকার সংস্করণ থেকে যে বইয়ের প্রচ্ছদ রচনা শুরু, তার শেষ কাজ নিজের লেখার সংকলন ‘সেরা সত্যজিৎ’-এর প্রচ্ছদে। মাঝখানে তাঁর হাতের চিত্ররচনায় শোভিত হয়েছে বাংলা ইংরাজি বইয়ের প্রচ্ছদ, তাঁর নন্দনভাবনায় সজ্জিত হয়েছে কত অজস্র বাংলা বইয়ের ভেতরের ছবি। চিত্রপরিচালক সত্যজিতের কাজ শুরু ১৯৫৫-তে, লেখক সত্যজিৎ ১৯৪২-৪৩ থেকে লেখা শুরু করলেও ঠিক যে-ধরনের লেখার জন্য সত্যজিৎ লেখক-হিসেবে সমধিক পরিচিত, তাঁর সেই লেখকসত্তার জন্ম ১৯৬১-তে, সংগীত পরিচালক সত্যজিৎও ওই ১৯৬১-তেই কাজ শুরু করছেন--- অথচ চিত্রকর সত্যজিৎ স্বমহিমায় কাজ করতে শুরু করে একটি স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় গড়ে নিয়েছেন ১৯৪১ সাল থেকেই। অথচ তাঁহার কথা হেথা কেহ তো বলে না! তবুও যদিবা সত্যজিৎ বিবিধ অন্য পরিচয়ের সূত্রে জগৎবন্দিত বাঙালি বলে তাঁর অলংকরণ নিয়ে তত্ত্বতল্লাশি হয়েছে, কিন্তু অন্য অলংকরণশিল্পীরা তো রয়েই গিয়েছেন অপরিচয়ের অন্তরালে, বাংলা গ্রন্থশিল্পের ইতিহাস, বাংলা ছবির ইতিহাস তাঁদের রেখেছে উপেক্ষার অন্তরালে। বাংলা গ্রন্থের অলংকরণশিল্প এক উপেক্ষিত ইতিহাসের পর্ব। যাঁরা এই বিষয় নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা জানেন গ্রন্থসংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কত বইয়ের যে কভার ছিঁড়ে ভালো করে বই বাঁধানো হয় লাইব্রেরিতে--- আর তার ফলে হারিয়ে যায় বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পটি। বাজারে বই সম্পর্কে মলাটই ললাট কথাটা বেশ চালু--- কিন্তু সেই ললাটের ললাটলিখনে দীর্ঘায়ু লেখা নেই!

প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার।

 

লেখক সত্যজিৎ সেই উপেক্ষার ইতিহাসকে বেঁধে রেখেছেন গল্পের মধ্যে। সম্ভবত এইরকম কোনো ভাবনায়, যে, কোনোদিন যদি কেউ এই গল্পসূত্রেই উদ্ধার করেন এই উপেক্ষিত শিল্পরূপের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। মনে রাখা দরকার, ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর আর বাবা সুকুমারও কিন্তু এই বর্গেরই শিল্পী--- তাঁরাও ছিলেন বঙ্গীয় অলংকরণশিল্পের দুই অন্যতম প্রধান পুরোধা। ফলে এক বিকল্প ইতিহাসের কথা শুরু করতেই কি বলছিলেন সত্যজিৎ গল্পের মাধ্যমে? সেই ভিন্নধর্মী ভাবনা থেকেই কি ১৯৮৩ সালে তিনি লিখলেন ‘মানপত্র’ গল্পটি? স্মরণীয়, এই গল্প লেখার ঠিক এক দশক আগে, ১৯৭৩-এ মননশীল আর মেধাবী কথাকার ও চিন্তাবিদ কমলকুমার মজুমদার উপস্থাপন করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত এবং স্বল্পপঠিত প্রবন্ধ ‘বঙ্গীয় গ্রন্থচিত্রণ’। কলমকুমারের লেখা যদি এই নতুন শিল্পের দিকে বক্তৃতার মাধ্যমে বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি চেষ্টা তাহলে, ছোটোদের জন্য লেখা গল্পে এই শিল্পবিশ্বের দিকে চোখ-ঘোরানোর কারিগর সত্যজিৎ রায়। ‘মানপত্র’ সেইদিক থেকেই মন দিয়ে পড়া দরকার।

আরও পড়ুন
প্রতিকৃতির গল্পতত্ত্ব

সিনেমার সুপারস্টার সমরকুমার কথা দিয়েছিলেন শতদল সংস্থার নববর্ষের দিন সংবর্ধনাগ্রহণ করবেন। কিন্তু কালিম্পঙে শুটিং পড়ে যাওয়ায় একেবারে শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করেছেন তিনি। ফলে শতদল সংস্থার কর্তাদের মাথায় হাত--- অনুষ্ঠানের কী হবে! সেই অর্থে যত নাম-করা লোকজন সকলকেই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো ক্লাব বুক করে রেখেছে। ফলে, সমস্যা সাংঘাতিক। এই অবস্থায় ক্লাবের প্রবীণ সদস্য অক্ষয় বাগচি প্রস্তাব দিলেন, ‘নামের মোহ যদি ত্যাগ করতে পারো তো আমি একজনের নাম সাজেস্ট করতে পারি’। এইসূত্রেই তিনি বললেন, শিল্পী হরলাল চক্রবর্তীর নাম। নামটা শোনার পরে ক্লাবঘরের অবস্থা কেমন? সত্যজিৎ লিখছেন ‘নামটা উচ্চারণ করার পরে ক্লাবঘরে বেশ কয়েক মুহূর্তের নৈঃশব্দ্য। উপস্থিত সভ্যদের অনেকেই যে এ নামটি শোনেনি সেটা বোঝা যাচ্ছে।’ বেশ কিছুক্ষণ পরে একজনের মনে পড়ে এই নাম। হরলাল চক্রবর্তী ছিলেন আর্টিস্ট। অক্ষয় বাগচি মনে করিয়ে দেন, ‘আমরা ছেলেবেলা থেকে তাঁর আঁকা ছবি দেখে এসেছি গল্পের বইয়ে। বেশিরভাগ পৌরাণিক ছবি। আমাদের বাড়িতে কাশীদাসের একটা এডিশন ছিল, তাতে তাঁরই আঁকা ছবি ছিল।’ এবারে কারো মনে পড়ে, তাঁর বাড়িতে ছিল ‘হাতেমতাই’--- সেখানেও ছিল বটে এইচ চক্রবর্তী সই। যারা তার ছবি দেখেনি বা যাদের মনে পড়ল না তাঁর আঁকা ছবির কথা, তাদের জন্য বলা হল, ‘লোকটা বহুকাল ধরে কাজ করে গেছে। অক্লান্ত কর্মী। চাহিদা যখন ছিল তখন নিশ্চয়ই পপুলারিটি ছিল।’ অথচ ‘রেকগনিশন পায়নি’। গল্পে লক্ষণীয় ক্রিয়াপদগুলি। ‘কাজ করে গেছে’, ‘পায়নি’--- ‘কাজ করে গেছেন’ নয়, ‘পাননি’ নয়! ভুলে যাওয়া মানুষদের এখনকার মানুষদের স্মৃতিতে নিয়ে আসার কথাটাও বলেন কেউ কেউ--- বলেন, ‘রেসকিউইং ফ্রম ওবলিভিয়ন’! এই আরেক মনস্তত্ত্ব। নববর্ষের দিন ক্লাবের মুখরক্ষা করতে যে শিল্পীর কথা ভাবছে তারা, তিনি যেহেতু অলংকরণশিল্পী, তাই তাঁকেই যেন উদ্ধার বা রেসকিউ করছে তারা। ঠিক হল, পোস্টারে তাঁর নামের আগে ‘প্রখ্যাত প্রবীণ চিত্রশিল্পী’ শব্দটা বসিয়ে দেওয়া হবে, যাতে যারা চেনে না, তারাও বুঝতে পারে। আরো অদ্ভুত বিষয় হল, হরলাল থাকেন তাদের অঞ্চলেই। অথচ তাও কেউ চেনে না তাঁকে। কেউ তাঁকে কোনোদিন দেখেনওনি সেভাবে। গল্পটা যারা জানেন, তারা জানেন, সেই হরলাল চক্রবর্তীর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাঁর বাড়ি দেখে বোঝা গেল, ‘হরলাল চক্রবর্তীর ভাগ্যে যে শুধু খ্যাতিই জোটেনি তা নয়, অর্থোপার্জনের ব্যাপরেও তিনি তেমন সুবিধে করতে পারেননি।’ তাঁকে বাড়ি গিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হল আর তাঁকেই বলা হল তাঁর সম্পর্কে দু-চার কথা লিখে দিতে। তাঁর সেই লেখা থেকে তৈরি করা হল অনুষ্ঠানের বক্তৃতা। কী ভাগ্যিস! মানপত্রের ভাষা সাধারণভাবে লেখা। পুরো লেখাতে কোথাও বিশেষভাবে লেখা ছিল না সিনেমার নায়কের কথা--- ফলে যে-সংবর্ধনাপত্রে সিনেমার নায়কের গুণকীর্তন করা হয়, সেই ভাষাতেই গুণপনা করা চলে প্রবীণ চিত্রশিল্পীর। অনুষ্ঠানের আয়োজনে মুগ্ধ সকলের সঙ্গে হরলালও। নিজের ভাষণে বিনয়ের সঙ্গে তিনি শুধু বলেন, ‘এই প্রশংসাপত্র আমার প্রাপ্য নয়।’   

আরও পড়ুন
সন্ধানে ধন্ধায় সকলে!

আরও পড়ুন
নির্মীয়মাণ ‘বাগানবাড়ি’-র গল্পরেখা

সত্যিই ওই প্রশংসাপত্র প্রাপ্য ছিল না তাঁর। কারণ, তিনি হরলাল চক্রবর্তী নন, তিনি হরলালের ভাই রসিকলাল। তিন বছর আগে ওই শহরেই মারা গেছেন হরলাল সকলের চোখের আড়ালে। তিনি বেঁচেছিলেন, সেই খবর কেউ রাখেনি--- তিনি যে মারা গিয়েছেন, রাখেনি সেই খবরও। এই চরম উপেক্ষার করুণকাহিনিকে একটি ছোটোদের ছোটোগল্পের মধ্যে বুনে দেন সত্যজিৎ।

আরও পড়ুন
নামের আরো গল্পসল্প

একটি ছোট্টো প্রাসঙ্গিক তথ্য এখানে উল্লেখনীয়। বাংলা অলংকরণশিল্পের ইতিহাসে এক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ছিলেন প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কাজও সেকালের দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত পূজাবার্ষিকীর পাতায় পাতায়, শুকতারার পৃষ্ঠায় দেখে দেখে বাঙালির চোখে রয়ে গিয়েছে। তিনিও ছিলেন পৌরাণিক ছবি আঁকাতে অগ্রগণ্য। প্রতুলবাবু মারা যান ১৯৭৬ সালে। ওই একই বছরে মারা যান আরেক বিখ্যাত অলংকরণ শিল্পী মনোজমোহন বসু। তার বছর তিনেক পরে চলে গেলেন বঙ্গীয় গ্রন্থচিত্রণ প্রবন্ধের প্রণেতা আরেক চিত্রশিল্পী কমলকুমার মজুমদার। সত্যজিৎ ‘মানপত্র’ লিখলেন তার পরেপরেই--- ১৯৮৩ সালে। লেখার সময় সত্যজিতের মনে পড়েছিল নিশ্চয়ই, তাঁর পিতা সুকুমার রায়ের মৃত্যুসংবাদ খবরের কাগজে খুদে খুদে হরফে প্রকাশিত হয়েছিল ‘death of an artist’ শিরোনামে ইংরাজি কাগজে আর ‘আর্টিস্টের মৃত্যু’ শিরোনামে বাংলা কাগজের এক কোণে। বুঝি এই হারিয়ে যাওয়াই এইসব অলংকরণশিল্পীদের ভবিষ্যৎ। ‘মানপত্র’ বুঝি সেই উপেক্ষারই এক আশ্চর্য আখ্যান।

Powered by Froala Editor